ডেভোনিয়ান

ডেভোনিয়ান যুগ হল একটি ভূতাত্ত্বিক যুগ যা সিলুরিয়ান যুগের শেষ অর্থাৎ ৪১.৯২ কোটি বছর আগে থেকে কার্বনিফেরাস যুগের আরম্ভ অর্থাৎ ৩৫.৮৯ কোটি বছর আগে পর্যন্ত চলেছিল।[5] ইংল্যান্ডের ডেভন অঞ্চল থেকে প্রথম এই যুগের পাথরের প্রাপ্তি ও গবেষণার সুবাদে অঞ্চলটির নামে যুগের নামকরণ হয়েছে।

ডেভোনিয়ান যুগ
৪১.৯২–৩৫.৮৯ কোটি বছর পূর্বে
কা
পা
ক্রি
প্যা

ডেভোনিয়ান যুগের প্রথম দিকের পৃথিবী

গড় বায়ুমন্ডলীয় O
পরিমাণ
প্রায় ১৫ আয়তন %[1]
(বর্তমান মাত্রার ৭৫ %)
গড় বায়ুমন্ডলীয় CO
প্রায় ২২০০ পিপিএম[2]
(প্রাক শিল্প স্তরের ৮ গুণ)
ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় ২০ °সে[3]
(বর্তমান তাপমাত্রার ৬ °সে উপরে)
সমুদ্রপৃষ্ঠ (বর্তমান উচ্চতা থেকে যত উপরে) গড়ে ১৮৯ মিটার, যুগের শেষদিকে ক্রমশ ১২০ মিটারে পতন[4]

ডেভোনিয়ান যুগে প্রথম স্থলচর জীবকুলের অভিযোজনীয় বিকিরণ লক্ষ্য করা যায়। ডাঙায় প্রথম ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদের বিস্তার আরম্ভ হয় এবং ক্রমশ মহাদেশসমূহে বিস্তীর্ণ অরণ্যের সৃষ্টি হয়। মধ্য ডেভোনিয়ানে অনেক উদ্ভিদ প্রজাতির দেহে পাতা ও প্রকৃত মূলের আবির্ভাব হয়, এবং যুগের শেষভাগে প্রথম বীজ সংবলিত উদ্ভিদের দেখা মেলে। বিভিন্ন প্রজাতির স্থলচর সন্ধিপদীও বংশবৃদ্ধি করে। জলভাগে মাছেদের বহুসংখ্যক প্রজাতির আবির্ভাব ঘটার ফলে ডেভোনিয়ানকে ক্ষেত্রবিশেষে মাছের যুগ বলা হয়ে থাকে। প্রথম রশ্মিযুক্ত পাখনাবিশিষ্টরশ্মিহীন পাখনাবিশিষ্ট মাছেরা বিবর্তিত হয়, এবং প্ল্যাকোডার্মরা সমস্ত জলীয় পরিবেশে আধিপত্য কায়েম করে।

চতুষ্পদ প্রাণীকুলের পূর্বসূরী মাছেরা ডাঙায় চার পায়ে গমনের চেষ্টা করতে থাকে, আর তাদের শক্তিশালী বক্ষ ও শ্রোণী পাখনা থেকে যথাক্রমে অগ্রপদ ও পশ্চাৎপদের বিবর্তন হয়।[6] মহাসাগরে আদিম হাঙরেরা পূর্ববর্তী অন্ত্য অর্ডোভিশিয়ানসিলুরিয়ান যুগের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। প্রথম অ্যামোনাইট জাতীয় কম্বোজের বিবর্তন হয়। ট্রাইলোবাইট, কম্বোজ-সদৃশ ব্র্যাকিওপড ও বিরাট বিরাট প্রবাল প্রাচীর সমূহও তাদের আধিপত্য বজায় রাখে। আজ থেকে ৩৭.৫ কোটি বছর আগে নতুন প্রজাতির বিবর্তনের হার আকস্মিকভাবে কমে যায়, ফলে জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু এই ঘটনাকে বিলুপ্তি ঘটনা আখ্যা দেওয়া উচিত কি না তা সংশয়ের বিষয়।[7] এই সংকটের সময় সমস্ত প্ল্যাকোডার্ম এবং প্রোটিডা বর্গের সামান্য কিছু প্রজাতি ছাড়া সমস্ত ট্রাইলোবাইট লোপ পায়।

