চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন ছিল ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সংঘটিত সূর্য সেন-এর নেতৃত্বে কয়েকজন স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীর ব্রিটিশ পুলিশ ও সহায়ক বাহিনীর চট্টগ্রামে অবস্থিত অস্ত্রাগার লুন্ঠনের প্রয়াস।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
সূর্য সেন, অস্ত্রাগার লুন্ঠনের নেতা | |||||||
| |||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
সূর্য সেন |
অনুশীলন সমিতি |
---|
প্রভাব |
অনুশীলন সমিতি |
উল্লেখযোগ্য ঘটনা |
সম্পর্কিত প্রসঙ্গ |
বিপ্লবীরা
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সাথে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী অসীমসাহসী বিপ্লবীরা। এই বিপ্লবীদের নেতৃত্বে ছিলেন মাষ্টারদা সূর্য্যসেন। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং,অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্কশেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। এদের সাথে সুবোধ রায় নামক ১৪ বছরের এক বালকও ছিলেন।
পরিকল্পনা
সূর্য সেনের পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রাম শহরের অস্ত্রাগার দুটো লুট করা, এরপর টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংস করা এবং এরপর সরকারি ও সামরিক বাহিনীর অফিসারদের ক্লাব ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলা চালানো। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিলো ব্রিটিশদের অস্ত্রশস্ত্র লুট করা এবং রেল ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়া।
অস্ত্রাগার লুন্ঠন
অভিযান শুরু হয় ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল, রাত দশটায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী পুলিশ অস্ত্রাগারের এবং লোকনাথ বাউলের নেতৃত্বে দশজনের একটি দল সাহায্যকারী বাহিনীর অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা গোলাবারুদের অবস্থান শনাক্ত করতে ব্যর্থ হন। বিপ্লবীরা সফলভাবে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হন এবং রেল চলাচল বন্ধ করে দেন। ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা - এই নামের অধীনে সর্বমোট ৬৫ জন বিপ্লবী এই বিপ্লবে অংশ নেন। সফল বিপ্লবের পর বিপ্লবী দলটি পুলিশ অস্ত্রাগারে সমবেত হন এবং সেখানে মাস্টারদা সূর্য সেনকে মিলিটারী স্যালুট প্রদান করা হয়। সূর্য সেন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করেন। রাত ভোর হবার পূর্বেই বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম শহর ত্যাগ করেন এবং নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে যাত্রা করেন। এবং পাহাড়ের গায়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন।।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সাথে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী অসীমসাহসী বিপ্লবীরা। এই বিপ্লবীদের নেতৃত্বে ছিলেন মাষ্টারদা সূর্য্যসেন। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্কশেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাশগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। এদের সাথে সুবোধ রায় নামক ১৪ বছরের এক বালকও ছিলেন।
ফলাফল
কয়েক দিন পরে, পুলিশ বিপ্লবীদের অবস্থান চিহ্নিত করে। চট্টগ্রাম সেনানিবাস সংলগ্ন জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া বিপ্লবীদের কয়েক হাজার সৈন্য ঘিরে ফেলে ২২ এপ্রিল ১৯৩০ সালে।
দুই ঘণ্টার প্রচন্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন শহীদ হন।[1] এঁরা হচ্ছেন, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, হরিগোপাল বল, মতিলাল কানুনগো, প্রভাসচন্দ্র বল, শশাঙ্কশেখর দত্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাশগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, এবং অর্ধেন্দু দস্তিদার।[2] জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে অংশ নিয়ে পলায়ন করতে সক্ষম হলেও পরবর্তীকালে পুলিসের আক্রমণে দুজন শহীদ হন, এঁরা হচ্ছেন অপূর্ব সেন এবং জীবন ঘোষাল।
সূর্য সেন ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে তার লোকজনকে পার্শ্ববর্তী গ্রামে লুকিয়ে রাখে এবং বিপ্লবীরা পালাতে সক্ষম হয়। কলকাতা পালিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন গ্রেফতার হয়। কয়েকজন বিপ্লবী পুনরায় সংগঠিত হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ সালে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে দেবপ্রসাদ গুপ্ত, মনোরঞ্জন সেন, রজতকুমার সেন, স্বদেশরঞ্জন রায়, ফণিভূষণ নন্দী এবং সুবোধ চৌধুরী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে এবং এক মহিলা মারা যায়। কিন্তু তাদের পরিকল্পনায় বিপর্যয় ঘটে এবং দেবপ্রসাদ গুপ্ত, মনোরঞ্জন সেন, রজতকুমার সেন, স্বদেশরঞ্জন রায় নিহত হয় এবং ফণিভূষণ নন্দী এবং সুবোধ চৌধুরী আহত হন এবং ধরা পড়েন। ১৯৩০ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ২২ কর্মকর্তা ২২০ জন বিপ্লবী দ্বারা নিহত হয়। দেবী প্রসাদ গুপ্তের ভাই আনন্দ প্রসাদ গুপ্তকে বিচারের মাধ্যমে নির্বাসন দেয়া হয়।
