নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ

নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ [1] হল ভারত মহাসাগর এর একটি দ্বীপপুঞ্জ। এই দ্বীপপুঞ্জটি ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এর অন্তর্গত। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ এর দক্ষিণ দিকে এই দ্বীপপুঞ্জ অবস্থিত। নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ সুমাত্রা দ্বীপ থেকে ১৫০ কিলোমিটার (৯৩ মা) উত্তর দিকে ও থাইল্যান্ড আন্দামান সাগর দ্বারা এই দ্বীপপুঞ্জ থেকে পৃথক।ভারতীয় উপমহাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়া থেকে এই দ্বীপপুঞ্জ প্রায় ১,৩০০ কিলোমিটার (৮১০ মা) দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এবং বঙ্গোপসাগর দ্বারা পৃথক।

নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ
নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান
ভূগোল
অবস্থানভারত মহাসাগর
স্থানাঙ্ক৭°০৫′ উত্তর ৯৩°৪৮′ পূর্ব
দ্বীপপুঞ্জআন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ
মোট দ্বীপের সংখ্যা২২
প্রধান দ্বীপসমূহবড় নিকোবর, কার নিকোবর, ছোট নিকোবর
আয়তন১,৮৪১ বর্গকিলোমিটার (৭১১ বর্গমাইল)
সর্বোচ্চ উচ্চতা৬৪২ মিটার (২,১০৬ ফুট)
সর্বোচ্চ বিন্দুথুলিয়ের পর্বত
প্রশাসন
কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলআন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ
রাজধানী শহরপোর্ট ব্লেয়ার
বৃহত্তর বসতিমালাক্কা, কার নিকোবর (জনসংখ্যা ১,৬৩৭)
জনপরিসংখ্যান
জনসংখ্যা৩৬,৮৪২ (২০১১)
জনঘনত্ব২০ /বর্গ কিমি (৫০ /বর্গ মাইল)
জাতিগত গোষ্ঠীসমূহশোমপেন
ভারতের প্রধান ভূমিভাগের মানুষ
নিকোবরী
অতিরিক্ত তথ্য
সময় অঞ্চল
  গ্রীষ্মকালীন
  (ডিএসটি)
অফিসিয়াল ওয়েবসাইটwww.and.nic.in

বর্তমানে এই দ্বীপপুঞ্জের গ্রেট নিকোবর দ্বীপ ইউনেসকো কর্তৃক বায়ষ্ফিয়ার রিজার্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

ইতিহাস

নবম শতাব্দীতে আরব বেদুঈনদের কাছ থেকে সর্বপ্রথম এই দ্বীপপুঞ্জের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানতে পারা যায়, তারা সুমাত্রা যাত্রা করার সময় দ্বীপপুঞ্জের এই পথ ধরেই পাড়ি দিয়েছিল। সর্বপ্রথম পশ্চিমী পর্যটক মার্কো পোলো এটিকে ‘দ্য ল্যান্ড অফ হেড-হান্টারস’ রূপে আখ্যা দিয়েছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মারাঠারা এই দ্বীপপুঞ্জটিকৈ দখল করে নেয়। অষ্টদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এটি বারংবার ব্রিটিশ, ডাচ ও পর্তুগীজদের বাণিজ্যিক জাহাজ দখলকারী মারাঠা নৌসেনাপতি কানহোজী আংগ্রের ঘাঁটি হিসাবে গড়ে উঠেছিল।১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজরা নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয় এবং ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে এই নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে একটি একক প্রশাসনিক ইউনিট গঠনের জন্য আন্দামানের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৯৪২ সালে জাপানী সেনারা এই দ্বীপপুঞ্জটিকে দখল করে নেয় ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৪৫ সালের বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত তাদের ক্ষমতার অধীনেই থাকে। পরবর্তীকালে, ভারত ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ভারতের উপর স্থানান্তরিত করে দেওয়া হয়।

জলবায়ু

নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে সারা বছর ধরে একটি নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু অনুভূত হয়। প্রায় ৮০ শতাংশ আর্দ্রতা সহ, সমুদ্র-বায়ু এখানকার তাপমাত্রার পরিমাণকে ২৩° সেন্টিগ্রেড থেকে ৩১° সেন্টিগ্রেডের মধ্যে রাখতে সাহায্য করে। এখানকার অধিবাসীরা বছরের বিভিন্ন সময়ে বর্ষা অনুভব করে। দক্ষিণ-পশ্চিম বায়ুপ্রবাহের দ্বারা বর্ষাকাল মে মাসের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবর মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চলতে থাকে। এরপর দেড় মাসের অন্তরালে নভেম্বর মাসে পুনরায় উত্তর-পূর্ব দিক থেকে বর্ষা শুরু হয়ে যায় এবং ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চলতে থাকে।

