জামাল পাশা
জামাল পাশা (উসমানীয় তুর্কি: جمال پاشا, আধুনিক তুর্কি: Cemal Paşa), জন্ম নাম আহমেদ জামাল (উসমানীয় তুর্কি: احمد جمال, তুর্কি: Ahmet Cemal) ছিলেন উসমানীয় সামরিক নেতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সাম্রাজ্য শাসনকারী তিন পাশা বলে পরিচিত ব্যক্তিত্রয়ের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। তিনি ইস্তানবুলের মেয়র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।[1] তাকে আর্মেনীয় গণহত্যা ও এসিরিয় গণহত্যায় সংশ্লিষ্ট হিসেবে দেখা হয়।[2]
জামাল পাশা | |
---|---|
জন্ম | মিডিলি, উসমানীয় সাম্রাজ্য | ৬ মে ১৮৭২
মৃত্যু | ২১ জুলাই ১৯২২ ৫০) তিবলিসি, জর্জিয়ান সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিক, (বর্তমান: জর্জিয়া) | (বয়স
আনুগত্য | উসমানীয় সাম্রাজ্য |
কার্যকাল | ১৮৯৩–১৯১৮ |
পদমর্যাদা | বিরিনসি ফেরিক |
ইউনিট | নৌ মন্ত্রী |
নেতৃত্বসমূহ | ফোর্থ আর্মি |
যুদ্ধ/সংগ্রাম | বলকান যুদ্ধ, সিনাই ও ফিলিস্তিন অভিযান |
অন্য কাজ | বিপ্লবী |
জীবনী
জামাল পাশা লিসবসের মাইটিলেনে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুহাম্মদ নেসিপ বে একজন সামরিক ফার্মাসিস্ট ছিলেন। ১৯০৮ থেকে ১৯১৮ এর মধ্যে তিনি উসমানীয় সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে উঠেন। তিনি ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে কুলেলি সামরিক উচ্চ বিদ্যালয় এবং এরপর ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলের সামরিক একাডেমী থেকে স্নাতক হন। প্রথমে তিনি রাজকীয় জেনারেল স্টাফের প্রথম বিভাগের যোগ দেন এরপর সেকেন্ড আর্মিতে যোগ দেন। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তাকে দ্বিতীয় কর্পসে নিয়োগ করা হয়। দুই বছর পর তিনি সেলোনিকায় শিক্ষানবিশ ডিভিশনের স্টাফ কমান্ডার হন।
ইতিমধ্যে তিনি কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রগ্রেসকে সামরিক ইস্যুতে পুনর্গঠনে সহমত হন। এসময় ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রুমেলিয়া রেলওয়ের পরিদর্শক হন। ১৯০৬ এ তিনি উসমানীয় লিবার্টি সোসাইটিতে যোগ দেন। জামাল পাশা কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রগ্রেসের সামরিক বিভাগে প্রভাবশালী হয়ে উঠেন। ১৯০৭ এ তিনি তৃতীয় কর্পসের সদস্য হন। এখানে তিনি ভবিষ্যত তুর্কি মুখপাত্র ফেতহি ওকয়ার ও কামাল আতাতুর্কের সাথে কাজ করেন।
তার নাতি হাসান জামাল তুরস্কের বহুল পরিচিত কলামিস্ট, সাংবাদিক ও লেখক।
বলকান যুদ্ধ
১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে জামাল বাগদাদের গভর্নর নিযুক্ত হন। পরে বলকান যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য তিনি এ দায়িত্ব থেকে সরে দাড়ান। ১৯১২ এর অক্টোবরে তিনি কর্নেল পদে উন্নীত হন। প্রথম বলকান যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রগ্রেস কর্তৃক অঙ্কিত প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এটি ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে আলোচনার বিপক্ষে করা হয়েছিল। তিনি বাব ই আলি আক্রমণের পর সৃষ্ট সমস্যা দূর করতে চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধে জামাল পাশার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি সিইউপির বিপ্লবের পর তিনি কনস্টান্টিনোপলের কমান্ডার হন এবং জনস্বার্থ কাজের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নৌ মন্ত্রী হন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ইউরোপ দুইটি শিবিরে বিভক্ত ছিল। তিনি ফ্রান্সের সাথে মৈত্রীর সমর্থক ছিলেন। ফ্রান্সের সাথে মিত্রতার ব্যাপারে আলাপ করতে তিনি ফ্রান্স যান। তবে তিনি ব্যর্থ হন। এরপর তিনি জার্মানদের সমর্থক আনোয়ার পাশা ও তালাত পাশার পক্ষাবলম্বন করেন। