দারুল মুসান্নিফীন শিবলী একাডেমি

দারুল মুসান্নিফীন শিবলী একাডেমি (উর্দু: دار المصنفین شبلی اکیڈمی; হিন্দি: दारुल मुसन्निफीन शिब्ली एकेडमी) ভারতের উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে অবস্থিত একটি শিক্ষা, গবেষণা ও প্রকাশনা একাডেমি।[1][2] শিবলী নোমানীর চিন্তাদর্শনের আলোকে ১৯১৪ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। একই বছরে শিবলী নোমানী মৃত্যুবরণ করলে তার শিষ্যরা এটিকে পূর্ণাঙ্গ অবয়বে গড়ে তুলেন। পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় ধরে সুলাইমান নদভীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটি সমৃদ্ধ হয়। এর সাথে সংশ্লিষ্ট লেখক ও গবেষকগণ মাযহাব, ইতিহাস ও সাহিত্যের নানা বিষয়ে বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছেন; যা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অন্ততঃ উর্দু ভাষায় শীর্ষ শ্রেণীর গ্রন্থ। এখানে লিখিত কতিপয় গ্রন্থ অন্যান্য ভাষায় রচিত গ্রন্থ থেকেও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে শ্রেষ্ঠ ও অনন্য।[3] দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক তথ্যমতে, এটি ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২৫০টিরও অধিক বই প্রকাশ করেছে, যার মধ্যে সীরাতুন নবী, আল ফারুক অন্যতম।[4] প্রতিষ্ঠানটির সাথে সংশ্লিষ্ট বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে রয়েছেন সুলাইমান নদভী, আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদি, আবুল হাসান আলী নদভী, হামিদুদ্দিন ফারাহি প্রমুখ। মাআরিফ এর উর্দু মুখপত্র।

দারুল মুসান্নিফীন শিবলী একাডেমি
دار المصنفین شبلی اکیڈمی
দেশভারত
ধরনইসলামি
প্রতিষ্ঠিত২১ নভেম্বর ১৯১৪ (1914-11-21)
স্থপতিশিবলী নোমানী
অবস্থানআল্লামা শিবলী মার্গ, মুকেরিগঞ্জ, আজমগড়, উত্তরপ্রদেশ ২৭৬০০১, ভারত
প্রবেশাধিকার ও ব্যবহার
প্রবেশাধিকারউন্মুক্ত
অন্যান্য তথ্য
পরিচালকজিয়া উদ্দিন সালাহী
ওয়েবসাইটwww.shibliacademy.org

ইতিহাস

চেতনাভিত্তি

শিবলী নোমানী (১৮৫৭–১৯১৪

শিবলি নোমানী অনুভব করলেন, আজকের মুসলমানরা তাদের ধর্ম এবং পূর্বসুরীদের মুল্যবান সম্পদ সম্পর্কে অজ্ঞ। তিনি ধর্মকে মুসলমানদের সামনে এমনভাবে তুলে ধরতে চাইতেন, যাতে তারা নিজেদের ইসলামি মূল্যবোধ এবং এর মহত্ব সম্পর্কে সহজে উপলব্দি করতে পারে। এই লক্ষ্যকে কার্যে পরিণত করতে অর্থের প্রয়োজন ছিল। শিবলি নোমানীর কয়েকজন বিজ্ঞ ছাত্র এবং বিশেষ কিছু বন্ধু ছিল যাদের কাছে তিনি তার সকল আশাগুলো ব্যক্ত করতেন। শিবলী নোমানী তাদের কাছে লিখনী সাহিত্যে মারকাজ তৈরীর পরিকল্পনা তুলে ধরেন। যেখানে লিখনী সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়াবলীর উপর নিবন্ধ তৈরী হবে। যেমন: আধুনিক দর্শন বিজ্ঞানকে দেশীয় ভাষায় রূপান্তর করা, দর্শনের বিষয়গুলোকে ইলমে কালামের আঙ্গিকে আলোচনা করা, ভাষা অলংকারে শব্দের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার, ইসলামের ইতিহাস রচনা, তথ্যানুসন্ধানে আসমাউর রিজাল তৈরী করা এবং ধর্মের সঠিক নিয়ম নিরুপণ করে এবং আধুুনিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্যকে ঠিক রেখে উভয়ের মাঝে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলয় তৈরী করা। আলোচ্য বিষয়ের উপর নতুন সংকলন তৈরী করা। বিশেষ দ্বীনি শিক্ষা, তাফসীর, হাদিস, উসুলে ফিকাহ, তাসাউফ এবং ইলমে কালামকে নতুন রূপে উপস্থাপন করা। ইসলামি ঐতিহ্যের সাফল্যগুলো তুলে ধরে ঐতিহাসিক বিষয়াবলীর উপর ভুল ও সঠিক নিরুপণ করে সংস্কারমূলক কার্যক্রম তৈরী করা। ফার্সি, আরবি ও উর্দু সাহিত্যের ইতিহাস, ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির উপর ইতিহাস ভিত্তিক পর্যালোচনা এবং আধুনিক সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা।[5]

