গিনিপিগ
গিনিপিগ বৈজ্ঞানিক নাম: (Cavia porcellus) ইঁদুরজাতীয় ছোট্ট স্তন্যপায়ী প্রাণী। ল্যাটিন ভাষায় ক্যাভিয়া পোর্সেলাস শব্দের অর্থ হচ্ছে ছোট্ট শূকরশাবক। কিন্তু গিনিপিগের সাথে শূকরছানার কোনও সম্পর্ক নেই। এমনকি এটি গিনি থেকেও উদ্ভূত নয়। জৈবরসায়নবিদগণ গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, গিনিপিগের আদি বাসস্থান হচ্ছে আন্দেস পর্বতমালা। ক্যাভি প্রজাতির সাথে এদের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে এদের পরিচিতি রয়েছে। মূলতঃ এ জন্যই এদের সচরাচর বন্য পরিবেশে দেখা যায় না।[1][2]
গিনিপিগ | |
---|---|
পোষ মানা | |
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস | |
জগৎ: | Animalia |
পর্ব: | কর্ডাটা |
শ্রেণী: | Mammalia |
বর্গ: | Rodentia |
উপবর্গ: | Hystricomorpha |
পরিবার: | Caviidae |
উপপরিবার: | Caviinae |
গণ: | Cavia |
প্রজাতি: | C. porcellus |
দ্বিপদী নাম | |
Cavia porcellus (লিনিয়াস, ১৭৫৮) | |
প্রতিশব্দ | |
Mus porcellus |
জীববিজ্ঞানীগণ সপ্তদশ শতক থেকে গিনিপিগের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। ঊনবিংশ এবং বিংশ শতকেও আদর্শ প্রাণী হিসেবে এর উপর ধারাবাহিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। পরবর্তীকালে ইঁদুরের উপরও পরীক্ষাকর্ম চালানো হয়। এখনও গিনিপিগের উপর ব্যাপকভাবে গবেষণা করা হয় যা মানব চিকিৎসার লক্ষ্যে ডায়াবেটিস, যক্ষ্মা, স্কার্ভি ও গর্ভধারণ বিষয়ক জটিলতা নিরসনজনিত।
বৈশিষ্ট্যাবলী
গিনিপিগ ইঁদুরের চেয়ে বড় আকৃতিবিশিষ্ট হয়ে থাকে। এদের দেহের ওজন ৭০০ গ্রাম থেকে ১২০০ গ্রাম (১.৫ - ২.৫ পাউন্ড) পর্যন্ত হয়ে থাকে। দৈর্ঘ্য গড়পড়তা ২০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার (৮-১০ ইঞ্চি) হয়। গিনিপিগে দাঁতের সংখ্যা ২০। [3] সচরাচর এদের জীবনকাল গড়ে চার থেকে পাঁচ বছর। কিন্তু অনেক সময় আট বছরও হতে পারে।[4] ২০০৬ সালের গিনেস বিশ্বরেকর্ড বইয়ে সবচেয়ে দীর্ঘজীবী গিনিপিগের বয়সসীমা উল্লেখ করা হয়েছে ১৪ বছর সাড়ে ১০ মাস।[5]
আবাসস্থল
বাতাস চলাচল করে, আনন্দ চঞ্চল চিত্তে দৌঁড়াতে পারে, লাফ-ঝাঁপ দিতে পারে এমন উন্মুক্ত স্থানে গিনিপিগের উপযুক্ত আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত। এদের বৃদ্ধির জন্যে উচ্চ গুণাগুনসম্পন্ন সুষম খাবারের প্রয়োজন। এছাড়াও এদের জন্য অসীম ঘাস, খড়ও প্রয়োজন রয়েছে। গিনিপিগ হাতে থাকতেও পছন্দ করে। ৭.৫ বর্গফুটের চেয়ে বড় কিংবা এক জোড়া গিনিপিগের থাকার জন্যে উপযোগী ১০.৫ বর্গফুটের সমপরিমাণ খাঁচা প্রয়োজন। সামাজিক প্রাণী হিসেবে এদের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে এবং বন্ধুবৎসল। এদের বংশবৃদ্ধির হারও অগণিত।
