টাঙ্গুয়ার হাওর

টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত একটি হাওর। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এ হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি ।[2] স্থানীয় লোকজনের কাছে হাওরটি নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত।[3] এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার স্থান হিসাবে পরিচয়, প্রথমটি সুন্দরবন

উপাধি
প্রাতিষ্ঠানিক নামটাঙ্গুয়ার হাওর
অন্তর্ভুক্তির তারিখ১০ জুন ২০০০
রেফারেন্স নং১০৩১[1]
কয়েকজন ছাত্রী টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকা দিয়ে যাচ্ছে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে গোধূলির দৃশ্য।
সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর—বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ জলাভূমি এবং দর্শনীয় স্থান।

অবস্থান ও পরিচিতি

টাঙ্গুয়ার হাওর

টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশাতাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরা (ঝরনা) এসে মিশেছে এই হাওরে। দুই উপজেলার ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওরের সমন্বয়ে ৯,৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি। পানিবহুল মূল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার এবং বাকি অংশ বসতি ও কৃষিজমি। একসময় গাছ-মাছ-পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের আধার ছিল এই হাওর। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গুয়ার হাওরকে 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তখনই অবসান হয় দীর্ঘ ৬০ বছরের ইজারাদারির। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে ২০ জানুয়ারি এই হাওরকে 'রামসার স্থান' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আইসিইউএন এই হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করছে। হাওর এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে ১২ ফেব্রুয়ারি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ নভেম্বর থেকে হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। সুইস অ্যাজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন (এসডিসি) এবং আইসিইউএন ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে 'টাঙ্গুয়ার হাওর সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা' প্রকল্প পরিচালনা করছে।[4]

শীত মৌসুমে পানি শুকিয়ে কমে গেলে এখানকার প্রায় ২৪টি বিলের পাড় (স্থানীয় ভাষায় কান্দা) জেগে উঠলে শুধু কান্দার ভিতরের অংশেই আদি বিল থাকে, আর শুকিয়ে যাওয়া অংশে স্থানীয় কৃষকেরা রবিশস্যবোরো ধানের আবাদ করেন। এ সময় এলাকাটি গোচারণভূমি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বর্ষায় থৈ থৈ পানিতে নিমগ্ন হাওরের জেগে থাকা উঁচু কান্দাগুলোতে আশ্রয় নেয় পরিযায়ী পাখিরা রোদ পোহায়, জিরিয়ে নেয়। কান্দাগুলো এখন (২০১২) আর দেখা যায় না বলে স্থানীয় এনজিও ও সরকারি ব্যবস্থাপনায় সেখানে পুঁতে দেয়া হয়েছে বাঁশ বা কাঠের ছোট ছোট বিশ্রাম-দণ্ড।

জীববৈচিত্র্য

পাখি‌

টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন জাতের পাখি। স্থানীয় জাতের পাখি ছাড়াও শীতকালে, সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পরিযায়ী পাখিরও আবাস এই হাওর। ২০১৯ সালের পাখিশুমারি অনুযায়ী হাওর ও এর আশপাশের এলাকায় ২০৮ প্রজাতির পাখি দেখা গেছে।[5] পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক রয়েছে এই হাওরে। স্থানীয় জাতের মধ্যে শকুন, পানকৌড়ি, বেগুনি কালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস, কাক, শঙ্খ চিল, পাতি কুট (এই হাওরের ২৮-২৯%)[2] ইত্যাদি পাখির নিয়মিত বিচরণ এই হাওরে। এছাড়া আছে বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি কুড়ুল (বাংলাদেশে এর নমুনাসংখ্যা ১০০টির মতো)। ২০১১-এর পাখিশুমারিতে এই হাওরে চটাইন্নার বিল ও তার খাল, রোয়া বিল, লেচুয়ামারা বিল, রুপাবই বিল, হাতির গাতা বিল, বেরবেরিয়া বিল, বাইল্লার ডুবি, তেকুন্না ও আন্না বিলে প্রায় ৪৭ প্রজাতির জলচর পাখি বা ওয়াটারফাউলের মোট ২৮,৮৭৬টি পাখি গণনা করা হয়। এই শুমারিতে অন্যান্য পাখির পাশাপাশি নজরে আসে কুট, মরচেরং ভুতিহাঁস, পিয়ংহাস; সাধারণ ভুতিহাঁস, পান্তামুখী বা শোভেলার, লালচে মাথা ভুতিহাঁস, লালশির, নীলশির, পাতিহাঁস, লেনজা, ডুবুরি, পানকৌড়ি ইত্যাদি পাখিও।[2] প্রতি বছরই টাঙ্গুয়ায় সমগ্র দেশের মধ্যে সবচেয়ে বিরল কয়েক জাতের পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে বৈকাল তিলিহাঁস, বেয়ারের ভুঁতিহাস এবং কালোলেজ জৌরালি। বাংলাদেশে দৃশ্যমান আটটি বেয়ারের ভুঁতিহাসের পাঁচটিই পাওয়া গেছে টাঙ্গুয়ায়। বিরল প্রজাতির পাখিদের মধ্যে আরো আছে কালোপাখা টেঙ্গি, মোটাঠুঁটি ফাটানো, ইয়ার, মেটে রাজহাঁস, মাছমুরাল, লালবুক গুরগুরি, পাতি লালপা, গেওয়াল বাটান, লম্বা আঙুল চা পাখি, বড় গুটি ঈগল, বড় খোঁপা ডুবুরি, কালো গির্দি প্রভৃতি।[6]

