তথ্য

সাধারণ অর্থে তথ্য বলতে বাস্তব কোনও ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে প্রাপ্ত কোনও বিবরণকে বোঝায়, যা কোনও প্রেরক কোনও প্রাপকের কাছে একটি যোগাযোগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জ্ঞাপন করে। এভাবে যোগাযোগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাধ্যমে জ্ঞাপিত তথ্যকে অনেক সময় বার্তা বা সংবাদ বলে।

তথ্যের বিভিন্ন বিশেষায়িত সংজ্ঞা

বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রভেদে তথ্যের বিশেষ বিশেষ সংজ্ঞা রয়েছে।

দর্শনশাস্ত্রের আলোচনায় কোনও উপাত্তকে (বাস্তব ঘটনা সম্পর্কে প্রাপ্ত কাঁচা বা অশোধিত সংখ্যা, পরিসংখ্যান, বিবরণ, ইত্যাদি) যখন বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যাদানের মাধ্যমে রূপান্তরিত করে এমন একটি রূপ প্রদান করা হয়, যাতে সেটিকে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কাজে লাগানো যায়, তখন সেটিকে তথ্য বলে।

জ্ঞানতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে তথ্য হল এমন কিছু যা যোগাযোগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনও যথাযথ প্রাপকের কাছে জ্ঞাপিত হবার পরে ব্যাখ্যালাভ করে ও রূপান্তরিত হয়ে সেই প্রাপকের জ্ঞানের অবস্থায় পরিবর্তন সাধন করে।

বাগর্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনও বার্তার যা কিছু প্রাপকের কাছে অর্থ বহন করে, তাকে তথ্য বলে।

মনোবিজ্ঞান শাস্ত্রের তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিমান অনুযায়ী তথ্য হল সেই উপাত্ত, যার প্রতি কোনও ব্যক্তি প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে এবং যা কোনও বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট আচরণের জন্ম দেয়।

পরিগণন (কম্পিউটিং) ক্ষেত্রে পরিগণক যন্ত্রে (কম্পিউটারে) প্রবিষ্ট ও সংরক্ষিত বিভিন্ন অবিন্যস্ত (অগোছালো বা এলোমেলো) একক সংখ্যা, রাশি, অক্ষর, চিহ্ন বা প্রতীককে উপাত্ত বলে; এইসব অশোধিত উপাত্তকে যখন কোনও পরিগণক যন্ত্র দ্বারা প্রক্রিয়াজাত করা হয়, অর্থাৎ সেগুলিকে ঐ যন্ত্রের ব্যবহারকারী মানুষের জন্য উপকারী, ব্যবহারযোগ্য ও অর্থবহ রূপে রূপান্তরিত করা হয়, তখন উপাত্তের সেই পরিবর্তিত রূপটিকে তথ্য বলে। এভাবে সৃষ্ট তথ্যগুলিকে পরিগণক যন্ত্রে সংরক্ষণ করা হতে পারে কিংবা সেটি থেকে সম্প্রচার করা হতে পারে।

উপাত্ত ব্যবস্থাপনা, তথ্য ব্যবস্থাপনাজ্ঞান ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রগুলিতে উপাত্ত-তথ্য-জ্ঞান-প্রজ্ঞা পিরামিড নামক স্তরক্রমটিতে তথ্য হল দ্বিতীয়-সর্বনিম্ন স্তর (উপাত্ত স্তরের ঠিক উপরে)। উপাত্ত হল সংগৃহীত অশোধিত কোনও বিবরণ, যেগুলিকে প্রক্রিয়াজাত করে সুবিন্যস্ত করে সজ্জিত করলে তথ্য পাওয়া যায়। তথ্যের উপরে সংজ্ঞানাত্মক প্রক্রিয়া প্রয়োগ করলে জ্ঞান উৎপন্ন হয়। জ্ঞানের উপরে বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করলে প্রজ্ঞার সৃষ্টি হয়।

