জনমেজয়
জনমেজয় বা জন্মেজয় মহাভারত মহাকাব্যের অন্যতম চরিত্র। তিনি রাজা পরীক্ষিত ও রাণী মদ্রবতীর জ্যেষ্ঠপুত্র, অভিমন্যুর পৌত্র এবং অর্জুনের প্রপৌত্র। পরীক্ষিতের মৃত্যুর পর মন্ত্রীগণ তাকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। অশ্বমেধ যজ্ঞে তার অনুরোধে ও বেদব্যাসের উপদেশে ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়ন মহাভারত পাঠ করে শোনান।
জনমেজয় | |
---|---|
পূর্বসূরী | পরীক্ষিত |
উত্তরসূরী | অশ্বমেধদত্ত |
সন্তান | শতানীক |
পিতা-মাতা |
রাজ্যাভিষেক ও বিবাহ
শমীক মুনির পুত্র শৃঙ্গীর অভিশাপে রাজা পরীক্ষিত তক্ষক নাগ কর্তৃক হত হওয়ার পর মন্ত্রীরা পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে তার পুত্র জন্মেজয়ের রাজ্যাভিষেক করেন। যথাসময়ে কাশীরাজ সুবর্ণবর্মার কন্যা বপুষ্টমার সাথে তার বিবাহ হয়। তিনি নিজের স্ত্রী ভিন্ন অন্য কোনো নারীর প্রতি দৃষ্টি দিতেন না এবং পতিব্রতা, সুরূপা বপুষ্টমার সঙ্গে সুখে কালযাপন করতেন।
সর্পসত্র যজ্ঞ
উতঙ্ক মুনির নিকট পিতা পরীক্ষিতের মৃত্যুবিবরণ শুনে জনমেজয় দুঃখিত হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তক্ষক নাগকে সবান্ধবে অগ্নিতে নিক্ষেপ করার জন্য ব্রাহ্মণদের পরামর্শে সর্পসত্র যজ্ঞের আয়োজন করেন। যজ্ঞস্থান নির্ধারণের সময় এক পুরাণ কথক সুত জানান যে কোনো ব্রাহ্মণ এই যজ্ঞে ব্যাঘাত ঘটাবে। সেই শুনে জন্মেজয় দ্বারপালকে নির্দেশ দেন কেউ যেন তার অজ্ঞাতসারে যজ্ঞস্থানে প্রবেশ না করে।
এরপর সর্পসত্র যজ্ঞ শুরু হয়। কৃষ্ণবসনধারী পুরোহিতরা সর্পগণকে আহ্বান করে অগ্নিতে নিক্ষেপ করতে থাকেন। ফলে বহু সাপ বিনষ্ট হয়| তক্ষক ভীত হয়ে ইন্দ্রের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন।
সর্পগণের মৃত্যুতে দুঃখিত হয়ে বাসুকি তার ভগিনীকে অনুরোধ জানান যে তার পুত্র আস্তীক যেন সর্পগণকে উদ্ধার করে। আস্তিক মনির মাতা মনসা ছিলেন সর্প ও পিতা ছিলেন ব্রাহ্মণ । সর্পগণের পরিত্রাণ ও পিতৃগণের উদ্ধারের নিমিত্ত তার জন্ম হয়েছিল। মাতার নিকট এই ইতিহাস শুনে তিনি সর্পগণকে উদ্ধার করতে যাত্রা করেন।
