নৃবিজ্ঞান

আক্ষরিক অর্থে নৃবিজ্ঞান (ইংরেজি ভাষায় Anthropology) মানুষ বিষয়ক বিজ্ঞান। নৃবিজ্ঞানের লক্ষ্য হলো অতীত ও বর্তমানের মানব সমাজ ও মানব আচরণকে অধ্যয়ণ করা । কিন্তু মানুষ বিষয়ক অন্যান্য বিজ্ঞানগুলির চেয়ে এটির পরিধি ব্যাপকতর। বিশ্বের সকল অঞ্চলের, সংস্কৃতির মানুষকে নিয়ে এই বিজ্ঞানে গবেষণা করা হয়। লক্ষ কোটি বছর ধরে মানুষের বিবর্তন এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের গবেষণাও নৃবিজ্ঞানের আওতায় পড়ে। নৃবিজ্ঞানে মানুষকে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গবেষণা করা হয়। বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ ও তাদের সব রকমের অভিজ্ঞতা নৃবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়। নৃবিজ্ঞানীরা কোন একটি বিশেষ মানব সম্প্রদায়ের সাধারণ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে ও সেগুলি ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলি মানুষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বা সামাজিক রীতিনীতি হতে পারে।

আমেরিকান আদিবাসীদের সাথে একজন নৃবিজ্ঞানী

ইতিহাস

প্রথম দিকে বিমূর্ত বিশেষ্য হিসাবে ইতিহাসের ক্ষেত্রে নৃবিজ্ঞান বা নৃতত্ত্ববিজ্ঞানকে ব্যবহার করা হতো । বর্তমানের নৃবিজ্ঞান শব্দের যে রূপ তা প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল রেনেসাঁস জার্মানিতে, ম্যাগনাস হন্ড্ট ও ওটো ক্যাসম্যানের কাজগুলোতে । তাদের নতুন ল্যাটিন অ্যানথ্রোপোলজিয়া গ্রিক শব্দ ánthrōpos (ἄνθρωπος, "মানব") এবং lógos (λόγος, "অধ্যয়ন") এর মিশ্র রূপ থেকে উদ্ভব হয়েছে । (এটি বিশেষণ হিসাবে অ্যারিস্টট্লের কাজগুলিতে প্রকাশিত হয়েছিল) ১৮ শতকের প্রথম দিকে এটি ইংরেজি ভাষায় ব্যবহার করা শুরু হয় সম্ভবত ফরাসি এনথ্রোপোলজির মাধ্যমে।

১৯ শতক

১৬৪৭ সালে কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বার্থোলিনস নিম্নরূপে ''l'anthropologie'' কে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন - নৃবিজ্ঞান বা বলা যেতে পারে মানুষ সম্পর্কিত বিজ্ঞানকে সচরাচর কিংবা যুক্তিসংগত কারণেই ভাগ করা হয় শরীর বিদ্যায়-যা আলোচনা করে দেহ ও তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে এবং মনোবিদ্যায়-যা আলোচনা করে আত্মা নিয়ে।' [1]

পরবর্তীতে এলোমেলোভাবে এই পরিভাষা বিভিন্ন বিষয়ে ব্যবহৃত হয়েছে।যেমন এতিয়েন সেরেস ১৮৩৯ সালে তুলনামূলক শরীরতত্ত্বের ভিত্তিতে মানুষের প্রাকৃতিক ইতিহাস বা জীবাশ্মবিজ্ঞান ব্যাখ্যার জন্য এবং ১৮৫০ সালে National museum of natural history(France) এর Jean louise armand de quatrefages breau নৃবিদ্যা এবং নৃকূলবিদ্যার সাহায্যে চেয়ার তৈরির ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে এই পরিভাষা ব্যবহার করেছিলেন।বিভিন্ন সময়ে নৃবিজ্ঞানীদের বেশ কিছু ক্ষণস্থায়ী সংগঠন তৈরি হয়েছে।১৮৩৯ সালে ফ্রান্সের Societe ethnologique de Paris যারা প্রথবার নৃকূলবিদ্যা পরিভাষা ব্যবহার করেছিলো তারা মূলত ছিলো দাস প্রথা বিরোধী।ফলে ১৮৪৮ সালে এই প্রথা বিলুপ্তির সাথে সাথে সংগঠনেরও বিলুপ্তি ঘটে।