যোগাযোগ প্রকৌশল ও পরিগণন প্রযুক্তিতে তথ্যের স্বরূপ

মার্কিন গণিতবিদ ও তড়িৎ প্রকৌশলী ক্লড শ্যানন, আধুনিক বিশ্বের তথ্য যুগের জনক

যোগাযোগ প্রকৌশল ক্ষেত্রে তথ্যের উপরোক্ত সাধারণ, অর্থভিত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক, আচরণভিত্তিক কিংবা উপাত্তের রূপান্তরভিত্তিক সংজ্ঞার পরিবর্তে ভৌত বিশ্বে প্রযুক্তির মাধ্যমে সংঘটিত বার্তা বা তথ্য যোগাযোগ প্রক্রিয়ার গাণিতিক প্রতিমানভিত্তিক একটি সংজ্ঞা ব্যবহার করা হয়। যোগাযোগ প্রকৌশলীদের মতে ভৌত বিশ্বের দুইটি বিন্দুর মধ্যে কোনও বার্তা বা তথ্য সম্প্রচার করতে হলে সেই বার্তা বা তথ্যকে বহন করার জন্য একটি সংকেত আবশ্যক, অর্থাৎ একটি আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় সংকেত ছাড়া তথ্যের কোনও ভৌত অস্তিত্ব নেই। এরই প্রেক্ষিতে মার্কিন প্রকৌশলী ক্লড শ্যানন ১৯৪০-এর দশকের শেষভাগে এসে ১৯৪৮ সালে তথ্য তত্ত্ব নামক তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠা করেন ও সেখানে তথ্যের একটি বৈপ্লবিক গাণিতিক ও পরিমাণবাচক সংজ্ঞা প্রদান করেন। শ্যানন সম্পূর্ণরূপে প্রকৌশল তথা প্রযুক্তিগত ও গাণিতিক সম্ভাবনার দৃষ্টিকোণ থেকে তথ্যকে বিশ্লেষণ করেন। তিনি তথ্যের রূপ, প্রকৃতি, কাজ কিংবা অর্থবহতা নিয়ে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি তথ্যকে একটি দৃষ্টবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে সম্ভাবনাভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন। শ্যাননের তত্ত্বে তথ্যের প্রাপক ও প্রেরক উভয়েই তথ্য গঠনকারী প্রতীকসম্ভার সম্পর্কে অবহিত থাকে, যেখানে প্রতিটি প্রতীককে একটি সংকেতে রূপান্তরিত করা হয়। এই তত্ত্বে "তথ্য" হল কোনও উৎস বা প্রেরকের দ্বারা দৈব প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট এমন কোনও সম্ভাব্য প্রতীকসমষ্টি যার প্রতিটি প্রতীককে একের পর এক সংকেতায়িত করে সেই সংকেতগুলিকে কোনও কোলাহলপূর্ণ (যেখানে কোলাহল আরেকটি দৈব চলক) যোগাযোগ প্রণালীর মধ্য দিয়ে প্রাপকের উদ্দেশ্যে সম্প্রচার করা হয়, যেখানে প্রাপক সেই প্রাপ্ত সংকেতগুলিকে কোলাহলমুক্ত করে ও সাংকেতিক তথ্যটিকে বিসংকেতায়িত করে সর্বোচ্চ ত্রুটিহীনভাবে মূল প্রেরিত তথ্যটি উদ্ধার করে। শ্যাননের মতে অর্থবহতা নির্বিশিষে কোনও তথ্যের উৎস থেকে যে তথ্যবাহী সংকেতগুলি পাঠানো হয়, সেগুলির প্রতিটির সাথে একটি সম্ভাবনা (অর্থাৎ অনিশ্চয়তা) যুক্ত থাকে। এখন যদি কোনও সংকেত প্রাপ্তির সম্ভাবনা বেশি থাকে, তাহলে তার অনিশ্চয়তা-মাত্রা (যাকে শ্যানন বিশৃঙ্খলা-মাত্রা বা শ্যানন এনট্রপি বলে) কম হবে, সুতরাং সেটিতে প্রাপকের জন্য নতুন তথ্যের পরিমাণও কম থাকবে। এর বিপরীতে কোনও সংকেত প্রাপ্তির সম্ভাবনা যদি কম হয়, তাহলে তার সাথে সংশ্লিষ্ট অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাবে, ফলে প্রাপকের জন্য সেটির দ্বারা বহনকৃত নতুন তথ্যের পরিমাণও বেশি হবে। শ্যানন প্রতিটি ক্ষুদ্রতম একক সংকেতের সম্ভাবনা তথা অনিশ্চয়তা-মাত্রাকে একটি হ্যাঁ-না প্রশ্নের উত্তর হিসেবে কল্পনা করেন, যা দুইটি মাত্র অঙ্ক দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব: ০ (না) ও ১ (হ্যাঁ)। অর্থাৎ পাঠ্য (টেক্সট), শ্রাব্য (অডিও), দৃশ্য স্থিরচিত্র (ইমেজ) বা চলমান চিত্র (ভিডিও), ইত্যাদি সব ধরনের তথ্যকে শেষ বিচারে ০ ও ১ এই দুইটি অঙ্ক-ভিত্তিক সংকেতে রূপান্তরিত করা সম্ভব, যে অঙ্কগুলির ইংরেজি নাম বাইনারি ডিজিট বা সংক্ষেপে বিট (বিট নামটি শ্যাননই প্রথম জনপ্রিয় করেন)। শ্যাননের মতে এই "বিট"-ই হল সব ধরনের তথ্যের ক্ষুদ্রতম মৌলিক, গাণিতিক, পরিমাপযোগ্য একক, যাকে বর্তমান তথ্য তত্ত্বে শ্যাননের সম্মানে "শ্যানন" বলেও ডাকা হয় (আরও সঠিকভাবে বলতে বিট হল সাংকেতিক উপাত্তের একক, আর শ্যানন হল প্রতিটি বিটের সাথে সংশ্লিষ্ট তথ্যের একক)। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে যে ডিজিটাল তথা দ্বি-আঙ্কিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিপ্লবটি সংঘটিত হয়, তা সম্পূর্ণরূপে শ্যাননের এই গাণিতিক তত্ত্বের ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে আছে। আধুনিক ডিজিটাল বিশ্বের সবকিছুর মূলে রয়েছে শ্যাননের তত্ত্ব। তাই শ্যাননকে "তথ্য যুগের জনক" বলা হয়।