সমসাময়িক ভৌগোলিক বিশেষত্বের মধ্যে দক্ষিণের অতিমহাদেশ গণ্ডোয়ানা, উত্তরের মহাদেশ সাইবেরিয়া ও মধ্যবর্তী মহাদেশ ইউরামেরিকার কথা বলা যায়।

চর্চার ইতিহাস

ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে ডেভন কাউন্টির নামানুসারে এই যুগের নামকরণ করা হয়েছে। এই কাউন্টি থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রাচীন পাথর ও জীবাশ্মের শ্রেণীকরণ করতে গিয়ে পুরাজীববিদদের মধ্যে এক দীর্ঘস্থায়ী বিবাদের সূত্রপাত হয়। বিবদমান দুই পক্ষের একদিকে ছিলেন রডারিক মার্চিসন ও অ্যাডাম সেজ্‌উইক এবং অপর দিকে ছিলেন হেনরি দে লা বেশ ও জর্জ বেলাস গ্রীনাফ। মার্চিসন ও সেজ্‌উইক বিবাদে জয়লাভ করেন। এই ধরনের বিবাদের ইতিহাস ঘাঁটলে বোঝা যায় পুরাকালীন যুগবিভাগের ধারণা কতখানি আপেক্ষিক ও অনিশ্চিত।

সিস্টেম/
যুগ
সিরিজ/
উপযুগ
স্টেজ/
অধোযুগ
বয়স
 (কোটি বছর আগে)
কার্বনিফেরাস মিসিসিপিয়ান তুর্নাইসিয়ান নবীনতর
ডেভোনিয়ান অন্ত্য ফামেনিয়ান ৩৭.২২–৩৫.৮৯
ফ্রাসনিয়ান ৩৮.২৭–৩৭.২২
মধ্য জিভেশিয়ান ৩৮.৭৭–৩৮.২৭
এইফেলিয়ান ৩৯.৩৩–৩৮.৭৭
আদিম এমসিয়ান ৪০.৭৬–৩৯.৩৩
প্রাগিয়ান ৪১.০৮–৪০.৭৬
লচকোভিয়ান ৪১.৯২–৪১.০৮
সিলুরিয়ান প্রিদোলি প্রাণী পর্যায় অসংজ্ঞায়িত প্রাচীনতর
২০১২ তে আইসিএস কর্তৃক নির্ধারিত ডেভোনিয়ান যুগের উপবিভাগসমূহ।[8]
ডেভন প্রদেশের টর্কে অঞ্চলের লুমাটন প্রস্তরক্ষেত্রে প্রাপ্ত পাথর ডেভোনিয়ান যুগের নির্ধারণে মূল ভূমিকা নিয়েছিল।

যাই হোক, ডেভোনিয়ান যুগের প্রারম্ভিক ও অন্তিম পর্যায়গুলির নমুনা বিভিন্ন পাথরের স্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও সেগুলির যথার্থ বয়স এখনও নির্ণয় করা যায়নি। আন্তর্জাতিক স্তরবিদ্যা কমিশনের মতানুসারে (২০০৪) ৪১.৯২ কোটি বছর আগে সিলুরিয়ান যুগের শেষ থেকে ৩৫.৮৯ কোটি বছর আগে কার্বনিফেরাস যুগের আরম্ভ পর্যন্ত ডেভোনিয়ানের বিস্তার।

উনবিংশ শতাব্দীর লেখাপত্রে ডেভোনিয়ানকে "প্রাচীন লাল যুগ" বলা হত, কারণ যুক্তরাজ্যের প্রাচীন লাল বেলেপাথরের স্তর থেকেই এই যুগ সংক্রান্ত প্রথম আবিষ্কারগুলি করা গিয়েছিল। ডেভোনিয়ানের আরেকটা জনপ্রিয় ডাকনাম হল "মাছের যুগ"[9], কারণ এই যুগে প্রথম মাছেদের অনেকগুলো গোত্রের বিবর্তন ও বিভাজন ঘটে।

