জোয়ার-ভাটা

পৃথিবীর বাইরের মহাকর্ষীয় শক্তির (বিশেষ করে চাঁদের) প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের জল নিয়মিত বিরতিতে ফুলে ওঠাকে জোয়ার ও নেমে যাওয়ার ঘটনাকে ভাটা বলে। এই দুইয়ের একত্রে জোয়ার-ভাটা বলা হয়। জোয়ার-ভাটার ফলে সমুদ্রে যে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, তাকে জোয়ার তরঙ্গ (Tidal Eaves) বলে। জোয়ারের জল উপকূলের দিকে অগ্রসর হলে জল সমতলের যে উত্থান ঘটে, তাকে জোয়ারের জলের সর্বোচ্চ সীমা (High Tide Water) এবং ভাটার জল সমুদ্রের দিকে নেমে যাওয়ার সময় জল সমতলের যে পতন ঘটে, তাকে জোয়ারের জলের সর্বনিম্ন সীমা (Low Tide Water) বলে। প্রতি ১২ ঘণ্টা পরপর জোয়ার-ভাটা হয়ে থাকে ।অর্থাৎ দিনে দুবার জোয়ার ভাটা হয়। জোয়ার ভাটার কিছু উপকারিতা রয়েছে আবার কিছু অপকারিতা রয়েছে। আমরা জানি পৃথিবীতে চাঁদের আকর্ষণ বলের কারণে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি হয় ।জোয়ার-ভাটা একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া ।জোয়ার ভাটার সাহায্যে সমুদ্রের পাশে লবণ তৈরি করা হয়। জোয়ারের পানিতে ধরে রেখে রোদে শুকিয়ে লবণ তৈরি করা হয়। আবার বন্যার সময় জোয়ারের পানির কারণে নদী ভাঙ্গন হয়ে থাকে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উপর চাঁদের মহাকর্ষের প্রভাব
জোয়ারের সময় ঢেউয়ের তোড়ে উপচে পড়া জল

জোয়ার-ভাটা সৃষ্টির কারণ

জোয়ার-ভাটা সৃষ্টির প্রধান কারণ হল-

  • সূর্য ও প্রধানত চাঁদ দ্বারা পৃথিবীর ওপর প্রযুক্ত মহাকর্ষ বল।
  • পৃথিবীর ওপর কার্যকরী অপকেন্দ্রিক বল।

পৃথিবীর যে পাশে চাঁদ থাকে সে পাশে চাঁদ দ্বারা পৃথিবীপৃষ্ঠের সমুদ্রের জল তার নিচের মাটি অপেক্ষা বেশি জোরে আকৃষ্ট হয়। এ কারণে চাঁদের দিকে অবস্থিত জল বেশি ফুলে উঠে। একই সময়ে পৃথিবীর যে অংশ চাঁদের বিপরীত দিকে থাকে, সেদিকের সমুদ্রের নিচের মাটি তার উপরের জল অপেক্ষা চাঁদ কর্তৃক বেশি জোরে আকৃষ্ট হয়। আবার চাঁদ থেকে জলের দূরত্ব মাটি অপেক্ষা বেশি থাকায় জলের উপর চাঁদের আকর্ষণ কম থাকে। ফলে সেখানকার জলও ফুলে উঠে। ফলে একই সময়ে চাঁদের দিকে এবং চাঁদের বিপরীত দিকে পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের জলের এই ফুলে উঠাকে জোয়ার বলে।

আবার পৃথিবী ও চাঁদের ঘুর্ণনের কারণে একসময় ফুলে ওঠা জল নেমে যায়। জলের এই নেমে যাওয়াকে ভাটা বলে। পৃথিবী যে সময়ের মধ্যে নিজ অক্ষের চারদিকে একবার আবর্তন করে (এক দিনে) সে সময়ের মধ্যে পৃথিবীর যেকোন অংশ একবার চাঁদের দিকে থাকে এবং একবার চাঁদের বিপরীত দিকে থাকে। এ কারণে পৃথিবীর যেকোন স্থানে দুইবার জোয়ার এবং দুইবার ভাটা হয়।

জোয়ার-ভাটার জন্য সূর্যের আকর্ষণও অনেকাংশে দায়ী। তবে অনেক দূরে থাকায় সূর্যের আকর্ষণ চাঁদের আকর্ষণের থেকে কম কার্যকর। সূর্য এবং চাঁদ যখন সমসূত্রে পৃথিবীর একই দিকে বা বিপরীত দিকে অবস্থান করে তখন উভয়ের আকর্ষণে সর্বাপেক্ষা উঁচু জোয়ার হয়, জোয়ারের জল বেশি ছাপিয়ে পড়ে। এই অবস্থাকে ভরা কাটাল বা উঁচু জোয়ার বলা হয়। আর পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য এবং চাঁদের মধ্য কৌণিক দূরত্ব যখন এক সমকোণ পরিমাণ হয় তখন একের আকর্ষণ অন্যের আকর্ষণ দ্বারা প্রশমিত হয়। তাই সবচেয়ে নিচু জোয়ার হয় যাকে মরা কাটাল বলে আখ্যায়িত করা হয়।