শ্যাননের তত্ত্ব শুধু বার্তাপ্রেরণ বা যোগাযোগ ক্ষেত্রেই নয়, বরং পরিগণন (কম্পিউটিং) ক্ষেত্রের উপরেও বৈপ্লবিক প্রভাব ফেলে। শ্যাননের তথ্য তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার একই বছরে, অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে মার্কিন প্রকৌশলী উইলিয়াম শকলি, জন বার্ডিনওয়াল্টার ব্র্যাটেইন অর্ধপরিবাহীভিত্তিক এক ধরনের অতিক্ষুদ্র সুইচ (অর্থাৎ বৈদ্যুতিক বর্তনী খোলা বা বন্ধকারক) জাতীয় ইলেকট্রনীয় যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যার নাম ছিল ট্রানজিস্টর। একটি ট্রানজিস্টর হয় আহিত বা অনাহিত এই দুইটি অবস্থায় থাকতে পারে, যেখানে আহিত অবস্থাকে ১ এবং অনাহিত অবস্থাকে ০ দ্বারা নির্দেশ করা যায়। অর্থাৎ একটি ট্রানজিস্টর শ্যাননের তত্ত্বে প্রস্তাবিত দুই-ভিত্তিক আঙ্কিক উপাত্ত তথা বিটের আধার হিসেবে কাজ করতে পারে এবং একাধিক ট্রানজিস্টরের মাধ্যমে তৈরি বিশেষ ইলেকট্রনীয় যন্ত্র দিয়ে অনেক অল্প জায়গায় ও দ্রুততার সাথে বুলিয়ান বীজগণিত নামক গণিতের বিশেষ একটি উপক্ষেত্রের সূত্রাবলী প্রয়োগ করে বাইনারি বা দুই-ভিত্তিক সংকেত প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব। এইরূপ বহুসংখ্যক ট্রানজিস্টর দিয়েই পরবর্তীতে আধুনিক দ্বি-আঙ্কিক পরিগণক যন্ত্র তথা ডিজিটাল কম্পিউটার উদ্ভাবন করা হয়, যা বর্তমান তথ্য প্রযুক্তি বিপ্লবের ভৌত ভিত্তি গঠন করেছে। আর শ্যাননের চিন্তাধারাই দ্বি-আঙ্কিক পরিগণনের (ডিজিটাল কম্পিউটিং) গাণিতিক ভিত্তিমূল স্থাপন করে, যেখানে পরিগণক যন্ত্রে (কম্পিউটারে) প্রবিষ্ট সমস্ত প্রতীক তথা তথ্যকে শেষ বিচারে দুই-ভিত্তিক সংকেতে বা বিটে (১ ও ০) রূপান্তরিত করে সেগুলিকে নির্দিষ্ট কলনবিধি (অ্যালগোরিদম) দিয়ে প্রস্তুতকৃত পূর্বলেখ (প্রোগ্রাম) ব্যবহার করে (যে প্রোগ্রামগুলিও শেষ বিচারে বিট দিয়ে তৈরি) মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। অধিকন্তু শ্যাননের তত্ত্ব পরিগণক যন্ত্রে বা কম্পিউটার দ্বারা প্রক্রিয়াজাত তথ্যের পরিমাণ বিট এককে হিসাব করতে সাহায্য করে। এছাড়া তাঁর তত্ত্ব কম্পিউটারে অধিকতর দক্ষতার সাথে তথ্য সংরক্ষণ, সংকোচন ও ত্রুটি সংশোধনের কাজে, অর্থাৎ তথ্যকে ত্রুটিহীনভাবে সংকুচিত করে একই জায়গায় অনেক বেশি পরিমাণ তথ্য সংরক্ষণে সহায়তা করে।

