জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সিবিই,এফআরএসসি (২৩ এপ্রিল, ১৮৯৩ - ১০ মে, ১৯৮৩), রসায়ন বিজ্ঞানের কলয়েড বিভাগের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় বাঙালি রসায়নবিদ।[1]

জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
জন্ম(১৮৯৩-০৪-২৩)২৩ এপ্রিল ১৮৯৩
মহাদেবপুর, রাজশাহী, ব্রিটিশ ভারত,(বর্তমানে বাংলাদেশ)
মৃত্যু১০ মে ১৯৮৩(1983-05-10) (বয়স ৯০)
কলকাতা, ভারত
জাতীয়তাভারতীয়
মাতৃশিক্ষায়তনকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
পরিচিতির কারণবাউন্ডারী মেথড
পুরস্কারপদ্মভূষণ
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
ডক্টরাল শিক্ষার্থীবরদানন্দ চট্টোপাধ্যায়

প্রারম্ভিক জীবন

জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার মহাদেবপুর গ্রামে। তার পিতা দুর্গাদাস মুখোপাধ্যায় ছিলেন বরিশালের রাজচন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ। মাতার নাম সরস্বতী দেবী। তিনি তাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন। মাত্র বারো বছর বয়সে জ্ঞানেন্দ্রনাথের পিতার মৃত্যু হয়। ছোট ভাইয়ের সাথে তিনি একসাথে পড়াশোনা করেন।[2]

শিক্ষাজীবন

১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে জ্ঞানেন্দ্র নাথ বর্ধমানের মিউনিসিপাল হাই স্কুল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জেলা বৃত্তি লাভ করেন। জ্ঞানেন্দ্র নাথ প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন (১৯০৯-১৯১৫)। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে বিএসসি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজ -এ স্নাতকোত্তর পড়াশোনার পর ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে এমএসসি ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি পেয়েছিলেন। এমএসসি ছাত্রবস্থায় লিখিত তার প্রথম কোলাইড সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালে (১৯১৫,৩৯, ২৯২) প্রকাশিত হয়েছিল।[2]

একাডেমিক এবং গবেষণায় সাফল্য

কলয়েড বিজ্ঞান স্কুল

অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় কলয়েড নিয়ে প্রথম গবেষণার কাজটি স্বাধীনভাবে করেছিলেন, যখন তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের এমএসসি ছাত্র ছিলেন এবং তার এই গবেষণা ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এবং জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ অধ্যাপক এফজি ডনাননের অধীনে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের ভৌত রসায়ন পরীক্ষাগারে যোগ দেন। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় সেখানে কলয়েড নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান এবং তার প্রধান কাজটি ছিল বৈদ্যুতিন ডাবল স্তর এবং এর আয়নিক গঠন তত্ত্বটির সত্যতা প্রকাশ করা। জে এন মুখোপাধ্যায়ের তড়িৎরসায়ন বিদ্যায় কোলয়েড সংক্রান্ত কাজ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। কোলয়েড কণার ক্যাটাফোরেটিক গতি নির্ধারণের জন্য তিনি যে বাউন্ডারী মেথড বা সীমানা পদ্ধতিটি স্থির করেছিলেন সেজন্যও তিনি সুপরিচিত।[2]

মৃত্তিকা বিজ্ঞানের স্কুল

ডাঃ মুখার্জি মৃত্তিকার কোলয়েড অধ্যয়নের মাধ্যমে মাটির অনেক বৈশিষ্ট্য এবং সমস্যা সম্পর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। বছরের পর বছর ধরে গবেষণায় লিপ্ত থেকে তিনি যে সমস্ত সরঞ্জাম ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন সেগুলি মৃত্তিকা গবেষণায় ব্যবহা্রের কাজে এসেছে।[2] ১৯৪২ সালে, এনসি সেন গুপ্তের সাথে, মিলিত ভাবে তিনি অসাধারণ সান্দ্র গুণ বা বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের জন্য সাধারণ ঘূর্ণমান ভিস্কোমিটার তৈরি করেন। ১৯৪৪ সালে, তিনি ক্রোমাটোগ্রাফি কৈশিক বিশ্লেষণ এবং আল্ট্রা ভায়োলেট আলোকের ফ্লুরোসেন্সের উপর ভিত্তি করে অপরিশোধিত তেলের গুণাগুণ স্থির করার পদ্ধতিটি তৈরি করেন।[3]

