ঝুমুর গান
ঝুমুর গান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড ও উড়িষ্যা রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রচলিত লোকগীতি বিশেষ।
বাংলা-এর সঙ্গীত | |
---|---|
ধরন | |
| |
নির্দিষ্ট ধরন | |
ধর্মীয় সঙ্গীত | |
জাতিগত সঙ্গীত | |
ঐতিহ্যবাহি সঙ্গীত | |
মিডিয়া এবং কর্মক্ষমতা | |
সঙ্গীত মিডিয়া | বেতার
টেলিভিশন ইন্টারনেট |
অঞ্চল
ঝুমুর গান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা; ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগণা, সিংভূম, রাঁচি, হাজারিবাগ, পালামৌ, গিরিডি, ধানবাদ ও বোকারো জেলা এবং উড়িষ্যা রাজ্যের ময়ূরভঞ্জ, সুন্দরগড়, কেঁওনঝাড় ও সম্বলপুর জেলা ইত্যাদি এক বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচলিত।[1]:৩
প্রাচীনত্ব
ঝুমুর গানের প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে খুব একটা তথ্য পাওয়া যায় না, তবে সাহিত্যরত্ন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতে এই গান প্রায় হাজার বছর ধরে চলে আসছে। তার মতে ঝুমুরের সঙ্গে কীর্তন মিশে পরবর্তীকালে যাত্রার উদ্ভব ঘটেছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার পশ্চিম সীমান্তবঙ্গের লোকগীতি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে মধ্যযুগে ঝুমুর শব্দের প্রচলন ছিল। মধ্যযুগের পদকল্পতরু গ্রন্থের একটি পদে লেখা রয়েছে, 'যুবতী যুথ শত গায়ত ঝুমরী'। বিদ্যাপতি তার পদাবলীতে লিখেছেন, 'গওই সহি লোরি ঝুমরি সঅন - আরাধনে যাঞা'। গোবিন্দদাসের পদেও পাওয়া যায়, 'মদনমোহন হরি মাতল মনসিজ যুবতী যুথ গাওত ঝুমরী।'[1]:৩
ইতিহাস
পূর্বে ঝুমুর গানগুলি মুখে মুখে রচিত হত, দাঁড় নাচের গান হিসেবে ব্যবহৃত হত[n 1] এবং কোন ভণিতা বা পদকর্তার উল্লেখ থাকতো না। কিন্তু চৈতন্য পরবর্তী যুগে ভণিতাযুক্ত ঝুমুরের সূচনা হয়[1]:৫ এবং ধীরে ধীরে নৃত্যে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ হলে পুরুষদের মহিলা সেজে দাঁড় নাচে অংশগ্রহণের প্রচলন শুরু হয়।[1]:৬ এই সময় ঝুমুর গানের ওপর ভিত্তি করে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও কীর্তনের সুরে নাচনী নাচ ও দরবারী ঝুমুরের প্রচলন হয়। এই সময়ের ঝুমুরে পুরাণকাহিনি, সহজিয়া বাউলতত্ত্ব এবং রাধা কৃষ্ণের প্রেম বিষয়ক বৈষ্ণব ভক্তিতত্ত্ব স্থান পায়।[1]:৮ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী ঝুমুর গান বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার ওপর রচিত হওয়া শুরু হয়।[1]:১১
বৈশিষ্ট্য
নৃত্য, গীত ও বাদ্য সহযোগে ঝুমুর গাওয়া হলেও এতে গীতের প্রাধান্য থাকে। গানের সুর উচ্চগ্রাম থেক নিম্নগ্রামে অবরোহণ করা হয়, যা ঝুমুরের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তালকে অগ্রাহ্য করে মাত্রা অনুসরণ করে সুর দেওয়া হয়। সম থেকে শুরু না করে ফাঁক থেকে গান শুরু করা হয়।