পদার্থ ও মহাবিশ্বের ভিত্তি হিসেবে তথ্য

কোনও কোনও বিজ্ঞানীর মতে পদার্থ গঠনকারী অতিপারমাণবিক কণিকাগুলির সমস্ত বৈশিষ্ট্য তথ্যের আকারে এবং এই তথ্যকে দ্বিমিক বা বাইনারি সংকেত (০ বা ১) আকারে প্রকাশ করা সম্ভব। সুতরাং সমগ্র মহাবিশ্বকে দ্বিমিক সংকেত প্রক্রিয়াজাতকারী এক অতিদানবীয় পরিগণকযন্ত্র তথা সুপারকম্পিউটার হিসেবে কল্পনা করা সম্ভব। বিখ্যাত মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী জন আর্চিবল্ড হুইলার ("কৃষ্ণগহ্বর" পরিভাষার প্রবর্তক) তার কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে তথ্যের মাধ্যমে মহাবিশ্বের গঠন ব্যাখ্যার এক বড় সমর্থকে পরিণত হন। তার মতে মহাবিশ্বকে তিনভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব। প্রথমত, মহাবিশ্বের সবকিছুই হল কণা (পদার্থ ও শক্তির অতিক্ষুদ্র রূপ)। দ্বিতীয়ত মহাবিশ্বের সবকিছুই হল বিভিন্ন কোয়ান্টাম ক্ষেত্র ও তাদের আন্তঃক্রিয়া। তৃতীয়ত, মহাবিশ্বের সবকিছুই হল তথ্য। ১৯৮০-র দশকে হুইলার তথ্য তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করেন এবং ১৯৮৯ সালে একটি গবেষণাপত্রে লেখেন যে "যা কিছু আছে – সব কণা, সব বলক্ষেত্র, এমনকি স্থান-কাল পরম্পরার উদ্দেশ্য, অর্থ ও সমগ্র অস্তিত্ব – কোন কোন ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে হলেও – কিছু হ্যাঁ/না-জাতীয় প্রশ্নের উত্তরের উপর, তথা দ্বিমিক নির্বাচন, তথা বিটের উপর নির্ভরশীল।" অন্য ভাষায় মহাবিশ্ব এর ভেতরে নিহিত দ্বিমিক তথ্যের থেকে উৎসারিত হয়। হুইলার এ ব্যাপারটিকে সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্মরণীয় একটি ইংরেজি খণ্ডবাক্য দিয়ে প্রকাশ করেন— “ইট ফ্রম বিট” ("It from bit")। "ইট" হল সব পদার্থ আর "বিট" হল "দ্বিমিক বা বাইনারি সংকেত"।[1]

