চলন বিল
চলন বিল বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি বৃহৎ বিল। এটি নাটোর, সিরাজগঞ্জ, এবং পাবনা জেলা জুড়ে বিস্তৃত। এটি মূলত অনেকগুলি ছোট বিলের সমষ্টি। সাতচল্লিশটি নদী ও অন্যান্য জলপথ চলন বিলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়।[1] এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিল এবং সমৃদ্ধ জলাভূমি।[2] এর জলজ পরিবেশ ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১২টি গোত্রের ২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাস। ভৌগোলিকভাবে এটি আত্রাই ও বড়াল নদীর সংকোচনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, এবং যমুনা নদীর অন্যতম জল নিষ্কাশক প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। ১৯৮৬ সালের জরিপ মতে চলনবিলের আয়তন ৮০০ বর্গমাইল বা প্রায় ২০৭২ কিলোমিটার। বর্তমানে বিলটিতে পলিমাটি জমার ফলে এর আকার সংকুচিত হয়ে আসছে।[2]
চলন বিল | |
---|---|
চলন বিল | |
অবস্থান | পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ |
স্থানাঙ্ক | ২৪.৫২° উত্তর ৮৯.২২° পূর্ব |
ধরন | বৃহৎ বিল |
প্রাথমিক অন্তর্প্রবাহ | আত্রাই সহ আরও ৪৬টি নদনদী[1] |
অববাহিকার দেশসমূহ | বাংলাদেশ |
পৃষ্ঠতল অঞ্চল | ২,০৭২ বর্গকিলোমিটার (৮০০ বর্গমাইল) |
গড় গভীরতা | ২ মিটার (৬.৬ ফুট) |
সর্বাধিক গভীরতা | ৪ মিটার (১৩ ফুট) |
ইতিহাস
বাংলার ইতিহাসে নদীর আধিপত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল নদীগুলোর দ্বারা বাহিত পলির বিশাল অনুপাত। এটি পলি যা জমি তৈরি করেছে এবং এটিকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাসযোগ্য করে তুলেছে। পলি জমিকে উর্বর করেছে। তবে উপকারী সেই পলিও এখন বাংলার মানুষের মুখোমুখি বেশিরভাগ নদী সমস্যা তৈরি করেছে। পুরানো নদী চ্যানেলের বেডে জমা পলি তাদের গতিপথ পরিবর্তন করতে করেছে এবং নতুন এলাকার উন্নয়নে সহায়তা করার সময় পরিত্যক্ত এলাকার জন্য সমস্যা তৈরি করেছে।[3]
গঙ্গা নদীর পানির প্রধান আয়তন পদ্মা চ্যানেল দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে ষোড়শ শতাব্দীতে। পদ্মার পলি উত্তরবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চল গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। ১৭৮৭ সালে তার গতিপথ পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত তিস্তা এই অঞ্চলে সক্রিয় ছিল। এই অঞ্চলটি সক্রিয় ছিল যখন তিস্তা ব্যবস্থার দ্বারা উত্তরে উত্থাপিত জমি এবং দক্ষিণে পদ্মার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত।[4]
ভেন ডেন ব্রুকের ১৬৬০ সালের মানচিত্রে পদ্মার প্রধান চ্যানেলটি ফরিদপুর-বাখরগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত দেখানো হয়েছে। পদ্মা নদী মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হওয়ার আগে রাজশাহীর রামপুর বোয়ালিয়া , চলন বিল, ধলেশ্বরী এবং বুড়িগঙ্গার মধ্য দিয়ে চলে । তখন যমুনা কার্যত অস্তিত্বহীন ছিল এবং ব্রহ্মপুত্র তার পুরাতন চ্যানেল দিয়ে প্রবাহিত হত।[5]
রেলওয়ের প্রভাব
১৯৪৫ সালে গৃহীত একটি অনুমান প্রায় ১,৫৪৭ বর্গ মাইল (৪,০১৯ কিমি২) এর জলাশয় চলন বিলের মধ্যে প্রায় ৪৭ টি নদী এবং অন্যান্য জলপথ প্রবাহিত হয়েছিল। অনেক নৌপথের ক্রসরোড হওয়ার পাশাপাশি এটি দক্ষিণ বা পূর্ব দিকে প্রবাহিত অনেক নদীর উৎপত্তিস্থল হিসেবে কাজ করে যা অবশেষে পদ্মা বা যমুনার সাথে মিলিত হয়। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে, পশ্চিমে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে মেইন লাইন এবং উত্তরে সান্তাহার-বগুড়া শাখা লাইন নির্মাণের মাধ্যমে চলন বিলকে হেম করা শুরু হয়। এই এলাকার জলের নিষ্কাশন চ্যানেলগুলির প্রাকৃতিক প্যাটার্ন রেলপথ নির্মাণের বাধার কারণে ব্যাহত হয়েছিল কারণ এই নিচু জমিতে রেলপথ নির্মাণ করতে হয়েছিল।[1]
উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত
বিলের পাড় কাশ , বাবলা , নল , ঢোল কলমি , সিমুল ও খেজুরের ঘন ষ্টেন্ডে ঢাকা । সাত প্রজাতির ব্যাঙ এবং এক প্রজাতির টড উভচর প্রাণীর প্রতিনিধিত্ব করে। চলন বিলের মোট ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে, যার মধ্যে দশটি কচ্ছপ ও কাছিম, নয়টি টিকটিকি এবং বিভিন্ন প্রজাতির সাপ রয়েছে। ১২টি গোত্রের ২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে।[6]
অবস্থান
চলন বিল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জলাভূমি অঞ্চল। নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা এই তিন জেলার নয়টি থানা মিলে চলন বিলের অবস্থান। নাটোরের নলডাঙ্গা, সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম; সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া (আংশিক) ও নবগঠিত সলঙ্গা এবং পাবনা জেলার ভাঙ্গুরা ও চাটমোহর থানা এলাকাকে বর্তমানে চলন বিল অঞ্চল নামে অভিহিত করা হয়। চলনবিলের উত্তরে বগুড়া জেলাসীমা, দক্ষিণে পাবনা জেলার আটঘরিয়া ও ইশ্বরদী থানা, পূর্বে উল্লাপাড়া সিরাজগঞ্জ রেললাইন এবং পশ্চিমে নওগাঁ জেলার আত্রাই ও রানীনগর থানা। রানীনগর থানার পারিল ইউনিয়নের রক্তদহ বিল এককালে চলনবিলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে এটি চলনবিলের উত্তর-পশ্চিম সীমা নির্দেশ করছে।[7]
গঠন
চলন বিলের গঠন ঐতিহাসিকভাবেই আত্রাই ও বড়াল নদীর সংকোচনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আত্রাই নদী ছিল চলন বিলের প্রধান যোগান দানকারী প্রণালী যা বৃহত্তর রাজশাহী জেলার উত্তরাংশ ও দিনাজপুর এলাকার জল নিষ্কাশন করত। বড়াল চলন বিল থেকে জল নির্গম পথ হিসেবে কাজ করে এবং বিলের পানি বহন করে যমুনা নদীতে ফেলে। চলন বিলের মধ্য দিয়ে বেশ কয়েকটি নদী প্রবাহিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- করতোয়া, আত্রাই, গুড়, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, ভাদাই, চিকনাই, বরোনজা, তেলকুপি ইত্যাদি।[7]
নামকরণ
সরদার আব্দুল হামিদ তাঁর 'চলনবিলের ইতিকথা'য় চলনবিল নামকরনের প্রসংঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সেখানে চলনবিলের নামকরণের সাথে চোল সমুদ্রের কথাটি এসেছে। চলনবিলের এই নিচু এলাকার সাথে যুক্ত ছিল ছোট বড় বেশ কিছু নদী। নদীর সংযোগের কারণে চলনবিলের পানি সবসময় চলমান থাকতো। প্রাচীনকালে উরিষ্যা অঞ্চলে চোল রাজবংশ এবং চোল সমুদ্র বা চোল হ্রদ ছিল বলে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। ফলে চোলা রাজবংশ বা চোলা বিল থেকেও চলনবিলের নামকরণ হতে পারে ধারণা করা হয় ।
বর্তমানে চলনবিল অনেক ছোটো হয়ে গেছে, কিন্তু বর্ষাকালে চলবিল উগ্রমূর্তি ধারণ করে। নদী,খাল, জোলা, খাড়িসমূহ চলনবিলকে এমনভাবে বেঁধে আছে যে, স্বাভাবিকভাবেই বর্ষাকালে এর জলরাশিতে স্রোত বয়। আর এই স্রোতের চলমানতার কারণেই চলনবিল নামকরণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।[7]
আয়তন