[3]:৩০২ সাধারণতঃ সমঝদারের আসর ও নাচের আসর এই দুই জায়গায় ঝুমুর গাওয়া হয়। সমঝদারের আসরে বৈঠকী, ছুট ও পালাবদ্ধ ঝুমুর গাওয়া হয়। বৈঠকী ঝুমুরে গায়ক একজন, কোন নাচ থাকে না এবং বাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় হারমোনিয়াম ও পাখোয়াজ। ছুট ঝুমুর নাচ, গান, বাজনা সহযোগে একটি পূর্ণাঙ্গ ঝুমুর। পালা ঝুমুর একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গাওয়া হয়। নাচের আসরে নাচ, গান, বাজনা সহযোগে একটি পূর্ণাঙ্গ ঝুমুর গাওয়া হয়। এই আসরে রসক্যা বা রসিক সহযোগে নাচনী নাচ হয়ে থাকে।[3]:৩০৩ ঝুমুরকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু সুর ও তালের প্রচলন হয়েছিল, যার মধ্যে অধিকাংশের অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। তবে ডহরওয়া, পতরতুলা, বেঁগাড়ি, পাটিয়ামেধা, রিঁঝামাঠা, ঝুমরা, ঝুমটা, একডাঁড়িয়া, গোলোয়ারি, নাগপুরিয়া, তামাড়িয়া, শিখারিয়া, পাঁচপরগণিয়া, মুদিআরি প্রভৃতি সুরের অস্তিত্ব বর্তমানে রয়েছে।[1]:৬
বিভক্তি
বিষয়বস্তু ও রচনার বৈশিষ্ট্য অনুসারে ঝুমুর গানকে নানা ভাগে বিভক্ত করা হয়।[3]:৩০২-৩০৩
বিভক্তি | বৈশিষ্ট্য | উদহারণ |
---|---|---|
মার্জিত ভাষায় রচিত | বিষয়বস্তু দেহতত্ত্ব, কৃষ্ণলীলা, পুরাণ ইত্যাদি; পয়ার বা ত্রিপদী ছন্দে রচিত; চারটি কলি; ধুঁয়া, রঙ ও ভণিতাযুক্ত | দরবারী বা বৈঠকী ঝুমুর |
লৌকিক | কলির সংখ্যা তিন বা তিনের কম; সুরবৈচিত্র্য নেই; আকস্মিক আবেগে রচিত | টাঁড়, উধোয়া, ডমকচ, ডহরিয়া, দাঁড় প্রভৃতি |
সুর, তাল, নৃত্য অনুসরণ করে ঝুমুর | -- | বাউলছোঁয়া, ঢুয়া, কীর্তনছোঁয়া, দাঁড়শালিয়া, খেমটি, আড়হাইয়া প্রভৃতি |
ঋতু অনুসারে | -- | ভাদরিয়া, চৈতারি, আষাঢ়ি, বারমেসা প্রভৃতি |
অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যানুসারে | -- | বরাবাজারিয়া, বাগমুড়্যা, ঝালদোয়া, সিলিয়াড়ি, গোলায়ারি, তামাড়িয়া প্রভৃতি |
জাতি অনুসারে | -- | কুড়মালি, মুণ্ডারি প্রভৃতি |
পাদটীকা
- দাঁড়নাচের দাঁড়শালিয়া ঝুমুর এই ভাদরিয়া। দাঁড় নাচ সমবেত নৃত্য। যা অঙ্গে অঙ্গে জড়িয়ে হাতে হাত ধরাধরি করে নাচতে হয়। পরস্পর হাত ধরাধরি করে নাচে তাই এখানে কোন মুদ্রা প্রদর্শনের সুযোগ থাকে না। দাঁড় নাচ বা ভাদরিয়া ঝুমুর রাঢ় বাংলার প্রাণস্বরূপ। আদিকালে নাচটিতে মেয়েরা নাচত আর পুরুষরা বাজাতো। এই চলন বা প্রথা ৪০/৫০ বছর আগে পর্যন্ত বর্তমান ছিল।............সারা রাত্রি পুরুষদের বাজনায় অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে ঝুমুর খেলে ভোরবেলায় বাড়ি ফিরত।[2]
তথ্যসূত্র
- ঝুমুর কথা - ঝুমুর গীতি সংগ্রহ, ইস্টার্ন জোনাল কালচারাল সেন্টার, সাহায্যেঃ গ্রাম উন্নয়ন মন্ত্রক, ভারত সরকার; পঞ্চায়েত ও গ্রাম উন্নয়ন বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার; তথ্য ও সাংস্কৃতিক বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
- হরিধন মাহাতো, আদিরসকলা ঝুমুর পদাবলী
- তরুণদেব ভট্টাচার্য, পুরুলিয়া,ফার্মা কে এল প্রাইভেট লিমিটেড, ২৫৭-বি, বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট, কলকাতা-১২, ২০০৯