জীবনের ভিত্তি হিসেবে তথ্য

বংশগতীয় সংকেত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জীবনের সব মৌলিক তথ্য বহন করে

কিছু কিছু জীববিজ্ঞানীর মতে (যেমন মার্কিন আণবিক বংশাণুবিজ্ঞানী ক্রিস অ্যাডামি) জীবন শুধুমাত্র কোনও বিশেষ রাসায়নিক ঘটনা নয়। বরং জীবনের ভিত্তি হল একটি আত্ম-অনুলিপিকারী সাংকেতিক মৌলিক তথ্যভাণ্ডার, যা ডিএনএ বা আরএনএ নামক জটিল রাসায়নিক অণুতে ধারণ করা থাকে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হয়। এক্ষেত্রে একটি জীবের কাছে তথ্য হল এমন কোনও কিছু যা তার যাপিত জীবনের পরিবেশ সম্পর্কে কোনও বিবরণ দেয়, এবং যেটিকে ব্যবহার করে জীবটি ঐ পরিবেশ সম্পর্কে দৈব ভাগ্যের চেয়ে উন্নত সম্ভাবনাবিশিষ্ট পূর্বাভাস করার ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং এভাবে প্রদত্ত পরিবেশে টিকে থাকে। যেকোনও জীবের কোষের মধ্যে যে বংশাণুসমগ্র (ডিএনএ নামক অণুর বিশেষ অনুক্রমসমষ্টি) উপস্থিত, সেগুলি পৃথিবীর ভৌত প্রাকৃতিক পরিবেশ ও অন্যান্য জীবদের সাথে প্রতিযোগিতামূলক জীবমণ্ডলের সাথে অনবরত আন্তঃক্রিয়ার ফলে লক্ষ কোটি বছর ধরে বিবর্তনের মাধ্যমে একটু একটু করে জমা হয়ে সৃষ্টি হয়েছে, যাতে জীবন ধারণ করার জন্য সব ধরনের মৌলিক তথ্য (যেমন দেহে কী করে শক্তি উৎপাদন করতে হবে, কী করে শত্রুজীব বা রোগজীবাণুর কাছ থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে, কী করে প্রজননের মাধ্যমে বংশবিস্তার করতে হবে, ইত্যাদি) সংকলিত আছে। বংশাণুগত তথ্য তাই জীবনের মুদ্রা। যেকোনও জীবের ডিএনএ বা বংশাণুসমগ্র হল এক ধরনের সংকেতায়িত বিশ্বকোষ যাতে ঐ জীবটি যে বিশ্বে বাস করছে, সেই বিশ্বে সেটি কীভাবে টিকে থাকবে, সে সংক্রান্ত বিপুল সংখ্যক সাংকেতিক তথ্য সন্নিবিষ্ট আছে। প্রতিনিয়ত আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্ব সম্পর্কে জীবের ভেতরে তথ্য প্রবেশ করছে, এবং জীবের উদ্বর্তন বা টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি অতি ধীরগতিতে সাংকেতিকভাবে সেটির ডিএনএ-তে রক্ষিত হয়েছে ও হচ্ছে। যেমন মানুষের ডিএনএ-তে সঞ্চিত তথ্যগুলি পৃথিবী নামক গ্রহে এক প্রজাতির স্থলচর প্রাণী হিসেবে টিকে থাকার জন্য সৃষ্টি হয়েছে; মঙ্গলগ্রহে বা পানির নিচে বেঁচে থাকার জন্য সৃষ্টি হয়নি। সুতরাং জীবন হল এমন একটি তথ্যসমষ্টি যা নির্দিষ্ট পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। যদি কোনও জীবের পরিবেশ খুবই অল্প সময়ে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়, তাহলে ডিএনএ তথা জীবন সংক্রান্ত তথ্যগুলি অর্থহীন হয়ে পড়ে এবং জীব আর সেই নতুন পরিবেশে টিকে থাকতে পারে না। একারণেই ডাইনোসরেরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।[2] একই কারণে মানবজাতিকে যদি বহুদূরবর্তী কোনও ভবিষ্যতে অন্য কোনও গ্রহে টেকসই মানববসতি স্থাপন করতে হয়, তাহলে তাকে ঐ গ্রহের প্রাকৃতিক পরিবেশ (জীবনধারণের জন্য অনুকূল বায়ুচাপ, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, তেজস্ক্রিয়তা, অক্সিজেন) ও জীবমণ্ডলকে পৃথিবীর ন্যায় রূপদান করতে হবে, নতুবা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য বহু লক্ষ কোটি বছর ধরে অর্জিত যেসব বংশগত তথ্য মানব ডিএনএ-তে জমা হয়েছে, সেগুলি নতুন ঐ গ্রহে নিরর্থক ও অচল হয়ে পড়বে।

