পদ (ব্যাকরণ)

ব্যাকরণ শাস্ত্র, পদ হচ্ছে একটি ভাষার রূপতত্ত্বগত শ্রেণীবিভাগ, যা সেই ভাষার বাক্যের নির্মাণ পদ্ধতি ও শব্দের সনাক্তকরণ, বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য ভাষাগত গঠনের বর্ণনা করে। শব্দ যখন বাক্যে ব্যবহৃত হয় তখন তাকে পদ বলে।[1] বাক্যে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দকেই এমন ভাবে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, যার জন্য প্রতিটি শব্দের মধ্যে সম্পর্ক ও তাদের অর্থ সৃষ্টি করে। বিভিন্ন ভাষায় বিশেষ্য পদ ও ক্রিয়াপদ প্রায়শ ব্যবহৃত পদ। কিন্তু এর পরেও বিভিন্ন ভাষায় উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে। উদাহরণস্বরূপ, জাপানি ভাষায় তিন প্রকারের পৃথক বিশেষণ পদ আছে। সেই তুলনায় বাংলাইংরেজিতে বিশেষণের কোনো পার্থক্য নেই।

ইতিহাস

ভাষাবিজ্ঞানের ইতিহাসের প্রারম্ভিক পর্বেই পদ বিষয়ক আলোচনার প্রমাণ পাওয়া যায়।[2] প্রাচীন ভারতীয় ভাষাবিদ যস্ক তাঁর নিরুক্ত গ্রন্থে খ্রিস্টপূর্ব ৫ বা ৬ সালে সংস্কৃত পদ নিয়ে আলোচনা করেন। নিরুক্ত গ্রন্থটি থেকে সেসময় সংস্কৃত ব্যাকরণে ব্যবহৃত ৪ টি পদ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এটিই ছিল উপমহাদেশে সর্বপ্রথম পদ-বিষয়ক আলোচনার দলিল।

  • নাম পদ
  • আখ্যাত পদ
  • উপসর্গ পদ
  • নিপাত পদ

প্রকারভেদ

বাংলা ব্যাকরণে পদ মূলত ২ প্রকার হলেও সাধারণ ভাবে পদ ৫ প্রকার। কিন্তু আধুনিক প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ অনুসারে পদ ৮ প্রকার।

পদ মুলত ২ প্রকার:

সব্যয় পদ চার প্রকার:

সম্মিলিত শ্রেণীবিভাগ

উভয় মূল মিলিয়ে পদ মুলত ৫ প্রকার। যথা:

  • বিশেষ্য
  • বিশেষণ
  • সর্বনাম
  • ক্রিয়াপদ
  • অব্যয়

কিন্তু সাধারণ ব্যাকরণিক শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী অব্যয় পদটি একাধিক ভুমিকা পালন করে।

আধুনিক শ্রেণীবিভাগ

পদান্বয়ী অব্যয় অনুসর্গ রুপে কাজ করে, সমচ্চয়ী অব্যয় পদটি সংযোজক হিসেবে কাজ করে এবং অনন্বয়ী অব্যয় পদটি আবেগবাচক শব্দের ভুমিকা পালন করে। আবার ক্রিয়াবিশেষণকে বিশেষণের একটি অংশ মনে করা হয়। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ আলাদা শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। তাই, প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ অনুসারে শব্দ আট প্রকার।[1] যথা:

[1]

আলোচনা

পদ বৈশিষ্ট্য পদের উদাহরণ বাক্যে ব্যবহারের উদাহরণ টীকা
ক্রিয়াপদ ক্রিয়া বা অবস্থাকে সনাক্ত করে হয়, করি, গাওয়া, হতে, খাই আমি ভাত খাই
  • ক্রিয়াপদের একটি কর্তা অংশ থাকে, যেটি কাজটি সম্পাদন করে। কিছু ক্রিয়াতে কর্ম অংশও থাকে, যেটি ক্রিয়াকে গ্রহণ করে বা সম্পন্ন কাজের প্রতিফলন ঘটায়।
  • বাক্য গঠনের অন্যতম মৌলিক উপাদান হলো ক্রিয়াপদ। অপরটি হলো নামপদ (বিশেষ্য ও সর্বনাম)।
বিশেষ্য ব্যক্তি, স্থান, কাল ও বস্তু সনাক্ত করে কলম, কুকুর, কাজ, গান, নগর, ঢাকা, শিক্ষক, জহির ঢাকা একটি মহানগরী
  • বাক্য গঠনের মৌলিক উপাদানের একটি।
বিশেষণ বিশেষ্য ও সর্বনামের অবস্থা বোঝায় টি, ২ (দুই), সামান্য, ভালো, বড়, লাল, মজাদার বিড়ালটির রঙ সাদা
ক্রিয়াবিশেষণ ক্রিয়াপদের অবস্থা বোঝায় দ্রুত, আস্তে, খারাপভাবে, অতি, সত্যিই খাবার আস্তে আস্তে খাওয়া উচিত, দ্রুততার সাথে নয়
সর্বনাম বিশেষ্যের পরিবর্তে বসে আমি, তুমি, সে, তিনি, এটি সে ভালো গান পারে
  • বাক্য গঠনের অন্যতম মৌলিক উপাদান নামপদের অংশ।
অনুসর্গ নামপদের (বিশেষ্য ও সর্বনাম) সঙ্গে বাক্যেত অন্য পদের সংযোগ বা মিলন ঘটায় তো, এখানে, পরে, ওখানে, নিচে কুকুরটি টেবিলের নিচে
লোকটি সেতুর উপর দিয়ে দৌড়ে গেল
সংযোজক পদ অন্যান্য পদ, বাক্য ও উক্তিকে যুক্ত করে এ, কিন্তু, যখন, অথবা আমি আপেল কমলা পছন্দ করি, কিন্তু আঙুর নয়
আবেগসূচক পদ সংক্ষিপ্ত মনের ভাব ওহ!, আও!, ওহে আও! খুবই ব্যথা পেলাম!
  • একমাত্র পদ যেটি বাক্যে স্বাধীনভাবে বসে এবং অন্য কোনো পদের উপর নির্ভরশীল নয়।

