গ্যাব্রো
গ্যাব্রো (ইংরেজি: Gabbro; উচ্চারণ: /ˈɡæbroʊ/) একটি ফ্যানেরিটিক (স্থূল দানাযুক্ত), মাফিক অন্তঃজ আগ্নেয় শিলা, যা ভূ-পৃষ্ঠের গভীর তলদেশে ধীর শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায়, ম্যাগনেসিয়াম ও লৌহ-সমৃদ্ধ ম্যাগমা হতে সম্পূর্ণ-কেলাসিত (holocrystalline) ভরে রূপান্তরিত হয়। ধীরে শীতলীকৃত, মোটা দানার গ্যাব্রো আর দ্রুত শীতলীকৃত, সূক্ষ্ম দানার ব্যাসল্ট রাসায়নিকভাবে সমতুল্য। পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের অধিকাংশ অঞ্চলই গ্যাব্রো দ্বারা গঠিত, যা মধ্য-সাগরীয় শৈলশিরায় গঠিত হয়। মহাদেশীয় অগ্ন্যুৎপাতের সাথে সংশ্লিষ্ট প্লুটন হিসবেও গ্যাব্রো পাওয়া যেতে পারে। এর বিচিত্র স্বভাবের কারণে, "গ্যাব্রো" শব্দটি বৃহত্তর অর্থে অন্তঃজ শিলা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, যদিও এর অনেকগুলোকেই কেবল গ্যাব্রোয়িক বা গ্যাব্রো-সদৃশ বলা চলে।
ব্যুৎপত্তি
"গ্যাব্রো" শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৭৬০ এর দশকে, ইতালির অ্যাপনাইন পর্বতমালার ওফিওলাইট শিলারাজির মধ্যে প্রাপ্ত নতুন এক ধরনের শিলার নামকরণের জন্য।[1] এর নাম রাখা হয়েছিল ইতালি'র তোসকানা অঞ্চলের রোজিয়ানো মারিত্তিমো পৌরসভার নিকটবর্তী গ্যাব্রো নামক একটি গ্রামের নাম অনুসারে। এরপর ১৮০৯ সালে, জার্মান ভূতত্ত্ববিদ ক্রিশ্চিয়ান লিওপোল্ড ভন বুখ (Christian Leopold von Buch), ইতালিতে প্রাপ্ত ওফিওলাইট জাতীয় এই শিলাগুলোর বর্ণনায়, এই শব্দটিকে আরও সুনির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করেন।[2] তিনি ঐসব শিলার নাম হিসেবে "গ্যাব্রো" শব্দটি ব্যবহার করতেন, যেগুলোকে বর্তমানকালের ভূতত্ত্ববিদগণ আরও সুনির্দিষ্টভাবে "মেটাগ্যাব্রো" (রূপান্তরিত গ্যাব্রো) নামে চিহ্নিত করে থাকেন।[3]
শিলাতত্ত্ব
গ্যাব্রো একটি ঘন, সবুজাভ অথবা গাঢ় বর্ণের শিলা এবং এতে পাইরক্সিন (pyroxene), প্ল্যাজিওকেজ (plagioclase), এবং সামান্য পরিমাণে অ্যাম্ফিবোল (amphibole) ও অলিভিন (olivine) উপস্থিত থাকে।
গ্যাব্রোতে বিদ্যমান পাইরক্সিন প্রধানত ক্লিনোপাইরক্সিন, সাধারণত অগাইট, তবে সামান্য পরিমাণে অর্থোপাইরক্সিন-ও থাকতে পারে। যদি অর্থোপাইরক্সিনের পরিমাণ, মোট পাইরক্সিনের ৯৫% এর বেশি হয় (ক্লিনোপাইরক্সিনের পরিমাণ অনধিক ৫%), তাহলে ঐ শিলাকে বলা হয় নোরাইট (norite)। অন্যদিকে, গ্যাব্রোতে পাইরক্সিনের ৯৫% এর বেশি অংশই মনোক্লিনিক পাইরক্সিন জাতীয়। এ দুটির অন্তর্বর্তী শিলাগুলোকে বলা হয় গ্যাব্রো-নোরাইট। গ্যাব্রো'র উপাদান হিসেবে, ক্যালসিয়াম-সমৃদ্ধ প্ল্যাজিওক্লেজ ফেল্ডস্পার (ল্যাব্রাডোরাইট-বাইটোনাইট) এবং পাইরক্সিনের পরিমাণ শতকরা ১০ থেকে ৯০ শতাংশের মধ্যে হয়ে থাকে। যদি ৯০% এর বেশি প্ল্যাজিওক্লেজ উপস্থিত থাকে, তাহলে ঐ শিলাকে বলা হয় অ্যানোর্থোসাইট (anorthosite)। অন্যদিকে, যদি পাইরক্সিনের পরিমাণ ৯০% এর বেশি হয় (প্রায়শই উভয়ই উপস্থিত থাকে), তাকে পাইরক্সেনাইট (pyroxenite) বলা হয়। গ্যাব্রোতে সামান্য পরিমাণে অলিভিন (উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অলিভিন থাকলে "অলিভিন গ্যাব্রো"), অ্যাম্ফিবোল, এবং বায়োটাইট থাকতে পারে। গ্যাব্রোতে কোয়ার্টজ এর পরিমাণ, মোট আয়তনের ৫% এরও কম হয়ে থাকে।