যজ্ঞস্থানে পৌঁছে আস্তীক সেখানে প্রবেশের চেষ্টা করলে দ্বারপাল তাকে বাধা দেয়। তখন তিনি রাজা জন্মেজয়ের নামে স্তুতি করতে থাকেন। জন্মেজয় তাতে প্রসন্ন হয়ে তাকে বর দিতে চাইলে ব্রাম্ভণগণ জানান যে এখনও যজ্ঞ সম্পন্ন হয় নি। তাই আগে তক্ষককে আনার প্রয়াস করতে হবে। তখন ঋত্বিকগণ ইন্দ্রকে আহ্বান করেন। ইন্দ্র বিমান সহযোগে যজ্ঞস্থলে এলেন, তক্ষক তার উত্তরীয়তে লুকিয়ে রইল। জন্মেজয় ক্রদ্ধ হয়ে ইন্দ্রসহ তক্ষককে অগ্নিতে নিক্ষেপ করতে নির্দেশ দেন। ভীত ইন্দ্র তক্ষককে পরিত্যাগ করে যজ্ঞস্থান থেকে পলায়ণ করলে তক্ষক মোহগ্রস্তের ন্যায় যজ্ঞাগ্নির অভিমুখে আসতে লাগল।
তখন রাজা নিশ্চিন্ত হয়ে আস্তীককে বর দিতে চাইলে তিনি যজ্ঞ নিবৃত্ত করতে বলেন। রাজা ধনরত্ন যাচ্ঞা করতে বলে ব্যর্থ হন। অবশেষে ব্রাম্ভণদের পরামর্শে তিনি বর দিতে সম্মত হন। আস্তীক অভীষ্ট বর পেলেন, যজ্ঞ সম্পন্ন হল।
কুশধ্বংস
তক্ষকনিধনে ব্যর্থ হয়ে জন্মেজয়ের সমস্ত ক্রোধ গিয়ে পড়ে ব্রাম্ভণকুলের ওপর। তার পিতা রাজা পরীক্ষিত ধর্মশীল নামে জগৎখ্যাত ছিলেন। কিন্তু শমীক মুনি অবিবেচকের মতো তাকে অভিশাপ দিলেন, আবার এক ব্রাম্ভণকে দান করার জন্যই তক্ষকনিধন না করেই সর্পসত্র যজ্ঞ সমাপ্ত করতে হল। ক্রোধে তার সর্বাঙ্গ জ্বলতে থাকে। রাজা জন্মেজয় তার সভাসদগণের সামনে অঙ্গীকার করেন যে রাজ্যে যত দ্বিজ আছে তাদের সমূলে বিনাশ করবেন। রাজার এই বাণী শুনে সভাসদগণ নীরব হয়ে যান। সভাকে নিরুত্তর দেখে তিনি পুনরায় নিজের সিদ্ধান্ত জানান। তখন সভার নীরবতা ভঙ্গ করে প্রবীণ মন্ত্রী জানান যে ক্রোধের বশে কিছু করা উচিত নয়। ভৃগুবংশীয় পরশুরামের ক্ষোভে সমস্ত সংসার ক্ষত্রিয়হীন হয়ে যায়। পরে ব্রাম্ভণ থেকে পুনরায় ক্ষত্রিয়কুলের সৃষ্টি হয়। ব্রাম্ভণের ক্রোধ তার বচন দ্বারা নির্গত হয়। সে বাক্যপ্রয়োগের দ্বারা সমস্ত সংসারের সৃষ্টি বা ধ্বংস করতে পারে। অগ্নি, সূর্য বা কালসর্প থেকে রক্ষার উপায় আছে। কিন্তু ব্রাম্ভণের হাত থেকে রক্ষার উপায় নেই। মন্ত্রীর এই কথায় চিন্তিত হয়ে জন্মেজয় তার কাছে উচিত পরামর্শ চান। মন্ত্রী তখন বলেন যে ব্রাম্ভণ সবসময় কুশযুক্ত থাকেন। কুশোদক পান করে তারা পবিত্র হয় এবং নানা যজ্ঞ করেন। কুশ বিনা ব্রাম্ভণ যখন হীনবীজ ও কর্মহীন হয়ে ব্রাম্ভণত্ব হারিয়ে ফেলবে তখন তাদের ধ্বংস করা যাবে অনায়াসে। সুতরাং কুশবৃক্ষ ধ্বংস হলে ব্রাম্ভণ আপনিই বিনাশের পথে যাবে। মন্ত্রীর বিচার শুনে উৎফুল্ল রাজা রাজ্যের সমস্ত মালিকে ডেকে যেখানে যত কুশবৃক্ষ আছে তা সমূলে উৎপাতিত করতে নির্দেশ দিলেন। রাজার আদেশ শুনে মন্ত্রী প্রমাদ গুনলেন। তিনি রাজাকে বললেন এইভাবে কুশবৃক্ষ ধ্বংস করলে সমস্ত বিশ্ব জানবে রাজা জন্মেজয় ব্রাম্ভণ বিদ্বেষে কুশবৃক্ষ ধ্বংস করেছেন। এর ফলে ব্রাম্ভণবধের নিন্দা রাজার ওপরই বর্ষিত হবে। কুশবৃক্ষ ধ্বংসের জন্য কুশবৃক্ষ ছেঁড়ার প্রয়োজন নেই। কিছু ঘি, দুধ আর গুড় কুশবৃক্ষের গোড়ায় ঢেলে দিলে গুড়ের লোভে পিপঁড়ে হবে এবং পিপঁড়েরাই বৃক্ষের মূল কেটে দেবে। এতে কার্যসিদ্ধিও হবে, কিন্তু লোকে রাজার ব্রাম্ভণ বৈরীতার কথা জানতে পারবে না। মন্ত্রীর বুদ্ধি সাদরে গ্রহণ করেন রাজা জন্মেজয়। তিনি গোপনে চর পাঠিয়ে রাজ্যের সমস্ত কুশবৃক্ষের গোড়ায় ঘি, দুধ ও গুড় ঢেলে দিলেন। ধীরে ধীরে কুশবৃক্ষ পিপীলিকার আস্তানা হয়ে ওঠে। তখন কুশের অভাবে ব্রাম্ভণগণ চিন্তিত হয়ে নিজেদের মধ্যে সভা ডাকেন, 'কুশ ছাড়া কীভাবে ব্রাম্ভণের দৈনন্দিন কর্ম পরিচালিত হবে।'
ব্রাম্ভণকুলের এই সংকটের সংবাদ বদরিকা আশ্রমে ব্যাসদেবের কানে পৌঁছায়। তিনি ধ্যানযোগে সব জানতে পেরে হস্তিনাপুরে আসেন এবং জন্মেজয়কে জানান যে পরীক্ষিতের জন্মের সময়ই কোষ্ঠী গণনা করে বলা হয়েছিল জাতকের মৃত্যু হবে সর্পাঘাতে। এক্ষেত্রে ব্রাম্ভণ নিমিত্তমাত্র। ব্যাসদেবের কথায় জন্মেজয় সমস্ত বৈরীতা ত্যাগ করলেন। সুরক্ষিত হল ব্রাম্ভণকুল।
অশ্বমেধ যজ্ঞ
ব্রাম্ভণ হত্যা করে জন্মেজয়ের মনে তীব্র অনুশোচনার সৃষ্টি হয়। তিনি স্থির করেন পাপমুক্ত হওয়ার জন্য অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন। তার কথা শুনে ব্যাস জানান কলিকালে অশ্বমেধ যজ্ঞ নিষিদ্ধ। কিন্তু জন্মেজয় তার বাক্য উপেক্ষা করেন। উপরন্তু তীব্র উপহাস করে বলেন তার পূর্বপুরুষ যখন এই যজ্ঞ করতে পেরেছেন তখন তিনিও করতে পারেন। এই বিশ্বে তাকে বাধা দেওয়ার মত কেউ নেই। ব্যাসদেব এতে বিরক্ত হয়ে সেই স্থান ত্যাগ করেন।
রাজা জন্মেজয় অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন শুরু করেন। তিনি সর্বসুলক্ষণ একটি অশ্বের কপালে জয়পত্র লিখে সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে তা ছেড়ে দেন। অশ্ব নিজ ইচ্ছানুসারে যে রাজ্য অতিক্রম করে সেই রাজ্যের রাজা জয়পত্র দেখে বশ্যতা স্বীকার করেন। অশ্ব পৃথিবী দর্শন করে ফিরে এলে রাজা জন্মেজয় সর্বদেশের