কৃষি গবেষণা উন্নয়ন

মৃত্তিকা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রণী অবদানের পাশাপাশি ড। মুখার্জি দেশে কৃষি গবেষণা ও শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূরণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৪৫ সালে ভারতের কৃষি সংক্রান্ত মূল গবেষণা কেন্দ্র (বর্তমানে ভারতীয় কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, নয়াদিল্লি) এর অধিকর্তা নিযুক্ত হওয়ার পরপর ড। মুখার্জি সারা দেশে ইনস্টিটিউটের গবেষণা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমের পুনর্গঠন শুরু করেন। তার নির্দেশনায় ইনস্টিটিউট এর একাডেমিক কার্যক্রম এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও কাজকর্মের ক্ষেত্র যথেষ্ট প্রসারিত হয়েছিল। তিনি মৃত্তিকা-উদ্ভিদ অধ্যয়নের ক্ষেত্রে গবেষণা শুরু করেছিলেন। মৃত্তিকা বিজ্ঞান ও কৃষি রসায়ন বিভাগে তিনি যে কয়েকটি বিভাগ তৈরি করেছিলেন সেগুলির হ'ল - মৃত্তিকা সমীক্ষা,্মৃত্তিকা পদার্থবিজ্ঞান, কৃষি রসায়ন, মাটির উর্বরতা, মাটি মাইক্রোবায়োলজি, জৈব রসায়ন, জৈব রসায়ন এবং স্পেকট্রোস্কোপি। মাটি জরিপ, মাইক্রোবায়োলজি, জৈব রসায়ন, কৃষি রাসায়নিক, কৃষি পদার্থবিজ্ঞানের মতো কয়েকটি বিভাগের সাম্প্রতিক সম্প্রসারণ তার কাছে জমা হয়েছিল। মৃত্তিকা এবং উদ্ভিদে ক্ষুদ্র উপাদানসমূহের জন্য এবং অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে এবং আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে মাটির মৃত্তিকা খনিজবিজ্ঞানের উপর নিয়মিত পদ্ধতিগত গবেষণা শুরু করার কৃতিত্ব তারই। তিনি ইনস্টিটিউটে খাবার, ফিড এবং চারণের পুষ্টিকর মূল্য, কীটনাশক এবং ছত্রাকনাশক এবং উদ্ভিদের পণ্যগুলির রসায়নের বিষয়ে ইনস্টিটিউটে কাজ শুরু করেছিলেন। তিনিই দেশের প্রথম ব্যক্তি যিনি কৃষির বিকাশের জন্য মাটি জরিপের গুরুত্বের উপর অত্যন্ত জোর দিয়েছিলেন এবং ভারতের মাটির জরিপ, শ্রেণিবদ্ধকরণ এবং নামকরণের পদ্ধতির উপর গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। তার পরামর্শে ভারত সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়, মৃত্তিকা বিজ্ঞান সংক্রান্ত কমিটি গঠন করে এবং ১৯৪৯ সালে তিনিই হন ওই কমিটির চেয়ারম্যান। কমিটির শর্তাবলী এবং উদ্দেশ্যগুলি ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত নিখিল ভারত মাটি ও ভূমি ব্যবহার জরিপ সংস্থার ৪ টি আঞ্চলিক কেন্দ্রের লক্ষ্যগুলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। ভারতের মাটির মানচিত্রটি তার প্রদর্শিত (স্কেল ১"- ৭০ মাইল) হিসাবে ১৯৫৪ সালে ২০ টি শ্রেণীতে সংশোধিত আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ভারতের মাটির শ্রেণিবিন্যাসে মৌলিক মৃত্তিকার অনুরূপ বৈশিষ্ট্য যেমন, জলবায়ু, টোগোগ্রাফি, উদ্ভিদ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে মৌলিক ধারনাটি তৈরি করেছিলেন।[2]

কৃষিবিজ্ঞান শিক্ষা

অধ্যাপক মুখার্জি ভারতীয় কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট,(আইএআরআই) কে একটি নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে,কৃষি গবেষণা ও শিক্ষা বিষয়ক ইন্দো-আমেরিকান টিমের সুপারিশ এবং রকফেলার ফাউন্ডেশনের উদার সহায়তায়, স্নাতকোত্তর স্তরের স্কুল ভারত সরকারের এই ইনস্টিটিউটে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখন ইনস্টিটিউটটি ১৯৫৬ সালের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আইন মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করেছে।[2]

