নুরুল ইসলাম ফারুকী

নুরুল ইসলাম ফারুকী ছিলেন একজন বাংলাদেশী ইসলামী পণ্ডিত, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এবং ইসলাম প্রচারক। ২০১৪ সালে তাকে অজ্ঞাত হামলাকারীরা হত্যা করে।[1][2] তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি মেঘনা ট্রাভেলস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। এ ছাড়া তিনি একটি হজ এজেন্সি, ফারুক ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক ছিলেন।[3]

আল্লামা নুরুল ইসলাম ফারুকী
নুরুল ইসলাম ফারুকী
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম১৯৫৯
মৃত্যু২৭ অগাস্ট ২০১৪
ধর্মইসলাম
জাতিসত্তাবাংলাদেশী, বাঙালি
অঞ্চলবাংলাদেশ
আখ্যাসুন্নি
ব্যবহারশাস্ত্রহানাফি
প্রধান আগ্রহসুন্নি ইসলাম, সুন্নি হানাফী আইনশাস্ত্র
মুসলিম নেতা
যাদের প্রভাবিত করেন
  • বাকীবিল্লাহ মিশকাত চৌধুরী

জন্ম ও পরিচয়

শহীদ নুরুল ইসলাম ফারুকী ২৪ নভেম্বর ১৯৫৯ সালে পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের নাউতারী নবাবগঞ্জ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জামসেদ আলী, তিনিও একজন সুপরিচিত আলেম ছিলেন।

শিক্ষাজীবন

ফারুকী তার নিজ গ্রাম নাউতারী নবাবগঞ্জে প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করেন। ১৯৭৫ সালে নীলফামারী জেলার ডোমার থানার অন্তর্গত চিলাহাটি জামিউল উলুম সিনিয়র মাদরাসা থেকে দাখিল পরবর্তীতে একই মাদরাসা থেকে আলিম পাস করেন। ১৯৭৯ সালে ছারছিনা দারুসসুন্নাত কামিল মাদরাসা থেকে ফাজিল ও কামিল (হাদিস বিভাগ) পাশ লাভ করেন।[4]

এছাড়াও সাধারণ শিক্ষার দিক থেকে ১৯৮১ সালে নীলফামারী সরকারি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে জগন্নাথ কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে স্নাতক করেন। তিনি স্থানীয় কলেজের প্রতিযোগিতায় কোরআন তেলাওয়াতে প্রথম স্থান অধিকার করতেন।

কর্মজীবন

তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি প্রথমে পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার জামে মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার কিছুদিন পর ঢাকা কেরানীগঞ্জের নূরানীয়া চিশতীয়া আলিয়া মাদরাসার প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৮৯ সালে প্রথম হজ গমনের উদ্দেশে মক্কায় যান।

তিনি মোয়াজ্জামায় মোহাম্মদ মালিকি আলাদির রওজায় ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেন। কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। এসময় ঢাকাসহ বিভিন্ন মসজিদে ৩৩ বছর ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। আবার ছারছীনা পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ মাজারে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সারা দেশে ওয়াজ মাহফিল করতেন, সুন্নিয়াতের পক্ষে যুক্তিযুক্ত প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপন করতেন।

সর্বশেষ জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত খাজা শরফুদ্দিন চিশতির মাজারে খাদেম ও সুপ্রিমকোর্ট জামে মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইসলামী মিডিয়া জনকল্যাণ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন।

বিদেশ সফর

তিনি কাফেলা অনুষ্ঠানের প্রচারণার জন্য বহু দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ভারত, শ্রীলঙ্কা, জর্ডান, তুরস্ক, ইতালি, ইরান, মিশর সহ বহু দেশ বহু বার ভ্রমণ করেছেন।

প্রকাশিত বই

তিনি কয়েকটি বই লিখেছেন। তার বইগুলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকিদা ও সুফিবাদ ভিত্তিক। সর্বশেষে ‘মারেফুল হারামাইন’ বইটি লিখেছেন। বইগুলোতে ইসলামের স্থাপত্য বা অবিকৃত রূপ তুলে ধরা হয়েছে।

গণমাধ্যমে কাজ

তিনি চ্যানেল আই-এ শান্তির পথেকাফেলা নামে দুটি প্রোগ্রাম এবং মাইটিভিতে হক কথা প্রোগ্রাম উপস্থাপন করতেন। এছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। রাজনৈতিকভাবে, তিনি একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন এবং বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, যা কয়েকটি ইসলামী গোষ্ঠীর প্ল্যাটফর্ম।[5][6]