প্রাথমিক ধারণা

দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার গ্রন্থকেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপনের মধ্য দিয়ে শিবলীর চেতনায় প্রথম দারুল মুসান্নিফীনের প্রস্তাবনা তৈরী হয়। ১৯১০ সালের মার্চ মাসে দিল্লির বৈঠকে দারুল উলুমের তিন বৎসরের প্রবন্ধ প্রতিবেদন তিনি লিখে উপস্থাপন করেন।

শিবলী সুলাইমান নদভীকে দারুল মুসান্নিফীনের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একটি প্রস্তাবনা তৈরীর কথা বলেছিলেন। সুলাইমান নদভী যেই প্রস্তাবনা পেশ করেন তা ছিল শিবলী নোমানীর প্রস্তাবনার পুনরাবৃত্তি। ১৯১০ সালের ১০ আগস্ট মোজাম্মেলুল্লাহ খাঁন যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে সংবর্ধিত হন তখন তিনি শিবলী নোমানীকে লিখেন যে, তিনি তার লিখনীগুলো স্বরণীয় করতে দারুল উলুমে একটি কক্ষ তৈরী করতে চান। শিবলী নোমানী তার প্রেক্ষিতে এই ফুটনোটটি তৈরী করেন।

এই সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়ার পূর্বেই নদওয়াতুল উলামার সাথে শিবলী নোমানীর দূরত্ব সৃষ্টি হয়। শিবলী নোমানী ১৯১৩ সালের জুলাই মাসে নদওয়ার পরিচালনা পদ থেকে ইস্তিফা দেন। তারপর দারুল মুসান্নিফীন প্রতিষ্ঠায় তিনি আরও অগ্রসর হন।[6]

প্রস্তাবনা

শিবলী নোমানী ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯১৪ সালে "আল হেলাল" পত্রিকায় দারুল মুসান্নিফীন নিয়ে তার প্রস্তাবনাটি প্রকাশ করেন। ইংরেজি ভাষায় এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়। তা হল: "মহান আল্লাহর শুকরিয়া যে, দেশে সর্বত্র লিখা ও সংকলনের মিষ্টতা ছড়িয়ে পড়ছে। উপযুক্ত যোগ্যতা সম্পন্ন লিখক তৈরী হচ্ছে। আমাদের এই সদস্যদের মাঝে অধিকাংশ কলামিষ্ট রয়েছেন, যাদের লিখক পরিচয়ের পরিবর্তে প্রবন্ধকার বা সংকলক বলা বেশী ভাল হবে। কেননা, তাদের স্বরচিত কোন গ্রন্থ নেই। বরং সাধারণ প্রবন্ধ সম্বলিত বই এবং পত্রাবলী রয়েছে। এর মানে এই নয় যে, তাদের উঁচু মাপের লিখার যোগ্যতা নেই। বরং মূল কারণ হলো উঁচু মাপের লিখার জন্য যে উপকরণ প্রয়োজন, তা সংকলনে নেই। তাদের অধিকাংশের কাছে পুস্তিকার ভান্ডার নেই। যেগুলো নির্বাচন করে গবেষণায় এবং তথ্য নির্ভরতায় কাজে আসে। কোথাও কোন স্থানীয় গ্রন্থশালা থাকলেও তাতে প্রাণবন্ত উপকরণ নেই। যার মাধ্যমে নিশ্চিন্তে সেখান থেকে বই অধ্যায়নের মাধ্যমে তথ্য নিরুপণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তাছাড়া কোথাও কোন জ্ঞানের আসর নেই, যার মাধ্যমে পারস্পরিক মতামত ও চিন্তা চেতনার প্রকাশ করা যেতে পারে। এই সকল সমস্যার সমাধানে এবং লিখা ও সংকলনের নিমিত্তে প্রয়োজন একটি দারুত তাছনিফ বা লিখক ঘর। নিম্নোক্ত নিয়ম অনুযায়ী এটি প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে,[7]

