পরিভাষা

যে শব্দের দ্বারা সংক্ষেপে কোনো বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করা যায় তাকেই পরিভাষা বলা হয়। শব্দ হল যেকোনো কিছুর নাম বা তাকে ভাষায় প্রকাশ করার উপায়, প্রতিশব্দ হল সমার্থক শব্দ; কিন্তু পরিভাষা পুরোপুরিই সংজ্ঞাবাচক। এর অর্থ ব্যাপক। একটি পরিভাষা একটি পরিপূর্ণ সংজ্ঞাকে নির্দেশ করে। শব্দের অর্থ এবং পরিভাষার অর্থ ভিন্ন বা একেবারে বিপরীত হতে পারে। যেমন, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। সংস্কৃতে বিজ্ঞান শব্দের অর্থ ছিল ঈশ্বরানুভব, অপরোক্ষ জ্ঞান, তত্ত্বজ্ঞান বা বিশেষ জ্ঞান। কিন্তু বাংলায় এটি ইংরেজি সায়েন্স (science) শব্দের পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই বাংলায় বিজ্ঞান শব্দের অর্থ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফলে কোনো বিষয়ে ক্রম অনুসারে লব্ধ জ্ঞান। ঈশ্বরানুভূতি এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞান একেবারে বিপরীত। দেখা যাচ্ছে, পরিভাষার অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এটিই বর্তমানে একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।

‘স্থিরীকৃত’ সমার্থক শব্দ

পরিভাষা কাকে বলে?

পরিভাষা হচ্ছে বিষয়সমূহের অধ্যয়ন ও তার ব্যবহার। অভিধানে পরিভাষার অর্থ সংক্ষেপার্থ শব্দ। অর্থাৎ যে শব্দের দ্বারা সংক্ষেপে কোনো বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করা যায় তাই পরিভাষা। সাধারণত পরিভাষা বললে এমন শব্দ বা শব্দাবলি বোঝায় যার অর্থ পণ্ডিতগণের সম্মতিতে স্থিরীকৃত হয়েছে এবং যা দর্শন বিজ্ঞানের আলোচনায় প্রয়োগ করলে অর্থবোধে সংশয় ঘটে না। অন্যভাবে বলা যায়, সুনির্দিষ্ট সংক্ষেপার্থ সংশয়মুক্ত শব্দই হলো পরিভাষা। সহজভাবে বললে, বিশেষ ভাষা। বিদেশি ভাষার বিভিন্ন শব্দের স্বাদ, গন্ধ, বৈশিষ্ট্য, চরিত্র, সম্পর্ক, অর্থ ইত্যাদি অনুসারে বাংলা শব্দে রূপ দেয়া হয় তাকে পারিভাষিক শব্দ বলে। যেমন : Oxygen-অম্লজান, Act-আইন, Farm- খামার। পরিভাষার অর্থ ভূমিকা অংশেই বলা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন অভিধান ও বিশ্বকোষ থেকে নেয়া অর্থগুলো উল্লেখ করা হচ্ছে:

  • সংসদ বাঙ্গালা অভিধানে বলা হয়েছে, "বিশেষ অর্থে নির্দিষ্ট শব্দ বা সংজ্ঞা"।
  • চলন্তিকা অভিধানে রাজশেখর বসু এর অর্থ করতে গিয়ে লিখেছেন, "বিশেষ অর্থবোধক শব্দ"।
  • রাজশেখর বসু তার লঘুগুরু গ্রন্থে পরিভাষার অর্থ করতে গিয়ে লিখেছেন, "ভাষা একটি নমনীয় পদার্থ, তাকে টেনে বাঁকিয়ে চটকে আমরা নানা প্রয়োজনে লাগাই। কিন্তু এরকম জিনিসে কোনো পাকা কাজ হয়না, মাঝে মাঝে শক্ত খুঁটির দরকার, তাই পরিভাষার উদ্ভব হয়েছে।" (১৩৪৬ বঙ্গাব্দ)
  • বাচস্পত্য অভিধান গ্রন্থে বলা হয়েছে, "শাস্ত্রকারের সংজ্ঞা বিশেষ"।

পরিভাষা সম্পর্কে ভাষাবিদগণের অভিমত

  • সৈয়দ আলী আহসান : বাংলাদেশের প্রতি প্রকৃতির দিকে এবং বোধগম্যতার দিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের পরিভাষা নির্মাণ করতে হবে। যেখানে আরবি ফারসির প্রয়োগ সমীচীন সেখানে আরবি, ফারসি এবং যেখানে সংস্কৃতের প্রয়োজন হয় সেখানে সংস্কৃত-এটাই আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত।

সৈয়দ আলী আহসানের পরিভাষা নীতি—যে বিদেশি শব্দগুলোর অতিরিক্ত প্রয়োগে একটি সবল এবং সুষ্ঠুরূপ নিয়েছে সেগুলোর পরিবর্তন না করা। জটিল বৈজ্ঞানিক শব্দ যেগুলোর কোন প্রতিরূপ আমাদের ভাষায় নাই >সেগুলো অবিকৃত রাখা। যেগুলো ব্যাখ্যা চলে এবং ব্যাখ্যা করলেই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়-একমাত্র সেগুলোরই প্রতিশব্দ নির্মাণ করা।

  • মুহম্মদ আবদুল হাই : যতটা সম্ভব বাংলা ভাষার ধর্ম, তার শ্রুতিমাধুর্য এবং ব্যবহারিক প্রয়োজনের দিক লক্ষ্য রেখে সংস্কৃত ও আরবি ভাষার শব্দ মূলের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
  • ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর অভিমত: বাংলা গদ্যের সাহিত্যিক ব্যবহারের প্রারম্ভ থেকেই পরিভাষার জন্য সংস্কৃতের সাহায্য লওয়া হচ্ছে। আমি মনে করি যে বাংলা ভাষার এই ঐতিহ্যের দিকে লক্ষ্য করে আমরা একদম সংস্কৃত বর্জন করতে পারি না। সেইরূপ রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য করে আরবির ফারসিও আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি না।

