তৎপুরুষ সমাস

পূর্বপদের বিভক্তির লোপে যে সমাস হয় এবং যে সমাসে পরপদের অর্থ প্রধানভাবে বোঝায় তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে।[1] তৎপুরুষ সমাসের পূর্বপদে দ্বিতীয়া থেকে সপ্তমী পর্যন্ত যে কোনো বিভক্তি থাকতে পারে এবং পূর্বপদের বিভক্তি অনুসারে এদের নামকরণ করা হয়। যেমন: বিপদকে আপন্ন= বিপদাপন্ন। এখানে দ্বিতীয়া বিভক্তি 'কে' লোপ পেয়েছে বলে এর নাম দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস। এছাড়া তৎপুরুষ সমাসের অন্যান্য উদাহরণ হলো: লুচিকে ভাজা= লুচি-ভাজা, ছেলেকে ভোলানো= ছেলে-ভোলানো, লোককে দেখানো= লোক দেখানো, ট্রেনের দ্বারা ভ্রমণ= ট্রেনভ্রমণ, বজ্রের দ্বারা হত= বজ্রাহত ইত্যাদি।

প্রকারভেদ

তৎপুরুষ সমাস নয় প্রকার। যথা:

দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস

পূর্বপদের দ্বিতীয়া বিভক্তি (কে, রে, এরে) ইত্যাদি লোপ হয়ে যে সমাস হয়, তাকে দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস বা কর্ম তৎপুরুষ বলে। যথা: দুঃখকে প্রাপ্ত= দুঃখপ্রাপ্ত, বিপদকে আপন্ন= বিপদাপন্ন, পরলোকে গত= পরলোকগত,পুঁথিতে গত= পুঁথিগত। ব্যাপ্তি অর্থেও দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন: চিরকাল ব্যাপিয়া সুখী= চিরসুখী।

এরূপ- গাকে ঢাকা=গা-ঢাকা, রথকে দেখা=রথদেখা, বীজকে বোনা= বীজবোনা, ভাতরাঁধা, ছেলে-ভুলানো (ছড়া), নভেল-পড়া ইত্যাদি।

তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস

পূর্বপদে তৃতীয়া বিভক্তির (দ্বারা, দিয়া, কর্তৃক ইত্যাদি) লোপে যে সমাস হয়, তাকে তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: মন দিয়ে গড়া= মন গড়া, শ্রম দ্বারা লব্ধ= শ্রমলব্ধ, মধু দিয়ে মাখা= মধুমাখা।

ঊন, হীন, শূন্য প্রভৃতি শব্দ উত্তরপদ হলেও তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন: এক দ্বারা ঊন= একোন, বিদ্যা দ্বারা হীন= বিদ্যাহীন, জ্ঞান দ্বারা শূন্য= জ্ঞানশূন্য, পাঁচ দ্বারা কম= পাঁচ কম।

উপকরণব্যাক বিশেষ্য পদ পূর্বপদে বসলেও তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন: স্বর্ণ দ্বারা মণ্ডিত= স্বর্ণমণ্ডিত। এরূপ- হীরকখচিত, চন্দনচর্চিত, রত্নশোভিত ইত্যাদি।

চতুর্থী তৎপুরুষ সমাস

পূর্বপদে চতুর্থী বিভক্তি (কে, জন্য, নিমিত্ত ইত্যাদি) লোপে যে সমাস হয়, তাকে চতুর্থী তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: গুরুকে ভক্তি= গুরুভক্তি, আরামের জন্য কেদারা= আরামকেদারা, বসতের নিমিত্ত বাড়ি= বসতবাড়ি, বিয়ের জন্য পাগলা= বিয়েপাগলা ইত্যাদি। এরূপ- ছাত্রাবাস, ডাকমাশুল, চোষকাগজ, শিশুমঙ্গল, মুসাফিরখানা, হজযাত্রা, মালগুদাম, রান্নাঘর, মাপকাঠি, বালিকা-বিদ্যালয়, পাগলাগারদ ইত্যাদি।

পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস

পূর্বপদে পঞ্চমী বিভক্তি (হতে, থেকে ইত্যাদি) লোপে যে তৎপুরুষ সমাস হয়, তাকে পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: খাঁচা থেকে ছাড়া= খাঁচাছাড়া, বিলাত থেকে ফেরত= বিলাতফেরত ইত্যাদি