  • একটি সমৃদ্ধ ইমারত তৈরী করা, যার নাম হবে দারুত তাছনিফ। এটিতে বিশাল হল সমন্বয়ে একটি কুতুবখানা থাকবে। এর পাশে থাকবে বিভিন্ন কক্ষ, যেগুলো থেকে এখানে অবস্থানরত লোকেরা কুতুবখানা থেকে উপকৃত হতে পারে। এবং সংকলনে ও লিখনীতে ব্রত থাকতে পারে।
  • কক্ষগুলোর ধরন হবে সুন্দর মনোরম এবং নামকরণ হবে খ্যাতিমান লিখকদের নামে। যারা লিখনী সাহিত্যের বিশেষ শাখার উদ্ভাবক এবং বিশেষ বিষয়ে ভিত্তি স্থাপক।
  • একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা প্রতিষ্ঠিত করা। যেখানে শুধু বইয়ের সংখ্যার প্রতি লক্ষ্য না রেখে যে বিষয়ের বই হবে তা যেন বিরল তথ্য সমৃদ্ধ বই হয়, সে দিকে লক্ষ্য রাখবে।
  • লিখার সম্মানী নির্ধারণ করা হবে। অনুদান প্রদানকারীর নামে সম্মানীর নামকরণ করা হবে। সম্মানীটি মাসিক হারে প্রদান করা হবে অথবা কোন লিখার প্রেক্ষাপটে দেওয়া হবে ইত্যাদি।

এই প্রস্তাবনাটি প্রকাশনার পর এর ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের সাহায্য সহযোগীতার কাজ মাসুদ আলী নদভীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।[7]

কেন্দ্র

শিবলীর আশা ছিল দারুল মুসান্নিফীন নদওয়ায় প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু এতে তিনি সমর্থন পান নি। ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে শিবলী তার ভাই মোহাম্মদ ইসহাকের মৃত্যুতে আযমগড় আসেন। তখন জায়গাটি পছন্দ করেন এবং আংশিক কাজ শুরু করেন। সব পরিকল্পনা ঠিক করে তিনি কিছু অনুচ্ছেদ তৈরী করেন এবং নিজের হাতে গড়া বিশেষ ছাত্রদের চিঠি লিখেন। তারা যেন তার এই পথ পরিক্রমায় সম্বল নিয়ে তৈরী হয়ে যায়। কিন্তু একই বছর, ১৮ নভেম্বর ১৯১৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শিবলী নোমানীর মৃত্যুর সময় দারুল মুসান্নিফীন দুটি কাঁচাঘর, কিছু শতেক বই আর কিছু আলমারী নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ছিল। শিবলী নোমানী দারুল মুসান্নিফীনকে নদওয়ার ধাচে পরিচালনা করতে চাইতেন এই জন্য এর মধ্যে তাকমীল ও তাফসীর শ্রেণি চালু করতে চান। কিন্তু পরবর্তীতে তার ছাত্র ও বন্ধুগণ এটিকে শুধু লিখনে ও সংকলন তৈরী করণে সীমিত রাখেন।[8]

