জহিরুল হক খান
জহিরুল হক খান (জন্ম: ১৯৫০) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে।[1]
জহিরুল হক খান | |
---|---|
জন্ম | ১৯৫০ সুহিলপুর |
মৃত্যু | ২ রা নভেম্বর ২০১২ নরসিংদী |
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
নাগরিকত্ব | পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে) বাংলাদেশ |
পেশা | অবসরপ্রাপ্ত মেজর ও রাজনীতিবিদ |
পরিচিতির কারণ | বীর প্রতীক |
রাজনৈতিক দল | বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ |
সন্তান | ০১.ইমরান খান
০২.তৌহিদ আহমদ খান ০৩.আসিফ খান ০৪.তৌফিক আহমদ খান |
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
জহিরুল হক খানের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদর উপজেলার সুহিলপুর ইউনিয়নের সুহিলপুর গ্রামে। তার বাবার নাম সুলতান আহমদ খান এবং মায়ের নাম হাবিয়া খাতুন। তার স্ত্রীর নাম মাহবুবা আক্তার। তাদের চার ছেলে। দ্বিতীয় সন্তান তৌহিদ আহমদ খান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত আছেন।
কর্মজীবন
১৯৭১ সালে স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন জহিরুল হক খান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। সীমান্ত এলাকায় খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে অংশ নেন জহিরুল হক খান। জুন মাসে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় প্রথম বাংলাদেশ অফিসার্স ওয়ারকোর্সে। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে ৪ নম্বর সেক্টরের আমলাসিদ সাবসেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারপর বেশ কয়েকটি যুদ্ধে তিনি অগ্রবর্তী দলে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সিলেট জেলার অন্তর্গত জৈন্তাপুর-জকিগঞ্জ সংযোগ সড়কে সুরমা নদীর তীরে কানাইঘাট ছিলো ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তে। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা অবস্থান। প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। তাদের সহায়তা করেছে খাইবার রাইফেলস, থাল ও তোচি স্কাউটস এবং স্থানীয় রাজাকার বাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম মুক্ত হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী সিলেটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু কানাইঘাটের পাকিস্তানি অবস্থান ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শক্ত এক বাধা। এ জন্য কানাইঘাট দখলের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে জহিরুল হক খানের প্রতিরক্ষা অবস্থানের দিক দিয়ে। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছেন। তার ত্বরিত তৎপরতায় পাকিস্তানি সেনাদের পালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনাই নিহত হলো। মুক্ত হলো বিরাট এক এলাকা।
মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে কানাইঘাট-দরবস্ত রাস্তা ব্লক করতে ওই সড়কের লুবাছড়া চা বাগানে অবস্থান নেন। তখন পাকিস্তানিরা দূরবর্তী অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে ১০৫ মিলিমিটার কামানের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণের কৌশল রদবদল করে ভিন্ন পন্থা গ্রহণ করেন। তারা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যান এবং দুটি দল কাট অব পার্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। একটি দল অবস্থান নেয় কানাইঘাট দরবস্ত সড়কে। আরেকটি কানাইঘাট চরখাই সড়কে। এই দলের দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জহিরুল হক খান। অন্যটি আক্রমণকারী দল হিসেবে থাকে। ২ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা যে যাঁর অবস্থানে পৌঁছে যান। কিন্তু আক্রমণ শুরুর আগেই পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে।
মুক্তিযোদ্ধারাও ত্বরিত পাল্টা আক্রমণ চালান। যুদ্ধ চলতে থাকে কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদের পালানোর পথ ছিল রুদ্ধ। এক দল পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীরা জহিরুল হক খানের অবস্থানের দিক দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সে সুযোগ তারা পায়নি। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। তাদের প্রবল আক্রমণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ৪ ডিসেম্বর সকালে কানাইঘাট স্বাধীন হয়। কানাইঘাটের যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ৫০ জন নিহত, ২০ জন আহত এবং ২৫ জন আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিবাহিনীর ১১ জন শহীদ ও ২০ জন আহত হন। [2]
পুরস্কার ও সম্মাননা
তার সাহসিকতার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করে।
রাজনৈতিক জীবন
তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে মেজর পদে থাকা অবস্থায় অবসর নেন। এরপর তিনি যোগ দেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া -২ আসন থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করেন। কিন্তু সেই নির্বাচনে উনি হেরে যান। উনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামীলীগ এর যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আওয়ামীলীগ কে শক্তিশালী করার ব্যাপারে তার ভূমিকা ছিল অসামান্য। উনি সব সময় তৃণমূল এর নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। সর্বশেষ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামীলীগ এর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও একই সাথে জেলা ১৪ দলের সমন্বয়ক এর দায়িত্ব পালন করেন।
মৃত্যু
২রা নভেম্বর ২০১২ ইং তারিখে ফজরের নামাজ আদায় করার পর অসুস্থতা বোধ করেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত এম্বুলেন্স করে ঢাকা নেয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন। পরে সুহিলপুর পাঠান পাড়ায় তার পারিবারিক কবরস্থানে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।
পাদটীকা
- এই নিবন্ধে দৈনিক প্রথম আলোতে ১১-০১-২০১২ তারিখে প্রকাশিত তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না প্রতিবেদন থেকে লেখা অনুলিপি করা হয়েছে। যা দৈনিক প্রথম আলো ক্রিয়েটিভ কমন্স অ্যাট্রিবিউশন-শেয়ার-এলাইক ৩.০ আন্তর্জাতিক লাইসেন্সে উইকিপিডিয়ায় অবমুক্ত করেছে (অনুমতিপত্র)। প্রতিবেদনগুলি দৈনিক প্রথম আলোর মুক্তিযুদ্ধ ট্রাস্টের পক্ষে গ্রন্থনা করেছেন রাশেদুর রহমান (যিনি তারা রহমান নামেও পরিচিত)।
তথ্যসূত্র
- দৈনিক প্রথম আলো, "তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না" | তারিখ: ১১-০১-২০১২
- একাত্তরের বীরযোদ্ধা, খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা (প্রথম খন্ড)। প্রথমা প্রকাশন। এপ্রিল ২০১২। পৃষ্ঠা ২০৪। আইএসবিএন 9789843338884।