বিশেষ্য

বিশেষ্য অর্থ নাম। কোনো কিছুর নামকে বিশেষ্য বলে। যেমন, কোনো ব্যক্তি, বস্তু, স্থান, জাতি, সমষ্টি, কর্ম বা গুণের নাম। উদাহরণস্বরূপ, আলবার্ট আইনস্টাইন, কাজী নজরুল ইসলাম, জোসেফ স্তালিন, বাংলাদেশ, ভারত, ইতালি, নিউইয়র্ক, জানুয়ারি, রমজান, ফাল্গুন, গীতাঞ্জলি, দৈনিক ইত্তেফাক, ধাতু, লোহা, পানি, অক্সিজেন, আদর্শ, মধুরতা, বিশ্বাসী, সরলতা, দেশী, দর্শন, ধর্ম, ইসলাম, ক্যাথলিক, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বিজেপি, ডেমোক্রেটিক পার্টি, জনতা, সংঘ, ঝাঁক, লাইব্রেরি, গবেষণাগার, নাট্যশালা, মানুষ, গরু, ছাগল, পাহাড়, নদী, দালান, লবণ, বই, খাতা, পঠন, শয়ন, করানো, পাঠানো – এগুলো বিশেষণ।

সর্বনাম

বিশেষ্যের পরিবর্তে যা ব্যবহৃত হয় তাকে সর্বনাম বলে। বাক্যের মধ্যে বিশেষ্য যে ভূমিকা পালন করে সর্বনামও একই ভূমিকা পালন করে।[1] উদাহরণস্বরূপ, আমি, তুমি, আমরা, তোমরা, তুই, তোরা, এরা, ওরা, যে, সে, যিনি, তিনি, তাঁর, তাঁরা, সবাই, ওই, কেউ, কি, কোথায়, কীভাবে – এগুলো সর্বনাম।

বিশেষণ

বিশেষণ বিশেষ্য ও সর্বনামকে বিশেষিত করে। উদাহরণস্বরূপ, তাজা মাছ, সাদা গোলাপ, কালো পানি, দুই বিঘা, বেলে মাটি, প্রথম – এগুলো বিশেষণ।

ক্রিয়াপদ

যা দ্বারা কাজ করা বুঝায় তাকে ক্রিয়াপদ বলে। ক্রিয়ামূল বা ধাতুর সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত হয়ে ক্রিয়াপদ গঠিত হয়। পক্ষ ও কালভেদে ক্রিয়াপদের রূপভেদ হয়।[1] উদাহরণস্বরূপ, করবে, করলে, করে, শিখতে, ঘুমায়, পড়ছে, দিলেন, লিখছে, খেলছে, করাচ্ছেন, খাওয়ায়, চমকায়, ছটফটিয়ে, মরে যাওয়া, কমে আসা, এগিয়ে চলো, হেসে উঠেছে, দাঁড়িয়ে যাও – এগুলো ক্রিয়াপদ।

ক্রিয়াবিশেষণ

যা ক্রিয়ার ভাব, কাল বা সময়কে বিশেষিত করে তাকে ক্রিয়াবিশেষণ বলে। উদাহরণস্বরূপ, ধীরে বাতাস বায়, লোকটি দ্রুত হাটে, টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, যথাসময়ে সে হাজির হলো, আমার জানা নেই, সে যাবে না, কখনই বা দেখা হবে – এগুলো ক্রিয়াবিশেষণ।

আবেগসূচক পদ

যে শব্দ দ্বারা দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ ইত্যাদি প্রকাশ হয়ে থাকে তাকে আবেগসূচক পদ বলে। এধরনের পদ বাক্যের অন্যান্য পদের সঙ্গে সরাসরি সরাসরি সম্পর্কিত না হয়ে স্বাধীনভাবে বাক্যে বসে।[1] উদাহরণস্বরূপ, হ্যাঁ, বেশ, শাবাশ!, আহ!, ওহ!, ছি ছি!, বাপরে বাপ, আরে, হায় হায়! ওগো – আবেগসূচক পদ।

সংযোজক পদ

সংযোজক পদ দুটি শব্দের মধ্যে সংযোগ ঘটায়।উদাহরণস্বরূপ, ও, এবং, বা, অথবা, আর, না-হয়, না-কি, কিন্তু, তবে, যদি, কারণ, তাই – সংযোজক পদ।

অনুসর্গ

যা কোন শব্দের পরে বসে তাকে অনুসর্গ বলে। উদাহরণস্বরূপ, অবধি, আগে, উপরে, করে, কর্তৃক, ছাড়া, জন্য, তরে, থেকে, দ্বারা, ধরে, নাগাদ, পর্যন্ত, বনাম, ভেতরে, মধ্যে, লেগে, সঙ্গে, হতে – অনুসর্গ।

তথ্যসূত্র

  1. বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি, নবম-দশম শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, বাংলাদেশ। ২০২১ সংস্করণ।
  2. রবিন্স আরএইচ (১৯৮৯)। General Linguistics (৪র্থ সংস্করণ)। লন্ডন: লংম্যান।
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.