সত্তাতত্ত্ব

দর্শনের আলোচনায় সত্তাতত্ত্ব (ইংরেজি: Ontology) বলতে বাস্তব বিশ্বের সব কিছুর "থাকা", "হওয়া" বা "অস্তিত্ব" বিষয়ক সাধারণ ধারণাসমূহকে নিরপেক্ষভাবে অধ্যয়নকারী বিদ্যাকে বোঝায়। বিশেষত অস্তিত্ব, বাস্তবতা এবং এদের সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনাই সত্তাতত্ত্বের মুখ্য আলোচনার বিষয় । এটি দর্শনশাস্ত্রের অধিবিদ্যা শাখার প্রধান অংশটি গঠন করেছে। সত্তাতত্ত্ব অস্তিত্বশীলতা এবং অস্তিত্বশীল সত্তাগুলির একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে ।

Parmenides was among the first to propose an ontological characterization of the fundamental nature of reality.

বিকাশ

সত্তাতত্ত্বকে আরিস্তোতল "প্রথম দর্শন" হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ১৮শ শতকে জার্মান দার্শনিক ক্রিস্টিয়ান ভোলফ সত্তাতত্ত্বকে "সাধারণ অধিবিদ্যা" হিসেবে অভিহিত করেন। এর বিপরীতে আত্মা, দেহ ও ঈশ্বর সংক্রান্ত তত্ত্বগুলিকে তিনি "বিশেষ অধিবিদ্যক তত্ত্ব" হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি দাবি করেন যে সত্তাতত্ত্ব একটি অবরোহী শাস্ত্র হতে পারে, যার দ্বারা বস্তুসমূহের সার উদ্ঘাটন করা যেতে পারে। পরবর্তীতে ডেভিড হিউম ও এমানুয়েল কান্ট এই দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। ২০শ শতকের শুরুর দিকে প্রপঞ্চতত্ত্বঅস্তিত্ববাদের চর্চাকারী দার্শনিকেরা সত্তাতত্ত্ব নিয়ে পুনরায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন, যাদের মধ্যে এডমুন্ড হুসের্ল ও তাঁর ছাত্র মার্টিন হাইডেগারের নাম বিশেষভাবে উচ্চার্য। ইংরেজিভাষী বিশ্বে মার্কিন দার্শনিক উইলার্ড ভ্যান অর্ম্যান কোয়াইন ২০শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সত্তাতত্ত্ব নিয়ে লেখেন। ২০শ শতকের শেষভাগে এসে এটি বিশ্লেষণী দর্শনশাস্ত্রের একটি কেন্দ্রীয় বিদ্যায় পরিণত হয়।

ইংরেজিতে শব্দটি প্রথমে অন্তর্ভুক্ত হয় অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধাণে , যা গিডন হারভে নামক ব্যক্তি অন্তর্ভুক্তি করেন । লাইবনিজ হলেন সতেরো শতকের একমাত্র দার্শনিক যিনি এই শব্দটি ব্যবহার করেন।

সংক্ষিপ্ত বিবরণ

কিছু দার্শনিক ঘরানা, বিশেষত প্লাতোর অনুসারী দার্শনিক ঘরানাগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে সকল বিশেষ্য কোন না কোন অস্তিত্বশীল বস্তুকে নির্দেশ করে। পরবর্তীতে দার্শনিকরা বলেন যে বিশেষ্য সবসময় কোন বস্তু বা সত্তাকে নির্দেশ করে না, বরং কখনও কখনও কিছু বস্তু এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্কের ধারণাও প্রদান করে । পরবর্তীতে মনকে কোন সত্তা হিসেবে উল্লেখ না করে ব্যক্তির মানসিক ঘটনাসমূহের একটি সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করা হয় । সমাজ দ্বারা নির্দেশ করা হয় অনেকগুলো মানুষের সংগঠনকে এবং জ্যামিতি দ্বারা কিছু বুদ্ধিদীপ্ত ক্রিয়াকে নির্দেশ করা হয় । বাস্তববাদ এবং সংজ্ঞাবাদ এর এসকল মতের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন মত রয়েছে ।

কিছু মৌলিক প্রশ্ন

সত্তাতত্ত্বের কিছু মৌলিক প্রশ্ন হল:

  • "অস্তিত্বশীলতা কি?"
  • "বস্তু কি?"
  • "অস্তিত্বশীল বস্তুসমূহ কোন উপায়ে সম্পর্কিত হয়?"
  • "সত্তার অর্থ কি?"
  • "সত্তা হওয়ার বিভিন্ন শর্ত সমূহ কি?"

বিভিন্ন দার্শনিক এই প্রশ্নগুলোর বিভিন্ন জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন । সাধারণত বিষয় এবং বিষয়ীর মধ্যকার ভিন্নতা দ্বারা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রদানের চেষ্টা করেছেন দার্শনিকরা । তবে একেকজনের জবাব অন্যজন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, সকলের স্বতন্ত্র চিন্তাগুলো নিয়ে জ্ঞানবিদ্যা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতন শাখাগুলো সৃষ্টি হয়েছে । তত্ত্ববিদ্যক প্রকরণগুলো বিভিন্ন অনুক্রমে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে । এরিষ্টটলের করা শ্রেণীবিন্যাসে সত্তাকে বুঝানো হয়েছে সত্তা দ্বারাই । যথাঃ

  • ইহা কি? (সারসত্তা নির্দেশ)
  • ইহা কেমন? (গুণবাচকতা)
  • ইহার পরিমাণ কত? (পরিমাণবাচকতা)
  • ইহা কোথায়? (সম্পর্ক)

