গোদাবরী দত্ত

গোদাবরী দত্ত একজন প্রখ্যাত ভারতীয় লোকচিত্রশিল্পী, যিনি মধুবনী চিত্রকলার পুনরজ্জীবন এবং বিশ্বজুড়ে প্রসারের জন্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ভারত ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার অঙ্কিত চিত্রকলাগুলি প্রদর্শিত হয়েছে। তার অন্যতম সেরা চিত্রশিল্প 'ত্রিশূল' জাপানের একটি যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। জাপানের বিভিন্ন শহর যেমন-ওসাকা, টোকিও, কোবে ইত্যাদিতেও তার চিত্রগুলি প্রদর্শিত হয়েছে। মধুবনী শিল্পকে জনপ্রিয়করণে তার ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিতে ভারত সরকার ২০১৯ সালে তাঁকে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার- পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করেন[1]

গোদাবরী দত্ত
জাতীয়তাভারতীয়
পেশালোকচিত্রশিল্পী
পরিচিতির কারণমধুবনী চিত্রকলার পুনরজ্জীবন

বাল্যকাল ও ব্যক্তিগত জীবন

গোদাবরীর জন্ম প্রাচীন মিথিলা অঞ্চলে অর্থাৎ অধুনা বিহার রাজ্যের দ্বারভাঙা জেলার বাহাদুরপুরে স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে; যখন কন্যাসন্তানের জন্ম পরিবারের জন্যে কোন আনন্দ বয়ে নিয়ে আসত না। স্বাভাবিকভাবেই তিনি প্রথাগত শিক্ষালাভের সুযোগ পাননি। কিন্তু লোককাহিনী অনুসারে, তার গ্রামের প্রতিটি মেয়ের জন্যে মধুবনী চিত্রাঙ্কন শেখা বাধ্যতামূলক ছিল। গোদাবরীর মা সুভদ্রা দেবী একজন প্রখ্যাত মধুবনী শিল্পী ছিলেন এবং রামায়ণ এবং মহাভারতের কাহিনী বা প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী, ফুল বা তোতার মতো প্রেমের প্রতীকগুলি আঁকার জন্য প্রায়ই আমন্ত্রিত হতেন। মায়ের কাছেই গোদাবরীর মধুবনী চিত্রাঙ্কনে হাতেখড়ি।[2] ১০ বছর বয়সেই পিতৃহারা হন তিনি। ১৯৪৭ সালে, অল্পবয়সেই গোদাবরীর বিবাহ সম্পন্ন হয় এবং পুত্রের জন্ম হয় কিন্তু কাজের সন্ধানে তার স্বামী নেপালে চলে যান এবং আর কখনও ফিরে আসেননি। [3] যৌবনে গোদাবরীর মুখের চামড়ায় শ্বেতী রোগ ধরা পড়ে এবং কালক্রমে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। [4]

কর্মজীবন

মায়ের সাথে মধুবনী আল্পনার হাতেখড়ি

মিথিলার এই অঞ্চলে বিবাহের সময় বাসরঘরের দেওয়ালে মধুবনী চিত্রাঙ্কনের প্রথা বর্তমান। মায়ের সাথে বাসরঘরের ছবি আঁকতে গিয়েই গোদাবরীর আঁকার হাতেখড়ি। নিজের আগ্রহের কারণে, বাড়িতে এসে তিনি মায়ের আঁকা চিত্রসমূহ অভ্যাস করতেন এবং এইভাবেই মধুবনী চিত্রাঙ্কনে তার দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। প্রথম দিকে দেওয়ালে অঙ্কন করতে থাকলেও, ১৯৭১ সালে প্রথম তিনি কাগজের ক্যানভাসের উপর আঁকতে শুরু করেন। গোদাবরী যে সময়ে আঁকতে শুরু করেছিলেন, তখন তুলির ব্যবহার ছিল না। তিনি আঙ্গুল, বাঁশের তৈরি নিব-কলম, গাছের ডাল ইত্যাদির সাহায্যে এবং প্রাকৃতিক বর্ণ ব্যবহার করে ছবি আঁকা শুরু করেন। প্রথমে চালবাটা দিয়ে আল্পনার রূপ রেখা তৈরি করে নিয়ে, তার মধ্যে প্রাকৃতিক রং ভরে দেওয়া হয়। কালো রং পাওয়া যেত কাঠকয়লা থেকে, হলুদ রং পাওয়া যেত হলুদবাটা থেকে, চাল থেকে সাদা, নীল থেকে নীল, গাঁদা থেকে কমলা ইত্যাদি।[2]