সাধারণত চ্যুত, আগত, ভীত, গৃহীত, বিরত, মুক্ত, উত্তীর্ণ, পালানো, ভ্রষ্ট ইত্যাদি পরপদের সঙ্গে যুক্ত হলে পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন: স্কুল থেকে পালানো= স্কুলপালানো, জেল থেকে মুক্ত= জেলমুক্ত ইত্যাদি। এরকম- জেলখালাস, বোঁটাখসা, আগাগোড়া, শাপমুক্ত, ঋণমুক্ত ইত্যাদি।

কোনো কোনো সময় পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাসের ব্যাসবাক্যে 'এর', 'চেয়ে' ইত্যাদি অনুসর্গের ব্যবহার হয়। যেমন: পরাণের চেয়ে প্রিয়= পরাণপ্রিয়।

ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস

পূর্বপদে ষষ্ঠী বিভক্তির (র, এর) লোপ হয়ে যে সমাস হয়, তাকে ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: চায়ের বাগান= চাবাগান, রাজার পুত্র= রাজপুত্র, খেয়ার ঘাট= খেয়াঘাট। এরূপ- ছাত্রসমাজ, দেশসেবা, দিল্লীশ্বর, বাঁদরনাচ, পাটক্ষেত, ছবিঘর, ঘোড়দৌড়, শ্বশুড়বাড়ি, বিড়ালছানা ইত্যাদি।

ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাসে 'রাজা' স্থলে 'রাজ' এবং 'পিতা', 'মাতা', 'ভ্রাতা' স্থলে 'পিতৃ', 'মাতৃ', 'ভ্রাতৃ' হয়। যেমন: গজনীর রাজা= গজনীরাজ, রাজার পুত্র= রাজপুত্র, পিতার ধন= পিতৃধন, মাতার সেবা= মাতৃসেবা, ভ্রাতার স্নেহ= ভ্রাতৃস্নেহ, পুত্রের বধূ= পুত্রবধূ ইত্যাদি।

পরপদে সহ, তুল্য, নিভ, প্রায়, প্রতিম- এসব শব্দ থাকলেও ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন: পত্নীর সহ= পত্নীসহ, কন্যার সহ= কন্যাসহ, সহোদরের প্রতিম= সহোদরপ্রতিম/ সোদরপ্রতিম ইত্যাদি।

কালের কোনো অংশবাচক শব্দ পরে থাকলে তা পূর্বে বসে। যেমন: অহ্নের (দিনের) পূর্বভাগ= পূর্বাহ্ন।

পরপদে রাজি, গ্রাম, বৃন্দ, গণ, যূথ প্রভৃতি সমষ্টিবাচক শব্দ থাকলে ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন: ছাত্রের বৃন্দ= ছাত্রবৃন্দ, গুণের গ্রাম= গুণগ্রাম, হস্তীর যূথ= হস্তীযূথ ইত্যাদি।

'অর্ধ' শব্দ পরপদ হলে সমস্তপদে তা পূর্বপদ হয়। যেমন: পথের অর্ধ= অর্ধপথ, দিনের অর্ধ= অর্ধদিন।

শিশু, দুগ্ধ ইত্যাদি শব্দ পরে থাকলে স্ত্রীবাচক পূর্বপদ পুরুষবাচক হয়। যেমন: মৃগীর শিশু= মৃগশিশু, ছাগীর দুগ্ধ= ছাগদুগ্ধ ইত্যাদি।

ব্যাসবাক্যে 'রাজা' শব্দ পরে থাকলে সমস্তপদে তা আগে বসে। যেমন: পথের রাজা= রাজপথ, হাঁসের রাজা= রাজহাঁস।

  • অলুক ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস

ঘোড়ার ডিম, মাটির মানুষ, হাতের পাঁচ, মামার বাড়ি, সাপের পা, মনের মানুষ, কলের গান ইত্যাদি। কিন্তু ভ্রাতার পুত্র= ভ্রাতুষ্পুত্র (নিপাতনে সিদ্ধ)।

