জ্ঞানতত্ত্ব

জ্ঞানতত্ত্ব জ্ঞানের[1][2] প্রকৃতি ও পরিধি সংশ্লিষ্ট দর্শনের শাখা। জ্ঞানতাত্ত্বিক অভিযাত্রা মূলত ‘জ্ঞান কি’ এবং ‘কীভাবে এটি অর্জিত হতে পারে’- এ-প্রশ্নগুলো নিয়েই। যেকোনো বিষয় বা সত্তা সম্পর্কে কী মাত্রায় জ্ঞান অর্জন করা যায়- এটা নিয়েও আলোচনা চলে। জ্ঞানের স্বরূপ বা প্রকৃতির দার্শনিক বিশ্লেষণ এবং এটি (জ্ঞানের স্বরূপ) কীভাবে সত্য, বিশ্বাস ও যাচাইকরণ ধারণার সাথে সম্পর্কিত- বেশিরভাগ বিতর্ক এটাকে কেন্দ্র করেই। গ্রিক "epistēmē" ও "logos" শব্দদ্বয়ের সংসক্তিতেই Epistemology শব্দটির উদ্ভব আর এই শব্দেরই বাংলা রূপ, জ্ঞানতত্ত্ব। স্কতিশ দার্শনিক জেমস ফেদারিক ফেরিয়ারের (James Frederick Ferrier) মাধ্যমে Epistemology শব্দটি আলোচনায় এসেছে।

পটভূমি এবং অর্থ

Epistemology শব্দটি জার্মান ধারণা ভাইজেনসাফটসলেহার (Wissenschaftslehre) ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়েছে। হুসার্লের (Husserl) আগে এটি ফিকটে (Fichte) ও বোলযার (Bolzano) ব্যবহার করেছেন। [3] জে. এফ. ফেরিয়ার দর্শনের ‘তত্ত্ববিদ্যা’ শাখার মডেল তৈরি ও জ্ঞানের অর্থ আবিষ্কার করার সময় শব্দটি ব্যবহার করেন। শব্দটি épistémologie (এর ইংরেজি রূপ, 'theory of knowledge) নামে ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, যেটা মূলের চেয়ে অনেকটা সংকীর্ণতর অর্থবাহী। এমিলি মেয়ারসন(Émile Meyerson) তার ‘Identity and Reality’ (১৯০৮) বইয়ে মন্তব্যসহকারে এভাবে বয়ান করেছেন।

জ্ঞান

জ্ঞান কি, জ্ঞান কীভাবে এবং পরিচয়ের মাধ্যমে জ্ঞান

সাধারণত জ্ঞানতত্ত্ব বা জ্ঞানবিদ্যায় জ্ঞানের যে ধরন সচরাচর আলোচনা করা হয় তা বাচনিক জ্ঞান(propositional knowledge), যে ‘জ্ঞান যা’ (knowledge that) হিসেবেও পরিচিত। এটা ‘জ্ঞান কীভাবে’ (knowledge how) ও ‘পরিচয়-জ্ঞান’ (acquaintance-knowledge)এর চেয়ে পৃথক। কিছু দার্শনিক ভাবেন যে, জ্ঞানতত্ত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট ‘জ্ঞান যা’, ‘জ্ঞান কীভাবে’ ও ‘পরিচয়-জ্ঞান’এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। বার্ট্রান্ড রাসেল তার পেপার On Denoting ও পরের বই Problems of Philosophy-এ "knowledge by description" ও "knowledge by acquaintance" এর মধ্যকার পার্থক্যে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেন। গিলবার্ত রাইলও The Concept of Mind বইয়ে উদ্বিগ্নতার সাথে knowing how ও knowing that –এর মধ্যকার পার্থক্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন। মিখাইল পোলানঈ (Michael Polanyi) তার Personal Knowledge বইয়ে knowing how ও knowing that-এর জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রাসঙ্গিকতার পক্ষে যুক্তি পেশ করেছেন। বাইসাইকেল চালনার সময়ে ভারসাম্য রক্ষার উদাহরণ দিয়ে তিনি প্রস্তাব রাখেন যে, ভারসাম্য রক্ষা করা সম্পর্কে পদার্থবিদ্যার তাত্ত্বিক জ্ঞান কীভাবে তা চালানো যায় তার বাস্তব জ্ঞানের পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। কীভাবে উভয়কে প্রতিষ্ঠিত ও ভিত্তিশীল করা যায়, তাও তিনি প্রস্তাব করেন। এ-অবস্থায় রাইল যুক্তি দেন যে, knowledge that ও knowledge how-এর পার্থক্য স্বীকার করার অসামর্থ্যই অসীম পূর্বগতিকে (infinite regress) প্রণোদিত করে।

