নাচুক তাহাতে শ্যামা

নাচুক তাহাতে শ্যামা হল স্বামী বিবেকানন্দের লেখা একটি বাংলা কবিতা।[1] ১৯০৪ সালে বিবেকোদয়ম্‌ পত্রিকায় দুই পর্বে এই কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে দ্য কমপ্লিট ওয়ার্কস ওফ স্বামী বিবেকানন্দ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে এই কবিতার ইংরেজি অনুবাদটি এবং স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা গ্রন্থের ষষ্ঠ খণ্ডে মূল বাংলা কবিতাটি প্রকাশিত হয়।[2] এই কবিতাটিতে হিন্দু দেবী শ্যামার (কালী) প্রতি আত্মনিবেদনের কথা বলা হয়েছে।[3] মূল কবিতাটিও কালীর প্রতি উৎসর্গিত।[4]

নাচুক তাহাতে শ্যামা
স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক রচিত
এই কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র হিন্দু দেবী কালী বা শ্যামা
দেশভারত
ভাষাবাংলা
প্রকাশকবিবেকোদয়ম্‌
প্রকাশনার তারিখ১৯০৪

কথা

কবিতার মূল বাংলা নিচে দেওয়া হল:

ফুল্ল ফুল সৌরভে আকুল, মত্ত অলিকুল গুঞ্জরিছে আশে পাশে।
শুভ্র শশী যেন হাসিরাশি, যত স্বর্গবাসী বিতরিছে ধরাবাসে॥
মৃদুমন্দ মলয়পবন, যার পরশন, স্মৃতিপট দেয় খুলে।
নদী, নদ, সরসী-হিল্লোল, ভ্রমর চঞ্চল, কত বা কমল দোলে॥
ফেনময়ী ঝরে নির্ঝরিণী—তানতরঙ্গিণী—গুহা দেয় প্রতিধ্বনি।
স্বরময় পতত্রিনিচয়, লুকায়ে পাতায়, শুনায় সোহাগবাণী॥
চিত্রকর, তরুণ ভাস্কর, স্বর্ণতুলিকর, ছোঁয় মাত্র ধরাপটে।
বর্ণখেলা ধরাতল ছায়, রাগপরিচয় ভাবরাশি জেগে ওঠে॥

মেঘমন্দ্র কুলিশ-নিস্বন, মহারণ, ভুলোক-দ্যুলোক-ব্যাপী।
অন্ধকার উগরে আঁধার, হুহুঙ্কার শ্বসিছে প্রলয়বায়ু॥
ঝলকি ঝলকি তাহে ভায়, রক্তকায় করাল বিজলীজ্বালা।
ফেনময় গর্জি মহাকায়, ঊর্মি ধায় লঙ্ঘিতে পর্বতচূড়া॥
ঘোষে ভীম গম্ভীর ভূতল, টলমল রসাতল যায় ধরা।
পৃথ্বীচ্ছেদি উঠিছে অনল, মহাচল চূর্ণ হয়ে যায় বেগে॥

শোভাময় মন্দির-আলয়, হ্রদে নীল পয়, তাহে কুবলয়শ্রেণী।
দ্রাক্ষাফল-হৃদয়-রুধির, ফেনশুভ্রশির, বলে মৃদু মৃদু বাণী॥
শ্রুতিপথে বীণার ঝঙ্কার, বাসনা বিস্তার, রাগ তাল মান লয়ে।
কতমত ব্রজের উচ্ছ্বাস, গোপী-তপ্তশ্বাস, অশ্রুরাশি পড়ে বয়ে॥
বিম্বফল যুবতী-অধর, ভাবের সাগর—নীলোৎপল দুটি আঁখি।
দুটি কর—বাঞ্ছাঅগ্রসর, প্রেমের পিঞ্জর, তাহে বাঁধা প্রাণপাখী॥