বাংলা পরিভাষা নির্মাণের ইতিহাস

১৭৭২ সালের ১৫ আগস্ট প্রতি জেলায় দেওয়ানি বিচারের জন্য মফস্বলে দেওয়ানি আদালত স্থাপিত হয়। ১৭৭৫ সালে স্থাপিত হয় কলকাতায় সুপ্রি ম কোর্ট। ১৭৯৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করেন। ওই আইনের রেগুলেশন খাতে সরকার ইচ্ছামত পরিবর্তন না করতে পারে সে ব্যাপারে নির্দেশ থাকে। প্রতিটি রেগুলেশন মুদ্রিত এবং দেশি ভাষায় অনূদিত হবারও নির্দেশ থাকে। এই আবশ্যিক অনুবাদের মাধ্যমে এদেশে আইনের অনুবাদ শুরু হয়। ফলে ১৭৭৬ সাল থেকে ১৭৯৭-৯৮ সাল পর্যন্ত জেন্টু কোড, অর্ডিন্যান্স অভমনু, এ ডাইজেস্ট অব হিন্দুল (১৭৭৬-১৭৯৮) প্রণয়নে সংস্কৃত থেকে ইংরেজি পরিভাষা নির্মাণের গোড়াপত্তন হয়। বাংলায় পরিভাষা নির্মাণের গোড়াপত্তন হয় ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। ১৭৮৪ সালে জনাথান ডানকানের ‘হইবার কারণ ধারার নিয়ম বাংলা ভাষায়’র বাংলা হরফে প্রকাশ হবার মধ্য দিয়েই বাংলা পরিভাষার সূচনা হয়। এ ধারা অব্যাহত থাকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত। ১৮৯৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে যা ব্যাপক পরিণতরূপ পায়। বিগত দুশো বছরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পাশাপাশি পরিভাষা নির্মাণে অবদান রেখেছেন ফেলিকস কেরি, জনমেক, উইলসন, পীয়ারসন বৃটন প্রমুখ মনীষী থেকে শুরু করে অক্ষয় কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপিনবিহারী দাস, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, যোগেশচন্দ্র রায়, ড. রঘুবীর, বি এন শীল, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের পরিভাষা

১৯৪৭ সালে পূর্বপাকিস্তান নামকরাষ্ট্র জন্মাবার পর শিশুরাষ্ট্রে ভাষা সংকট দেখা দেয়। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে জিন্নাহর দাম্ভিক ঘোষণা পূর্ববঙ্গবাসীদের মর্মাহত করে। যার পরিণতি ১৯৫২ সালে রক্তাক্ত মহান ভাষা আন্দোলন। অনেক রক্তের বিনিময়ে ১৯৫৬ সালে পশ্চিমা শাসকরা উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। সেদিন পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা ভাষার প্রশ্নে ছিল উত্তপ্ত ও উদ্বেলিত। বাংলা অক্ষর, ভাষা ও ব্যাকরণকে সহজ করার জন্য বাঙালিরা ২টি সংস্থার জন্ম দেয়। বাংলা ভাষা পরিকল্পনায় এদুটো প্রতিষ্ঠানই মুখ্য ভূমিকা রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাবোর্ড, টেকস্টবুক বোর্ড তখনও গৌণ। এসব প্রতিষ্ঠান নিজনিজ ক্ষেত্রে প্রয়োজন মতো পরিভাষা প্রণয়নে ভূমিকা রাখে। বাংলা একাডেমি (১৯৫৭) ও বাংলা উন্নয়ন বোর্ড (১৯৬৩)। এদেশে পরিভাষা সম্পর্কিত চিন্তার সূত্রপাত হয়। মুহম্মদ আব্দুল হাই-এর ‘আমাদের পরিভাষা সমস্যায় সংস্কৃতের স্থান’ (১৯৬১) এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘আমাদের পরিভাষা সমস্যা’ (১৯৬২) প্রবন্ধ দুটি পরিভাষার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে পরিভাষা প্রণয়নে ৩ জন মনীষীর নাম স্মরণযোগ্য। যেমন : আব্দুল হাই, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও সৈয়দ আলী আহসান।


উল্লেখযোগ্য পরিভাষা

  • Camera―চিত্রনী
  • Calculus―কলনবিদ্যা
  • Council―পরিষদ / অনুষদ
  • Computer―গণনী
  • Nihilism―শূন্যতাবাদ
  • attested―প্রত্যয়িত
  • Consumer Goods―ভোগ্যপণ্য
  • internet―অন্তর্জাল
  • network―জালবুনুনি
  • telephone―দূরভাষ
  • mobile phone―চলভাষ
  • radio―বেতার
  • television―দূরদর্শন
  • stadium―ক্রীড়াঙ্গন
  • cinema―চলচ্চিত্র
  • school―বিদ্যালয়
  • student―শিক্ষার্থী

আরও দেখুন

  • বাংলা পরিভাষা
  • সমাজতত্ত্বের পরিভাষা

তথ্যসূত্র

    • বিজ্ঞানচর্চায় বাঙলা পরিভাষা: ইতিহাস, সমস্যা ও সমাধান — লেখক - নৃপেন ভৌমিক; প্রকাশক - পার্থশঙ্কর বসু, নয়া উদ্যোগ, ২০৬ বিধান সরণি, কলকাতা-৬; প্রথম প্রকাশ - ফেব্রুয়ারি, ২০০২; আইএসবিএন ৮১-৮৫৯৭১-৯৯-৪
    This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.