সাম্প্রতিক সময়ে কিছু জ্ঞানতাত্ত্বিক, যেমন- সোসা (Sosa), গ্রেকো (Greco), ভানভিগ (Kvanvig), জাগজেবস্কি (Zagzebski) ও ডান্কান প্রিটচার্ড (Duncan Pritchard) যুক্তি দেন যে, জ্ঞানতত্ত্ব কেবল প্রস্তাবনা বা প্রস্তাবিত-মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়-আশয় নয়, জনগণের ‌‘বিষয়-আশয়’ (properties), বিশেষ করে বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যের (intellectual virtues) মূল্যায়ন করবে।

বিশ্বাস

বিশ্বাস করা মানে সত্য হিসেবে গ্রহণ করা । বিশ্বাস বলতে সাধারণত যেকোনো বুদ্ধিগম্য বিষয়কে সত্য হিসেবে গ্রহণকে বোঝায় । সাধারণ কথায়, বিশ্বাসের বিবৃতি (statement of belief) হলো বৈশিষ্ট্যগতভাবে কোনো সত্ত্বার অন্য কোনো শক্তি বা অন্য কোনো সত্ত্বার প্রতি ভক্তি বা আস্থার একটি প্রকাশ । যেখানে এটি জাতীয় বিশ্বাসকে নির্দেশ করে, সেখানে জ্ঞানবিদ্যা বা জ্ঞানতত্ত্ব কেবল এ-অর্থে নয়, ব্যাপক অর্থে শব্দটি গ্রহণ করে ।[4]

সত্য

যদি কারো বিশ্বাস সত্য হয়, তবে তার বিশ্বাসের পক্ষে এটি যথেষ্ট নয়। অন্য কথায়, যদি কোনোকিছু প্রকৃতভাবে জানা যায়, তবে তা নিশ্চিতভাবে মিথ্যা হতে পারে না। উদাহরণ স্বরূপ, যদি কেউ বিশ্বাস করে যে, একটি ব্রিজ তার পারাপারের জন্য যথেষ্ট নিরাপদ, কিন্তু এটি অতিক্রম করার সময় দেখা যায়-এটি ভেঙে পড়লো, তখন এটা বলা যায় যে, ব্রিজটির নিরাপদ থাকার যে ‘বিশ্বাস’ তার ছিল তা ভুল ছিল। এ-বিশ্বাসকে ‘সঠিক’ বলা যাবে না এই জন্যে যে, ব্রিজটির নিরাপদ থাকার যে-ব্যাপারটি সে ‘জেনেছিল’, তা স্পষ্টভাবে ছিল না। ভিন্নভাবে বললে, যদি ব্রিজটি সঠিকভাবে তার ওজনকে সমর্থন করতো, তবে সে বলতে পারতো- সে বিশ্বাস করেছিলো যে ব্রিজটি নিরাপদ ছিল এবং এখন এটি প্রমাণ করার পর (অতিক্রম করার পর) সে ‘জানে’ ব্রিজটি নিরাপদ।

জ্ঞানতাত্ত্বিক বা জ্ঞানবিদ্যকরা বিশ্বাসকে সঠিক সত্যের বাহক (truth-bearer) বলেও যুক্তি দিয়েছেন। জ্ঞানকে কেউ কেউ খানিকটা যাচাইকৃত সত্য বিবৃতির পদ্ধতি, আবার কেউ কেউ যাচাইকৃত সত্য বাক্যের পদ্ধতি হিসেবে বর্ণনা করতেন। প্লাতো তার গর্জিয়াসে (Gorgias) যুক্তি দেন যে, বিশ্বাস হচ্ছে অতি সাধারণভাবে প্রলুব্ধকারী সত্য-বাহক।