সপ্তমী তৎপুরুষ সমাস

পূর্বপদে সপ্তমী বিভক্তি (এ, য়, তে) লোপ হয়ে যে সমাস হয়, তাকে সপ্তমী তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: গাছে পাকা= গাছপাকা, দিবায় নিদ্রা= দিবানিদ্রা। এরূপ- বাকপটু, গোলাভরা, তালকানা, অকালমৃত্যু, বিশ্ববিখ্যাত, ভোজনপটু, দানবীর, বাক্সবন্দী, বস্তাপচা, রাতকানা, মনমরা,ইত্যাদি।

সপ্তমী তৎপুরুষ সমাসে কোনো কোনো সময় ব্যাসবাক্যে পরপদ সমস্তপদের পূর্বে আসে। যেমন: পূর্বে ভূত= ভূতপূর্ব, পূর্বে অশ্রুত= অশ্রুতপূর্ব, পূর্বে অদৃষ্ট= অদৃষ্টপূর্ব।

নঞ্ তৎপুরুষ সমাস

না বাচক নঞ্ অব্যয় (না, নেই, নাই, নয়) পূর্বে বসে যে তৎপুরুষ সমাস হয়, তাকে নঞ্ তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: না আচার= অনাচার, না কাতর= অকাতর। এরূপ- অনাদর, নাতিদীর্ঘ, নাতিখর্ব, অভাব, বেতাল ইত্যাদি।

খাঁটি বাংলায় অ, আ, না কিংবা অনা হয়। যেমন: না কাল= অকাল বা আকাল। এরূপ- আধোয়া, নামঞ্জুর, অকেজো, অজানা, অচেনা, আলুনি, নাছোড়, অনাবাদী, নাবালক ইত্যাদি।

না- বাচক অর্থ ছাড়াও বিশেষ বিশেষ অর্থে নঞ্ তৎপুরুষ সমাস হতে পারে। যেমন: না/নয় বিশ্বাস= অবিশ্বাস (বিশ্বাসের অভাব), না/নয় লৌকিক= অলৌকিক (ভিন্নতা), না/নয় কেশা= অকেশা (অল্পতা), না/নয় সুর= অসুর (বিরোধ), না/নয় কাল= অকাল (অপ্রশস্ত), না/নয় ঘাট= অঘাট (মন্দ)। এরূপ- অমানুষ, অসঙ্গত, অভদ্র, অনন্য, অগম্য ইত্যাদি।

উপপদ তৎপুরুষ সমাস

যে পদের পরবর্তী ক্রিয়ামূলের সঙ্গে কৃৎ প্রত্যয় যুক্ত হয়, সে পদকে উপপদ বলে।[1] কৃদন্ত পদের সাথে উপপদের যে সমাস হয়, তাকে উপপদ তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: জলে চরে যা= জলচর, জল দেয় যা= জলদ, পঙ্কে জন্মে যা= পঙ্কজ ইত্যাদি। এরূপ- গৃহস্থ, সত্যবাদী, ইন্দ্রজিৎ, ছেলেধরা, ধামাধরা, পকেটমার, পাতাচাটা, হাড়ভাঙ্গা, মাছিমারা, ছারপোকা, ঘরপোড়া, বর্ণচোরা, গলাকাটা, পা-চাটা, পাড়াবেড়ানি, ছা-পোষা , কলাধর, ঘুসখোর ইত্যাদি।এর আরেক নাম কৃদন্ত তৎপুরুষ।

অলুক তৎপুরুষ সমাস

যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের দ্বিতীয়াদি বিভক্তি লোপ পায় না, তাকে অলুক তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: গায়ে পড়া, ঘিয়ে ভাজা, কলে ছাঁটা, কলের গান, গরুর গাড়ি ইত্যাদি।

তবে গায়ে-হলুদ, হাতেখড়ি ইত্যাদি সমস্তপদে পরপদের অর্থ প্রধান রূপে প্রতীয়মান হয় না অর্থাৎ হলুদ বা খড়িকে বোঝায় না, অনুষ্ঠান বিশেষকে বোঝায়। সুতরাং এগুলো অলুক তৎপুরুষ নয়, অলুক বহুব্রীহি সমাস

আরো দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, নবম-দশম শ্রেণি, শিক্ষাবর্ষ ২০১৬, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, বাংলাদেশ
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.