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে জামাল, আনোয়ার ও তালাত উসমানীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণভার লাভ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ব্যপী কার্যত তারা তিনজন সাম্রাজ্য শাসন করেন। জামাল সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির অন্যতম স্থপতি ছিলেন। এগুলোর অধিকাংশ সাম্রাজ্যের জন্য বিধ্বংসী প্রমাণিত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্য যুদ্ধ ঘোষণার পর আনোয়ার পাশা মিশরে ব্রিটিশ সেনাদের বিরুদ্ধে জামাল পাশাকে নেতৃত্বের জন্য মনোনীত করলে তিনি এ পদ গ্রহণ করেন। আনোয়ারের মত তিনি সামরিক নেতা হিসেবে সফল ছিলেন না।
সিরিয়া ও লেবানন
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে জামাল পাশা সিরিয়ায় সামরিক ও বেসামরিক ব্যাপারে পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হন। সে বছরের মে মাসে একটি অন্তর্বর্তী আইন দ্বারা তাকে জরুরি ক্ষমতা দেয়া হয়। কনস্টান্টিনোপল থেকে সিরিয়ায় আগত সকল আদেশে তার অনুমোদনের প্রয়োজন হত। তার প্রথম ও দ্বিতীয় সুয়েজ খাল আক্রমণ ব্যর্থ হয়। এ তিন বছরে যুদ্ধকালীন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে অত্র অঞ্চলের জনগণ উসমানীয় সরকারের প্রতি বিরূপ হয় ও আরব বিদ্রোহের দিকে মোড় নেয়।
স্থানীয় আরব অধিবাসীদের কাছে তিনি আল সাফফাহ বা "রক্তপাতকারী" বলে পরিচিত ছিলেন। ১৯১৬ এর ৬ মে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে দামেস্ক ও বৈরুতে অনেক লেবানিজ, সিরিয়ান শিয়া ইসলাম ও খ্রিষ্টানকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য এমন বলা হয়।[3]
“বৈরুত সংস্কার আন্দোলন” এর নেতা সালিম আলি সালাম তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেন, “জামাল পাশা তার প্রতিহিংসার অভিযান পুনরায় শুরু করেন; তিনি অধিকাংশ আরব ব্যক্তিত্বকে কারারুদ্ধ করেন, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ আনেন। তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল চিন্তাশীল মস্তিস্কগুলো সরিয়ে দেয়া, যাতে আরবরা আর কখনো শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে না পারে, এবং তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলার কেউ না থাকে ... [ইস্তানবুল থেকে] বৈরুত ফিরে আসার পর আমাকে তলব করা হয় ... দামেস্কে জামাল পাশাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ... আমি ট্রেন ধরি এবং আলেয়তে পৌছার পর আমরা বুঝতে পারি যে পুরো ট্রেনটি দামেস্কে বন্দীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছিল ... যখন আমি তাদের দেখি আমি বুঝতে পারি যে তারা তাদের হত্যার জন্য দামেস্কে নিয়ে যাচ্ছে। তাই ... আমি নিজেকে বলি, কীভাবে আমি এই কসাইয়ের সাথে দেখা করতে পারি যখন সে এদিন দেশের গণ্যমান্যদের হত্যা করবে? এবং আমি কীভাবে তার সাথে আলাপ করব? ... দামেস্কে আসার পর সে সন্ধ্যায় কিছু ঘটার আগেই আমি তাকে দেখার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করি, কিন্তু সফল হয়নি। পরদিন সকালে সব শেষ হয়ে যায়, এবং .. গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যাদেরকে আলেয় থেকে নিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল তারা ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলছিল।"[4]
১৯১৫ এর শেষে যুদ্ধের সমাপ্তির জন্য তিনি মিত্রশক্তির সাথে গোপন আলোচনা শুরু করেন বলে বলা হয়। এ গোপন আলোচনার ফলাফলে কিছু হয়নি কারণ মিত্রশক্তি উসমানীয় সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত অঞ্চলের ব্যাপারে একমত হতে পারছিল না।[5] তবে সাম্প্রতিক গবেষণা এধরনের আলোচনার ব্যাপারে সন্দিহান।[6]
