নব কৈলাশ মন্দির

নব কৈলাশ মন্দির বা ১০৮ শিবমন্দির হল বর্ধমান জেলার কালনার আকর্ষণীয় শিব মন্দির। একটি স্থাপত্য বিস্ময়, এই মন্দিরের কাঠামো দুটি সমকেন্দ্রিক বৃত্তের একটি সমন্বয়, যার মধ্যে প্রতিটি ছোট মন্দির ভগবান শিবকে নিবেদিত করা হয়েছে। এটি একটি পুঁতির অক্ষমালাকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং এই মন্দিরের দেয়ালে রামায়ণ ও মহাভারতের পর্ব এবং শিকারের বহু দৃশ্যও চিত্রিত রয়েছে। বাইরের দিকে চুয়াত্তরটি মন্দির আছে এবং ভিতরে চৌত্রিশটি মন্দির আছে যেগুলি মঙ্গলকর চিন্তাভাবনাসহ পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে নির্মিত হয়েছে। এই ১০৮টি মন্দিরের প্রতিটিতে একটি করে শিবলিঙ্গ রয়েছে। ভেতরের প্রতিটি শিবলিঙ্গ শুভ্র বর্ণের যা সদাশিবের প্রতীক, অন্যদিকে বাইরের বৃত্তের অর্ধেক শিবলিঙ্গ কৃষ্ণবর্ণের রুদ্রের প্রতীক এবং অর্ধেক শিবলিঙ্গ শুভ্রবর্ণের।

নব কৈলাশ মন্দির
১০৮ শিবমন্দির
ধর্ম
অন্তর্ভুক্তিহিন্দুধর্ম
অবস্থান
অবস্থানকালনা, বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ
স্থাপত্য
ধরনগৌড়ীয় স্থাপত্য, চালা শিল্পরীতি (বাংলার মন্দির স্থাপত্যরীতি)
সৃষ্টিকারীমহারাজ তেজচন্দ্র বাহাদুর

প্রতিষ্ঠালিপি

লোককথায় এই মন্দির ১০৮ শিব মন্দির বলে প্রসিদ্ধ। তবে প্রতিষ্ঠালিপি অনুসারে এই মন্দির ১০৯ শিব মন্দির। এর প্রতিষ্ঠালিপিতে বলা হয়েছে-

শাকে চন্দ্র শিবাক্ষি সপ্ত কুমিতে শ্রী

তেজচন্দ্রাভিধৌবা সূর্য্যইব স্থি
রার্পিতে চলচ্চণ্ড প্রতাপানলঃ
শম্ভোর্ধাম পরম নবাধিকশত শ্রী
মন্দিরৈর্মণ্ডলম্ প্রাকার্ষীন্মহদ
অম্বিকাখ্য় নগরে কৈলাসমেতং নবং।

এখানে চন্দ্র-১, শিবাক্ষি-৩, সপ্ত-৭ ও কু-১, অর্থাৎ বামাগতি নিয়মানুসারে এই নবাধিক শত মন্দিরটি ১৭৩১ শকাব্দে বা ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজা তেজচন্দ্র কর্তৃক নির্মিত হয়। শ্রীতেজচন্দ্র অম্বিকানগরে শ্রীমন্দিরমণ্ডল শিবালয় নবকৈলাসরূপে নির্মান করলেন। রাজা স্বয়ং সূর্যসম। তার সূর্যের মতো ভয়ঙ্কর বহ্নি। তার মধ্যেও প্রতাপানল প্রচন্ড, তবে তিনি সচল।[1]