রাজাদের যজ্ঞদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ করেন। যজ্ঞের আয়োজন করতে একবছর অতিবাহিত হয়। তারপর এল চৈত্র-পূর্ণিমার শুভ তিথি। রাজা জন্মেজয়ের স্ত্রী বপুষ্টমাও যজ্ঞ শুরু হওয়ার পূর্বে যজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে পালন হওয়ার জন্য নিষ্ঠা সহকারে অসি-পত্র-ব্রত পালন করেন। অবশেষে যজ্ঞ শুরু হয় এবং যজ্ঞে নিবেদিত অশ্বের বলিপ্রদান করে যজ্ঞ সম্পন্ন হয়।
অশ্বমেধ যজ্ঞ সুসম্পন্ন হতে দেখে স্বর্গে দেবরাজ ইন্দ্র চিন্তা করলেন, কলিকালে অশ্বমেধ যজ্ঞ বেদনিন্দার শামিল। এতে তারই নিন্দা হবে। এইসব চিন্তা করে তিনি ক্রুদ্ধ যজ্ঞস্থলে পড়ে থাকা কাটামুণ্ডের মধ্যে প্রবেশ করলেন। প্রবেশ করা মাত্রই কাটামুণ্ডটি আপনা থেকেই নাচতে শুরু করে। এই ঘটনায় অন্যান্য সকলে ভীত হয় এবং রাজা জন্মেজয়ের কপালে পড়ে চিন্তার ভাঁজ। ইতিমধ্যে এক ব্রাম্ভণ বালক বালকসুলভ চপলতায় কাটামুণ্ডের সঙ্গে তালি দিতে দিতে নাচতে শুরু করলে জন্মেজয় অধৈর্য হয়ে সম্মুখে রাখা বলিপ্রদানের খড়গ দ্বারা বালকটিকে কেটে খণ্ড খণ্ড করে ফেলেন।
এই দৃশ্য দেখে যজ্ঞস্থল মূহূর্তের মধ্যে রণভূমিতে পরিণত হয়। ব্রাম্ভণগণ ক্ষুব্ধ হয়ে উপহার সামগ্রী ফেলে যজ্ঞস্থান ত্যাগ করেন এবং রাজ্যবাসীও রাজাকে ত্যাগ করেন। এমন সময় আবার ব্যাসদেবের আগমন ঘটে। তিনি জন্মেজয়কে বলেন যে তিনি পূর্বেই অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে নিষেধ করেছিলেন। রাজা তখন তার কাছে পাপমুক্তির উপায় জানতে চান। তিনি বলেন কলিযুগে মহাভারতের পাঠ শুনলেই সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। মহাভারতের পাঠ শোনার সময় মাথার ওপর কালো চাঁদোয়া টাঙাতে বলেন। পাঠ যত অগ্রসর হবে ততই কৃষ্ণবর্ণের চাদর শুল্কবর্ণ ধারণ করবে। একথা শুনে রাজা ব্যাসদেবকে মহাভারতের পাঠ শোনাতে অনুরোধ করেন। ব্যাসদেব জানান মহাভারতের অনেক বিস্তার, কিন্তু তার কাছে সময় কম। তাই তার শিষ্য বৈশম্পায়ণ জন্মেজয়কে মহাভারতের পাঠ শোনাবেন। সকলে তার আজ্ঞা মাথা পেতে গ্রহণ করল। এরপর শুরু হল মহাভারত পাঠ। রাজা ও উপস্থিত বিস্মিত হয়ে দেখলেন কৃষ্ণবর্ণ চাঁদোয়া শুক্লবর্ণ ধারণ করল। নিষ্পাপ হলেন রাজা জন্মেজয়।
তথ্যসূত্র
আরো পড়ুন
- কালীপ্রসন্ন সিংহ: মহাভারত
- রাজশেখর বসু: মহাভারত সারানুবাদ