পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী

পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী (২৫ ডিসেম্বর, ১৯০২ - ২৯ অক্টোবর, ১৯৪৫) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী । তিনি উপমহাদেশের অন্যতম এক সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাঙালির জ্ঞান গোঁসাই। বিষ্ণুপুর ঘরানার এক প্রবাদপ্রতিম শিল্পী।

Acharya
Jnanendra Prasad Goswamy
আচার্য জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী
প্রাথমিক তথ্য
জন্ম(১৯০২-১২-২৫)২৫ ডিসেম্বর ১৯০২
বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া,বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি,ব্রিটিশ ভারত
মৃত্যু২৯ অক্টোবর ১৯৪৫(1945-10-29) (বয়স ৪২) বিষ্ণুপুর,বাঁকুড়া,বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি,ব্রিটিশ ভারত
ধরনবিষ্ণুপুর ঘরানা
পেশাগায়ক

জন্ম ও পরিবার

১৯০২ সালের ২৫ ডিসেম্বর জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের জন্ম বিষ্ণুপুরের শাঁখাির বাজারের কাছে গোস্বামী পাড়ায়। তার পরিবারে সঙ্গীতচর্চার ঐতিহ্য ছিলই। তিনি শ্রীনিবাস আচার্যের বংশধর। শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের পরে তার যে তিনজন নিকট পার্ষদ বাংলার বৈষ্ণব সমাজে বিশেষ সমাদৃত, তাদের মধ্যে শ্রীনিবাস আচার্য অন্যতম। বিষ্ণুপুরের রাজা বীর হাম্বীর তার কাছেই বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। রাজার অনুরোধে শ্রীনিবাস পরবর্তী কালে বিষ্ণুপুরে বসবাস শুরু করেন। জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের পিতামহ জগৎচাঁদ গোস্বামী ছিলেন বিষ্ণুপুরের স্বনামধন্য পাখোয়াজি। জগৎচাঁদের পাঁচ পুত্র। তারা সকলেই যন্ত্র এবং কণ্ঠসঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। জগৎচাঁদের দ্বিতীয় সন্তান বিপিনচন্দ্রের পুত্র জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ।

সংগীত শিক্ষা

বাড়িতে এক সাঙ্গীতিক পরিবেশে লালিত হন তিনি। ছোট থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তার আগ্রহ দেখে পারিবারিক উদ্যোগে শুরু হয় সঙ্গীত চর্চা। মাত্র ছ’বছর বয়স থেকেই যা শুরু হয় তার পিতৃতুল্য লোকনাথের কাছে। সাত বছর বয়সে তার পিতৃবিয়োগ ঘটে। জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের কাকা রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী সে সময়ে সঙ্গীত জগতে এক নক্ষত্র। তিনি বহরমপুরে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি পিতৃহীন জ্ঞানেন্দ্রকে তার কাছে বহরমপুরে নিয়ে গিয়ে সঙ্গীতের তালিম দিতে শুরু করেন। রাধিকাপ্রসাদ তাকে ধ্রুপদ, খেয়াল শিখিয়ে তার উপযুক্ত উত্তরসূরি তৈরি করেছিলেন।

সঙ্গীত সাধনায় মগ্ন হলেন জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ। স্কুল-কলেজে প্রথাগত বিদ্যাশিক্ষা তার হয়নি। রাধিকাপ্রসাদ কলকাতা কিংবা বিষ্ণুপুরে গেলে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদও তার সঙ্গী হতেন। এ ছাড়া তার সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও যেতেন। বহরমপুরে রাধিকাপ্রসাদ প্রায় পনেরো বছর ছিলেন। ১৯১৯-২০ নাগাদ বহরমপুর সঙ্গীত বিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পরে জ্ঞানেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কলকাতার পাথুরিয়াঘাটায় আসেন। সেখানে সঙ্গীতের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ ঘোষের বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন।

জীবনের প্রথম দিকে ফৈয়াজ খান-র গায়কির প্রতি তিনি আকৃষ্ট না হলেও ১৯৩৩-৩৪ সাল নাগাদ ফৈয়াজের কাছে ধ্রুপদ, খেয়ালের তালিম নিতে শুরু করেন জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ। ফৈয়াজ খান তখন মহিষাদল রাজবাড়িতে ছিলেন। সেখানেই তার কাছে নাড়া বেঁধে তালিম নিয়েছিলেন জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ। তৎকালীন রাজমাতার বিশেষ অনুরোধে তার জ্যেষ্ঠপুত্র দেবপ্রসাদ গর্গকে সঙ্গীতের তালিম দিতেন। প্রতি মাসে একবার সেখানে গিয়ে কিছু দিন থাকতেন জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ।

জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের জীবনে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। ভূপেন্দ্রকৃষ্ণের জহুরির চোখ তাকে চিনতে ভুল করেনি। এখানেই জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ প্রবাদপ্রতিম বিষ্ণুদিগম্বর পালুস্কর-এর সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। সে সময়ে তিনি ভূপেন্দ্রকৃষ্ণের বাড়িতে কিছু দিন ছিলেন। যদিও তখন বিষ্ণুদিগম্বর জনসমক্ষে গান গাওয়া বা অনুষ্ঠান করা ছেড়ে দিয়েছেন। চোখেও দেখতে পেতেন না। তবে রোজ ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুম থেকে উঠে তিনি গলা সাধতেন। ঘরের দরজা বন্ধ থাকায় জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ সেই ঘরের চৌকাঠে মাথা পেতে দিনের পর দিন গান শোনার চেষ্টা করতেন। জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ তার সংস্পর্শে এসে সমৃদ্ধ হয়েছিলেন। [1]

সংগীত জীবন

জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের বয়স যখন ২১, তখন রাধিকাপ্রসাদ পরলোক গমন করেন। ইতিমধ্যেই জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের নামডাক চার দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ ঘোষের ইচ্ছেতেই জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ নিখিল বঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলনে প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলেন। এই সম্মেলনে ধ্রুপদ গেয়ে শ্রোতাদের মন জয় করেছিলেন। এক বার ওই সম্মেলনের উস্তাদ আব্দুল করিম খান জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের কণ্ঠে ‘বাগেশ্রী’ শুনে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। তখন আব্দুল করিম যত দিন কলকাতায় ছিলেন, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ তার কাছে কিছু গান শেখার সুযোগ পান।

প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই পেশাগত জীবনে তার জয়যাত্রা শুরু হয়। ১৯৩২ সালে এইচ এম ভি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম রেকর্ড। গান দু’টি ‘বরষ বরষ থাকি চাহিয়া’ এবং ‘একি তন্দ্রা বিজড়িত আঁখিপাতে’। মেগাফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত ‘অনিমেষ আঁখি আমার’ এবং ‘মুরলীর ধনী কার বাজে’। ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত ‘আমায় বোলো না ভুলিতে’ (বেহাগ) ও ‘আজি নিঝুম রাতে কে বাঁশি বাজায়’ (দরবারী কানাড়া) সাড়া ফেলেছিল।

জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের গানের আসরের কত স্মৃতি আজও অমলিন। তার কণ্ঠস্বর বলিষ্ঠ ও জোরালো ছিল। আসরে তাই মাইক্রোফোন ব্যবহার করতে চাইতেন না। একবার গানের আসর বসেছে থিয়েটার রোড ও রডন স্ট্রিটের সংযোগস্থলের এক বাড়িতে। সেই আসরে নিমন্ত্রিত ছিলেন জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ ও ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়

কলকাতার আসর থেকে বাংলার নানা প্রান্তে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে। আসরে শ্রোতার মন না ভরা পর্যন্ত তিনি স্বস্তি পেতেন না। চট্টগ্রােম এক গানের আসরে অনেক শিল্পী থাকায় গাওয়ার জন্য তাকে উপযুক্ত সময় দেওয়া হয়নি। কম সময় গান শুনে শ্রোতাদেরও মন ভরেনি। গান শেষে শ্রোতারা অনুরোধ করলেন যে, তারা একদিন শুধু জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের গান শুনবেন। সেই মতো ব্যবস্থাও হল। সে আসরে প্রায় তিন ঘণ্টা একের পর এক গান গেয়েছিলেন তিনি। দিলীপকুমার রায় লিখেছিলেন, ‘‘জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের গানের সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল তার ওজস। ...জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের অলোকসামান্য গীতপ্রতিভা ও ওজঃশক্তি শ্রোতার মনকে পুলকিত করে তুলত মুহূর্তে। গান শুরু করার আগে উদাত্ত কণ্ঠে তিনি যখন ‘সা’তে দাঁড়াতেন, তখন মনে শিহরণ জাগতো সত্যিই।’’

আসরে তিনি গেয়েছিলেন মালকোষে ‘নীর ভরণ মৈ তা চলি জাত হুঁ।’ রাগাশ্রয়ী বাংলা গানে সম্পূর্ণ এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ। তিনি ভাল ধ্রুপদী গায়ক ছিলেন। কিন্তু আসরে ধ্রুপদকে অবলম্বন না করে তিনি খেয়ালকে অবলম্বন করেছিলেন। আবার যখন বাংলা গান গাইতেন, তখন তার মধ্যে থাকত খেয়ালের ভঙ্গিতে তান বিস্তার এবং টপ্পার কাজ। সাধারণত ধ্রুপদ এবং খেয়াল গাওয়া হত হিন্দুস্থানি প্রথায়। কিন্তু বাংলা গানে এই খেয়ালের রং পরিবর্তিত হত বাঙালি মানসিকতার আদর্শে। এই ধরনের রাগাশ্রয়ী বাংলা গানে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন অনন্য।

