ক্লজ ফুক্‌স

ক্লজ এমিল জুলিয়াস ফুক্‌স (জার্মান: Klaus Emil Julius Fuchs; জন্ম: ২৯ ডিসেম্বর, ১৯১১ - মৃত্যু: ২৮ জানুয়ারি, ১৯৮৮) জার্মানির রাসেলসহেইমে জন্মগ্রহণকারী ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী এবং পরমাণু গুপ্তচর ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এবং বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়কালে আমেরিকা, ব্রিটেন এবং কানাডার যৌথ অংশগ্রহণে পরমাণু বোমা গবেষণা কেন্দ্র নামে পরিচিত ম্যানহাটন প্রকল্প থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর তথ্যাদি সোভিয়েত ইউনিয়নে পাচারের দায়ে ১৯৫০ সালে গ্রেফতার হন এবং সাজা ভোগ করেন। লস আলামোজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে কর্মরত অবস্থায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক হিসাবনিকাশের সাথে জড়িত পরমাণু বিভাজনে তৈরি প্রথম আণবিক বোমা এবং প্রথম নিউক্লীয় সংযোজনে সৃষ্ট হাইড্রোজেন বোমার প্রথমদিককার নকশা প্রণয়নের সাথে জড়িত ছিলেন।[1][2]

ক্লজ ফুক্‌স
জন্ম
ক্লজ এমিল জুলিয়াস ফুক্‌স

(১৯১১-১২-২৯)২৯ ডিসেম্বর ১৯১১
রাসেলসহেইম, জার্মানি
মৃত্যু২৮ জানুয়ারি ১৯৮৮(1988-01-28) (বয়স ৭৬)
জাতীয়তাজার্মান
ব্রিটিশ
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রতাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা
প্রতিষ্ঠানসমূহলস আলামোজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি
হেরওয়েল অ্যাটমিক এনার্জি রিসার্চ এস্টাবলিশমেন্ট
ফরশাংজেনট্রাম ড্রেসডেন-রোজেনডর্ফ

প্রারম্ভিক জীবন

পদার্থবিজ্ঞান এবং গণিত বিষয়ে লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন। ১৯৩০ সালে জার্মানির কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৩ সালে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বাধীন নাজি (NAZI বাংলায় নাতসি) বাহিনী ক্ষমতায় আরোহণ করলে তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। পরবর্তীতে স্কটল্যান্ডে থেকে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তার শিক্ষাজীবন চালাতে থাকেন। সেখান থেকে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভূমিকা

জার্মান বিধায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে অন্যান্য জার্মান নাগরিকদের পাশাপাশি অন্তরীণ ছিলেন ফুক্‌স। জুন থেকে ডিসেম্বর, ১৯৪০ সাল পর্যন্ত আইল অফ ম্যানের নিরাপত্তা হেফাজতে থেকে কানাডার কুইবেক প্রদেশে তাকে পাঠানো হয়। অধ্যাপক ম্যাক্স বর্ন তার মেধা সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার যখন জানতে পারে যে তিনি বার্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আণবিক বোমা বিষয়ে গবেষণা করছেন ও পদার্থবিজ্ঞানে অগাধ জ্ঞান রাখেন, তখন তাকে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৪১ সালের শুরুর দিকে তাকে এডিনবরায় অস্থায়ীভাবে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর তিনি আরেকজন জার্মান শরণার্থী ও পদার্থবিদ রুডল্‌ফ পিয়ার্লসের অধীনে বার্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রিটিশ আণবিক বোমা গবেষণা প্রকল্প টিউব এলয়েজে কাজ করতে থাকেন। যুদ্ধকালীন সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও তাকে ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। এজন্যে তাকে দাপ্তরিক নিরাপত্তা আইনে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল।[1][2] যখন ফুক্‌স উপলদ্ধি করেন যে গবেষণা প্রকল্পের গুরুত্ব অপরিসীম ও তাতে তিনি সম্পৃক্ত রয়েছেন, তখন থেকেই তিনি বৈজ্ঞানিক গোপন তথ্যাদি সোভিয়েত ইউনিয়েন পাঠাতে শুরু করতে থাকেন। ১৯৪৩ সালে ফুক্‌সকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল লস আলামোজের ম্যানহাটন প্রকল্পে আণবিক বোমার মানোন্নয়নে তাত্ত্বিক ও বোমার নকশা প্রণয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাথে একযোগে কাজ করা। এ সংক্রান্ত নিজস্ব ধ্যান-ধারণা সোভিয়েত ইউনিয়নে হস্তান্তর করতে থাকেন। তার এই তথ্য পাচারের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাদের নিজস্ব পারমাণবিক বোমা প্রকল্পের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে বিস্তার ঘটাতে কমপক্ষে এক বছর সময় থেকে বাঁচায়।

বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তিনি পুনরায় ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। হেরওয়েলে অবস্থিত ব্রিটিশ পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রের প্রধানের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন তিনি।

গোয়েন্দাবৃত্তি

৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ তারিখে কানাডায় অবস্থানকারী ইগোর গোজেঙ্কো নামক গোয়েন্দা সংস্থার একজন কেজিবি কর্মকর্তা স্বপক্ষ ত্যাগ করে পশ্চিমা পক্ষে যোগ দেন। তিনি দাবী করেন যে, একজন সোভিয়েত গুপ্তচর ব্রিটেনে অবস্থান করে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন বলে তার কাছে প্রামাণ্য দলিল রয়েছে। গোজেঙ্কো এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যাদি কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করেন। এরফলে কানাডায় ২২জন স্থানীয় গুপ্তচর এবং ১৫জন সোভিয়েত গোয়েন্দাকে গ্রেফতার করা হয়। গোজেঙ্কোর কাছ থেকে এ তথ্য ফাঁস হবার ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৫-এর মুখোমুখি দাঁড় করানো হয় ফুক্‌সকে।