অলঙ্কৃত পদসমূহ

অধ্যাপক মুখার্জী তার উজ্জ্বাল কর্মজীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। যেমন -

  • রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়,
  • "ভারতীয় কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক";
  • সেন্ট্রাল বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট,রুরকি
  • অংশকালীন বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা, কৃষি বিভাগ, পশুপালন, সেচ, বন, সম্প্রদায় উন্নয়ন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ;
  • প্রশাসক, পশ্চিমবঙ্গ মধ্য শিক্ষা পর্ষদ, পশ্চিমবঙ্গ;
  • সদস্য, ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন;
  • সভাপতি,পশ্চিমবঙ্গের স্টেট কলেজ অফ এগ্রিকালচার ;
  • সভাপতি,ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশন;
  • সভাপতি, ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি;
  • সভাপতি, ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ সয়েল সায়েন্স ;
  • সভাপতি, বিজ্ঞানের চাষাবাদ সম্পর্কিত ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ;
  • প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক, ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি,
  • সভাপতি, ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশন ;
  • সভাপতি, মাটি ও জল সংরক্ষণের ইন্ডিয়ান সোসাইটি;
  • সহ-সভাপতি,ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট;
  • সদস্য, ফাউন্ডেশন কমিটি;
  • ফেলো, ভারতীয় বিজ্ঞান একাডেমী;
  • ফেলো, এশিয়াটিক সোসাইটি ;
  • আজীবন সদস্য, কেমিক্যাল সোসাইটি,লন্ডন
  • সদস্য, সাধারণ পরিষদ, আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক ইউনিয়ন পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটি * চেয়ারম্যান, রফতানি সার কমিটি ;
  • চেয়ারম্যান, হোমিওপ্যাথিক তদন্ত কমিটি ;
  • চেয়ারম্যান, গবেষণা কমিটি, কৃষি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার;
  • চেয়ারম্যান ভূমি ব্যবহার বোর্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার;
  • চেয়ারম্যান, গবেষণা কমিটি, সিএসআইআর;
  • সদস্য, কারিগরি কমিটি এবং বোর্ড, সিএসআইআর ;
  • সদস্য, সিনেট এবং অ্যাকাউন্ট অফ বোর্ড, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়;
  • সচিব(বিজ্ঞান), পুনর্গঠন কমিটি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়;
  • চেয়ারম্যান, আইসিএআর এর বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক কমিটি ;
  • ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতা : (i) ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অফ সোয়েল সায়েন্সের ষষ্ঠ কমিটি, হল্যান্ড (ii) আন্তর্জাতিক সোয়েল সায়েন্সের তৃতীয় কংগ্রেস, অক্সফোর্ড (iii) ইম্পেরিয়াল এগ্রিকালচারাল ব্যুরো রিভিউ কনফারেন্স, লন্ডন ; সদস্য, সরকারের বৈজ্ঞানিক মিশন ভারত থেকে যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় ;
  • সদস্য, রয়্যাল সোসাইটি এম্পায়ার সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ব্রিটিশ কমনওয়েলথ অফিসিয়াল সায়েন্টিফিক কনফারেন্স, লন্ডনের ভারতীয় প্রতিনিধি; সংস্থান সংরক্ষণ এবং ব্যবহারের বিষয়ে ইউনাইটেড জাতীয় বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধি, লেক সাকসেস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র;
  • সদস্য, প্যান ইন্ডিয়ান ওশান সায়েন্টিফিক অ্যাসোসিয়েশন, পার্থ, অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় কংগ্রেসে ভারতীয় প্রতিনিধি ;
  • ক্রান্তীয় এবং subtropical মৃত্তিকা, রথহ্যামস্টে সম্মেলনে প্রতিনিধি ;
  • সভাপতি,ট্রাস্টি বোর্ড; সুরেন্দ্রনাথ ট্রাস্ট, কলকাতা।[2]

পুরস্কার এবং সম্মান

তথ্যসূত্র

  1. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ২৫১-২৫২, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  2. "JNANENDRA NATH MUKHERJEE" (PDF)
  3. "NeglectedScience :: Jnanendra Nath Mukherjee"
  4. "Padma Awards" (পিডিএফ)। Ministry of Home Affairs, Government of India। ২০১৬। ১৫ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ জানুয়ারি ২০১৬
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.