নজরুল তন্ত্র

কাজী নজরুল-র বেশ কিছু গানের জনপ্রিয়তার নেপথ্যে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯৩২ সালে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের সঙ্গে নজরুলের আলাপ হয়েছিল মেগাফোন কোম্পানির অফিসে। রবীন্দ্রনাথের ‘অল্প লইয়া থাকি তাই’ গানটি জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের খুব প্রিয় ছিল। শোনা যায়, ওই গানটি রেকর্ড করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেও তার অনুমতি মেলেনি। এর পরে ভারাক্রান্ত মনে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ যখন এইচএমভির রিহার্সাল রুমে গেলেন, তখন সেখানে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম ও জমিরুদ্দিন খান। ঘটনাটি শুনে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন কাজী নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথের গানটি শুনতে চান। কাগজে একটি গান লিখে বললেন, ঠিক ওই সুরে এই গানটা করো তো! জ্ঞানবাবু ধীরে ধীরে গাইলেন ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর’। গানটি রেকর্ড করা হলে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। যদিও পরবর্তী কালে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ রেকর্ড করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের একটি গান, ‘বিমল আনন্দে জাগো রে’।

কাজী নজরুলের বেশ কিছু গান রেকর্ড করেছিলেন জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ। তার মধ্যে ছিল রাগাশ্রয়ী থেকে শ্যামাসঙ্গীত। গানগুলির মধ্যে ‘স্বপনে এসেছিল মৃদুভাষিণী’, ‘আয় মা উমা রাখব এ বার’, ‘মধুর মিনতি শুনো’, ‘আজি নন্দলাল মুখচন্দ্র,’ ‘মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়’, ‘পিউ পিউ বিরহী পাপিয়া’, ‘মেঘে মেঘে অন্ধ’ ইত্যাদি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল।

শোনা যায় মানসিক টানাপড়েনের সময়ে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ ও নজরুল দু’জনেই তন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। জনশ্রুতি, লালগোলার প্রসিদ্ধ তন্ত্রসাধক বরদা মজুমদারের কাছে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদকে নিয়ে গিয়েছিলেন নজরুল। অনেকে মনে করেন এর ফলস্বরূপ কালজয়ী কিছু শ্যামাসঙ্গীত সৃষ্টি হয়েছিল। এই গানগুলির মধ্যে ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা’, ‘মা মা বলে ডাকি কালী’, ‘শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে’ উল্লেখ্য।

ব্যক্তিত্ব

বাংলা গান গাইতে তিনি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন। এক বার ক্রাউন সিনেমা হলে সারা রাত্রিব্যাপী সঙ্গীতের আসরে কেশর বাই কেরকর-সহ নানা বিখ্যাত শিল্পীর গান ছিল। ভোরবেলা জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ মঞ্চে উঠে বললেন, সারা রাত খেয়াল, ঠুমরি, গজলের পরে এ বার কিছু বাংলা গান শুনবেন? এতক্ষণ শ্রোতারা যেন সেই অপেক্ষাই করছিলেন। শুরু হল গান। প্রায় চার ঘণ্টা গেয়েছিলেন তিনি!

গানের আসরে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ অবাঙালি উস্তাদদের কোনও রকম পরোয়াই করতেন না। এক বার এক অনুষ্ঠানে দিলীপচন্দ্র বেদী তার সৃষ্ট ‘বেদী কা ললিত’ জাহির করে শোনাচ্ছিলেন। পরবর্তী শিল্পী ছিলেন জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ। তিনি গান শুরু করার আগে ঘোষণা করে বলেছিলেন, ‘‘বেদী কা ললিত শুন লিয়া অব গোঁসাইকা ললিত শুনো।’’

আসরে অবাঙালি উস্তাদদের পরোয়া করতেন না । [1]

শিষ্য

তার শিষ্যদের মধ্যে ছিলেন ধীরেন ঘটক, জয়কৃষ্ণ সান্যাল, সত্যেন ঘোষাল প্রমুখ। তার উপার্জিত যাবতীয় অর্থ এক ছাত্রের কাছে গচ্ছিত রাখতেন। ছাত্রটি অত্যন্ত দরিদ্র বলে তাকে বিনা পয়সায় গানও শেখাতেন।

তথ্যসূত্র

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.