ঠাট
ঠাট বা মেল হচ্ছে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক ধরনের সাঙ্গীতিক প্রকাশ যা মূলতঃ রাগ সঙ্গীতকে শ্রেণীবদ্ধ করেছে। ঠাট এক বিশেষ শ্রেণীর স্বর সমগ্র। প্রতিটি ঠাটই ভিন্ন ভিন্ন শুদ্ধ ও বিকৃত সুরের সমন্বয়ে গঠিত। একটি সপ্তকের ১২টি ঘরের মধ্যে ৭টি করে স্বর নিয়ে এক-একটি ঠাট গঠিত হয়েছে।
মেল স্বরসমূহঃ স্যাদ্রাগব্যঞ্জন শক্তিমান্।
— অভিনব রাগমঞ্জরী
[1]:৬৮
মেল স্বর-সমূহের এক বিশিষ্ট রচনা যার থেকে উৎপন্ন হয়।
ঠাটের নিম্নলিখিত বিশিষ্টগুলি উল্লেখযোগ্য:[1]:৬৮
- ঠাটের স্বর-সংখ্যা হবে সাতটি।
- সাতটি স্বরই হবে ক্রমানুসারে, যেমন—সা রে গ ম প ধ নি।
- ঠাটে কেবলমাত্র আরোহ হয়।
- একই ঠাটে শুদ্ধ ও বিকৃত স্বর পাশাপাশি ব্যবহৃত হয় না।
- ঠাট রচনায় রঞ্জকতা না থাকলেও চলে।
- ঠাট গাওয়া যায় না।
একটি ঠাটের অধীনে অনেকগুলো রাগ থাকে।
অপর দিকে এই সাতটি শুদ্ধ স্বর এর মধ্যে ৫টি স্বর এর বিকৃত রূপ রয়েছে:
র → ঋ (কোমল রে)
গ → জ্ঞ (কোমল গা)
ম → হ্ম (তীব্র/কড়ি মা)
ধ → দ (কোমল ধা)
ন → ণ (কোমল নি)
পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে (১৮৬০-১৯৩৬) বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগ সমূহকে দশটি ঠাট বা শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেছেন । মোটামুটিভাবে এই শ্রেণী বিভাজনই সর্বজন গৃহীত। এই রাগ-রাগিনী নিম্নলিখিত ১০টি মুখ্য ঠাটের উপরেই বিভাজিত।
জনক ঠাট কাকে বলে?
সকল ঠাট থেকেই রাগ উৎপন্ন হতে পারে না। মুষ্টিমেয় কয়েকটি মাত্র ঠাট থেকে রাগ উৎপন্ন হয় এবং রাগ উৎপাদক সেই বিশেষ ঠাটগুলিকে বলা হয় জনক ঠাট।[1]:৬৮ হিন্দুস্তানি সংগীতে প্রচলিত ১০টি ঠাটকেই জনক বলা চলে।
পণ্ডিত ব্যঙ্কটমুখীর ৭২টি ঠাট
দাক্ষিণাত্যের পণ্ডিত ব্যঙ্কটমুখী তাঁর ‘চতুর্দশী প্রকাশিকা’ গ্রন্থে গণিতশাস্ত্রের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে ১২টি স্বর থেকে মোট ৭২টি ঠাট উৎপন্ন হতে পারে।[1]:৬৯ প্রথমতঃ তিনি সা, ঋা, রা, জ্ঞা, মা, হ্মা, পা, দা, ধা, ণা, না—এই ১২টি স্বর থেকে তীব্র-মধ্যম বাদ দিয়ে তার-ষড়জ অন্তর্ভুক্ত করে ১২টি স্বর নিয়েছেন এবং ৬টি করে এগুলি পূর্বাঙ্গ ও উত্তরাঙ্গ এই দুইভাগে বিভক্ত করেছেন,[1]:৬৯ যেমন—
পূর্বাঙ্গ | উত্তরাঙ্গ |
---|---|
সা ঋা রা জ্ঞা গা মা | পা দা ধা ণা না সা |
- প্রতি অর্ধের ৪টি স্বর নিয়ে তিনি ৬টি করে combination স্থির করেছেন।
- এখন পূর্বার্ধ এবং উত্তরার্ধ—দুইটিকে একত্রিত করলে দেখা যাবে ৬ × ৬ = ৩৬টি ঠাট হয়েছে।
- এবার উত্তরাঙ্গকে একই প্রকার রেখে পূর্বাঙ্গের শুদ্ধ-মধ্যমের স্থানে তীব্র-মধ্যম বসিয়ে দিলে উপরিউক্ত-ভাবে আরও ৩৬টি ঠাট হবে। অতএব এই উপায়ে মোট সংখ্যা হবে ৩৬ + ৩৬ = ৭২।
৭২টি ঠাটের মধ্যে ব্যঙ্কটমুখী মাত্র ১৯টি ব্যবহার করেছেন।[1]:৭০
হিন্দুস্তানী সংগীতে ৩২ ঠাট
পণ্ডিত ব্যঙ্কটমুখীর পদ্ধতি অনুসরণ করে উত্তর ভারতীয় সংগীতে ঠাটের সংখ্যা হয়েছে ৩২। এখানে ব্যঙ্কটমুখীর মত একই স্বরের শুদ্ধ ও বিকৃত রূপকে পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়নি। এখানেও সপ্তকের উত্তরাঙ্গ ও পূর্বাঙ্গ—এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, এবং প্রথমে তীব্র-মধ্যমকে বাদ দেওয়া হয়েছে।[1]:৭০
পূর্বাঙ্গ | উত্তরাঙ্গ |
---|---|
সা ঋা রা জ্ঞা গা মা | পা দা ধা ণা না সা |
- ৪টি করে স্বর নিয়ে প্রতি অর্ধে হয়েছে চারটি করে combination।
- এবারে পূর্বোক্ত নিয়মে দু’টি অর্ধের combination-এ পাওয়া যায় ৪ × ৪ = ১৬টি ঠাট। এরপর শুদ্ধ-মধ্যমের স্থানে তীব্র-মধ্যম বসিয়ে দিলে হাটের সংখ্যা হবে আরও ১৬টি। তাহলে মোট ঠাটের সংখ্যা হবে পণ্ডিত ভাতখণ্ডে এই ৩২টি ঠাট থেকে সুবিধার জন্য মাত্র ১০টি ঠাটের প্রচলন করেছেন।[1]:৭১
প্রথম বর্গ | কল্যাণ | ঋষভ, গান্ধার ও ধৈবত শুদ্ধ |
বিলাবল | ||
খাম্বাজ | ||
দ্বিতীয় বর্গ | ভৈরব | ঋষভ কোমল এবং গান্ধার ও নিষাদ শুদ্ধ |
পূর্বী | ||
মারোয়া | ||
তৃতীয় বর্গ | কাফী | গান্ধার ও নিষাদ কোমল |
ভৈরবী | ||
আশাবরী | ||
তোড়ী |
[1]:৭১
তথ্যসূত্র
- শম্ভুনাথ ঘোষ। সংগীতের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড। ৯, শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট, কলকাতা: আদি নাথ ব্রাদার্স। পৃষ্ঠা ৬৮–৭১।