দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতি
ভারতের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতি সারা বিশ্বের কওমী ও দেওবন্দী মাদ্রাসা সমূহ অনুসরণ করে থাকে। সে মূলনীতিকে সাধারনতঃ মূলনীতি অষ্টক বা উসূলে হাশতে গানা (اصول ہشتگانہ) বলা হয়।[1]
মূলনীতির রচয়িতা
মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি পরাধীন ভারতে ধ্বসে পড়া ইসলামি শিক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে গণ-চাঁদার উপর ভিত্তি করে শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। সময় ও অবস্থার প্রেক্ষাপটে সে ধারাকে সুশৃঙ্খলভাবে টিকিয়ে রাখা এবং তার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে এ সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ করে দারুল উলূম দেওবন্দের জন্য তিনি কতিপয় মূলনীতি প্রবর্তন করেছিলেন। ইতিহাসে এই মূলনীতিগুলোই ‘উসূলে হাশতগানা’ বা ‘মূলনীতি অষ্টক’ নামে পরিচিত। সেই নীতিমালায় তিনি এ কথাও উল্লেখ করেছেন, যে কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য মৌলিকভাবে এ সকল নীতিমালাকে অত্যাবশ্যকীয় মনে করতে হবে।[2]
মূলনীতি অষ্টক
প্রথম নীতি
যথাথাসম্ভব মাদরাসার কর্মচারী ও কর্মকর্তাদেরকে অধিকহারে চাঁদা আদায়ের বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। নিজেও এর জন্য চেষ্টা করতে হবে, অন্যের মাধ্যমেও চেষ্টা করাতে হবে। মাদরাসার হিতাকাঙ্খীদেরও এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
দ্বিতীয় নীতি
যেভাবেই হোক মাদরাসার ছাত্রদের খানা চালু রাখতে হবে বরং ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি করার ব্যাপারে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে।
তৃতীয় নীতি
মাদরাসার উপদেষ্টাগণকে মাদরাসার উন্নতি, অগ্রগতি এবং সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার দিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখতে হবে। নিজের মত প্রতিষ্ঠার একগুঁয়েমী যাতে কারো মাঝে না হয় এ দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। উপদেষ্টাগণ নিজ নিজ মতের বিরোধিতা কিংবা অন্যের মতামতের সমর্থন করার বিষয়টি সহনশীলভাবে গ্রহণ করতে না পারেন তাহলে এ প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিমূল দুর্বল হয়ে পড়বে। আর যথাসম্ভব মুক্ত মনে পরামর্শ দিতে হবে এবং মাদরাসার শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি লক্ষণীয় হতে হবে। নিজেরমত প্রতিষ্ঠার মনোবৃত্তি না থাকতে হবে। এ জন্য পরামর্শদাতাকে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তার মতামত গ্রহণীয় হওয়ার ব্যাপারে অবশ্যই আশাবাদী না হতে হবে। পক্ষান্তরে শ্রোতাদেরকে মুক্তমন ও সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তা শুনতে হবে। অর্থাৎ এরূপ মনোবৃত্তি রাখতে হবে যে, যদি অন্যের মত যুক্তিযুক্ত ও বোধগম্য হয়, তাহলে নিজের মতের বিপরীত হলেও তা গ্রহণ করে নেওয়া হবে। আর পরিচালকের জন্য পরামর্শসাপেক্ষে সম্পাদনীয় বিষয়ে উপদেষ্টাগণের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া অবশ্যই জরুরী। তবে মুহতামিম নিয়মিত উপদেষ্টাদের থেকেও পরামর্শ করতে পারবেন। তবে যদি ঘটনাক্রমে উপদেষ্টা পরিষদের সকল সদস্যের সাথে পরামর্শ করার সুযোগ না হয় এবং প্রয়োজনমাফিক উপদেষ্টা পরিষদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যের সাথে পরামর্শক্রমে কাজ করে ফেলা হয়, তাহলে কেবল এ জন্য অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত হবে না যে, ‘আমার সাথে পরামর্শ করা হল না কেন?’ কিন্তু যদি মুহতামিম কারো সঙ্গেই পরামর্শ না করেন, তাহলে অবশ্যই উপদেষ্টা পরিষদ আপত্তি করতে পারবে।
চতুর্থ নীতি
মাদরাসার সকল শিক্ষককে অবশ্যই সমমনা ও একই চিন্তা চেতনার অনুসারী হতে হবে।
পঞ্চম নীতি
পূর্ব থেকে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারিত রয়েছে কিংবা পরবর্তীতে পরামর্শের ভিত্তিতে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারণ করা হবে, তা যাতে সমাপ্ত হয়; এই ভিত্তিতেই পাঠদান করতে হবে। অন্যথায় এ প্রতিষ্ঠান সুপ্রতিষ্ঠিতই হবে না, আর যদি হয়ও তবু তা উপকারী হবে না।
ষষ্ঠ নীতি
এ প্রতিষ্ঠানের জন্য যতদিন পর্যন্ত কোন স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হবে; ততদিন পর্যন্ত আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার শর্তে তা এমনিভাবেই চলতে থাকবে। কিন্তু যদি স্থায়ী আয়ের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যেমন কোন জায়গীর লাভ, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, মিল ফ্যাক্টরী গড়ে তোলা কিংবা বিশ্বস্ত কোন আমীর উমারার অনুদানের অঙ্গীকার ইত্যাদি, তাহলে এরূপ মনে হচ্ছে যে, আল্লাহর প্রতি ভয় ও আশার দোদুল্যমান অবস্থা; যা মূলতঃ আল্লাহমুখী হওয়ার মূল পুঁজি, তা হাত ছাড়া হয়ে যাবে এবং গায়েবী সাহায্যের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে। তদুপরি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও কর্মচারীগণের মাঝে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও কলহ বিবাদ দেখা দিবে। বস্তুতঃ আয় আমদানি ও গৃহাদি নির্মাণের বিষয়ে অনেকটাই অনাড়ম্বরতা ও উপায় উপকরণহীন অবস্থা বহাল রাখার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
সপ্তম নীতি
সরকার ও আমীর উমারাদের সংশ্লিষ্টতাও এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতির কারণ।
অষ্টম নীতি
যথা সম্ভব এমন ব্যক্তিদের চাঁদাই প্রতিষ্ঠানের জন্য অধিক কল্যাণময় হবে ; যাদের চাঁদাদানের মাধ্যমে সুখ্যাতি লাভের প্রত্যাশা থাকবে না। বস্তুতঃ চাঁদাদাতাগণের সৎ নিয়ত প্রতিষ্ঠানের জন্য অধিক স্থায়ীত্বের কারণ হবে বলে মনে[2] হয়।
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
- "دارالعلوم دیوبند کی تقدیس اور ترقی وتنزل کا مدار"। www.darululoom-deoband.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-২১।
- Tajul, Islam। "উসূলে হাশতগানা ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার কার্যকারিতা"। Komashisha। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-২১।