ভূ-প্রকৃতি

ভূতাত্ত্বিকদের গবেষণা অনুসারে - এই দ্বীপপুঞ্জের সাথে যোগসূত্র ছিল আসামের নাগা ও লুসাই পর্বতমালা এবং ইয়াংগুনের ইয়োমা পর্বতমালার সাথে। প্রায় ১৪ কোটি বছর আগে মেসোজোয়িক যুগের শেষভাগে ক্রেটাসিয়াস (Cretaceous) অধিযুগে, ইন্দো-অস্ট্রেলীয় প্লেট এবং ইউরেশীয় প্লেটের সংঘর্ষের সূত্রে হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয়েছিল এই দ্বীপপুঞ্জ।নিকোবরের ভূ-প্রকৃতি, মাটি জলবায়ু, সবুজ বন-বনানী গাছপালা, প্রাণীজ ও দেশীয় জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই দ্বীপে রয়েছে ছয় স্তর বিশিষ্ট মাটি। সবচেয়ে পুরনো স্তরটির বয়স প্রায় দশ কোটি বছর। এর নতুন স্তরটির বয়স প্রায় দশ হাজার বছর। প্রাচীন তলার স্তরগুলিতে আগ্নেয়গিরি ও পরবর্তী স্তরগুলোতে বিচিত্র সামুদ্রিক জীবাশ্ম লক্ষণীয়।নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত।এই দ্বীপ গুলি পাথুরে প্রকৃতির।দ্বীপ গুলিতে ছোট পাহার দেখা যায়।এই দ্বীপপুঞ্জে প্রবাল প্রচীর দেখা যায়।দ্বীপপুঞ্জের মোট আয়তন ১৭৬৫ বর্গ কিলোমিটার।দ্বীপ গুলির উপকূলভাগ খুবই গভীর।এই দ্বীপপুঞ্জের সর্ব দক্ষিণের অংশ হল ইন্দিরা পয়েন্ট।এটি গ্রেট নিকোবর দ্বীপ এ অবস্থিত।

জনসংখ্যা

এই দ্বীপপুঞ্জটি ভারতের জনবিরল এলাকা গুলির মধ্যে একটি। এখানে জনসংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১১ সালের জনগননায় নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জনসংখ্যা হয়েছে ৩৬ হাজার ৮৪৪ জন।

সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান

নিকোবরে, একমাত্র আদিবাসী সম্প্রদায় হল শোমপেন, যারা বাইরের দুনিয়ার সাথে বিমুখ রয়েছে। সবচেয়ে বৃহত্তম সমষ্টি নিকোবরী-বর্মী, মালয়, সোম এবং শান সম্প্রদায়ের মিশ্রণ। তারা খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ ও উচ্ছসিত হয় এবং তারা অর্থ সংগ্রহে বিশ্বাসী নয়, তারা বিনিময় প্রথা পছন্দ করে। মৃত আত্মার সঙ্গে কথোপকথন, নিকোবরে এক কৌতুহলপূর্ণ রীতি। কিছু নির্দিষ্ট সমষ্টির, বিশেষ বিশেষ পালিত উৎসবগুলির মধ্যে রয়েছে- বাঙালীদের দুর্গাপূজা, তামিলদের পঙ্গুনি উথিরাম, তেলুগুদের পোঙ্গল এবং মালায়ালিদের জন্য ওনাম। আন্দামানে স্থানীয়ভাবে জন্ম নেওয়া মানুষ হিন্দু, মুসলিম ও খ্রীষ্টান ধর্মে বিভক্ত, যারা তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসবগুলি পালন করে। তাদের প্রধান কিছু উৎসবের মধ্যে রয়েছে শিবরাত্রি, জন্মাষ্টমী, হোলি, দীপাবলি, রামনবমী, ঈদ্, খীষ্টমাস, গুড ফ্রাইডে ইত্যাদি। এখানে তিনটি ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ একে অপরের উৎসব-অনুষ্ঠানগুলিতে অংশগ্রহণ করে।

শিক্ষাব্যবস্থা

ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলির ন্যায়, নিকোবর দ্বীপপুঞ্জেও একই শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, এখানে ১৪ বছরের কম বয়সের শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক এবং বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এখানকার উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা, কেন্দ্রীয় মধ্য শিক্ষা (সি.বি.এস.ই) পর্ষদ দ্বারা অনুমোদিত। মহাবিদ্যালয়গুলি সাধারণত পন্ডিচেরি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিছু পলিটেকনিক মহাবিদ্যালয় রয়েছে যেগুলি নিউ দিল্লী-র দ্বারা অনুমোদিত। এখানে এমন মহাবিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ডাক্তারি, ইঞ্জিনীয়ারিং এবং আইন বিষয়ে পেশাগত শিক্ষা অর্জন করতে পারে। এখানে এই প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।