'কোয়ার্টজ গ্যাব্রো' বা মঞ্জোগ্যাব্রো'র উপস্থিতিও দেখা যায়, যেমন- উত্তর-পূর্ব স্লোভেনিয়ার পোহরিয়াতে (Pohorje) প্রাপ্ত সিয্লাকিতে (cizlakite)।[4] এগুলো সম্ভবত সিলিকা দ্বারা অতিপৃক্ত ম্যাগমা হতে জাত। এসেক্সাইট (Essexite) দ্বারা ওইসব গ্যাব্রোকে বোঝায় যেগুলোর গঠনকারী ম্যাগমায় সিলিকা অসম্পৃক্ত অবস্থায় ছিল; ফলস্বরূপ আনুষঙ্গিক খনিজ হিসেবে কোয়ার্টজ গঠিত না হয়ে, নেফিলিন, ক্যানক্রিনাইট, সোডালাইট- এর মত ফেল্ডসপ্যাথয়েড-জাতীয় খনিজসমূহ গঠিত হয় (প্রাকৃতিক খনিজবিদ্যার (Normative mineralogy) সাহায্যে সিলিকার সম্পৃক্ততা মূল্যায়ন করা যায়)। গ্যাব্রোতে খুব সামান্য পরিমাণে, সচরাচর কয়েক শতাংশ হিসেবে, আয়রন-টাইটেনিয়াম অক্সাইড (যেমন- ম্যাগনেটাইট, ইল্মেনাইট, আল্ভোস্পিনেল) বিদ্যমান থাকে।
গ্যাব্রো সাধারণত স্থূল দানাদার, যার কেলাস ১ মি.মি. বা বৃহত্তর আকারের হয়ে থাকে। সূক্ষ্মতর দানার গ্যাব্রোকে বলা হয় ডায়াবেইজ (diabase; যা ডোলেরাইট (dolerite) নামেও পরিচিত); যদিও অধিকতর বর্ণনামূলক পরিচিতির স্বার্থে মাইক্রোগ্যাব্রো শব্দটিও বহুল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। গ্যাব্রো বেশ মোটা দানাযুক্ত থেকে পেগমাটাইট-সদৃশ (পেগমাটাইট এক ধরনের আগ্নেয় শিলা, যার কেলাসের আকার ২৫ মি.মি. অপেক্ষা বৃহত্তর হয়ে থাকে) হতে পারে, এবং কিছু কিছু পাইরক্সিন-প্ল্যাজিওকেজ সঞ্চিত শিলা আসলে স্থূল-দানাদার গ্যাব্রো। এদের কোন কোনটি আবার সূঁচসদৃশ স্ফটিকের (acicular crystal) ন্যায় আচরণ করে।
গ্যাব্রো'র গঠনিবিন্যাস সাধারণত সুষম-দানাদার (equigranular), যদিও এরা কখনো কখনো পর্ফিরিটিক (porphyritic; যে শিলার কাঠামোতে আকারে স্পষ্ট পার্থক্য আছে এমন দুই ধরনের কেলাস বিদ্যমান) প্রকৃতিরও হয়ে থাকে; বিশেষ করে যখন ভিত্তিভর খনিজের তুলনায় প্ল্যাজিওক্লেজ ওইকোক্রিস্ট (plagioclase oikocrysts) খনিজগুলো আগেই তৈরি হয়ে যায়।
প্রাপ্তিস্থান
পাইরক্সিন এবং প্ল্যাজিওক্লেজ এর স্বাভাবিক কেলাসকরণ প্রক্রিয়ায় বিশাল, সুষম অন্তঃজ শিলা হিসেবে গ্যাব্রো গঠিত হতে পারে। আবার পাইরক্সিন ও প্ল্যাজিওক্লেজ সঞ্চিত হয়ে স্তরীভূত অন্তঃজ শিলা হিসেবেও তা গঠিত হতে পারে। সঞ্চিত গ্যাব্রোকে আরও যথার্থভাবে পাইরক্সিন-প্ল্যাজিওক্লেজ অ্যাডকিউমুলেট নামে নির্দেশ করা হয়।
মহাসাগরীয় ভূ-ত্বকের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হচ্ছে গ্যাব্রো, যা ভূ-ত্বকীয় ৩য় ও ৪র্থ জোনে (স্তরীভূত প্রাচীর জোন থেকে বিস্তীর্ণ গ্যাব্রো জোন পর্যন্ত), ওফিওলাইট মিশ্রণের অংশ হিসেবে বিদ্যমান থাকে। আদি-চিড়বর্তী অঞ্চল ও এদের সীমানার চারপাশে অনুপ্রবিষ্ট গ্যাব্রো-বলয় গঠিত হয়, যেগুলো চিড়ের পার্শ্বভাগ দিয়ে সীমানার ভেতরে ঢুকে যায়। মাফিক ও অতিমাফিক (ultramafic) অনুপ্রবেশ এবং ব্যাসল্ট এর সমকালীন আগ্নেয়-ক্রিয়াকলাপ এর ওপর নির্ভর করে, আচ্ছাদন চূড়া (mantle plume) প্রস্তাবনা কর্তৃক তা নির্ণয় করা যেতে পারে।