প্রতিষ্ঠা

শিবলী নোমানীর মৃত্যুর পর তার শিষ্যরা দারুল মুসান্নিফীন প্রতিষ্ঠার কাজ অব্যাহত রাখে। শিবলী নোমানীর মৃত্যুর ৩য় দিন, ১৯১৪ সালের ২০ নভেম্বর হামিদুদ্দিন ফারাহির আহ্বানে সবাইকে একত্রিত করে ইখওয়ানুস্সফা নামক একটি সাধারণ সভার আহবান করা হয়। এই সভায় মাসুদ আলী নদভী দারুল মুসান্নিফীনের পরিচালক নির্বাচিত হন। সভায় প্রথম করণীয় ঠিক হয় শিবলীর অসম্পূর্ণ কাজ সীরাতুন নবী সমাপ্ত করা। এজন্য সুলাইমান নদভীকে সহযোগিতা করা অব্যাহত রাখা হয়। শিবলি নোমানীর বাগান এবং যে ওয়াকফ বিঘা সম্পত্তিতে অসম্পূর্ণ থেকে যায় তার নিষ্পত্তির জন্য ১৯১৪ সালের ২৪ নভেম্বর ওমায়েদুদ্দিন শহরে একটি সভা ডাকা হয়, এতে ওয়াকফের বাকি সম্পত্তিগুলো আয়ত্ত্বে এসে যায়। শিবলী নোমানীর বিশেষ বন্ধু মির্জা সেলিম এবং মির্জা মোহাম্মদ নাসিমের বাগান যেটি শিবলী নোমানীর বাগানের পাশাপাশি ছিল তারা তা দারুল মুসান্নিফীনের জন্য ওয়াকফ করে দেন। সুলাইমান নদভী এই কাজে দেশের খ্যাতিমান লেখক, প্রবন্ধকার এবং আকাবিরদের চিঠি লিখে এর সহযোগিতা কামনা করেন। প্রাথমিকভাবে দারুল মুসান্নিফীনের নিম্নোক্ত কর্মসূচীগুলো বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়:[9]

  1. দেশের ভিতরে উঁচু মাপের গ্রন্থাগার এবং একদল উঁচু মানের সাহিত্যিক তৈরী করা।
  2. সমৃদ্ধশালী গ্রন্থ লিখা, অনুবাদ ও সংকলন তৈরী করা।
  3. সাহিত্য ও জ্ঞান সমৃদ্ধ বইগুলো ছাপানো ও মুদ্রণ করার আসবাব তৈরী করা।

হামিদুদ্দিন ফারাহির প্রচেষ্টায় সরকারের পক্ষ থেকে মাসিক ওজুফা নির্ধারণ করা হয়। তিনি জরুরী ভিত্তিতে দারুল মুসান্নিফীনের রেজিষ্ট্রি করার পরামর্শ দেন। ১৯১৫ সালের জুন মাসে লখনউতে ‘দারুল মুসান্নিফীনের’ শিবলি একাডেমী নামে এর নিয়মিত রেজিষ্ট্রি করা হয়। এর পর থেকে নিয়মিত এর কার্যক্রম চলতে থাকে। দেশের খ্যাতিমান লেখকদের পনেরো সদস্য বিশিষ্ট একটি সংঘ তৈরী হয়। নবাব ওম্মাদুল মূলক এদের মাঝে প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তার অর্থ ও পরামর্শ দিয়ে দারুল মুসান্নিফীনকে এগিয়ে নিয়ে যান। বিচারপতি কারামত হোসাইন প্রধান সহকারির দায়িত্বে নিয়োজিত হন। তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে পরামর্শ দিয়ে বিন্যাসন ও সংকলনের নীতিমালা তৈরী করেন। ব্যবস্থাপনা কমিটির অধীনে একটি কার্য পরিষদ কমিটি গঠন করা হয়। হামিদুদ্দিন ফারাহী এর প্রধান মনোনীত হন। তার জীবন দারুল মুসান্নিফীনের উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। কার্যকরী পরিষদে পাঁচজন সদস্য ছিলেন। যারা নিজেদের হাতে দারুল মুসান্নিফীনের সকল ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করেন। হামিদুদ্দিন ফারাহী, সুলাইমান নদভী, মাসুদ আলী নদভী, আব্দুস সালাম নদভী ছাড়াও শিবলী নোমানীর খলিফা হামিদ নোমানী, হাবিবুর রহমান শেরওয়ানী, আলী হাসান খান লখনউ, আব্দুল কাদের পুনে, শেখ মোহাম্মদ ইকবাল লাহোর, নবাব ওম্মাদুল মূলক সাইয়্যেদ হোসাইন আলী বলগরামী হায়দারাবাদ, আব্দুল্লাহ ওম্মাদী এবং আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদি প্রমুখগণকে দারুল মুসান্নিফীনের ভিত্তি প্রবর্তক নির্বাচন করা হয়।[9]