গঠনাকৃতি

১০৮ শিবমন্দিরের ভিতরের বৃত্ত

নবকৈলাস মন্দিরের ১০৯টি মন্দিরের মধ্যে ১০৮টি মন্দির জ্যামিতিক বৃত্তে বিন্যস্ত। দুটি বৃত্তে বিন্যস্ত এই মন্দিরগুলির বাইরের বৃত্তে ৭৮টি এবং ভেতরের বৃত্তে মোট ৩৪টি অবস্থিত। বৃত্তের বহির্দেশে, পশ্চিমদিকে ১০৯ সংখ্যক মন্দিরটি অবস্থিত। বৃত্তের মধ্যে অবস্থিত ১০৮টি মন্দির আটচালা স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। ভিতরের বৃত্তের পরিধি প্রায় ৩৩৬ ফুট এবং বাইরের বৃত্তের পরিধি ৭১০ ফুট। এই মন্দিরগুলি স্বল্প উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত এবং মন্দিরগুলি পরস্পর সংলগ্ন। মন্দিরগুলির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট এবং প্রস্থ ৯.৫ ফুট। এই মন্দিরের দেয়ালে রামায়ণ ও মহাভারতের পর্ব এবং শিকারের বহু দৃশ্যও চিত্রিত রয়েছে। ১০৯ সংখ্যক মন্দিরটি আটটি সিঁড়িবিশিস্ট বারান্দার উপর অবস্থিত পঞ্চরত্ন মন্দির। এর মন্দিরটি ৬ ফুট উচ্চ ভিত্তিবেদীর উপর অবস্থিত, যার আয়তন ১৩ ফুট X ১৩ ফুট এবং উচ্চতা ৩৫ ফুট। এই মন্দিরটির বর্তমান নাম জলেশ্বর মন্দির[1] বৃত্তদুটির কেন্দ্রে একটি বাধানো ইঁদারা আছে যা মন্দিরের পূজার কাজে ব্যবহৃত জলের চাহিদা মেটায়। তবে অনেকে মনে করেন এটি শূণ্য অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মস্বরূপ শিবের প্রতীক।

শিবমূর্তি

কৃষ্ণবর্ণের শিবমূর্তি

বাইরের বৃত্তের শিবলিঙ্গগুলি পর্যায়ক্রমে শুভ্র ও কৃষ্ণবর্ণের এবং ভিতরের বৃত্তের শিবলিঙ্গগুলি শুভ্র বর্ণের। ১০৯ সংখ্যক জলেশ্বর শিবমূর্তিটি কৃষ্ণবর্ণের। মন্দিরের শুভ্রবর্ণের শিবলিঙ্গগুলি ভগবান সদাশিবের প্রতীক, যার অর্থ চৈতন্য ও জ্ঞান এবং কৃষ্ণবর্ণের শিবলিঙ্গগুলি রুদ্রের প্রতীক যার, অর্থ তিনি বোধের অতীত।[2][3]

জলেশ্বর শিবমন্দির

নব কৈলাস মন্দিরের বহির্দেশে পৃথকভাবে অবস্থিত ১০৯ সংখ্যক শিব মন্দিরটি হল জলেশ্বর শিব মন্দির। এই মন্দিরটি সম্পর্কে যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী বলেছেন যে জপমালায় যেমন ১০৮টি বীজ প্রথিত থাকে, এবং মধ্যস্থলে ঈশৎ বড় আকারের একটি বীজ মেরুস্বরূপ থাকে এই শিবক্ষেত্র নির্মাণের সময় উক্ত বিধান মানা হয়েছিল।[4][5]

সমস্যা

যখন পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে, তখনই মন্দিরটিকে ঘিরে দেখা দিয়েছে অন্য দুশ্চিন্তা। দু’টি বৃত্তেরই গায়ে গায়ে থাকা মন্দিরগুলি বেশ কয়েকটির গা থেকে খসে পড়ছে ইটের টুকরো। লাগাতার নোনা ধরে খসে পড়ার কারণে বহু মন্দিরের গা থেকে হারিয়ে গেছে নকশা, কারুকার্য। কয়েকটি মন্দিরের অবস্থা এতটাই খারাপ যে গায়ের বেশির ভাগ কারুকার্যই নষ্ট হয়ে ভিতরের লাল ইট বেরিয়ে এসেছে। বাইরের বৃত্ত থেকে ভিতরের বৃত্তের মন্দিরগুলির দশা আরও খারাপ। প্রতিটি মন্দিরে ঢোকার মুখে রয়েছে ছোট ছোট কাঠের দরজা। ভিতরে ঢুকলে দেখা যায় ভিতরের অংশের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়েছে। শিব লিঙ্গের চার পাশের দেওয়ালে জল জমে রয়েছে। কয়েকটি দেওয়াল থেকে খসে পড়ছে চাঙর।[6]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. বিবেকানন্দ দাশ (১৯৯৯)। কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত। ২৫৭-বি, বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০ ০১২: ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড। পৃষ্ঠা ৭১।
  2. বিবেকানন্দ দাশ (১৯৯৯)। কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত। ২৫৭-বি, বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০ ০১২: ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড। পৃষ্ঠা ৭৪।
  3. যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী (১৯৯৪)। বর্ধমান: ইতিহাস ও সংস্কৃতি (৩ খণ্ড)। পুস্তক বিপনি। পৃষ্ঠা ১২৭।
  4. বিবেকানন্দ দাশ (১৯৯৯)। কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত। ২৫৭-বি, বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০ ০১২: ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড। পৃষ্ঠা ৭২।
  5. "১০৮ শিবমন্দির নিয়ে উদ্বেগ কালনায়"
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.