গাজীর গান

গাজীর গান বা গাজী পীরের বন্দনা বাংলাদেশের ফরিদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসিলেট অঞ্চলে এক সময়ের প্রচলিত এক ধরনের মাহাত্ম্য গীতি। গাজী পীর সাহেব মুসলমান হলেও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানইসলাম ধর্মের অনুসারীদের একটি অংশ তার ভক্ত ছিলো। আর ভক্তরাই এ গাজীর গানের আসর বসাতো। গান চলার সময় আসরে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা তাদের মানতের অর্থ গাজীর উদ্দেশ্য দান করতো। বর্তমানে এ গানের প্রচলন নেই।[1][2]

উদ্দেশ্য

সন্তান লাভ, রোগব্যাধির উপশম, অধিক ফসল উৎপাদন, গো-জাতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি এরূপ মনস্কামনা পূরণার্থে গাজীর গানের পালা দেওয়া হতো এ নিয়ে আসর বসিয়ে কিছু লৌকিক কার্যক্রমসহ গাজীর গান পরিবেশিত হতো।[1][3]

বিবরণ

মূল গানে প্রথমে গাজীর প্রশংসা করা হতো। ‘পূবেতে বন্দনা করি পূবের ভানুশ্বর। এদিকে উদয় রে ভানু চৌদিকে পশর\ ...তারপরে বন্দনা করি গাজী দয়াবান। উদ্দেশে জানায় ছালাম হেন্দু মোছলমান’ বন্দনা তথা প্রশংসার পরে গাজীর জীবন বৃত্তান্ত, দৈত্য-রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ, রোগ-মহামারী, বালা-মুসিবত, খারাপ আত্মার সাথে যুদ্ধ, অকুল সমুদ্রে ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে পুণ্যবান ভক্ত সওদাগরের নৌকা রক্ষার কাহিনী এসবে গানে বর্ণনা করা হতো।[1]

এছাড়া গানের মাধ্যমে তৎকালিন সমাজের বিভিন্ন অপরাধ, বিচার ও সমস্যা-সম্ভাবনা তুলে ধরা হতো। কিছু কিছু গানে দধি ব্যবসায়ী গোয়ালার ঘরে দুগ্ধ থাকা সত্ত্বেও গাজীকে না দেওয়ার শাস্তি বর্ণণা করা হতো।

একটি গানে ইতিহাস বর্ণণা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, গাজী পীর জমিদারের অত্যাচার থেকে প্রজা সাধারণকে রক্ষা করেতেন। এমনকি কোনো কোনো ভক্ত মামলা জয়ী হওয়ার আশ্বাসও ছিলো একটি গানে: গানটির ছন্দ ছিলো এরকম- ‘গাজী বলে মোকদ্দমা ফতে হয়ে যাবে। তামাম বান্দারা মোর শান্তিতে থাকিবে’ এরূপ গানে ধর্মীয় ও বৈষয়িক ভাবনা একাকার ছিলো।[1][4]

ইতিহাস

বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে পট বা চিত্র দেখিয়ে গাজীর গান গেয়ে বেড়াত বেদে সম্প্রদায়ের একটি অংশ। তার মধ্যে মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফরিদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসিলেট অঞ্চলে নরসিংদী অঞ্চলেই এমন বেদেদের বিচরণ ছিল বেশি। এ সম্প্রদায়ের মানুষ গ্রামে গ্রামে গিয়ে গাজীর গান গেয়ে ধান অথবা টাকা নিতো, যা দিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। এভাবে করে একসময় গাজীর গান বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে যায়।

সময়কাল

গাজীর গান গাওয়ার সময় ছিল কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাস। যে সময় কৃষকের উঠোনে ধান থাকে। অন্য সময় কখনোই বেদেদের গাজীর গান গাইতে দেখা যেত না। গাজীর পটের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রবাদ আছে 'অদিনে গাজীর পট'। সঠিক সময় ছাড়া বা অসময়ে কেউ কিছু করলে এই প্রবাদটি বলা হতো।

পদ্ধতি

গাজীর পট গান বা চিত্রভিত্তিক গানের আসরে কারবালার ময়দান, কাশ্মীর, মক্কার কাবাগৃহ, হিন্দুদের মন্দিরের মতো পবিত্র স্থানগুলো বিশেষ চিহ্নে আঁকা থাকতো। অনেক সময় এসব চিহ্ন মাটির সরা বা পাতিলেও আঁকা হতো। পট হচ্ছে মূলত মারকিন কাপড়ে আঁকা একটি চিত্রকর্ম, যা প্রস্থে চার ফুট, দৈর্ঘ্যে সাত-আট ফুটের মতো। মাঝখানের বড় ছবিটি পীর গাজীর। তার দুই পাশে ভাই কালু ও মানিক। গাজী বসে আছে বাঘের ওপর। এই ছবিটি কেন্দ্র করে আরও আছে কিছু নীতি বিষয়ক ছবি বা চিত্র। মনোরম ক্যানভাসের এ পটটির বিভিন্ন অংশের ছবি লাঠি দিয়ে চিহ্নিত করে গীত গাওয়া হয়। গানের দলে ঢোলক ও বাঁশিবাদক এবং চার-পাঁচজন দোহার থাকতো। এদের দলনেতা গায়ে আলখাল্লা ও মাথায় পাগড়ি পরিধান করে একটি আসা দন্ড হেলিয়ে-দুলিয়ে এবং লম্বা পা ফেলে আসরের চারদিকে ঘুরে ঘুরে গান গাইতো। আর দোহাররা মুহুর্মুহু বাদ্যের তালে তালে এ গান পুনরাবৃত্তি করতো।[1]

আরো পড়ুন

তথ্যসূত্র

  1. "গাজীর গান"। আশরাফ সিদ্দিকী। বাংলাপিডিয়া। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মার্চ ২০২০
  2. "গাজীর বাঁশি"প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-১৮
  3. "রইল বাকি এক"সমকাল। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-১৮
  4. "গাজীর পট আর পালা গানে মূর্ত আ কা মো যাকারিয়া"চ্যানেল আই অনলাইন। ২০১৭-১০-০২। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-১৮

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.