হামিদুদ্দিন ফারাহীর মৃত্যুর পর সভাপতিত্বের পদে ধারাবাহিকভাবে হাবিবুর রহমান খান শেরওয়ানী, আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদি, আবুল হাসান আলী নদভী প্রমুখ অধিষ্ঠিত হন। দারুল মুসান্নিফীনের প্রথম সম্পাদক সুলাইমান নদভীর মাধ্যমে দারুল মুসান্নিফীন বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করে। বর্তমানে জিয়া উদ্দিন সালাহী এই পদে অধিষ্ঠিত আছেন। নবাব মুফখাম জাহ বাহাদুর ব্যবস্থাপনা পরিষদের প্রধান এবং আলী মিয়া শিক্ষা বিভাগের প্রধান পদে নিয়োজিত আছেন। আব্দুল মান্নান হেলালী কার্যনির্বাহী পদের প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত আছেন।[9]

সুলাইমান নদভীর ভূমিকা

সুলাইমান নদভী (১৮৮৪–১৯৫৩)

শিবলী নোমানী ১৯১৪ সালে মৃত্যুবরণ করলে সুলাইমান নদভী দেড় বছরের অধ্যাপনা জীবনে সমাপ্তি টেনে পুনার দাক্কান কলেজ ছেড়ে আযমগড় চলে আসেন। সেখানে শিবলী নোমানীর দারুল মুসান্নিফীনের প্রধান ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ১৯১৪–১৯৪৬ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। তার পরিচালনায় দারুল মুসান্নিফীন ইসলামী প্রকাশনার কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। তিনি এ প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মীয়, সাহিত্য ও ইতিহাস নির্ভর অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার পরিচালনায় "মাসিক মাআরিফ" এবং ইসলামের ইতিহাস ও ভারতীয় ইতিহাস রচনার গোড়াপত্তনের ক্ষেত্রে দারুল মুসান্নিফীনের ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। সুলাইমান নদভী তার শিক্ষক শিবলী নোমানীর চিন্তা-চেতনা অনুযায়ী ১৯১৬ সালের জুলাই মাসে দারুল মুসান্নিফীন থেকে সাহিত্য পত্রিকা "মাহনামা মাআরিফ" (ماہنامہ معارف) প্রকাশ করা শুরু করেন। এ পত্রিকা প্রকাশের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে আধুনিক ধ্যান-ধারণার আঙ্গিকে ইসলামের ইতিহাস ও ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনার গোড়াপত্তন ও প্রচার প্রসার করা। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি ইতিহাস নির্ভর বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখে এ পত্রিকায় প্রকাশ করা শুরু করেন। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ভুল তথ্যনির্ভর বর্ণনার প্রত্যাখ্যান ও প্রতিউত্তরের কাজটিও তিনি এ পত্রিকার মাধ্যমে সম্পাদন করেন। তিনি ৩০ বছরের চেয়েও বেশি সময় ধরে এ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এ বিশাল সময়কালে ইতিহাসের বিভিন্ন দিকসমূহের উপর অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করে এতে প্রকাশ করেন। দেশের অন্যান্য নামীদামী কলামিষ্টদের গবেষণামূলক ঐতিহাসিক প্রবন্ধাবলীও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এতে প্রকাশ করেন। তিনি ইসলামের ইতিহাস ও ভারতীয় ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত এত বেশি প্রবন্ধ এতে প্রকাশ করেন, যেগুলো একত্রিত করলে একটি বড় গ্রন্থভাণ্ডারে পরিনত হবে। বিশেষত ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান সমৃদ্ধ কোনো বিষয়ই এতে প্রকাশ করা থেকে বাদ দেননি। তিনি ইতিহাস বিষয়ক যে কোনো তথ্যাবলী অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এতে প্রকাশ করেন।[10]

অনুষদসমূহ

দারুল মুসান্নিফীনের অধীনে নিম্নোক্ত অনুষদগুলো অন্তর্ভূক্ত রয়েছে:[11]

  1. দারুত তাসনীফ বা লিখনী অনুষদ
  2. প্রকাশনী অনুষদ
  3. বই সংকলন অনুষদ
  4. ছাপা বিভাগ
  5. প্রবন্ধ পরিচিতি অনুষদ।

দারুত তাসনীফের মাধ্যমে দারুল মুসান্নিফীন শুরু হয়। পরে প্রকাশনা বিভাগ চালু করা হয়। পরবর্তীতে প্রয়োজনের তাগিদে এর অন্যান্য শাখাগুলো বর্ধিত করা হয়।