মুখ্য জোয়ার

চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে আবর্তনকালে পৃথিবীর যে অংশ চন্দ্রের নিকটবর্তী হয়, সেখানে চন্দ্রের আকর্ষণ সর্বাপেক্ষা বেশি হয়। এ আকর্ষণে চারদিক হতে জলরাশি এসে চন্দ্রের দিকে ফুলে ওঠে এবং জোয়ার হয়। এরুপে সৃষ্ট জোয়ারকে মুখ্য জোয়ার বা প্রত্যক্ষ জোয়ার বলা হয়।

গৌণ জোয়ার

চাঁদ পৃথিবীর যে পার্শ্বে আকর্ষণ করে তার বিপরীত দিকের জলরাশির ওপর মহাকর্ষণ শক্তির প্রভাব কমে যায় এবং কেন্দ্রাতিগ শক্তির সৃষ্টি হয়। এতে চারদিক হতে পানি ঐ স্থানে এসে জোয়ারের সৃষ্টি করে। এভাবে চাঁদের বিপরীত দিকে যে জোয়ার হয় তাকে গৌণ জোয়ার বা পরোক্ষ জোয়ার বলে।

ভরা কটাল

অমাবস্যাপূর্ণিমা তিথিতে পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য একই সরল রেখায় অবস্থান করলে, চন্দ্র ও সূর্যের মিলিত বলের প্রবল আকর্ষণে যে তীব্র জোয়ারের সৃষ্টি হয়, তাকে তেজ কটাল বা ভরা কটাল বা ভরা জোয়ার বলে।

মরা কটাল

কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে চাঁদ ও সূর্য পৃথিবীর সঙ্গে পরস্পর সমকোণে থাকলে চাঁদের আকর্ষণে যেদিকে জলরাশি ফুলে ওঠে ঠিক তার সমকোণে সূর্যের আকর্ষণেও সমুদ্রের জল ফুলে ওঠে। চাঁদ ও সূর্যের আকর্ষণ বল পরস্পর বিপরীতে কাজ করায় সমুদ্রপৃষ্ঠের জলরাশি বিশেষ ফুলে ওঠে না, এইভাবে সৃষ্ট জোয়ারকে মরা কটাল বা মরা জোয়ার বলে।

জোয়ার-ভাটার সময়ের ব্যবধান

কোনো নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট একটি সময়ে মুখ্য জোয়ার হওয়ার ১২ ঘণ্টা ২৬ মিনিট পরে সেখানে গৌণ জোয়ার হয় এবং মুখ্য জোয়ারের ২৪ ঘণ্টা ৫২ মিনিট পর সেখানে আবার মুখ্য জোয়ার হয়। তাই প্রত্যেক স্থানে জোয়ারের ৬ ঘণ্টা ১৩ মিনিট পরে ভাটা হয়।এ পৃথিবীর চারদিকে একবার ঘুরে আসতে চাদের সময় লাগে প্রায় ২৭ দিন। পৃথিবী যখন ২৪ ঘণ্টায় একবার নিজের মেরুদণ্ডের চারদিকে আবর্তন করে তখন চাঁদ নিজের অক্ষের ১ অংশ বা ৩৬০° ২৭ = (প্রায়) ১৩° পথ এগিয়ে যায়। এই ১৩° পথ অতিক্রম করতে পৃথিবীর আরও (১৩° x ৪ মিনিট = ৫২ মি.) ৫২ মিনিট সময় লাগে। সুতরাং পৃথিবীর যেকোন স্থান ২৪ ঘণ্টা ৫২ মিনিট পরে একবার করে চাদের সামনে আসে। তাই প্রতিটি মুখ্য বা গৌণ জোয়ার ২৪ ঘণ্টা ৫২ মিনিট পরে অনুষ্ঠিত হয় এবং একটি নির্দিষ্ট স্থানে একদিন যে সময়ে মুখ্য জোয়ার হয় সেইদিন তার ১২ ঘণ্টা ২৬ মিনিট পরে সেখানে গৌণ জোয়ার অনুষ্ঠিত হয়। আর, যে দুই স্থানে জোয়ার হয় তাদের সমকোণে অবস্থিত স্থান দুটিতে সবসময় ভাটা হয় বলে প্রত্যেক জায়গায় জোয়ারের প্রায় ৬ ঘণ্টা ১৩ মিনিট পরে সেখানে ভাটা হয়।

জোয়ার ভাটার ফলাফল

সুবিধা :

  1. যেসব নদীতে জোয়ার ভাটা রয়েছে সেসব মধ্যে উন্নত দেশগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায়।
  2. শীতপ্রধান দেশ গুলোতে জোয়ারের জল এর মাধ্যমে সেখানকার নদী বন্দরের জল বরফ মুক্ত থাকে। [1]
  3. জোয়ারের ফলে সমুদ্রের অনেক মাছ নদীতে প্রবেশ করে ।
  4. জোয়ারের বলে জলযান এর যাতাযাত করতে সুবিধা হয়।
  5. জোয়ারের ফলে নদীর জল আবর্জনা মুক্ত থাকে।[2]

তথ্যসূত্র

  1. "জোয়ার ভাটার ফলাফল ও প্রভাব (Impact of Tides) | BengalStudents"bengalstudents.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-৩১
  2. "জোয়ার ভাটার ফলাফল ও প্রভাব (Impact of Tides) | BengalStudents"bengalstudents.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-৩১
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.