সরীসৃপ ও উভচর

টাঙ্গুয়ার হাওর ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২০ প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির উভচর, ৪ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটিসহ নানাবিধ প্রাণীর আবাস। বিলুপ্ত কাছিমের মধ্যে রয়েছে হলুদ কাছিম, কড়ি কাইট্টা ও পুরা কাইট্টা। তবে বর্তমানে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে জাত কাছিম ও ধুম কাছিম।[7] মার্বেল টোড ব্যাং (বৈজ্ঞানিক নাম Duttaphrynus stomaticus) বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে বিরল হলেও টাঙ্গুয়ায় সহজপ্রাপ্য। এছাড়া রয়েছে ঝিঁঝিঁ ব্যাং ও সারসারি ব্যাং।[8] সাপের মধ্যে আছে জালবোরা, কোবরার দুটি জাত ও দাঁড়াশ সাপ[9]

অধ্যাপক আলী রেজা খান-এর বর্ণনানুযায়ী এই হাওরে সব মিলিয়ে প্রায় ২৫০ প্রজাতির পাখি, ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২'র বেশি প্রজাতির ব্যাঙ, ১৫০-এর বেশি প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১০০০-এরও বেশি প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণীর আবাস রয়েছে। (পরিপ্রেক্ষিত: জানুয়ারি ২০১২)[2]

মৎস্যসম্পদ

টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এ হাওরের বিখ্যাত মাছের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় মহাশোলের কথা। মাছটির দুটো প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম যথাক্রমে Tortor এবং Torputitora, টাঙ্গুয়ার হাওরে দুই প্রজাতিই পাওয়া যেত।[10]

উদ্ভিদবৈচিত্র্য

টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে হিজল, করচ, বরুণ, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলসী, নলখাগড়া, বল্লুয়া, চাল্লিয়া, সিংড়া, শালুক, শাপলা, গুইজ্জাকাঁটা, উকল ইত্যাদি।[11]

হাওর ঘিরে অপরাধ

২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরটি জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আছে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশআনসার সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকে। সেখানে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। তবে স্থানীয় প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এক শ্রেণির অসাধু লোক চুরি করে মাছ ও পাখি শিকার করে এবং তারা মাঝে মাঝে ধরাও পড়ে। রাতের বেলায় টর্চ জ্বালিয়ে পাখি শিকার করে বলে অভিযোগ উঠেছে।[10][12]

চিত্রশালা

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. "Tanguar Haor"Ramsar Sites Information Service। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৪-২৫
  2. পরিযায়ী পাখির চারণভূমি: নাম যার টাঙ্গুয়ার হাওর ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১৫-১০-২৬ তারিখে, রেজা খান (বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ), সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র অন্য আলো, দৈনিক প্রথম আলো, ঢাকা থেকে প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৩ জানুয়ারি ২০১২; সংগ্রহের তারিখ: ১৩ জানুয়ারি ২০১২ খ্রিস্টাব্দ।
  3. ইতিহাস-ঐতিহ্য: "নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল", শাহ দিদারুল আলম; রকমারি, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন; পৃষ্ঠা ৫; ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১১; পরিদর্শনের তারিখ: ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১১।
  4. কাইয়ুম, আব্দুল (২০১৯). টাঙ্গুয়ার হাওর: জীববৈচিত্র্যের জীবন্ত মডেল. মহাবৃত্ত (সংখ্যা ৪), ঢাকা
  5. কাইয়ুম, আব্দুল (২০১৯). টাঙ্গুয়ার হাওর: জীববৈচিত্র্যের জীবন্ত মডেল. মহাবৃত্ত (সংখ্যা ৪), ঢাকা
  6. কাইয়ুম, আব্দুল (২০১৯). টাঙ্গুয়ার হাওর: জীববৈচিত্র্যের জীবন্ত মডেল. মহাবৃত্ত (সংখ্যা ৪), ঢাকা
  7. কাইয়ুম, আব্দুল (২০১৯). টাঙ্গুয়ার হাওর: জীববৈচিত্র্যের জীবন্ত মডেল. মহাবৃত্ত (সংখ্যা ৪), ঢাকা
  8. কাইয়ুম, আব্দুল (২০১৯). টাঙ্গুয়ার হাওর: জীববৈচিত্র্যের জীবন্ত মডেল. মহাবৃত্ত (সংখ্যা ৪), ঢাকা
  9. কাইয়ুম, আব্দুল (২০১৯). টাঙ্গুয়ার হাওর: জীববৈচিত্র্যের জীবন্ত মডেল. মহাবৃত্ত (সংখ্যা ৪), ঢাকা
  10. আশীষ-উর-রহমান (২২ জুলাই ২০১০)। "হাওরে মহাশোল!"দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা। ২০১৯-১০-২১ তারিখে মূল (ওয়েব) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ৬, ২০১০
  11. কাইয়ুম, আব্দুল (২০১৯). টাঙ্গুয়ার হাওর: জীববৈচিত্র্যের জীবন্ত মডেল. মহাবৃত্ত (সংখ্যা ৪), ঢাকা
  12. "টাঙ্গুয়ার হাওর শিকারির খপ্পরে অতিথি পাখি"দেশ রূপান্তর

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.