১৯১৫ এর বসন্তে আরব বিদ্রোহ শুরু হয়। তিনি সিরিয়ায় আরব প্রতিপক্ষের উপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। জামাল পাশার বাহিনী ১৯১৬ থেকে পরের সময়গুলো আরব জাতীয়তাবাদীদের সাথে লড়াই করে। উসমানীয়রা বৈরুত ও দামেস্কের ফরাসি কনসুলেট দখল করে নেয় এবং ফরাসি গোপন দলিল উদ্ধার করে। এ থেকে আরব বিদ্রোহের কর্মকাণ্ড ও সংশ্লিষ্ট নাম বের হয়ে আসে। জামাল এ তথ্যগুলো ব্যবহার করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে তার সামরিক ব্যর্থতার জন্য ফরাসিদের অধীনে বিদ্রোহ দায়ী ছিল। দলিলগুলো পাওয়ার পর জামাল বিদ্রোহী দলের মোকাবেলায় নামেন। বিদ্রোহীরা আরব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতাদের অধীনে কাজ করছিল। এরপর বিদ্রোহের বিচার অনুষ্ঠিত হয় যা "Âliye Divan-ı Harb-i Örfisi" বলে পরিচিত। এতে নেতাদের শাস্তি দেয়া হয়।
১৯১৭ এর শেষে তিনি স্বাধীন শাসক হিসেবে দামেস্ক থেকে শাসন করতে থাকেন। ১৯১৭ এ উসমানীয়রা জেনারেল এলেনবির নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হলে তিনি ফোর্থ আর্মি থেকে পদত্যাগ করেন এবং কনস্টান্টিনোপল ফিরে আসেন।
সংসদ
১৯১৭ তে অনুষ্ঠিত কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রগ্রেসের কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় প্রশাসন বোর্ডে নির্বাচিত হন।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে সাম্রাজ্যের পরাজয় এবং ২ নভেম্বর তালাত পাশার পদত্যাগের পর জামাল পাশা সিইউপির সাতজন নেতা সব জার্মানি ও পরে সুইজারল্যান্ড পালিয়ে যান।
সামরিক বিচার
তুরস্কের একটি সামরিক আদালত সাম্রাজ্যের আরব প্রজাদের উপর নির্যাতনের জন্য তাকে অভিযুক্ত করে ও তার অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদন্ড দেয়। এসত্ত্বেও এ আদালত মিত্রশক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।[7] পরে তিনি মধ্য এশিয়া চলে যান। সেখানে তিনি আফগান সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্য কাজ করেন। বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্যের পর তিনি তিবলিসি ভ্রমণ করেন। ১৯২২ এর ২১ জুলাই সেখানে তাকে তার সচিবসহ হত্যা করা হয়। আর্মেনীয় গণহত্যার জন্য অপারেশন নেমেসিসের আওতায় তাকে হত্যা করা হয়। তার দেহাবশেষ এরজুরুমে নিয়ে আসা হয় ও সমাধিস্থ করা হয়।
গ্রন্থপঞ্জি
- Memories of a Turkish statesman: 1913–1919, New York: George H. Doran Company, ১৯২২
তথ্যসূত্র
- Mango, Andrew (১৯৯৯)। Atatürk: The Biography of the Founder of Modern Turkey। Woodstock, NY: The Overlook Press। পৃষ্ঠা 113। আইএসবিএন 1-58567-011-1।
- Wolfgang Benz: Vorurteil und Genozid. Ideologische Prämissen des Völkermords. Böhlau Verlag, 2010. p. 54
- Cleveland, William: A History of the Modern Middle East. Boulder: Westview Press, 2004. "World War I and the End of the Ottoman Order", 146–167.
- Salibi, K. (1976). "Beirut under the Young Turks: As Depicted in the Political Memoirs of Salim Ali Salam (1868–1938)," In J. Berque, & D. Chevalier, Les Arabes par leurs archives: XVIe-XXe siecles. Paris: Centre National de la Recherche Scientifique.
- Fromkin, David, A Peace to End All Peace: The Fall of the Ottoman Empire and the Creation of the Modern Middle East. New York: Avon Books, 1989, p. 214.
- McMeekin, Sean. The Russian Origins of the First World War. Cambridge, MA: Belknap Press of the Harvard University Press, 2011, pp. 198–201.
- Revisiting the Armenian Genocide by Guenter Lewy.