ভ্রান্তিবশত ডেভোনিয়ানকে "গ্রীনহাউস যুগ"-ও বলা হয়েছে, কারণ ডেভোনিয়ানের প্রাথমিক নমুনাগুলোর বেশির ভাগ পাওয়া গিয়েছিল পশ্চিম ইউরোপ ও পূর্ব উত্তর আমেরিকা থেকে, আর ঐ যুগে ঐ অঞ্চলগুলো নিরক্ষরেখার অনেক কাছে থাকায় প্রাপ্ত পাথরে প্রবাল দ্বীপ ও উষ্ণ জলবায়ুর অন্যান্য নিদর্শন ছিল। প্রকৃতপক্ষে ডেভোনিয়ানের জলবায়ু উপযুগভেদে ও অঞ্চলভেদে বিপুল বৈচিত্র্যের প্রমাণ দেয়। যেমন, আদি ডেভোনিয়ানে সাইবেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকা ও চীনে ঊষর জলবায়ু থাকলেও আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় উষ্ণ আর্দ্র জলবায়ু ছিল। অন্ত্য ডেভোনিয়ানে সামগ্রিকভাবে গ্রহের আর্দ্রতা বাড়ে ও মরুভূমির পরিমাণ হ্রাস পায়।

জলবায়ু

ডেভোনিয়ান যুগে জলবায়ু ছিল মোটের উপর উষ্ণ, এবং খুব সম্ভবত সমগ্র যুগে পৃথিবীতে কোনও হিমবাহের অস্তিত্ব ছিল না। নিরক্ষরেখা থেকে মেরু অঞ্চল পর্যন্ত তাপমাত্রার যে বিরাট পার্থক্য এখন দেখা যায়, তা ডেভোনিয়ানে ছিল অনেক কম। নিরক্ষরেখা সন্নিহিত অঞ্চলে আদি ডেভোনিয়ানে ঊষর জলবায়ু ছিল।[10] কনোডন্ট অ্যাপালাইট থেকে নির্ণীত ক্রান্তীয় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার মানচিত্র অনুযায়ী আদি ডেভোনিয়ানে গ্রহের গড় তপমাত্রা ছিল ৩০° সে (৮৬° ফা)।[10] সদ্য বিবর্তিত বন-জঙ্গল ক্রমশ মাটিচাপা পড়ার মাধ্যমে ডেভোনিয়ান যুগে বায়ুমণ্ডলের অনেকখানি কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস ভূপৃষ্ঠে আটক হয়, ফলে গোটা আদি ডেভোনিয়ান উপযুগ ধরে গ্রহের গড় উষ্ণতা হ্রাস পায়। এভাবে মধ্য ডেভোনিয়ানে প্রায় ৫° সে (৯° ফা) তাপমাত্রা কমেছিল। অন্ত্য ডেভোনিয়ানে আবার তাপমাত্রা বেড়ে আদি ডেভোনিয়ানের কাছাকাছি চলে যায়; এই উষ্ণায়নের কারণ জানা যায়নি (কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ এই সময় বাড়েনি), তবে মহাদেশীয় আবহবিকার ও উদ্ভিদের বণ্টন ইত্যাদির হিসেব থেকে অন্ত্য ডেভোনিয়ান উষ্ণায়নের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।[10] এই উষ্ণায়ন স্ট্রোমাটোপোরয়েড জাতীয় প্রবাল প্রাচীর সৃষ্টিকারী সংবেদনশীল প্রাণীকুলের বিলুপ্তির কারণ হয়ে থাকতে পারে।

পুরাভূগোল

ডেভোনিয়ান যুগে ভূপৃষ্ঠের টেকটনিক সক্রিয়তা বেশি ছিল। ইউরামেরিকা ও গণ্ডোয়ানা মহাদেশ দুটি এই যুগে কাছাকাছি আসে।

আদি ডেভোনিয়ানে মকরক্রান্তি রেখা সন্নিহিত অঞ্চলে লরেন্‌শিয়া ও বাল্টিকা মহাদেশের মিলনের ফলে ইউরামেরিকা তথা লরাশিয়া (লরেশিয়া নয়) অতিমহাদেশের সৃষ্টি হয়। এই অঞ্চলের ঊষর জলবায়ুর প্রমাণ পাওয়া যায় অধিক জারিত হেমাটাইট মিশ্রিত লাল বেলেপাথরের স্তর থেকে।