এসকল তত্ত্ববিদ্যক প্রশ্নের আরো কিছু উদাহরণঃ

  • অস্তিত্ব কি? এটা দ্বারা কি বুঝানো হয়?
  • অস্তিত্ব কি কোন সম্পদ?
  • অস্তিত্ব কি কেবলমাত্র নির্দিষ্ট পার্থক্য দ্বারা বিভক্ত একটি জাতি বা সাধারণ শ্রেণী?
  • কোন সত্তা? যদি থাকে তবে তার মৌলিকতা কি?
  • সকল সত্তাই কি বস্তু?
  • একটি বস্তুর বৈশিষ্ট্য কীভাবে তার নিজের সাথে সম্পর্কিত হয়?
  • বস্তুগত কোন বৈশিষ্ট্য কি অস্তিত্বশীল?
  • একটি বস্তুর কোন বৈশিষ্ট্য একে অন্যদের থেকে পৃথক করে?
  • অস্তিত্বশীলতার কতগুলো ধাপ রয়েছে? ধাপ কি?
  • প্রাকৃতিক বস্তু কি?
  • প্রাকৃতিক বস্তুর অস্তিত্বশীলতার কোন প্রমাণ কি কেউ দিতে পারবে?
  • অ-প্রাকৃতিক বস্তুর অস্তিত্বশীলতার কোন প্রমাণ কেউ দিতে পারবে?
  • বস্তুর গঠন পরিচয় নির্ধারণ করে কে ?
  • কখন একটি বস্তু অস্তিত্বের বাইরে যায় বা পরিবর্তিত হয়?
  • বিষয় এবং বিষয়ীর বাইরেও কি কোন সত্তা অস্তিত্বশীল? বিষয় এবং বিষয়ী কি আধুনিক দর্শন এর অনিবার্যতাকে বিভক্ত করে?

ধারণা

অপরিহার্য তত্ত্ববিদ্যক দ্বি-বিভাজনসমূহঃ

  • সার্বিক এবং বিশেষ
  • দ্রব্য ও অদ্রব্য
  • মূর্ত এবং বিমূর্ত বস্তু
  • অস্তিত্ব ও সারসত্তা
  • নির্ধারণবাদ ও অনির্ধারণবাদ
  • একত্ববাদ ও দ্বৈতবাদ

ভাববাদ ও বাস্তববাদ

প্রকার

দার্শনিকগণ বিমূর্ততার মানদণ্ড ব্যবহার করে সত্তাতত্ত্বকে বিভিন্ন উপায়ে শ্রেণীবিন্যস্ত করেন । যথাঃ

  • পরা-সত্তাতত্ত্ব: যেসকল ধারণা সত্তাতত্ত্বের বিকাশ ঘটায় সেসকল বিষয়ের আলোচনা করে।
  • কার্য-সত্তাতত্ত্ব: বিশেষ কোন বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত ধারণা, কার্যক্ষেত্র অথবা এর সাথে প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ধারণা নিয়ে আলোচনা করে, কম্পিউটারের ভাষা, অথবা বিজ্ঞানের কোন বিশেষ শাখার ন্যায় ।
  • আন্তর্পৃষ্ঠ সত্তাতত্ত্ব: দুইটি বিদ্যার ধারণার সংযোগ ঘটানো
  • পদ্ধতিগত সত্তাতত্ত্ব: আগম (ইনপুট), নির্গম (আউটপুট), সীমাবদ্ধতা, ক্রম তথ্য ইত্যাদির কৌশল প্রকিয়া নিয়ে কাজ করে ।

ইতিহাস

সত্তাতত্ত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম শতকে হিন্দু দর্শনের সাংখ্য সম্প্রদায়ে । গুণের বৈশিষ্ট্যের ধারণায় এর তিনটি ভাগের কথা বলা হয় , যথা স্বতঃ,তম ও রজ ; যা সকল অস্তিত্বশীল বস্তুর মধ্যে বিদ্যমান থাকে  ; এটি এই সম্প্রদায়ের একটি উল্লেখযোগ্য ধারণা ।

পারমানাইডিস এবং একত্ববাদ

গ্রীক দর্শনে, পারমানাইডিস খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর দিকে প্রথম অস্তিত্বের মৌলিক প্রকৃতির তত্ত্ববিদ্যক বৈশিষ্ট্য প্রদান করেন । তার প্রকৃতিবিষয়ক পদ্য On Nature এ তিনি অস্তিত্ব বিষয়ে দুইটি ধারণা প্রদান করেন; কোনকিছু থেকেই কোনকিছু আসেনা তাই অস্তিত্ব চিরন্তন । ফলস্বরূপ সত্য বিষয়ে আমাদের ধারণা ভ্রান্ত এবং অমূলক হতে পারে । পাশ্চাত্য দর্শনের বেশিরভাগ ধারণাই মিথ্যা প্রতিপাদন নীতিকে অনুসরণ করে, এই নীতির ধারণা পারমানাইডিসের এ মত থেকেই সৃষ্ট । এর দ্বারা বোঝানো হয় অস্তিত্ব হলো যা আমরা চিন্তা করি,সৃষ্টি করি এবং ধারণ করি । প্রকৃত বাস্তবতার ধারণা আমরা নাও পেতে পারি তবে তা অস্তিত্বশীলতা থেকে কখনোই বিনষ্ট হয়ে যাবেনা । পারমেনাইডিস বলেন, আমাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান ভ্রমমূলক ।

তত্ত্ববিদ্যক দ্বৈতবাদ

পারমানাইডিসের তত্ত্ববিদ্যক একত্ববাদের বিপরীত মতই হচ্ছে তত্ত্ববিদ্যক দ্বৈতবাদ । এনাক্সেগোরাস এবং লিউসিপাস সত্তা এবং বাস্তবতার ধারণার পরিবর্তন সাধন করেন ।

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.