গুলেন বারি সিনড্রোম
গিয়েন বারে সিনড্রোম (ইংরেজি Guillain–Barré syndrome) বা ল্যান্ড্রির প্যারালাইসিস,প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণকারী অ্যাকিউট বা তীব্র পলিনিউরোপ্যাথি রোগ যার ফলে হাত-পা খুব দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে।কোন সংক্রমণ বা ইনফেকশনের পর এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়।অনুভূতিতে ভিন্নতা কিংবা ব্যাথার পর হাতে এবং পায়ে দুর্বলতা দেখা যায় যা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।রোগ খুব তীব্র হলে প্রাণঘাতী হতে পারে,তখন কৃত্তিমভাবে শ্বাসকার্য চালানোর জন্য ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। কিছু ব্যক্তির স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রে ডিসঅটোনমিয়া হলে হৃদ স্পন্দন ও রক্তচাপে গোলযোগ দেখা যায়।
গুলেন বারি সিনড্রোম | |
---|---|
চিত্র:Spirodoc FVC.jpg | |
বিশেষত্ব | স্নায়ুচিকিৎসাবিজ্ঞান |
ক্লিনিক্যালি এই রোগ অন্যান্য বিকল্প কারণ ব্যতিরেকে স্নায়ু পরিবহন পরীক্ষা ও সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়। যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন,তাদের আন্তঃশিরা ইম্যুনোগ্লোবিউলিন বা প্লাসমাফেরেসিসের মাধ্যমে নিবিড় পর্যবেক্ষণে উত্তরণ হওয়া সম্ভব,যদিও কিছু ব্যক্তির ব্যাথা,হাঁটাচলায় সমস্যা থাকতে পারে।গুলেন বারি সিনড্রোম বিরল,প্রতি ১,০০,০০০ জনে এক/দুটি কেস দেখা যায়।.[1][2] এই রোগের নামকরণ ফরাসি চিকিৎসক জর্জ গুলেন ও জিন আলেকজান্ডার বারির অনুসরণে হয়েছে,যারা ১৯১৬ সালে আন্দ্রে স্ট্রোলের সাথে বর্ণনা করেছিলেন। [3][4]
লক্ষণ ও উপসর্গ
গুলেন বারি সিনড্রোমের প্রথম দিকে অসাড়তা,ব্যাথা থাকতে পারে। এর পরবর্তীকালে দেহের উভয় পাশের হাত পা সময়ের সাথে সাথে দূর্বল হয়ে যায়।[5][6] এই দূর্বলতা একদিন থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে তীব্র আকার ধারণ করে স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে।[6] পাঁচজনে একজনের দুর্বলতা ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত অগ্রসর হতে থাকে।[7] ঘাড়ের পেশীও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং অনেকেরই কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের অসাড় হয়ে যাবার কারণে মুখের পেশি দুর্বল,খাবার গিলতে অসুবিধা,চোখের পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে।[7] ৮ শতাংশের ক্ষেত্রে দুর্বলতা শুধু পায়েই সীমাবদ্ধ থাকে।[7] সব মিলিয়ে,গুলেন বারি সিনড্রোমে আক্রান্তদের এক তৃতীয়াংশ হাঁটতে পারে।[7] এছাড়া শরীরে বিভিন্ন জায়গা যেমন ঘাড়,পিঠ,কোমর ইত্যাদি জায়গায় ব্যথা থাকতে পারে।[7]
কারণ
গুলেন বারি সিনড্রোমে আক্রান্ত মানুষের দুই তৃতীয়াংশই পূর্বে সংক্রমণ বা ইনফেকশনে ভুগছিলেন। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত শ্বাসনালীর সংক্রমণ বা পাকতন্ত্রের সংক্রমণ। অনেক ক্ষেত্রেই সংক্রমণের নির্দিষ্ট কারণ জানা যায়।[7] Campylobacter jejuniনামক এক প্রকার ডায়রিয়া সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়া গুলেন বারি সিনড্রোমের জন্য ৩০% দায়ী। এছাড়া ১০% রোগের জন্য দায়ী সাইটোমেগালো ভাইরাস[6] Campylobacter jejuni এর সব প্রকরণই GBS করে না।[7]