ভাষা

এই দ্বীপপুঞ্জের প্রধান ভাষা হল নিকোবরী। তবে, আধিকারিক ভাষাগুলি যেমন হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলুগু ও ইংরেজী ভাষারও এখানে ব্যাপকভাবে প্রচলন রয়েছে।প্রায় ২৫ শতাংশ নিকোবরবাসী বাংলা ভাষায় কথা বলেন।

অর্থনীতি

নিকোবরে প্রধান অর্থকরী ফসল হিসাবে নরিকেল ও সুপারির ফলন হয়। এছাড়াও জমি ফসলের মধ্যে ডাল, তৈলবীজ ও শাক-সবজি এবং মশলার মধ্যে মরিচ, লবঙ্গ, জায়ফল ও দারুচিনির চাষ করা হয়। রাবার, লাল তৈল, পাম এবং কাজু-ও এখানে সীমিত পরিমাণে উৎপন্ন হয়। এই অঞ্চলের প্রধান প্রধান শিল্পগুলি হল পি.ভি.সি পাইপ ও জিনিসপত্র তৈরী, রঙ ও বার্ণিশ, ফাইবার গ্লাস, সফ্ট ড্রিঙ্ক ও পানীয় পদার্থ এবং ইস্পাতের আসবাবপত্র ইত্যাদি। এম.ভি হর্ষবর্ধন, এম.ভি আকবর, এম.ভি নিকোবর-এর ন্যায় নিয়মিত যাত্রিবাহী জাহাজ পরিষেবা পোর্টব্লেয়ার থেকে চেন্নাই, কলকাতাবিশাখাপত্তনমের মধ্যে চলাচল করে।

পর্যটন

ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, এই স্থান হল ভাসমান পান্না দ্বীপ ও পাথরের একটি সমষ্টি।নিকোবর দ্বীপপুঞ্জটি নারকেল ও পাম গাছ দিয়ে ঘেরা সুন্দর সমুদ্র-সৈকত ও তার স্বচ্ছ নীল জল এবং তার জলের নিচে ডুবে থাকা কোরাল ও অন্যান্য সামুদ্রিক জীবের অবস্থানের জন্য বিখ্যাত। ম্যানগ্রোভ সংযুক্ত খাঁড়ি বরাবর দূষণমুক্ত বায়ু এবং বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী জীবনের দরুণ এই দ্বীপপুঞ্জ বিখ্যাত।[2]

দ্বীপপুঞ্জের ভাগ গুলি

নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দ্বীপ গুলি তিনটি বিভাগে বিভক্ত।যথা

  • উত্তর ভাগ
  1. কার নিকোবর দ্বীপ- কার নিকোবর হল নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসনিক কেন্দ্র।
  2. বাট্টিমলয় দ্বীপ
  • মধ্য ভাগ
  1. টেরেসা দ্বীপ
  2. বোমপুকা দ্বীপ
  3. কাটচাল দ্বীপ
  4. কামোরটা দ্বীপ
  5. নানকোয়রিয় দ্বীপ
  6. ট্রিনকেট দ্বীপ
  7. চোয়রা দ্বীপ
  • দক্ষিণ ভাগ
  1. গ্রেট নিকোবর দ্বীপ - এটি নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে বসচেয়ে বড় দ্বীপ।এর আয়তন ৯২২ কিলোমিটার (৫৭৩ মা)
  2. ছোট নিকোবর দ্বীপ
  3. কোনডুল দ্বীপ
  4. পুলো মিলো দ্বীপ

যোগাযোগ

এই দ্বীপপুঞ্জটি অনেক গুলি ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত। ফলে এই দ্বীপ পুঞ্জের মধ্যে প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম হল নৌ পরিবহন। কার নিকোবর ও গ্রেট নিকোবর দ্বীপে একটি করে ভারতের সেনাবাহিনীর বিমানবন্দর রয়েছে।কিন্তু এই বিমানবন্দর গুলি যাত্রি পরিবহন করেনা।গ্রেট নিকোবর দ্বীপে একটি নৌ বন্দর রয়েছে।[3]

তথ্যসূত্র

  1. "Nicobar Islands declared as world biosphere reserv"। সংগ্রহের তারিখ ১১ জানুয়ারি ২০১৭
  2. "দ্বীপ পর্যটন উৎসব ২০১৭ আজ শুরু"। সংগ্রহের তারিখ ১১ জানুয়ারি ২০১৭
  3. "চীনকে মোকাবেলার জন্য আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ভারতের নয়া সামরিক কৌশল"। সংগ্রহের তারিখ ১১ জানুয়ারি ২০১৭

বহিঃসংযোগ

টেমপ্লেট:ভারতের দ্বীপপুঞ্জ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.