দারুত তাসনীফ বা লিখনী অনুষদ

দারুল মুসান্নিফীন প্রতিষ্ঠার পর থেকে লিখনী অনুষদে প্রচুর মানসম্মত লেখকের আনাগোনা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম সুলাইমান নদভী, আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদি, আব্দুস সালাম নদভী প্রমুখ। ইংরেজি ও আরবী উভয় ভাষায় পারদর্শী লিখকগণ এই অনুষদকে তাদের জীবনের অনবদ্য অংশে পরিণত করেন। দারুত তাসনীফের লেখকগণ লিখনী সাহিত্যের বিভিন্ন শ্রোতধারায় যে অবদান রেখেছেন তা কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা:[12]

  1. সিরাত রচনার ধারা প্রবর্তন।
  2. সাহাবী ও তাবেয়ীনদের জীবনালেখ্য তৈরী করণ।
  3. ইতিহাস রচনায় জ্ঞানের সমৃদ্ধ করণ।
  4. ইসলামের ইতিহাস রচনা।
  5. হিন্দুস্তানের ইতিহাস রচনা।
  6. দর্শন ইতিহাস।
  7. কুরআনিক গবেষণা।
  8. হাদিস ও মুহাদ্দিসীন সম্পর্কে পর্যালোচনা।
  9. ফকিহ ও ফিকাহ সম্পর্কে পর্যালোচনা।
  10. জীবন ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে আলোচনা।
  11. দর্শন এবং কালাম সম্পর্কে আলোচনা।
  12. বক্তব্য ও প্রবন্ধ রচনা।
  13. পত্রাবলী।
  14. সাহিত্য ও সমালোচনা।
  15. যুগোপযোগী বিষয়াবলী নিয়ে আলোকপাত।
  16. প্রাচ্য ও ইসলামী ভাবধারা পর্যালোচনা।

লিখনী অনুষদ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবদান রেখে চলেছে। এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জিজ্ঞাসিত ইসলামি জ্ঞান, ইতিহাস, আকায়েদ ও মাসায়েল সম্পর্কে তথ্য নির্ভর উত্তর প্রদান করে থাকে।[12]

প্রকাশনা অনুষদ

দারুল মুসান্নিফীনের লেখক এবং শিবলী নোমানীর রচিত বইগুলো এই বিভাগে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে গ্রন্থপুঞ্জি আকারে দারুল মুসান্নিফীন কয়েক লক্ষ বই সমৃদ্ধ গ্রন্থশালায় পরিণত হয়েছে। প্রকাশনা বিভাগের সকল ছাপানো কার্যক্রম এই বিভাগ থেকে পরিচালনা করা হয়। বহিঃবির্শ্ব এবং ভারতের প্রতিটি অঞ্চলে এখান থেকে ছাপানো বইগুলো প্রেরণ করা হয়। দারুল মুসান্নিফীনের গ্রন্থপুঞ্জি ব্যবসা হল আমদানীর মূল মাধ্যম। এই অনুষদের তথ্য নির্ভর এবং গ্রহণযোগ্য স্বত্ত্বাধিকারী বই প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুই শতাধিক। এই অনুষেদের কিছু বই যেমন: সীরাতুন নবী, সীরাতুস সাহাবা এবং তারিখুল ইসলাম বিশ্বব্যাপী নির্ভযোগ্য বই হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। সীরাতুন নবীর মত উঁচু মাপের বই পৃথিবীর কোন ভাষায় লেখা হয়নি। দারুল মুসান্নিফীন থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তারিখে হিন্দ সমগ্র ভারতে নির্ভরযোগ্য সমৃদ্ধ বই হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। দারুল মুসান্নিফীনের অসংখ্য বই ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাচ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কারিকুলামে অধিভূক্ত রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন স্থানীয় ভাষা ছাড়াও ফার্সি, আরবী, তুর্কি, পশতু ও ইংরেজি ভাষাতেও অনুবাদ প্রকাশের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা পায়। দারুল মুসান্নিফীনের মূল্য উদ্দেশ্য উর্দু ভাষা ও সাহিত্যকে পরিচর্চার মাধ্যমে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।[13]