ডাকে ভেরী, বাজে ঝর‍্‍র্ ঝর‍্‍র্ দামামা নক্কাড়, বীর দাপে কাঁপে ধরা।
ঘোষে তোপ বব-বব-বম্, বব-বব-বম্ বন্দুকের কড়কড়া॥
ধূমে ধূমে ভীম রণস্থল, গরজি অনল বমে শত জ্বালামুখী।
ফাটে গোলা লাগে বুকে গায়, কোথা উড়ে যায় আসোয়ার ঘোড়া হাতী॥
পৃথ্বীতল কাঁপে থরথর, লক্ষ অশ্ববরপৃষ্ঠে বীর ঝাঁকে রণে।
ভেদি ধূম গোলাবরিষণ গুলি স্বন্ স্বন্, শত্রুতোপ আনে ছিনে॥
আগে যায় বীর্য-পরিচয় পতাকা-নিচয়, দণ্ডে ঝরে রক্তধারা।
সঙ্গে সঙ্গে পদাতিকদল, বন্দুক প্রবল, বীরমদে মাতোয়ারা॥
ঐ পড়ে বীর ধ্বজাধারী, অন্য বীর তারি ধ্বজা লয়ে আগে চলে।
তলে তার ঢের হয়ে যায় মৃত বীরকায়, তবু পিছে নাহি টলে॥
দেহ চায় সুখের সঙ্গম, চিত্ত-বিহঙ্গম সঙ্গীত-সুধার ধার।
মন চায় হাসির হিন্দোল, প্রাণ সদা লোল যাইতে দুঃখের পার॥
ছাড়ি হিম শশাঙ্কচ্ছটায়, কেবা বল চায়, মধ্যাহ্নপতন-জ্বালা।
প্রাণ যার চণ্ড দিবাকর, স্নিগ্ধ শশধর, সেও তবু লাগে ভাল॥
সুখতরে সবাই কাতর, কেবা সে পামর দুঃখে যার ভালবাসা?
সুখে দুঃখ, অমৃতে গরল, কণ্ঠে হলাহল, তবু নাহি ছাড়ে আশা॥
রুদ্রমুখে সবাই ডরায়, কেহ নাহি চায় মৃত্যুরূপা এলোকেশী।
উষ্ণধার, রুধির-উদ্গার, ভীম তরবার খসাইয়ে দেয় বাঁশী॥
সত্য তুমি মৃত্যরূপা কালী, সুখবনমালী তোমার মায়ার ছায়া।
করালিনি, কর মর্মচ্ছেদ, হোক মায়াভেদ, সুখস্বপ্ন দেহে দয়া॥
মুণ্ডমালা পরায়ে তোমায়, ভয়ে ফিরে চায়, নাম দেয় দয়াময়ী।
প্রাণ কাঁপে, ভীম অট্টহাস, নগ্ন দিক‍্‍বাস, বলে মা দানবজয়ী॥
মুখে বলে দেখিবে তোমায়, আসিলে সময় কোথা যায় কেবা জানে।
মৃত্যু তুমি, রোগ মহামারী বিষকুম্ভ ভরি, বিতরিছ জনে জনে॥

হে উন্মাদ, আপনা ভুলাও, ফিরে নাহি চাও, পাছে দেখ ভয়ঙ্করা।
দুখ চাও, সুখ হবে বলে, ভক্তিপূজাছলে স্বার্থ-সিদ্ধি মনে ভরা॥
ছাগকণ্ঠ রুধিরের ধার, ভয়ের সঞ্চার, দেখে তোর হিয়া কাঁপে।
কাপুরুষ! দয়ার আধার! ধন্য ব্যবহার! মর্মকথা বলি কাকে?
ভাঙ্গ বীণা—প্রেমসুধাপান, মহা আকর্ষণ—দূর কর নারীমায়া।
আগুয়ান, সিন্ধুরোলে গান, অশ্রুজলপান, প্রাণপণ, যাক্ কায়া॥
জাগো বীর, ঘুচায়ে স্বপন, শিয়রে শমন, ভয় কি তোমার সাজে?
দুঃখভার, এ ভব-ঈশ্বর, মন্দির তাহার প্রেতভূমি চিতামাঝে॥
পূজা তাঁর সংগ্রাম অপার, সদা পরাজয় তাহা না ডরাক তোমা।
চূর্ণ হোক স্বার্থ সাধ মান, হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহাতে শ্যামা॥ [5]