যাচাইকরণ

প্লেটোর অনেক ডায়ালগে, যেমন মেনো (Meno) এবং বিশেষ করে থিয়েটেটাস (Theaetetus)-এ, সক্রেটিস ‘জ্ঞান কি’ সংক্রান্ত কিছু মত বিবেচনা করেছেন, এবং শেষে এসে বলেছেন, জ্ঞান হচ্ছে সত্য বিশ্বাস যা কিছু উপায়ে পরীক্ষিত অথবা স্থিরিকৃত অর্থের (meaning) একটা হিসাব (given an account of)। জ্ঞান হচ্ছে যাচাইকৃত সত্য বিশ্বাস (justified true belief) - এই তত্ত্ব অনুসারে, প্রদত্ত বচন (proposition) সত্য, কিন্তু এই প্রাসঙ্গিক সত্য বচনকে কেবল বিশ্বাস করা হবে না, একে বিশ্বাস করার মতো ভালো যুক্তিও থাকতে হবে। এর একটি নিহিতার্থ এই যে, কোনো ব্যক্তি যেটা সত্য হিসেবে ঘটবে তা বিশ্বাস করা দ্বারা কেবল জ্ঞান অর্জন করতে পারে না। উদাহরণ স্বরূপ, একজন রোগা লোক, যার কোন ডাক্তারি প্রশিক্ষণ নেই কিন্তু সাধারণভাবে একটি আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আছে, বিশ্বাস করতে পারে যে, সে দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে। তার এই বিশ্বাস যদি সত্যে পরিণত হয়, তবু বলা যাবে না- রোগী নিশ্চিত করে ‘জানতো’ সে সুস্থ হবে। কেননা এটি ছিলো রোগীর যাচাইশূন্য বিশ্বাস (belief lacked justification)।

‘যাচাইকৃত সত্য বিশ্বাস’- জ্ঞানের এই সংজ্ঞা ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ব্যাপকভাবে গৃহীত ছিল না। এই সময়ে, মার্কিন দার্শনিক এডমুন্ড গেটিয়ারের একটি থিসিস পেপার জ্ঞানবিদ্যক এ-বিষয়কে ব্যাপক আলোচনার সম্মুখীন করেন।

গেটিয়ার সমস্যা

জ্ঞানের সংজ্ঞা উপস্থাপনকারী অয়লার ছক

এডমুন্ড গেটিয়ার 'Is Justified True Belief Knowledge?' নামক সংক্ষিপ্ত থিসিস পেপারের (‌১৯৬৩ সালে প্রকাশিত) জন্য অতি পরিচিত। এ পেপারে তিনি হাজার হাজার বছর ধরে দার্শনিকদের নেতৃত্ব দেওয়া জ্ঞানতত্ত্বের সত্যতা সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন।[5] কিছু পৃষ্ঠায় তিনি যুক্তি দেন যে, কিছু পরিস্থিতি রয়েছে, যেগুলোতে একজনের বিশ্বাস যাচাইকৃত বা সত্য হতে পারে, যদিও তাকে জ্ঞান হিসেবে গণ্য করা অসফলতাপূর্ণ। অর্থাৎ, গেটিয়ার বলছেন, সত্য বচনে যাচাইকৃত বিশ্বাসটি জ্ঞেয় বচনের জন্য অত্যাবশ্যক- এটা যথেষ্ট নয়। যেহেতু, ছকে, একটি সত্য বচন একজন ব্যক্তি (বেগুনি অঞ্চল) দ্বারা বিশ্বসিত হতে পারে, কিন্তু এটি জ্ঞান-শ্রেণিতে (হলুদ অঞ্চল) পড়তে পারে না।

