নিবারণ পণ্ডিত

কবি নিবারণ পণ্ডিত (২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯১২ - ১ নভেম্বর্‌ ১৯৮৪) অবিভক্ত বাংলার ভাটিয়ালি গান রচয়িতাদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তি। ১৯৪১ সালে অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার সময়, ১৯৪৫ সালের কৃষক আন্দোলনের সময় তিনি গণসঙ্গীত রচনা করে প্রতিবাদ করেন। ভারতের উদ্বাস্তুদের নিয়ে তিনি বাস্তুহারাদের মরনকান্না গ্রন্থে দুর্দশার বর্ণনা করেন।

কবি নিবারণ পণ্ডিত ও হেমাঙ্গ বিশ্বাস

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

ব্রিটিশ ভারতে ময়মনসিংহ জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাদের পরিবার মূলত কৃষিভিত্তিক হলেও পিতা ভগবানচন্দ্র শিক্ষকতা করার জন্য পণ্ডিত উপাধি পেয়েছিলেন। নিবারণ পণ্ডিত কিশোরগঞ্জের রমানন্দ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১০ বছর বয়সে পিতার মৃত্যু হওয়ায় তার আর বিদ্যালাভ করা হয় নি। সংসারের হল ধরতে বিড়ি বাধার কাজ করতে হয়।

কাব্যকীর্তি ও বিপ্লবী জীবন

ছোটবয়স থেকেই তিনি গ্রাম্য গান ও কবিতা রচনায় পারদর্শী ছিলেন। গ্রামের যাত্রা দলে ও গায়করা তাকে তাদের দলে নিয়ে যেতেন। তিনি পালা গান গায়কদের হয়ে গোপনে গান লিখে দিতেন। প্রশ্নত্তর পর্বের গান অর্থাৎ কবিগানে ভীষণ দক্ষ ছিলেন। তাকে দলে নেওয়ার জন্য হিড়িক পড়ে যেত। কবির আত্মকথনে জানা যায় তিনি প্রেম ও ভক্তি রসের গান রচনায় আগ্রহী হলেও রূঢ় বাস্তব ক্রমে তার চিন্তা ভাবনা পরিবর্তন হতে থাকে। সমাজের অন্যায় অবিচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার গান অন্তর থেকে নির্গত হয়। সেই সময় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে তার যোগাযোগ হয়। ১৯৪১ সালে ঢাকার হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার সময় তিনি সাম্যবাদীর গান রচনা করেন। ১৯৪৩ সালে মনন্বন্তর ও ১৯৪৫ সালের গারো পাহাড়ে হাজং জাতির উপরে টংক প্রথার বিরুদ্ধে তিনি গীতিকবিতা লেখেন।

দেশভাগ ও ভারতে আগমন

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের দেশভাগের পরপরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আসেননি। সেখানে থেকেই তিনি আনা কৃষি-বিলের বিরুদ্ধে গান লিখে পুস্তক ছাপেন ও কৃষকদের মাঝে গাইতে থাকেন। ফলে খুব তাড়াতাড়িই প্রশাসনের নজরে পড়ে যান। এরপর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে আনসার বাহিনী তাকে কারারুদ্ধ করেন এবং তিনি কারাগারে অত্যাচারের সম্মুখীন হন। তিনি কবি, গণসঙ্গীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে একটি চিঠিতে লেখেন

এরপর কারাগার থেকে মুক্তি পেলে সেখান থেকে ছোট-বড় নয়টি পরিবারকে নিয়ে তিনি ভারতে চলে আসেন।

ভারতে বিপ্লবী জীবন

'জনযুদ্ধ' পত্রিকার ১৯৪২ সালের ১লা জুলাই সংখ‍্যায় নিবারণ পণ্ডিতের 'জনযুদ্ধের ডাক' নামের কবিতাটি প্রকাশের পর তার খ‍্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। যুক্ত হন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে। ১৯৪৩ সালের মে মাসে তিনি মুম্বাইয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস ও আইপিটিএ-র প্রথম সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। ভারতীয় থিয়েটার, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত  জগতের দিকপাল ব‍্যক্তিদের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে‌। একেবারে এক অন্য মানুষ হয়ে ফিরে আসেন নিবারণ পণ্ডিত - উদ‍্যম, আত্মবিশ্বাস ও স্থির রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিপূর্ণ হয়ে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর নিবারণ পূর্ব পাকিস্তানেই থেকে যান। কিন্তু লিগ পুলিশের হাতে অমানবিক অত‍্যাচারের ফলে বাধ‍্য হয়ে ভারতে চলে আসেন ১৯৫০ সালের ডিসেম্বরে। ১৯৭৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিআইএম-এর টিকিটে ডাউয়াগুড়ি গ্রাম থেকে লড়াই করে জয়লাভ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নিবারণ। ১৯৭৮ সালে তাকে আইপিটিএ-র সান্মানিক আজীবন সদস‍্যপদ দেওয়া হয়েছিল।

জীবনাবসান

১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে কবি নিবারণ পণ্ডিত হৃদরোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার শরীরের কিছুটা উন্নতি হলেও ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। কলকাতায় দীর্ঘ চিকিত্সার পর ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর কোচবিহারের ডাউয়াগুড়ি-কলেরপাড় এলাকায়, নিজ গৃহে তার জীবনাবসান ঘটে।

সংগৃহীত রচনাবলী

কবির প্রথম জীবনে লেখা প্রতিবাদী কবিতা, গান ও বিভিন্ন রচনাগুলি কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমি দ্বারা ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত লোককবি নিবারন পণ্ডিতের গান পুস্তকে লেখক কঙ্কন ভট্টাচার্য তার বেশকিছু গানকে স্বরলিপি সহ সংকলিত করেছেন। এছাড়া ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লোকসঙ্গীত নামে একটি সংকলন প্রকাশ করে যেখানে নিবারন পণ্ডিতের কিছু গান পাওয়া যায়। তার যাবতীয় প্রাপ্ত গান ও কবিতা এবং চিঠিপত্রের সংকলনের নাম "জনযুদ্ধের গান"। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একাধিক গানের ক্যাসেট ও সিডি।

তথ্যসূত্র

    This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.