সংকলন অনুষদ

শিবলী নোমানী তার নিজস্ব বই ঘরটি নদওয়াতুল উলামাকে ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। এরপর সংকলনের ক্ষেত্রে যে বইগুলো এসেছে এবং শিবলী নোমানীর বন্ধুমহল যে সকল বইগুলো দারুল মুসান্নিফীনকে দিয়েছিলেন এগুলো দিয়ে বই সংকলন অনুষদ প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপক চাহিদার ক্ষেত্রে তা অপ্রতুল ছিল। ফলে শুরু থেকে গ্রন্থাগারের প্রশস্ততা এবং সমৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। বই ক্রয়ের জন্য বার্ষিক উপযুক্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কয়েক বছরের পরিশ্রম ও চেষ্টায় গ্রন্থগারটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞানের মিলনমেলায় পরিণত হয়। আরবি এবং ফার্সির ৪১টি পুরানো দুর্লভ হস্তলিখিত বই যেগুলো ঐতিহাসিক আলোচনায় এবং বিষয়ভিত্তিকভাবে গুরুত্বের দিক থেকে নির্বাচিত সেগুলি এখানে সংরক্ষিত রয়েছে।[14]

ছাপা বিভাগ

শিবলী নোমানীর রচিত বইগুলো প্রকাশনার মাধ্যমে এই বিভাগের পদযাত্রা। মাআরেফ প্রেস নাম দিয়ে ১৯১৪ সালে এটির কর্মযাত্রা শুরু হয়। দারুল মুসান্নিফীনের সব বইগুলো এই ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত।[14]

প্রবন্ধ পরিচিতি অনুষদ

প্রবন্ধ সম্বলিত একটি ছোট জার্নাল প্রকাশ করা দারুল মুসান্নিফীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল। সংকলনটির শিরোনাম শিবলীর মতামত অনুযায়ী "মারেফ" রাখা হয়। এর প্রথম পান্ডুলিপি ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধ সম্বলিত এই ছোট জার্নালটি দারুল মুসান্নিফীনের মুখপাত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছে।[14]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

উদ্ধৃতি

  1. দত্ত, অমরেশ (১৯৮৮)। Encyclopaedia of Indian Literature [ভারতীয় সাহিত্য বিশ্বকোষ] (ইংরেজি ভাষায়)। সাহিত্য একাডেমি ভারত। পৃষ্ঠা ১৭৪৮। আইএসবিএন 978-81-260-1194-0।
  2. ইসলাম, আরশাদ (১ ডিসেম্বর ২০১৪)। "Contribution of Darul Musannefin: history of Islam in Europe" [দারুল মুসান্নিফীনের অবদান: ইউরোপে ইসলামের ইতিহাস]আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়া
  3. ভারতবর্ষে মুসলমানদের অবদান, পৃ. ৯১–৯২
  4. সিং, বিনয় (২৯ নভেম্বর ২০১৪)। "Darul Musannefin an excellent seat of learning"টাইমস অব ইন্ডিয়া
  5. মাহমুদ, মিনহাজ উদ্দীন (২০১৬)। উর্দু সাহিত্যে আল্লামা শিবলী নোমানীর অবদান (গবেষণাপত্র)। উর্দু বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পৃষ্ঠা ২৫৫–২৫৭।
  6. মাহমুদ ২০১৬, পৃ. ২৫৭–২৬০।
  7. মাহমুদ ২০১৬, পৃ. ২৬০–২৬২।
  8. মাহমুদ ২০১৬, পৃ. ২৬২–২৬৬।
  9. মাহমুদ ২০১৬, পৃ. ২৬৬–২৬৮।
  10. বাহারুল ইসলাম, মোহাম্মদ (২০১৭)। উর্দু সাহিত্যে সৈয়দ সুলাইমান নদভীর অবদান (গবেষণাপত্র)। উর্দু বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পৃষ্ঠা ৬৬–৬৭।
  11. মাহমুদ ২০১৬, পৃ. ২৬৮।
  12. মাহমুদ ২০১৬, পৃ. ২৬৮–২৭০।
  13. মাহমুদ ২০১৬, পৃ. ২৭০–২৭১।
  14. মাহমুদ ২০১৬, পৃ. ২৭২।

গ্রন্থপঞ্জি

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.