নূরজাহান বেগম

নূরজাহান বেগম (৪ জুন ১৯২৫ - ২৩ মে ২০১৬) বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত এবং সাহিত্যিক। তিনি ভারত উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা "বেগম" পত্রিকার সূচনালগ্ন থেকে এর সম্পাদনার কাজে জড়িত ছিলেন এবং ছয় দশক ধরে বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার ডাক নাম ছিল নূরী

নূরজাহান বেগম
জন্ম
নূরজাহান বেগম

জুন ৪, ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ
চালিতাতলী গ্রাম, চাঁদপুর[1]
মৃত্যুমে ২৩, ২০১৬(2016-05-23) (বয়স ৯০)
ঢাকা, বাংলাদেশ
পেশাসাংবাদিক
পরিচিতির কারণবেগম পত্রিকার সম্পাদক
দাম্পত্য সঙ্গীরোকনুজ্জামান খান
পুরস্কারবেগম রোকেয়া পদক

প্রাথমিক জীবন

নূরজাহান বেগম ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুর জেলার চালিতাতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ও মাতার নাম ফাতেমা বেগম। নাসিরউদ্দীন, সওগাত পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯২৯ সালে সাড়ে তিন বছর বয়সে মা আর মামা ইয়াকুব আলী শেখের সঙ্গে তিনি কলকাতায় তার পিতার সঙ্গে বসবাস করার জন্য চলে যান। সেখানে তারা সওগাত পত্রিকার দপ্তর ১১, ওয়েলেসলি স্ট্রিটের দোতলা বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।

সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণীতে ভর্তির মাধ্যমে তিনি তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে বেলতলা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন কিন্তু সেখান থেকে পুনরায় আগের বিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন এবং ১৯৪৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। এখানে তার সহপাঠী ছিলেন সাবেরা আহসান ডলি, রোকেয়া রহমান কবির, সেবতি সরকার, জ্যোত্‍স্না দাশগুপ্ত, বিজলি নাগ, কামেলা খান মজলিশ, হোসনে আরা রশীদ, হাজেরা মাহমুদ ও জাহানারা ইমাম। উচ্চ মাধ্যমিকে তার বিষয় ছিল দর্শন, ইতিহাসভূগোল। একই কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন।

সওগাত পত্রিকা অফিসে নিয়মিত সাহিত্য মজলিস বসত যেখানে যোগ দিতেন কাজী নজরুল ইসলাম, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, হবীবুল্লাহ বাহার, ইবরাহীম খাঁ, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ৷ এই সাহিত্য মজলিসের নিয়মিত শ্রোতা ছিলেন নূরজাহান।

বেগম পত্রিকা

বেগম পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই যখন নূরজাহান বেগম বিএ শ্রেণীতে পড়তেন। তার বাবা নাসিরুদ্দীন প্রতিষ্ঠিত বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। প্রথম চার মাস সম্পাদক হিসেবে এর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। নূরজাহান বেগমের মতো যারা সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল ও লেডি বেবোর্ন কলেজে পড়তেন তারা সবাই মিলে বেগম-এর জন্য কাজ করতেন। বেগমের শুরু থেকে নূরজাহান বেগম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। তিনি বিয়ে করেন রোকনুজ্জামান খানকে (দাদা ভাই)। ১৯৫০ সালে তারা বাংলাদেশে চলে আসেন।[1]

ঢাকায় এসে নারীদের ছবি আঁকতে, লেখার জন্য উৎসাহী দিতেন নূরজাহান বেগম, যাতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ে। যারা লেখা পাঠাত, তাদের ছবিও ছাপাতেন বেগম পত্রিকা। প্রথমদিকে পুরুষরাও এতে লিখতেন। তবে এখন এতে শুধুমাত্র নারীরাই লিখে থাকেন।[2] ১৯৫৪ সালে মার্কিন মহিলা সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী মিসেস আইদা আলসেথ ঢাকায় বেগম পত্রিকা অফিস পরিদর্শন করেন। ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে 'বেগম ক্লাব' প্রতিষ্ঠিত হয় যার প্রেসিডেন্ট হন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ, সেক্রেটারি হন নূরজাহান বেগম এবং বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন এর অন্যতম উপদেষ্টা।