এ প্রজাতির প্রাণী বন্য পরিবেশে পাওয়া যায় না। কিন্তু এর সাথে সম্পর্কযুক্ত কিছু ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীকে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়।[1] কিছু প্রজাতিকে বিংশ শতকে বনে চিহ্নিত করা হয়েছে যা সম্ভবতঃ গৃহপালিত গিনিপিগের বন্য পরিবেশে পুণঃপ্রবেশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।[6] বন্য গিনিপিগকে সমান্তরাল ভূমিতে দেখা যায়। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ঘাস ও অন্যান্য সব্জিজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করে। প্রকৃতিগতভাবেই এরা খাদ্য সঞ্চয় করে না।[7] এছাড়াও নিজেরা কোন বাসা তৈরী করে না। অন্যান্য প্রাণীর কাছে অবস্থান করতেই এদের পছন্দ। এরা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তকালীন সময়েই বেশি সক্রিয় হয়ে উঠে যাতে করে এরা অন্য কোন শিকারী প্রাণীর খপ্পরে না পড়ে।[8]
পোষা প্রাণী
বিশ্বের অনেক দেশেই গিনিপিগকে গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে লালন-পালন করা হয়। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু, ইকুয়েডর, বলিভিয়াসহ অন্যান্য দেশসমূহে খাবারের উদ্দেশ্যে বড় করা হয়। খাদ্যের আদর্শ যোগানদাতা হিসেবে কিছু অঞ্চলের লোকজনের ধারণা যে, গিনিপিগ অশুভ আত্মাকে দূরে সরিয়ে রাখতে সমর্থ। পেরুর কুইচুয়া এলাকার উপজাতিরা স্থানীয় ভাষায় এ প্রাণীকে কুইভি বলে। অন্যদিকে স্পেনীয়ভাষী লোকজন একে কাই নামে ডাকে।
প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বে পেরুর অধিবাসীরা কৃষিভিত্তিক জীবন ব্যবস্থায় এ প্রাণীকে লালন-পালন করতো। ইনকারা গিনিপিগ সংরক্ষণ করতো এবং একই সময়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভেনেজুয়েলা থেকে চিলির মধ্যভাগের উপজাতীয়রা পোষা প্রাণী হিসেবে গিনিপিগকে পোষ মানাত। এখনো তাদেরকে বাড়ীতে কিংবা বাইরে মুক্তভাবে জীবনধারনের উদ্দেশ্যে পালা হয়। ষোড়শ শতকে ইউরোপে গিনিপিগকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং অষ্টাদশ শতকে জনপ্রিয় পোষা প্রাণী হিসেবে গিনিপিগ পরিচিতি লাভ করে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা
মানব কল্যাণ সাধনে বিশেষতঃ শারীরিক সমস্যা দূরীকরণ, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিভিন্ন রোগ-শোক থেকে দূরে রাখার স্বার্থে কোন কিছু উদ্ভাবনে গিনিপিগের ব্যবহার রয়েছে। সেজন্যে গিনিপিগকে বিজ্ঞানীরা জীববিদ্যার বিভিন্ন গবেষণায় ব্যবহার করে আসছেন।
বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় গিনিপিগের ব্যবহার হয়ে আসছে সপ্তদশ শতক থেকে। ইতালীয় জীববিজ্ঞানী মার্সেলো মালপিঘি এবং কার্লো ফ্রাকাসাতি শারীরবৃত্ত কাঠামো পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে সর্বপ্রথম গিনিপিগের উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেছেন বলে ধারণা করা হয়।[9] ১৭৮০ সালে এন্টোনি ল্যাভোইসিয়ে তাপ উৎপাদনের একক হিসেবে ক্যালরিমিটার আবিস্কারে গিনিপিগ ব্যবহার করেছিলেন যা ছিল মোম পুড়িয়ে ফেলার মতো।[10]
ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে জীবাণু তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এ প্রাণীটি। লুই পাস্তুর, এমিলে রোক্স এবং রবার্ট কোচ এতে নেতৃত্ব দেন।[11] মহাকাশ বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এর সবিশেষ অংশগ্রহণ রয়েছে বেশ কয়েকবার। ৯ মার্চ, ১৯৬১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক স্পুতনিক ৯ মহাকাশ খেয়াযানের স্বার্থক উৎক্ষেপনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে এটি।[12] চীনও ১৯৯০ সালে যাত্রী হিসেবে গিনিপিগকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল।[13]
বিংশ শতকের শেষদিকে পরীক্ষাগারে গিনিপিগের ব্যবহার খুবই জনপ্রিয় পন্থা হিসেবে কাজ করেছিল। ১৯৬০-এর দশকে একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাগারগুলোয় প্রতি বছর প্রায় ২.৫ মিলিয়ন গিনিপিগ ব্যবহার করা হয়েছিল।[14]
তথ্যসূত্র
- Weir, Barbara J. (1974). "Notes on the Origin of the Domestic Guinea-Pig". In Rowlands, I. W.; Weir, Barbara J.. The Biology of Hystricomorph Rodents. Academic Press. pp. 437–446. আইএসবিএন ০-১২-৬১৩৩৩৩-৬
- Nowak, Ronald M. (1999). Walker's Mammals of the World, 6th edition. Johns Hopkins University Press. আইএসবিএন ০-৮০১৮-৫৭৮৯-৯
- Vanderlip, Sharon (2003). The Guinea Pig Handbook. Barron's. p. 13. আইএসবিএন ০-৭৬৪১-২২৮৮-৬
- Richardson, V.C.G. (2000). Diseases of Domestic Guinea Pigs (2nd ed.). Blackwell. pp. 132–133. আইএসবিএন ০-৬৩২-০৫২০৯-০
- editor, Craig Glenday (2006). Guinness Book of World Records. Guinness World Records Ltd.. p. 60. আইএসবিএন ১-৯০৪৯৯৪-০২-৪
- Nowak, Ronald M. (1999). Walker's Mammals of the World (6th ed.). Baltimore, Md.: Johns Hopkins University Press. pp. 1667–1669. আইএসবিএন ০-৮০১৮-৫৭৮৯-৯
- Wagner, pp. 31–32
- Terril, Lizabeth A.; Clemons, Donna J. (1998). The Laboratory Guinea Pig. CRC Press. p. 6. আইএসবিএন ০-৮৪৯৩-২৫৬৪-১
- Guerrini, Anita (2003). Experimenting with Humans and Animals. Johns Hopkins. p. 42. আইএসবিএন ০-৮০১৮-৭১৯৬-৪
- Buchholz, Andrea C; Schoeller, Dale A. (2004). "Is a Calorie a Calorie?". American Journal of Clinical Nutrition 79 (5): 899S–906S. PubMed. Retrieved 2007-03-12
- Guerrini, pp. 98–104
- "Gray, Tara (1998). "A Brief History of Animals in Space". National Aeronautics and Space Administration. Retrieved 2007-05-03"। ২০০৮-০১-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৮-৩১।
- ""Timeline: China's Space Quest". CNN.com. 2004-01-05. Retrieved 2007-05-03"। ২০১২-০১-২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৮-৩১।
- Gad, Shayne C. (2007). Animal Models in Toxicology (2nd ed.). Taylor & Francis. pp. 334–402. আইএসবিএন ০-৮২৪৭-৫৪০৭-৭
বহিঃসংযোগ
- উইকিঅভিধানে গিনিপিগ-এর আভিধানিক সংজ্ঞা পড়ুন।
- উইকিপ্রজাতিতেCavia porcellus সম্পর্কিত তথ্য।
- উইকিমিডিয়া কমন্সে Cavia porcellus সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।
- ACBA – American Cavy Breeders' Association
- Domestic Guinea Pig Genome
টেমপ্লেট:Caviidae nav