নিরক্ষরেখার কাছে ইউরামেরিকা ও গণ্ডোয়ানার পাত দুটি পরস্পরের খুব কাছে এসে জুড়ে যেতে আরম্ভ করে; এইভাবেই পরবর্তী অতিমহাদেশ প্যানজিয়ার গঠনপ্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। এই সংঘর্ষের ফলে অ্যাপালেশিয়ান পর্বতমালার উচ্চতা বাড়ে এবং গ্রেট ব্রিটেনস্ক্যান্ডিনেভিয়ায় ক্যালিডোনিয়ান পর্বতমালার উত্থান আরম্ভ হয়।

উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের ভূগাঠনিক সক্রিয়তা ছিল অপেক্ষাকৃত কম। এই অঞ্চলটি ডেভোনিয়ান যুগে পলিসঞ্চয়শীল অগভীর উপকূলীয় সমুদ্র, বিভিন্ন নদীর ব-দ্বীপ প্রভৃতি দ্বারা অধ্যুষিত ছিল। বর্তমানে এগুলো আইডাহোনেভাদা রাজ্যের অংশ। অন্ত্য ডেভোনিয়ানে মহাদেশীয় পাতের কিনারায় অনেকগুলো আগ্নেয় দ্বীপের সৃষ্টি হয়, যা ক্রমশ ভূভাগে আলোড়ন সৃষ্টি করে কার্বনিফেরাস যুগে অ্যান্টলার গিরিজনির সূত্রপাত ঘটায়।[11]

বিশ্ব জুড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ছিল বেশি, এবং অধিকাংশ ভূভাগ ছিল অগভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত। এই সমস্ত স্থানে ক্রান্তীয় প্রবাল প্রাচীর গঠনকারী জীবকুলের বাস ছিল। সুগভীর ও সুবিশাল প্যানথলসা অতিমহাসাগর অবশিষ্ট পৃথিবীকে আচ্ছাদিত রেখেছিল। বিভিন্ন উপযুগে সৃষ্ট অন্যান্য ছোট মহাসাগরের মধ্যে ছিল প্যালিও-টেথিস, প্রোটো-টেথিস, রাইক মহাসাগর ও উরাল মহাসাগর। শেষোক্তটি সাইবেরিয়া ও বাল্টিকা মহাদেশের সংঘর্ষের সময় বুজে যায়।

তথ্যসূত্র

  1. Image:Sauerstoffgehalt-1000mj.svg
  2. Image:Phanerozoic Carbon Dioxide.png
  3. Image:All palaeotemps.png
  4. Haq, B. U.; Schutter, SR (২০০৮)। "A Chronology of Paleozoic Sea-Level Changes"। Science322 (5898): 64–68। ডিওআই:10.1126/science.1161648পিএমআইডি 18832639বিবকোড:2008Sci...322...64H
  5. Gradstein, Felix M.; Ogg, J. G.; Smith, A. G. (২০০৪)। A Geologic Time Scale 2004। Cambridge: Cambridge University Press। আইএসবিএন 0521786738।
  6. "Fossil tracks record 'oldest land-walkers'", BBC News.
  7. বিলুপ্তির হার না বাড়লে তো মহাবিলুপ্তি হয় না!
  8. "International Chronostratigraphic Chart"। International Commission on Stratigraphy। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১২
  9. Age of Fishes Museum
  10. Joachimski, M. M.; Breisig, S.; Buggisch, W. F.; Talent, J. A.; Mawson, R.; Gereke, M.; Morrow, J. R.; Day, J.; Weddige, K. (২০০৯)। "Devonian climate and reef evolution: Insights from oxygen isotopes in apatite"। Earth and Planetary Science Letters284 (3–4): 599–596। ডিওআই:10.1016/j.epsl.2009.05.028বিবকোড:2009E&PSL.284..599J - কনোডন্ট অ্যাপাটাইট থেকে প্রাপ্ত প্রাচীন তাপমাত্রার রেখাচিত্র ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে
  11. "Devonian Paleogeography"। ২১ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

বহিঃসংযোগ

প্যালিওজোয়িক মহাযুগ
ক্যাম্ব্রিয়ান অর্ডোভিশিয়ান সিলুরিয়ান ডেভোনিয়ান কার্বনিফেরাস পার্মিয়ান
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.