২০ ও ২১ শতক


ক্ষেত্র

সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান

সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে বৈচিত্র্যতা এবং সাদৃশ্যতা  অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে থাকে। সংস্কৃতি হলো একটি মানবগোষ্ঠীর ধর্ম, সামজিক রীতিনীতি, খাবার, আচার ও শিল্পের বৈশিষ্ট্য। ফলে, সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে মানুষ কীভাবে সংস্কৃতির অংশ হয়ে জীবন-যাপন করে, সেটা অন্যতম আলোচ্য বিষয়। সংস্কৃতির পরিবর্তনের ব্যাপারগুলোও এইক্ষেত্রে আলোচিত হয়৷  সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান সামাজিক কাঠামোর উন্মোচন,প্রতীকের ব্যাখ্যা প্রদানের কাজও করে থাকে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য অধ্যয়ন ও ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা মাঠকর্ম অথবা সংস্কৃতির তুলনামূলক অধ্যয়নের মাধ্যমে করে থাকেন। মাঠকর্মে নৃবিজ্ঞানীরা যে সমাজ, সংস্কৃতি ও জনগোষ্ঠী সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করেন তারা সেই জনগোষ্ঠীর সাথে বসবাস করে এসকল তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেন। প্রথাগতভাবে নৃবিজ্ঞানীরা ছোট কোন জনগোষ্ঠীতে থেকে ঐ জনগোষ্ঠীর আচার, রীতিনীতি, প্রথা, বিশ্বাস, সামাজিক রীতি, ধর্ম, অর্থনীতি ও রাজনীতি পর্যবেক্ষণ এবং অধ্যয়ন করেন। নৃবৈজ্ঞানিক চিন্তাসূত্র নৃতাত্ত্বিক মাঠকর্ম থেকে উদ্ভূত হয় বলে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিজ্ঞান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সংস্কৃতির আড়াআড়ি পাঠের ক্ষেত্রে নৃবিজ্ঞানীরা মাঠকর্ম থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ করে থাকে। সাংস্কৃতিক তুলনা, বৈচিত্র্য নির্ণয় ও সাধারণীকরণ করতে এথনোলজি ( Ethnology ) অনুসরণ করা হয়। অনুমান নিরীক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত তত্ত্ব নির্মাণে এথনোলজি সাহায্য করে। বহু মহাদেশে নৃবিজ্ঞান বলতে কেবলমাত্র ‘সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান’ কে বোঝায় কিন্তু উত্তর আমেরিকায় নৃবিজ্ঞানের যেকোনো উপবিভাগের অনুশীলন ঘটে ‘চার ক্ষেত্রের’ সাপেক্ষ হিসেবে।

জৈবিক নৃবিজ্ঞান

নৃবিজ্ঞানের এই ক্ষেত্রে মানুষের প্রাচীনসত্তা বা জৈবিকসত্তা নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা হয়ে থাকে। প্রধান উদ্দেশ্য হল - মানুষকে জৈবিকসত্তা হিসাবে বিবেচনা করে তার প্রাণিজগতে সঠিক অবস্থান, ক্রমবিকাশের ধারায় তার উদ্ভব, বৈজ্ঞানিক অভিধা,তার জিনের গঠন, শারীরিক গঠনগতবিদ্যা এবং বাসস্থানগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে সর্বেক্ষণ ও পর্যালোচনা।

প্রত্নতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান

প্রত্নতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান হলো অতীতের মানুষ ও তার সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণার ক্ষেত্র। নৃবিজ্ঞানের এই শাখায় মানুষের পূর্বসূরী ও মানব-সদৃশ প্রাণীর জীবাশ্মের নিদর্শন এবং সেইসব মানুষ ও মানব-সদৃশ প্রাণী গোষ্ঠীর জীবন যাপনে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক ও সামাজিক বস্তুসামগ্রী গুরুত্বসহকারে পর্যালোচনা করা। এই ক্ষেত্রের উল্লেখযোগ্য দিক হলো প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতির সাথে বর্তমানের সেতুবন্ধন।

ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান

নৃবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান শাখা হল দৈহিক নৃবিজ্ঞান। দৈহিক নৃবিজ্ঞানের একটি উপশাখায় পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ও পরবর্তীকালে তাদের শারীরিক বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয়; এই ক্ষেত্রটি মনুষ্য জীবাশ্মবিজ্ঞান নামে পরিচিত। দৈহিক নৃবিজ্ঞানের আরেকটি উপশাখায় বর্তমান মনুষ্য সমাজগুলির মধ্যকার দৈহিক বৈচিত্র্যের প্রকৃতি ও কারণ আলোচনা করা হয়; এই ক্ষেত্রটি মনুষ্য বৈচিত্র্য নামে পরিচিত।