১৯৩৩ সালে মাস্টারদা সূর্যসেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের মৃত্যুদণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য চট্টগ্রাম যুব বিপ্লবী দলের চার জন সদস্য ইউরোপীয় ক্লাব (পল্টন) মাঠে ইংরেজদের ক্রিকেট খেলার সময় ৭ জানুয়ারি, ১৯৩৪ তারিখে বোমা ও রিভলভারের সাহায্যে কয়েকজন অফিসারকে আক্রমণ করেন। এতে পুলিস সুপার পিটার ক্লিয়ারি নিহত হয় এবং কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ আহত হন। মিলিটারির পাল্টা আক্রমণে ঘটনাস্থলে নিত্যরঞ্জন সেন এবং হিমাংশুবিমল চক্রবর্তী নিহত হন। কৃষ্ণকুমার চৌধুরী এবং হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী গ্রেপ্তার হন।[3] বিচারে দুজনেরই ফাঁসি হয় এবং ১৯৩৪ সনের ৭ জানুয়ারি কৃষ্ণকুমার চৌধুরীর ফাঁসি বহরমপুর জেলে কার্যকর করা হয়। একই দিন হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেন।[2][3]
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায় অনন্ত সিং, লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ, লালমোহন সেন, সুবোধ চৌধুরী, ফণিভূষণ নন্দী, আনন্দ গুপ্ত, ফকির সেন, সহায়রাম দাস, বনবীর দাসগুপ্ত, সুবোধ রায় এবং সুখেন্দু দস্তিদারের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হয়।[2] এই মামলায় অভিযুক্ত সকল বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলার পাশাপাশি 'বিস্ফোরক পদার্থ আইন, ১৯০৮'-এর ৪বি ধারা এবং 'ভারতীয় অস্ত্র আইন, ১৮৭৮'-এর ১৯এফ ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছিল। মামলায় বিপ্লবীদের পক্ষে মামলা লড়েছিলেন শরৎচন্দ্র বসু, সন্তোষকুমার বসু এবং বীরেন্দ্রনাথ শাসমল।
বিচার
হামলায় গ্রেপ্তারকৃতদের বিচার সমাপ্ত হয় ১ জানুয়ারি ১৯৩২ সালে এবং রায় ঘোষণা করা হয় ১ মার্চ ১৯৩২ সালে। আসামীদের মধ্যে ১২ জনকে নির্বাসন, ২ জনকে তিন বছরের জেল এবং বাকি ৩২ জনকে খালাস দেয়া হয়।
গ্রেপ্তার ও সূর্য সেনের মৃত্যু
সূর্য সেন গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিলেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩ সালে, রাতে সেখানে বৈঠক করছিলেন কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত, ব্রজেন সেন আর সুশীল দাসগুপ্ত। পুরস্কার টাকা বা ঈর্ষা, বা উভয়ের জন্য, ব্রজেন সেনের সহোদর নেত্র সেন সূর্য সেনের উপস্থিতির খবর পুলিশকে জানিয়ে দেয়।[4] সেখানে অস্ত্রসহ সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন। ধরা পড়ার সময় পুলিশ অফিসার মি: হিকস মাস্টারদাকে বলে, " I shall hang you "
হিকস সদলবলে চলে যাবার পর মাস্টারদা ব্রজেনকে বললেন -
"আমিও ফাঁসি চাই। আমার ফাঁসি হবে। তোমরা রইলে। জেল থেকে বেরিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করবে। ধলঘাটের বিশ্বাসঘাতকতা নিরক্ষর গ্ৰাম্য লোকের দ্বারা হয়েছিল বলে ক্ষমা করেছি। এবারের বিশ্বাসঘাতকতা যেন কিছুতেই ক্ষমা না পায়। আমাদের দুর্বলতা যেন প্রকাশ না পায়। এতে বিপ্লবী কাজের খুব ক্ষতি হবে। "
প্রধানত মাস্টারদার নির্দেশেই হত্যা করা হয় নেত্র সেনকে। [5]নেত্র টাকা পাবার আশায় আনন্দে দিন গুনতে থাকে। কিন্তু টাকা পাওয়ার আগেই কিরণ সেন নামক এক বিপ্লবী (কাকতালীয়ভাবে কিরণ সেনের নেত্রর বাড়িতে যাতায়াত ছিল, ব্রজেন সেনের বন্ধু হিসেবে)র হাতে তার মুণ্ডচ্ছেদ হয় ৯ই জানুয়ারি ১৯৩৪ সালে (মাস্টারদার ফাঁসির মাত্র তিন দিন পূর্বে)। কিরণময় সেনের সাথে ছিলেন আরেক বিপ্লবী রবীন্দ্র (খোকা) নন্দী।
১২ জানুয়ারি ১৯৩৪ সালে তারকেশ্বর দস্তিদারসহ সূর্য সেনকে ব্রিটিশ সরকার ফাঁসি কার্যকর করে।[6]
চলচ্চিত্র
১৯৪৯ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন নামে বাংলা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এটি পরিচালনা করেন নির্মল চৌধুরী।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন নিয়ে ২০১০ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র খেলে হাম জি জান সে নির্মাণ করেন পরিচালক আশুতোষ গোয়ারিকার।
এছাড়া, চিটাগং (চলচ্চিত্র) নামে আরেকটি হিন্দি চলচ্চিত্র তৈরি করেন বেদব্রত পাইন ২০১০ সালে এবং মুক্তি পায় ২০১২ সালে।
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
- পূর্ণেন্দু দস্তিদার (২০০৯)। স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম। ঢাকা: অনুপম প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ১২২।
- ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, জেলে ত্রিশ বছর, পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ধ্রুপদ সাহিত্যাঙ্গন, ঢাকা, ঢাকা বইমেলা ২০০৪, পৃষ্ঠা ১৭৮, ১৯৩।
- সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৩৫৭, ৮৬৪, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
- পটিয়ার ইতিহাস ও আতিথ্য, এস এম এ কে জাহাঙ্গীর, ১৯৯৮, চট্টগ্রাম
- পাল, রুপময় (১৯৮৬)। সূর্য সেনের সোনালি স্বপ্ন। কলকাতা: দীপায়ন। পৃষ্ঠা ২২৮।
- Chandra, p.252