শিল্পী-জীবন

যখন 'সর্ব-ভারতীয় হস্তশিল্প কেন্দ্র' মধুবনী চিত্রকর্ম বিক্রি শুরু করে, গোদাবরী তাদের মাধ্যমে নিজের আঁকা চিত্র প্রচার করার সুযোগ পান। পরের কয়েক বছর ধরে, তিনি এই শিল্পকে উন্নত করার জন্য তার সমস্ত শক্তি নিবেদন করেছিলেন। তিনি ভারত জুড়ে একাধিক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন। এমনকি প্রদর্শনী করার জন্য তিনি জার্মানি এবং জাপানে বেশ কয়েকবার ভ্রমণ করেছিলেন। তার চিত্রগুলি খ্যাতি অর্জন করতে শুরু করে। তার আঁকা ছবি জনপ্রিয় হতে শুরু হলে, দালালরা তার বাড়ি থেকে চিত্র ক্রয় করতে আসতে থাকে। তার নিজের কথায় “আমি আমার চিত্রকলাগুলি ৫ টাকায় বিক্রি শুরু করেছি। আমি এক বছরে কমপক্ষে ১০ টি প্রদর্শনীতে অংশ নিই। আমি অন্যান্য লোকশিল্প যেমন ওয়ারলি, কলমকারি, পিথৌরি এবং কালিঘাট পটচিত্র থেকে অনেক কিছু শিখেছি। ভ্রমণ আমার জ্ঞান আরও বাড়িয়ে তোলে।” [2]

শিক্ষকতা

রাষ্ট্রপতি পুরস্কার বিজয়ী গোদাবরী দেশ-বিদেশের প্রায় ৫০,০০০ শিক্ষার্থীকে এই শিল্প কলাটিতে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি ভারত সরকারের "সাংস্কৃতিক সম্পদ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র" প্রকল্পের আওতায় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। [5]

স্ব-উদ্যোগ

গোদাবরী দত্ত মিথিলা চিত্রকলায় গ্রামের মহিলাদেরও জড়িত করেছেন এবং তাদের আর্থিকভাবে স্বাধীন হতে সহায়তা করেছেন। শুধু তাই নয়, মেয়েদের লেখাপড়ার প্রচারে তিনি একটি গ্রাম কমিটিও গঠন করেছেন।[5] এছাড়া তিনি জাপানের টোকোমাচিতে 'মিথিলা জাদুঘর' প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছিলেন যেখানে বিভিন্ন শিল্পীর সাড়ে আটশোটিরও বেশি মধুবনীচিত্র সংরক্ষিত রয়েছে। প্রকল্পটি শেষ করতে ৭ বছর সময় লেগেছিল যার জন্য গোদাবরী দত্তকে কিছুদিন জাপানে থাকতেও হয়েছিল। মধুবনী চিত্রকলার প্রসারের জন্যে গোদাবরী জার্মানিতেও গিয়েছেন। তার স্বপ্ন মধুবনী চিত্রকলার উপর একটি বই লেখার কারণ এখনও মধুবনী চিত্রকলার মূলনীতি গুলো প্রধানত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে মৌখিকভাবে শেখানো হয়।[6]

স্বীকৃতি ও সম্মাননা [7]

গোদাবরী দত্তকে শিল্প গুরু পুরস্কার-২০০৬ প্রদান করছেন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল
  • ১৯৮০ সালে জাতীয় পুরস্কার
  • ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপতি দ্বারা অর্পিত 'শিল্পগুরু' সম্মাননা
  • ২০১৯ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.