বিষয়বস্তু

এই কবিতায় বিবেকানন্দ আধ্যাত্মিক চৈতন্যের জগৎ নিয়ে কথা বলেছেন।[6] সহজ জীবনের আবেদনকে প্রত্যাখ্যান করে জীবনের কঠিন সমস্যাগুলির মুখোমুখি হয়ে সেগুলির সমাধানের মাধ্যমে জীবনে সুখ ও শান্তি আনার কথা বলা হয়েছে এই কবিতায়।[3] বাংলার ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় সাহিত্যের মতো এই কবিতাতেও "ব্যক্তি আত্মা থেকে দিব্য প্রেম এবং কালী থেকে ব্রহ্মের" অনুসন্ধান করা হয়েছে।[7]

ভারতীয় ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি "যৌনতার আকর্ষণ" ও "প্রেমের মাদকতা" থেকে মুক্তির কথা বলা হয়েছে এই কবিতায়।[8] স্বামী বিবেকানন্দ ইংরেজিতে অনুবাদ করার সময় এই কবিতাটির ইংরেজি নাম রেখেছিলেন And Let Shyama Dance There (অ্যান্ড লেট শ্যামা ড্যান্স দেয়ার)। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, ইংরেজি অনুবাদটিতে, "প্রকৃতির মধুর ও কঠিন দিকগুলিকে যুগপৎ বর্ণনা করা হয়েছে। এই বর্ণনা শিল্পীর কল্পনাশক্তির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এবং একটি অনন্য কাব্যচিত্র।"[8]

স্বামী বিবেকানন্দ, পোয়েটিক ভিশনারি গ্রন্থের রচয়িতা মোহিত চক্রবর্তী লিখেছেন যে কোন ভয়ংকর পরিবেশে শ্যামা তার প্রলয়ঙ্করী নাচটি নাচেন, সেই বিষয়ে একটি দৃশ্যময় বর্ণনা ও সাংকেতিক প্রতীকের সাহায্যে কবি আমাদের প্রস্তুত করেছেন।[6] তিনি আরও লিখেছেন যে হৃদয়ের সঙ্গে ঠোঁট ও চোখের কল্পনা "সব রকম চৈতন্যের সীমার বাইরে অসামান্য বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সামগ্রিক পরিস্থিতে সকল অবস্থার নিয়ন্তক শ্যামার যথার্থ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে।"[6]

প্রভাব

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ফ্রিডম স্ট্রাগল: সুভাষচন্দ্র বসু: হিজ আইডিয়াস অ্যান্ড ভিশন গ্রন্থের রচয়িতা রত্না ঘোষ বলেছেন, এই কবিতাটি "সুভাষচন্দ্র বসুর মনে অজানার প্রতি আকর্ষণ জাগিয়ে তোলে এবং তিনি মাঝে মাঝেই এমনভাবে এই কবিতাটি পাঠ করতেন যে শুনে মনে হত যে তিনি নিজের আদর্শটি এই কবিতার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন।[9]

এই কবিতায় বর্ণিত আধ্যাত্মিক বা অজানার প্রতি আকর্ষণের দিকটির বর্ণনা সুভাষচন্দ্র বসুকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তিনি নিজের ভাবনা অনুসারে আনন্দময় "সীমাহীন দ্রুততা"র সঙ্গে এই কবিতাটি আওড়াতেন।[10]

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

  1. Vivekananda 2004, পৃ. 602
  2. Vivekananda 1989, পৃ. 103
  3. Macphail 2010, পৃ. 366।
  4. Nivedita 1968, পৃ. 93।
  5. "নাচুক তাহাতে শ্যামা" (পিডিএফ)
  6. Chakrabarti 1998, পৃ. 164
  7. Majumdar 1963, পৃ. 561, 565।
  8. Majumdar 1963, পৃ. 553
  9. Ghosh2006, পৃ. 12
  10. Ghosh 2006, পৃ. 12।
Bibliography
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.