মৃত্যু

২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট ফারুকীকে তার রাজাবাজার কার্যালয়ে ৮-১০ জন অজ্ঞাত হামলাকারী হত্যা করে।[2] এর আগে একজন মহিলা, যিনি তাকে বারবার টেলিফোন করেছিলেন তাকে তার বাড়িতে দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, চল্লিশ বছর বয়সী মহিলা ফারুকির বাড়িতে দুই ঘণ্টা থাকার সময় নার্ভাস ছিলেন এবং অদ্ভুত আচরণ করেছিলেন।[2] তার পরিবারের দাবি, বেশ কয়েকজন যুবক হজ নিয়ে কথা বলতে বাড়িতে এসে তাকে হত্যা করেছে। স্থানীয় এক ইমামের মতে, দুই যুবক রাত সাড়ে টার দিকে তার বাড়িতে আসে এবং ৬-৭ জন সশস্ত্র যুবক ঘরে তার কাছে থাকা সব টাকা দাবি করে।[6] ফারুকী বলেছিলেন, তার বাড়িতে প্রায় এক লাখ টাকা আছে, তখন তারা (অজ্ঞাত যুবকগণ) বলে এই টাকা তাদের অনেকের জন্য হবে না। তারা তার শোবার ঘরে কাপড় দিয়ে তার হাত-পা বেঁধে ফেলে এবং যাওয়ার আগে তাকে জবাই করে,[6] তবে তার পরিবারের কিছু হয়নি।[6]

প্রতিক্রিয়া

ফারুকীর স্ত্রী দাবি করেন, রহস্যময়ী নারীকে গ্রেফতার করা হলে অপরাধীরা ধরা পড়বে। তার পুত্র আহমেদ রেজা ফারুকী একটি লিখিত বক্তব্য পড়ে বলেছিলেন: "আমার বাবা 'সুন্নি' মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। যারা তার মতাদর্শের বিরোধিতা করেছিল তাদের কাছ থেকে তিনি মোবাইল ফোন এবং ফেসবুকে হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন। চরমপন্থী বা খারেজি-ওহাবী আহলে হাদিস তাকে হত্যা করেছিল, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ছিল।[7]

ফারুকীর হত্যাকাণ্ডের কারণে বেশ কয়েকটি ইসলামী গোষ্ঠী বিক্ষোভ শুরু করে, যারা অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে দেশব্যাপী ধর্মঘট ডেকেছিল। [8]

তার সংগঠন আহলে সুন্নাতের সদস্যরা তাদের নেতা নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যার প্রতিবাদ করে চট্টগ্রামে মুরাদপুর মোড় অবরোধ করে।[5] ২০১৪ সালের আগস্টে, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র সেনার প্রধান মুহাম্মদ নুরুল হক চিশতি এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, দলীয় নেতা নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে সারা বাংলাদেশে অর্ধদিবস ধর্মঘট পালিত হবে। [9][10] হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আশুগঞ্জ এলাকায় মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা[11] আসল খুনিদের বিচারের দাবিতে সৈয়দ ইমাম হায়াতের নির্দেশনায় বিশ্ব সুন্নি আন্দোলন বেশ কয়েকটি শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনেরও আয়োজন করে।[12]

গ্রেফতার

হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকা থেকে মাহবুবা নামের ‘রহস্যময়ী নারী’ কে আটক করে বাংলাদেশ পুলিশ।[2]

ব্যক্তিগত জীবন

ফারুকীর দুটি স্ত্রী ছিল। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী লুবনা ইসলাম, রাজাবাজার বাড়ীতে তার সাথে বসবাস করতেন ও তার প্রথম স্ত্রী সন্তানদের সাথে ঢাকার মালিবাগ এলাকায় তখন বাস করতেন।[7]

তথ্যসূত্র

  1. "Faruqi killing: Wahabi, Moududi followers blamed"Dhaka Tribune। ১৬ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মার্চ ২০১৬
  2. Moutushi, Patracia (৩০ আগস্ট ২০১৪)। "Farooqi murder: Mystery woman held"Priyo News। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ মে ২০১৬
  3. Khan, Tazlina Zamila। "Case filed over Ahle Sunnat leader Faruqi killing"The Dhaka Tribune। ২ জুন ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ এপ্রিল ২০১৬
  4. "মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী (রহঃ)"www.sunnipediabd.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৯
  5. "Ahle Sunnat protests Faruqi killing"Dhaka Tribune। ১৬ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মার্চ ২০১৬
  6. "Bangladesh Islami Front leader slaughtered at Dhaka home"bdnews24.com। ২৭ আগস্ট ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৮ মে ২০১৬
  7. "Extremists responsible for Farooqi's murder, claims family"bdnews24.com। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মার্চ ২০১৬
  8. "2 suspects placed on 2-day remand"The New Nation। ১ সেপ্টেম্বর ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
  9. "Chhatra Sena calls strike for Sunday"bdnews24.com। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মার্চ ২০১৬
  10. "Islami Chhatra Sena to enforce hartal on Sunday"Dhaka Tribune। ১৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মার্চ ২০১৬
  11. "Bangladesh Islami Chhatra Sena formed a human chain"The Daily Observer। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মার্চ ২০১৬
  12. "পটিয়ায় বিশ্ব সুন্নি আন্দোলনের উদ্যোগে নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন"DailyInqilabOnline। ২০১৭-০৮-২৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১০-৩১
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.