কৌশল
Campylobacter jejunum দ্বারা দেহ আক্রান্ত হলে সেই অ্যান্টিজেনের বিপক্ষে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।এই অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি কমপ্লেক্স পরবর্তীতে নিউরনের মায়েলিন শীথে আক্রমণ করলে গুলেন বারি সিনড্রোম সংঘটিত হয়।
পরিণতি
গুলেন বারি সিনড্রোম হতে কিছু জটিলতা, যেমন- তীব্র সংক্রমণ বা ইনফেকশন, রক্তজমাট ইত্যাদি কারণে মৃত্যু হতে পারে। সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখার পরেও এর পরিমাণ ৫ শতাংশ।[6]
অধিকাংশ রোগীর প্রথম এক থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত লক্ষণ বেশি দেখা যায়।[6] চতুর্থ সপ্তাহ থেকে অবস্থার উন্নতি হতে থাকে,কিন্তু এই উন্নতির হারের কিছু হেরফের আছে।[6] ৮০% মানুষই কয়েক মাস থেকে বছর খানেকের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ্ হয়ে উঠে,যদিও সামান্য কিছু ছোটোখাটো সমস্যা থাকতে পারে।সুস্থ্ হয়ে উঠার পরও প্রায় ৫-১০% মানুষের কিছু শারীরিক অক্ষমতা দেখা যায়।আবার ৫-১০% মানুষের পরবর্তিতে পুনরায় রোগাক্রান্ত হবার আশঙ্কা আছে।
গবেষণায় গুলেন বারি সিনড্রোম থেকে সুস্থ্ হয়ে উঠা ব্যক্তিদের ০ -৬ স্কেলে গ্রেডিং বা শ্রেণীভাগ করা হয়,যেখানে ০-পরিপূর্ণ সুস্থ,১-খুব স্বল্প সমস্যা কিন্তু দৌড়াতে সক্ষম,২-হাঁটতে সক্ষম,কিন্তু দৌড়াতে অক্ষম,৩-কোন ছড়ি বা সাপোর্টের প্রয়োজন,৪-বিছানা বা চেয়ারে পড়ে থাকা অবস্থা,৫-দীর্ঘমেয়াদি কৃত্তিমভাবে শ্বাসকাজ চালানো,৬-মৃত্যু।[8]
গুলেন বারি সিনড্রোমের রোগোত্তর অবস্থা বয়সের উপর(৪০ বছরের উপরে খুব কম উন্নতি) ও লক্ষণের দুই সপ্তাহ পরের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে।যাদের ডায়রিয়া থেকে এ রোগ হয়েছে,তাদের অবস্থা খুব একটা ভাল হয় না।[9]
রোগতত্ত্ব
পাশ্চাত্যে এই রোগের ঘটনা প্রতি ১,০০,০০০ জনে ০.৮৯ থেকে ১.৮৯।বড়দের থেকে শিশু ও কিশোররা কম আক্রান্ত হয়।প্রতি দশ বছরে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি ২০% বেড়ে যায়।[2] নারীদের থেকে পুরুষের গুলেন বারি সিনড্রোম হবার সম্ভাবনা ১.৭৮ গুণ বেশি।[2][6]
ইতিহাস
ফরাসি চিকিৎসক জা ব্যাপ্টিস্ট অক্টাভ ল্যান্ড্রি এই অসুখ সম্পর্কে ১৮৫৯ সালে বর্ণনা করেন।[11] ১৯১৬ সালে জর্জ গুলেন,জিন আলেকজান্ডার বারি এবং আন্দ্রে স্ট্রোল দুজন সৈনিকের মাঝে এই অসুখ লক্ষ্য করেন এবং রোগের প্রধান শনাক্তকারি বৈশিষ্ট্য কোষ থেকে অ্যালবুমিন বিচ্ছিনকরণ বা albuminocytological dissociation নিয়ে আলোচনা করেন।[3][4] [12]
তথ্যসূত্র
- "Guillain–Barré Syndrome Fact Sheet"। NIAMS। জুন ১, ২০১৬। ৫ আগস্ট ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ আগস্ট ২০১৬।