মানব বংশাণুসমগ্রে (জিনোম) প্রায় ৩ শত কোটি ভিত্তি জোড় (বেজ পেয়ার) আছে, যেগুলির প্রতিটিকে দুইটি বিট (১ ও ০-ভিত্তিক দুই অংকের সংখ্যা) দিয়ে সংকেতায়িত করা সম্ভব, অর্থাৎ ৬ শত কোটি বিট দিয়ে উপস্থাপন করা সম্ভব, যা কিনা প্রায় ৭০০ মেগাবাইট পরিমাণ উপাত্ত। কিন্তু এই উপাত্তগুলিকে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণযোগ্য উপকারী তথ্যে রূপান্তরিত করলে সেগুলির পরিমাণ হয় প্রায় ২০০ গিগাবাইট। অর্থাৎ প্রতিটি জীবিত মানুষ প্রায় ২০০ গিগাবাইট অর্থবহ বংশাণুগত তথ্য বহন করে চলছে, যেগুলি তার জীবনের ভিত্তি।[3] আবার মানুষের বংশাণুসমগ্রে (জিনোম) উপস্থিত প্রায় ২০ হাজার বংশাণু (জিন) থেকে কমপক্ষে ২০ হাজার থেকে শুরু করে বহু লক্ষ প্রকারের প্রোটিন অণু (দেহসার) তথা মানবদেহ গঠনকারী সারবস্তু সৃষ্টি হওয়া সম্ভব, যেখানে প্রোটিনের প্রতিটি প্রকার মানবদেহে নির্দিষ্ট কোনও কাজে নিয়োজিত। এই বিপুল সংখ্যক প্রোটিন বা দেহসারের ধরন সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য এখনও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি, যা কিনা প্রোটিনসমগ্র বিজ্ঞান (প্রোটিওমিকস) নামক শাস্ত্রে অধীত বিষয়।