শেষ জীবন

নূরজাহান বেগম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঢাকার শরৎ গুপ্ত স্ট্রিটের ৩৮ নম্বর বাড়িতে প্রায় ৬৪ বছর ধরে বসবাস করেছেন। নারী জাগরণ, নতুন লেখক সৃষ্টি, সাহিত্য ও সৃজনশীলতায় নারীকে উৎসাহী করাই ছিল মূল লক্ষ্য। বেগম-এর প্রথম দিকে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তারা লেখা ও ছবি সংগ্রহ করেতেন। নূরজাহান বেগম বলেনঃ

মেয়েরা এখন হরহামেশা বাইরে পড়তে যাচ্ছে। উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরছে। তারপরও আমার মনে হয় নারীকে আরও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। তাহলে সামাজিক উন্নয়ন দ্রুত ঘটবে। যোগ্যতার সুবিচার করতে হবে তাঁদের।[2]

পত্রিকার বাইরে তিনি আপওয়া, জোনটা ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ, মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে সমাজসেবা করেছেন।

সম্মাননা

১৯৯৬ সালে নূরজাহান বেগম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ত্ব হিসেবে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠ চক্রের সন্মাননা লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার থেকে রোকেয়া পদক, ১৯৯৯ সালে গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি থেকে শুভেচ্ছা ক্রেস্ট , ২০০২ সালে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার,[3] ২০০৩ ও ২০০৫ সালে নারী পক্ষ দুর্বার নেটওয়ার্ক ও কন্যা শিশু দিবস উদ্‌যাপন কমিটির পক্ষ থেকে তিনি সংবর্ধনা লাভ করেন। এছাড়াও তিনি সংবর্ধিত হয়েছেন বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, চট্টগ্রাম লেডিজ ক্লাব, চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ, ঢাকা লেডিজ ক্লাব, ঋষিজ শিল্প গোষ্ঠী, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র প্রভৃতি সংগঠনের মাধ্যমে। স্বর্ণপদক পেয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, লেখিকা সংঘ, কাজী জেবুনন্নেসা মাহাবুবুল্লাহ ট্রাষ্ট, বাংলাদেশ সাংবাদিক ফোরাম, রোটারি ক্লাব প্রভৃতি সংগঠন থেকে। ২০১০ সালে পত্রিকা শিল্পে তার অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক নারী সংগঠন ইনার হুইল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮ সম্মাননা পান তিনি।[4]

মৃত্যু

৫ মে ২০১৬ তারিখে অসুস্থ অবস্থায় তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ মে ২০১৬ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন।[5]

তথ্যসূত্র

  1. হাসান, শেখ মেহেদী (৭ই জুন,২০১০)। "৮৬ বছরে নূরজাহান বেগম"দৈনিক বাংলাদেশ সময়। সংগ্রহের তারিখ ১৭ই ফেব্রুয়ারি,২০১১ এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  2. শিরোপা, তৌহিদা (১২-০১-২০১১)। "কালের সাক্ষী নূরজাহান বেগম"দৈনিক প্রথম আলো। ২০২০-০৫-০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ই ফেব্রুয়ারি,২০১১ এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  3. "৮৬ বছরে নূরজাহান বেগম"সাপ্তাহিক একুশে। ৭ই জুন,২০১০। সংগ্রহের তারিখ ১৭ই ফেব্রুয়ারি,২০১১ এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  4. "নূরজাহান বেগম"দৈনিক ইত্তেফাক। ২১শে আগস্ট,২০১০। সংগ্রহের তারিখ ১৭ই ফেব্রুয়ারি,২০১১ এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  5. "'বেগম' সম্পাদক নূরজাহান বেগম আর নেই"প্রথম আলো। ২৩ মে ২০১৬।

আরো পড়ুন

  • তোমারি কথা বলবো ,রায়হানা হোসেন- কাজী মদিনা ,প্রকাশক- জনান্তিকা, ৫০, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ,ঢাকা- ১০০০। (প্রকাশকাল: ২০ জুলাই ২০০৩)
  • চারবেলা চারদিক (সাপ্তাহিক পত্রিকা)।
  • দৈনিক যুগান্তর (সুরঞ্জনা) , ৩০ অক্টোবর ২০০২।
  • দৈনিক ইত্তেফাক (মহিলা অঙ্গন), ৪ ডিসেম্বর ২০০০।
  • দৈনিক জনকন্ঠ (অপরাজিতা), ১ জুন ১৯৯৯।
  • প্রথম আলো (ছুটির দিনে), ২৩ জুলাই ২০০৫।
  • মাকু (পাক্ষিক পত্রিকা), ৫ অক্টোবর ১৯৯৭ ,বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.