- Sejvar, James J.; Baughman, Andrew L.; Wise, Matthew; Morgan, Oliver W. (২০১১)। "Population incidence of Guillain–Barré syndrome: a systematic review and meta-analysis"। Neuroepidemiology। 36 (2): 123–133। ডিওআই:10.1159/000324710। পিএমআইডি 21422765। পিএমসি 5703046 । ২০১৪-১২-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- van Doorn, Pieter A; Ruts, Liselotte; Jacobs, Bart C (অক্টোবর ২০০৮)। "Clinical features, pathogenesis, and treatment of Guillain–Barré syndrome"। The Lancet Neurology। 7 (10): 939–950। ডিওআই:10.1016/S1474-4422(08)70215-1। পিএমআইডি 18848313।
- Eldar AH, Chapman J (এপ্রিল ২০১৪)। "Guillain Barré syndrome and other immune mediated neuropathies: diagnosis and classification"। Autoimmunity Reviews। 13 (4–5): 525–30। ডিওআই:10.1016/j.autrev.2014.01.033। পিএমআইডি 24434363।
- Willison, Hugh J; Jacobs, Bart C; van Doorn, Pieter A (মার্চ ২০১৬)। "Guillain–Barré syndrome"। The Lancet (Online first)। ডিওআই:10.1016/S0140-6736(16)00339-1। পিএমআইডি 26948435।
- Yuki, Nobuhiro; Hartung, Hans-Peter (১৪ জুন ২০১২)। "Guillain–Barré Syndrome"। New England Journal of Medicine। 366 (24): 2294–2304। ডিওআই:10.1056/NEJMra1114525। পিএমআইডি 22694000।
- van den Berg, Bianca; Walgaard, Christa; Drenthen, Judith; Fokke, Christiaan; Jacobs, Bart C.; van Doorn, Pieter A. (১৫ জুলাই ২০১৪)। "Guillain–Barré syndrome: pathogenesis, diagnosis, treatment and prognosis"। Nature Reviews Neurology। 10 (8): 469–482। ডিওআই:10.1038/nrneurol.2014.121। পিএমআইডি 25023340।
- Hughes RA, Swan AV, Raphaël JC, Annane D, van Koningsveld R, van Doorn PA (সেপ্টে ২০০৭)। "Immunotherapy for Guillain-Barré syndrome: a systematic review"। Brain। 130: 2245–57। ডিওআই:10.1093/brain/awm004। পিএমআইডি 17337484।
- van Doorn PA, Kuitwaard K, Walgaard C, ও অন্যান্য (মে ২০১০)। "IVIG treatment and prognosis in Guillain–Barré syndrome"। Journal of Clinical Immunology। 30 Suppl 1: S74–8। ডিওআই:10.1007/s10875-010-9407-4। পিএমআইডি 20396937। পিএমসি 2883091 ।
- Goetz, C. G. (১ মে ১৯৯৮)। "Georges Guillain's neurologic exploration of America"। Neurology। 50 (5): 1451–1455। ডিওআই:10.1212/WNL.50.5.1451। পিএমআইডি 9596004।
- Landry, Jean-Baptiste (১৮৫৯)। "Note sur la paralysie ascendante aiguë"। Gazette Hebdomadaire de Médecine et de Chirurgie। 6: 472–474, 486–488। ২০১৭-০২-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- Guillain, G.; Barré, J.; Strohl, A. (১৯১৬)। "Sur un syndrome de radiculonévrite avec hyperalbuminose du liquide céphalo-rachidien sans réaction cellulaire. Remarques sur les caractères cliniques et graphiques des réflexes tendineux"। Bulletins et mémoires de la Société des Médecins des Hôpitaux de Paris। 40: 1462–70।