জৈব, চিকিৎসাগত ও স্বাস্থ্যগত তথ্য

বর্তমান যুগে এসে জীববিজ্ঞানচিকিৎসাবিজ্ঞান ক্ষেত্রে নতুন নতুন পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ প্রযুক্তির সাহায্যে জীবদেহ ও জীবদেহ থেকে উৎপাদিত পদার্থসমূহ সম্পর্কে অভূতপূর্ব দ্রুতগতিতে বিপুল পরিমাণ তথ্য আহরণ ও সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ফলে এইসব জৈব ও জৈব-চিকিৎসাগত তথ্যগুলিকে আর কেবল মানুষের একার পক্ষে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। তাই শক্তিশালী আধুনিক পরিগণন (কম্পিউটিং) প্রযুক্তি ব্যবহার করে এগুলি অনুধাবন করা ও এগুলির উপকারী প্রয়োগ আবিষ্কার করার একটি ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যার নাম জৈব তথ্যবিজ্ঞান। এই ক্ষেত্রটিতে জীববৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা কিংবা চিকিৎসাক্ষেত্রে উৎপাদিত বিপুল তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যাপ্রদান নিয়ে অধ্যয়ন করা হয়। এই আন্তঃশাস্ত্রীয় গবেষণা ক্ষেত্রটিতে জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের পাশাপাশি পরিগণক বিজ্ঞানী (কম্পিউটার বিজ্ঞানী), গণিতবিদ, পরিসংখ্যানবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানীরাও কাজ করছেন।[4] অন্য ভাষায় জৈব তথ্যবিজ্ঞান হল বংশাণুসমগ্র বিজ্ঞান, জৈব প্রযুক্তি ও তথ্য প্রযুক্তির মেলবন্ধন। এতে অধীত জৈব উপাত্ত ও তথ্যগুলি মূলত জীবদেহে প্রাপ্ত জৈব অণু যেমন বংশাণু (জিন), ডিএনএ, আরএনএ, অ্যামিনো অ্যাসিড, প্রোটিন, ইত্যাদির অনুক্রম বা কাঠামো। এই অনুক্রম বা কাঠামোগুলিকে বিশ্লেষণ করে ও একে অপরের সাথে তুলনা করে এগুলির কাজ নির্ণয় করা হয়, এবং এগুলিকে সুবিন্যস্ত করে সূচীবদ্ধ করে উপাত্তভাণ্ডার বা তথ্যভাণ্ডার নির্মাণ করা হয়। ভিন্ন ভিন্ন জীবের জৈব উপাত্ত তুলনা করে সেগুলির মধ্যে বিবর্তনগত সম্পর্কও নির্ণয় করা হয়। এছাড়া জীব দ্বারা উৎপন্ন ঔষধি যৌগগুলিও এই ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ করা হয়। ভাষাবিজ্ঞানীরা যেমন ভাষিক উপাত্ত ও তথ্যের বিন্যাস নিয়ে কাজ করেন, ঠিক একইভাবে জৈব তথ্যবিজ্ঞানীরা জৈব অণুসমূহের বিন্যাসের ভাষা নিয়ে কাজ করেন, তবে জৈব তথ্যের প্রকৃতি অন্যান্য তথ্যের তুলনায় অনেক বেশি জটিল। এগুলিকে অনুক্রম, বিন্যাস, রেখাচিত্র, জ্যামিতিক চিত্র, নির্দিক ও সদিক ক্ষেত্র, সীমাবদ্ধতা, চিত্র, স্থানিক তথ্য, গাণিতিক ও পরিগাণনিক প্রতিমান, গদ্য, অনুকল্প, সাক্ষ্যপ্রমাণ, ইত্যাদি বিভিন্ন রূপে সংরক্ষণ করা হতে পারে, এবং এগুলি একমাত্রিক, দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক ধরনের হতে পারে। তবে পরিগণক যন্ত্র বা ব্যবস্থায় এগুলিকে বিট (০ বা ১) হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। প্রাক্কলন করা হয়েছে যে ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বে ৪০ এক্সাবাইট (৪ হাজার কোটি গিগাবাইট) বংশাণুসামগ্রিক তথ্য উৎপাদিত হবে। ভবিষ্যতে স্নায়ুবিজ্ঞান ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের চিত্রণের ফলে উৎপাদিত স্নায়ুকোষ সম্পর্কিত তথ্যগুলি আরও অনেক জটিল হবে ও এদের পরিমাণও আরও বিপুল হবে। আরেকটি উৎস অনুসারে বিশ্ব স্বাস্থ্যখাতে ২০২০ খ্রিস্টাব্দে এক বছরে ২৪০০ এক্সাবাইট (২৪ লক্ষ কোটি গিগবাইট) পরিমাণ স্বাস্থ্যগত উপাত্ত উৎপন্ন হয়।[5]