গেটিয়ার অনুসারে, কিছু অবস্থা রয়েছে, যেখানে একজন লোক জ্ঞান পায় না, এমনকি উপরোল্লিখিত সকল অবস্থার উপস্থিতি থাকলেও জ্ঞান পাওয়া যায় না। গেটিয়ার দুটো চিন্তন-পরীক্ষণের (thought experiments) প্রস্তাব দিয়েছেন, যেগুলো ‘গেটিয়ার মামলা’ (Gettier cases) বা জ্ঞানের ধ্রপদী ব্যাখ্যার প্রতি বিরুদ্ধ-উদাহরণ হিসেবে পরিচিত। প্রথম মামলায় স্মিথ ও জোনস নামক দুইজন মানুষকে যুক্ত রাখা হয়, যারা একই চাকরির জন্য তাদের আবেদনের ফলাফল আশা করছে। প্রত্যেকের পকেটে দশটি মুদ্রা রয়েছে। স্মিথের বিশ্বাস করার চমৎকার যুক্তি রয়েছে যে, জোনস চাকরিটি পাবে, এবং আরও জানে যে, জোনসের পকেটে দশটি মুদ্রা রয়েছে (সম্প্রতি সে সেগুলো গুনে দেখেছে)। এই থেকে স্মিথ অনুমান করে, “যে লোক চাকরিটি পাবে, তার পকেটে দশটি মুদ্রা রয়েছে”। যদিও স্মিথ অজ্ঞাত যে, তার নিজের পকেটেও দশটি মুদ্রা রয়েছে এবং জোনস নয় তিনিই চাকরিটি পেতে যাচ্ছেন। জোনস চাকরিটি পাবে– বিশ্বাস করার পক্ষে যেহেতু স্মিথের শক্ত প্রমাণ রয়েছে, সেহেতু সে ভুল করেছে। স্মিথের যাচাইকৃত সত্য বিশ্বাস রয়েছে যে, যে লোকের পকেটে দশটি মুদ্রা থাকবে সে চাকরিটি পাবে, কিন্তু গেটিয়ার অনুসারে- স্মিথ ‘জানে’ না যে, যে লোকের পকেটে দশটি মুদ্রা থাকবে সে চাকরিটি পাবে, কারণ স্মিথের বিশ্বাস “...সত্য নির্দিষ্ট পরিমাণ মুদ্রা জোনসের পকেটে থাকার কারণে, যেখানে স্মিথ জানে না তার পকেটে কি পরিমাণ মুদ্রা রয়েছে, এবং নির্ভর করেছে জোনসের পকেটে মুদ্রার একটা হিসাব রয়েছে- এই বিশ্বাসের উপর। সে মিথ্যাপূর্ণভাবে লোকটি চাকরি পাবে বলে বিশ্বাস করেছে” (দেখুন[5] p. 122.) । এই মামলাগুলো জ্ঞান হতে অসমর্থ হয়েছে, কারণ কর্তার বিশ্বাস যাচাইকৃত, কিন্তু কেবলমাত্র ভাগ্যের বলে সত্য হয়েছে। অন্য কথায়, ভুল যুক্তির জন্য সে সঠিক পছন্দ করেছে। এই উদাহরণ বিশ্বাস ও সত্যতা আলোচনা করার সময় প্রায়ই দেওয়া হয় এমন কিছুর সমরূপ, যেখানে প্রকৃত জ্ঞান প্রাপ্তি ছাড়া যা ঘটবে বা আকস্মিকভাবে সঠিক হতে পারে-এমন ধারণার ভিত্তি করে কোনো ব্যক্তির নির্মিত বিশ্বাস রয়েছে।

ব্যবহারিক প্রয়োগ

জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কিত অন্যান্য সাধারণ প্রয়োগসমূহ:

আরও দেখুন

পাদটীকা

  1. G & C. Merriam Co. (১৯১৩)। Noah Porter, সম্পাদকগণ। Webster's Revised Unabridged Dictionary (1913 সংস্করণ)। G & C. Merriam Co.। পৃষ্ঠা 501। ১৫ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ জানুয়ারি ২০১৪E*pis`te*mol"o*gy (?), n. [Gr. knowledge + -logy.] The theory or science of the method or group. Epistemology is the study of how we know what we know.ds of knowledge.
  2. Encyclopedia of Philosophy, Volume 3, 1967, Macmillan, Inc.
  3. Suchting, Wal। "Epistemology"। Historical Materialism। Academic Search Premier: 331–345।
  4. http://www.merriam-webster.com/dictionary/believe
  5. Gettier, Edmund (১৯৬৩)। "Is Justified True Belief Knowledge?"Analysis23 (6): 121–23। জেস্টোর 3326922ডিওআই:10.2307/3326922

আরও পড়ুন

বহিঃসংযোগ

দর্শনের স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে নিবন্ধসমূহ:

অন্যান্য সংযোগসমূহ:

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.