নৃবিজ্ঞানের দ্বিতীয় প্রধান শাখা হল সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান আবার তিনটি উপশাখায় বিভক্ত---প্রত্নবিজ্ঞান, নৃতাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানজাতিবিজ্ঞান। এই তিনটি উপশাখাই মানুষের সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে। এগুলি থেকে কোন নির্দিষ্ট সমাজের চিন্তাধারা ও আচরণের রীতিনীতি বুঝতে পারা যায়।

প্রত্নবিজ্ঞানীরা প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের দৈনন্দিন জীবন এবং রীতিনীতি তাত্ত্বিকভাবে পুনর্গঠন করতে চেষ্টা করেন। এছাড়াও তারা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন অনুসরণ করেন এবং এই পরিবর্তনগুলি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তারা পুরাতন মনুষ্য সংস্কৃতিগুলির অবশেষ থেকে ইতিহাস পুনর্নির্মাণের চেষ্টা চালান।

নৃতাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানীদের একাংশ ভাষার আবির্ভাব এবং সময়ের সাথে ভাষার বিস্তার নিয়ে আগ্রহী; এই ক্ষেত্রটি ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান নামে পরিচিত। তারা সমকালিক ভাষাগুলি কীভাবে একে অপরের থেকে আলাদা, তা নিয়েও গবেষণা করেন; এই গবেষণা বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের আওতায় পড়ে। এছাড়াও তারা সমাজে ভাষার প্রকৃত প্রয়োগ নিয়েও আগ্রহী; এই ক্ষেত্রটির নাম দেওয়া হয়েছে সমাজভাষাবিজ্ঞান।

বর্তমান ও নিকট অতীতের জাতিগুলির রীতিনীতি, চিন্তাভাবনা ও কাজকর্মের মধ্যে কী পার্থক্য আছে এবং কেনই বা এই পার্থক্য হয়, তা জাতিবিজ্ঞানে আলোচিত হয়। জাতিবিজ্ঞানীদের একাংশ জাতিবিবরণে আগ্রহী; একজন জাতিবিবরক কোন একটি সমাজে গিয়ে বছরখানেক বাস করেন, কথা বলেন এবং সেই সমাজের রীতিনীতি পর্যবেক্ষণ করেন। পরবর্তীতে তিনি সামাজিক দলটির একটি পূর্ণাঙ্গ জাতিগত বিবরণ প্রস্তুত করেন। আরেক ধরনের জাতিবিজ্ঞানীর নাম জাতি-ইতিহাসবিদ; এরা লিখিত দলিলপত্র অনুসন্ধান করে সময়ের সাথে কোন একটি নির্দিষ্ট জাতিগত দলের জীবনধারা কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তা নির্ণয় করার চেষ্টা করেন। তৃতীয় আরেক ধরনের জাতিবিজ্ঞানীকে বলা হয় আন্তঃসাংস্কৃতিক গবেষক; এরা জাতিবিবরক ও জাতিইতিহাসবিদদের উপাত্ত থেকে কিছু সংস্কৃতির নমুনা নেন এবং কোন ধরনের রীতিনীতি সাধারণভাবে সব ধরনের সমাজে প্রযোজ্য, তা আবিষ্কারের চেষ্টা করেন।

নৃবিজ্ঞানের গবেষণা মানুষকে সহিষ্ণু করতে সাহায্য করতে পারে। অন্য জাতির লোক কেন সাংস্কৃতিক ও দৈহিক দিক থেকে আলাদা আচরণ করে, নৃবিজ্ঞান তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়। যেসব সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ও কাজকর্ম আমাদের কাছে ভুল বা অশোভন মনে হতে পারে, সেগুলি হয়ত বিশেষ পরিবেশগত বা সামাজিক অবস্থার জন্য অভিযোজনের ফসল।

এছাড়াও নৃবিজ্ঞানের আরো অনেক শাখা রয়েছে, সেগুলো হলোঃ- স্বাস্থ্য নৃবিজ্ঞান, ব্যবসায় নৃবিজ্ঞান, অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান প্রভৃতি।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. Bartholin, Caspar the Younger। Oxford Music Online। Oxford University Press। ২০১৩-০২-১১।
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.