তথ্য-সাক্ষরতা ও সাংবাদিকতা

আধুনিক যুগে এসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সহায়তায় আন্তর্জাল (ইন্টারনেট) ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলির মাধ্যমে প্রতিটি ব্যক্তি বিপুল পরিমাণ তথ্যের সান্নিধ্যে আসে। এই তথ্যগুলি কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে, এগুলির গুণমান কীরকম, কীভাবে চাহিদামাফিক তথ্য খুঁজে বের করে সেগুলির মূল্যায়ন করে সেগুলিকে ব্যক্তিগত, সামাজিক, পেশাগত বা শিক্ষাগত জীবনের বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, এই ব্যাপারগুলিকে একত্রে তথ্য-সাক্ষরতা নাম দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল তথ্যনির্ভর বিশ্বে তথ্য সাক্ষরতা একটি মৌলিক মানবাধিকারে পরিণত হয়েছে। এই ধারণাটির সাথে চিরায়ত সাক্ষরতা, পরিগণকযন্ত্র (কম্পিউটার) সাক্ষরতা, গবেষণা দক্ষতা ও সমালোচনামূলক চিন্তার ক্ষমতার মতো ধারণাগুলির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। গণতান্ত্রিক, বহুমতভিত্তিক, সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ, জাতি ও সমাজ নির্মাণে তথ্য সাক্ষরতা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বর্তমানে সংবাদমাধ্যমগুলিতে হলুদ সাংবাদিকতা, ভুয়া খবর, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুল তথ্যের বিস্তার, মিথ্যা অপতথ্যের বিস্তার ও সত্য কিন্তু মর্যাদাহানিকর ক্ষতিকর তথ্যের বিস্তার প্রতিরোধ করতে এই ব্যাপারটি আরও গুরুত্ব লাভ করেছে। একই সাথে অগণতান্ত্রিক কিংবা তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তথ্যের বিবাচন (সেন্সরশিপ) ও দমন-নিপীড়নের ভয়ে সাংবাদিকদের আত্ম-বিবাচন (সেলফ-সেন্সরশিপ) কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব কারণে অনেক দেশে সাংবাদিকদের উপরে পাঠকসমাজের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে।

তথ্যসূত্র

  1. Maria Popova, It from Bit: Pioneering Physicist John Archibald Wheeler on Information, the Nature of Reality, and Why We Live in a Participatory Universe
  2. Kevin Hartnett (৯ নভেম্বর ২০১৫)। "The Information Theory of Life"QuantaMagazine। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুন ২০২২
  3. "Genomic Data Science"National Human Genome Research Institute। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুন ২০২২
  4. "Bioinformatics"National Human Genome Reseach Institute। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুন ২০২২
  5. "The Skyrocketing Volume Of Healthcare Data Makes Privacy Imperative"Forbes। ৬ আগস্ট ২০২১। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুন ২০২২

আরও দেখুন

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.