প্রায় সকল গ্যাব্রোই প্লুটোনিক বস্তু'র মধ্যে পাওয়া যায়। তবে শুধুমাত্র প্লুটোনিক শিলার মধ্যেই একে সীমাবদ্ধ করাটা যথার্থ নয় (আন্তর্জাতিক ভূতত্ত্ববিজ্ঞান সমিতি, আই.ইউ.জি.এস. এর প্রস্তাবনা অনুসারে), কেননা নির্দিষ্ট কিছু ঘন লাভা'র অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠেও মোটা দানাযুক্ত গ্যাব্রো পাওয়া যেতে পারে (উদাহরণস্বরূপ, দেখুন[5])। এ কারণে কীভাবে বা কোথায় গঠিত হয়েছে, তার ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত না করে, বরং শিলার বিবরণমূলক বৈশিষ্ট্য থেকেই একে সংজ্ঞায়িত করা শ্রেয়তর।[6]
ব্যবহার
গ্যাব্রোর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মূল্যবান ধাতু, যেমন- ক্রোমিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট, স্বর্ণ, রৌপ্য, প্ল্যাটিনাম এবং কপার সালফাইডের উপস্থিতি থাকে।
গ্যাব্রোর বর্তুলাকার প্রকরণসমূহকে অলংকার পাথর, শান পাথর হিসেবে ব্যবহার করা হয়, এবং এটি বাজারে কৃষ্ণ গ্রানাইট নামেও পরিচিত। রান্নাঘরের কাউন্টারটপ হিসেবেও এর ব্যবহার রয়েছে।
আরও দেখুন
- পেরিডোটাইট - মোটা দানাবিশিষ্ট অতিমাফিক আগ্নেয় শিলা
- আগ্নেয় পৃথকীকরণ - যে সকল প্রক্রিয়ায় ম্যাগমা আংশিক গলন, শীতলীকরণ, সন্নিবেশন এবং উদ্গীরণ চলাকালে এর আয়তনিক রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে
- আংশিক কেলাসন - আগ্নেয় বা ম্যাগমা পৃথকীকরণের প্রধান একটি পদ্ধতি
তথ্যসূত্র
- Bortolotti, V. et al. Chapter 11: Ophiolites, Ligurides and the tectonic evolution from spreading to convergence of a Mesozoic Western Tethys segment in F. Vai, G.P. and Martini, I.P. (editors) (2001) Anatomy of an Orogen: The Apennines and Adjacent Mediterranean Basins, Dordrecht, Springer Science and Business Media, p. 151. আইএসবিএন ৯৭৮-৯০-৪৮১-৪০২০-৬
- Bortolotti, V. et al. Chapter 11: Ophiolites, Ligurides and the tectonic evolution from spreading to convergence of a Mesozoic Western Tethys segment in F. Vai, G.P. and Martini, I.P. (editors) (2001) Anatomy of an Orogen: The Apennines and Adjacent Mediterranean Basins, Dordrecht, Springer Science and Business Media, p. 152. আইএসবিএন ৯৭৮-৯০-৪৮১-৪০২০-৬
- Gabbro at SandAtlas geology blog. Retrieved on 2015-07-09.
- Le Maitre, R. W.; et al., eds., 2005, Igneous Rocks: A Classification and Glossary of Terms, Cambridge Univ. Press, 2nd ed., p. 69, আইএসবিএন ৯৭৮০৫২১৬১৯৪৮৬
- Arndt et al., 1977, Komatiitic and iron-rich tholeiitic lavas of Munro Township, northeast Ontario: J. Petrol., v. 18, pp. 319–69
- Robin Gill. Igneous Rocks and Processes, 2010