গঠিত হওয়ার সময় চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১ হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে এর আয়তন অনেক কমে এসেছে। চলনবিলের আয়তন ৫০০ বর্গমাইল বা প্রায় ১৪২৪ বর্গকিলোমিটার।[8] ১৯৮৬ সালের কোন জরিপ মতে চলনবিলের আয়তন ৮০০ বর্গমাইল বা প্রায় ২০৭২ কিলোমিটার।[9][10] পূর্ব-পশ্চিমে দৈর্ঘ্য ৩২ মাইল এবং উত্তর দক্ষিণে প্রস্থ সাড়ে ২৪ মাইল। বর্তমানে চলনবিল অনেকখানি হ্রাস পেয়ে আয়তন দাঁড়িয়েছে ১১৫০ বর্গ কিলেমিটারে। শুধু বাংলাদেশ নয় সমগ্র পাক-ভারত উপমহাদেশে চলনবিলের ন্যায় আয়তন বিশিষ্ট আর কোনো বিল আছে বলে জানা যায় না।
বিলসমূহ
আসলে চলনবিল অনেকগুলো ছোট ছোট বিলের সমষ্টি।[2] চলন বিল গঠনকারী ছোট ছোট বিলগুলি পশ্চিম থেকে পূর্বে যথাক্রমে:
- পূর্ব মধ্যনগর
- পিপরুল
- ডাঙাপাড়া
- লালোর
- তাজপুর
- নিয়ালা
- চলন
- মাঝগাঁও
- ব্রিয়াশো
- চোনমোহন
- শাতাইল
- খরদহ
- দারিকুশি
- কাজীপাড়া
- গজনা
- বড়বিল
- সোনাপাতিলা
- ঘুঘুদহ
- কুরলিয়া
- চিরল
- দিক্ষিবিল এবং
- গুরকা
- হালতি
বড় আকারের বিলগুলির বেশিরভাগই পাবনা জেলায় অবস্থিত, যেমন- গজনা বিল, বড়বিল, সোনাপাতিলা বিল, ঘুঘুদহ, চিরল বিল এবং গুরকা বিল। গজনা বিল দুলাই-এর দক্ষিণে ১২৩ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে অবস্থিত। বড়বিলের আয়তন ৩১ বর্গ কিমি। প্রায় ৩৫ বর্গ কিমি আয়তনের সোনাপাতিলা বিল পাবনা জেলার উত্তরাংশ জুড়ে অবস্থিত। চাটমোহর উপজেলায় কুরলিয়া ও দিক্ষিবিল দুটি যথাক্রমে ১৮ ও ১৫ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে অবস্থিত। চিরল ও গুরকা বিল- উভয়েরই আয়তন ৮ বর্গ কিমি এবং ঘুঘুদহ ৪ বর্গ কিমি।
চিত্রশালা
- পড়ন্ত বিকলে চলনবিল
- শরৎকালের চলনবিল
- মেঘলা দিনে চলনবিল
- চলনবিলের কিনারা
- সূর্যাস্তের দৃশ্য
ক্ষতিকর প্রভাব
চলন বিল বেশ দ্রুত ভরাট হয়ে আসছে। জমি পুনরুদ্ধার হচ্ছে এবং বিলের ধার দিয়ে গড়ে উঠছে গ্রাম। কেবল কেন্দ্রের গভীরতম অংশটুকু ছাড়া শুকনো মৌসুমে সমস্ত ছোট-বড় বিল শুকিয়ে যায়। [11]
তথ্যসূত্র
- Srinivasan, Roopa; Tiwari, Manish; Silas, Sandeep (২০০৬)। Our Indian Railway: Themes in India's Railway History। নতুন দিল্লি: Foundation Books। আইএসবিএন 81-7596-330-1। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১১-২৯।
- মোহা. শামসুল আলম ও মোঃ সাজ্জাদ হোসেন (২০১২)। "চলন বিল"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- Majumdar, S.C.,p. 54
- Majumdar, S.C., Chief Engineer, Bengal, Rivers of the Bengal Delta, Government of Bengal, 1941. p. 109–110
- Roy, Niharranjan, Bangalir Itihas, Adi Parba, (বাংলা ভাষায়), first published 1972, reprint 2005, p. 83, Dey’s Publishing, 13 Bankim Chatterjee Street, Kolkata, আইএসবিএন ৮১-৭০৭৯-২৭০-৩
- Nishat, Ainun; Huq, S. M. Inamul; Barua, Shuvasish P.; Reza, Ali A. H. M.; Khan, A. S. Monirazzaman, সম্পাদকগণ (২০০২)। Bio-ecological zones of Bangladesh। International Union for Conservation of Nature Bangladesh Country Office। আইএসবিএন 978-984-31-1090-9। সংগ্রহের তারিখ ২৯ নভেম্বর ২০০৭।
- "চলন বিল: উৎপত্তি ও নামকরণ প্রসঙ্গে"। Platform for Human Trend & Cultural Heritage (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৭-০৩-১২। ২০১৯-০৭-০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-৩০।
- ১৯১৯ সালে ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া
- ১৯৬৮ সালের জরিপ
- মোর্শেদ, সারোয়ার (২০১৯-১০-১২)। "প্রকৃতির লীলাভূমি চলনবিল"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-৩০।
- "চলন বিল"। বাংলা পিডিয়া। ১৫ এপ্রিল ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ ডিসেম্বর ২০১৯।