ফুক্‌স কোনরূপ গোয়েন্দাবৃত্তির সাথে তার সম্পৃক্ততা থাকার কথাসহ গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যোগাযোগ রক্ষার কথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন যাতে তাকে গ্রেফতার কিংবা অভিযুক্ত করা যায়। ফুক্‌সের গোয়েন্দাবৃত্তিতে জড়িত হবার বিষয়টি ১৯৫০ সালের অ্যাংলো-আমেরিকান পরিকল্পনা অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রে আবিষ্কৃত আণবিক বোমা ব্রিটেনের গ্রহণের কারণে বাতিল হয়ে যাচ্ছিল।[3] কিন্তু জিম স্কারডনের সাথে পুণঃপুণঃ জেরায় অবশেষে ২৩ জানুয়ারি, ১৯৫০ তারিখে স্বীকার করেন যে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে তথ্য পাচার করেছিলেন। স্বীকারোক্তির ছয় সপ্তাহ পর অভিযোগ দাখিল করলে বিচারক লর্ড রেনার গডার্ড ৯০ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে ফুক্‌সকে প্রাতিষ্ঠানিক গোপনীয়তা আইন ভঙ্গের দায়ে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেয়ার কথা ঘোষণা করেন যা গোয়েন্দাবৃত্তির জন্য সর্বোচ্চ সাজা। কিন্তু অপরাধ চলাকালে অপর্যাপ্ত দলিল প্রদর্শনের ফলে তিনি গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ থেকে মুক্তি পান। এছাড়াও ঐ সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন গ্রেট ব্রিটেনের শত্রু ছিল না, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল।[4] ১৯৫০ সালে এফবিআই হ্যারি গোল্ডকে গ্রেফতার করে। তিনি ফুক্‌সকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনায় সার্বিক সহযোগিতা করতেন বলে জানান। গোল্ডের স্বীকারোক্তির ফলে ডেভিড গ্রীনগ্লাস, ইথেল রোজেনবার্গ এবং জুলিয়াস রোজনবার্গকে গ্রেফতার ও গোয়েন্দা কার্যক্রমে তাদের সম্পৃক্ততার কথা বলেন।

মুক্তিলাভ

ডিসেম্বর, ১৯৫০ সালে ফুক্‌স তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিলের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। কিছু সূত্র দাবী করে যে তিনি মৃত্যুদণ্ড থেকে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু কমপক্ষে একজন প্রশ্নকর্তা মনে করেন যে ফুক্‌স ভুলবশতঃ বিশ্বাস করতেন যে তিনি হয়তোবা হেরওয়েলের কর্মময় জীবনে ফিরে যাবার অনুমতি পাবেন। নয় বছর চার মাস ওয়াকফিল্ড কারাগারে বন্দীজীবন শেষে ২৩ জুন, ১৯৫৯ সালে ক্লজ ফুক্‌সকে ভাল আচরণের জন্য মুক্তি দেয়া হয়।

শেষ জীবন

কারাগার থেকে মুক্তি পাবার পর ফুক্‌স তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পূর্ব জার্মানিতে চলে যান[5][6] ও নাগরিকত্ব লাভ করেন। সেখানে তিনি ড্রেসডেনের কাছাকাছি রোজেনডর্ফের সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চের উপ-পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। বাকী জীবন তিনি কম্যুনিস্ট হিসেবে ছিলেন। পূর্ব জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে অনেক সম্মাননা লাভ করেন ও বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি।

২৮ জানুয়ারি, ১৯৮৮ সালে পূর্ব জার্মানির ড্রেসডেন এলাকায় ক্লজ ফুক্‌সের দেহাবসান ঘটে।

তথ্যসূত্র

  1. Pace, Eric (29 January 1988). "Klaus Fuchs, Physicist Who Gave Atom Secrets to Soviet, Dies at 76". The New York Times. Retrieved 2008-07-07. "Klaus Fuchs, the German-born physicist who was imprisoned in the 1950s in Britain after being convicted of passing nuclear secrets to the Soviet Union, died yesterday, the East German press agency A.D.N. reported. He was 76 years old."
  2. ""Klaus Fuchs: Atom Bomb Spy". Crime Library. Retrieved 2010-12-20."। ২০০৮-১০-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০১-১১
  3. Baylis, John (1995). Ambiguity and Deterrence: British Nuclear Strategy 1945-1964. Oxford: Clarendon Press. pp. 76. আইএসবিএন ০-১৯-৮২৮০১২-২.
  4. A.M. Hornblum, 'The Invisible Harry Gold' (Yale University Press, 2010) kindle edition. locations 4030-37
  5. Pace, Eric (জানুয়ারি ২৯, ১৯৮৮)। "Klaus Fuchs, Physicist Who Gave Atom Secrets to Soviet, Dies at 76"New York Times। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৭-০৭Klaus Fuchs, the German-born physicist who was imprisoned in the 1950s in Britain after being convicted of passing nuclear secrets to the Soviet Union, died yesterday, the East German press agency A.D.N. reported. He was 76 years old.
  6. "Klaus Fuchs"TruTV। ২০০৩-০২-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৭-০৭His name was Klaus Emil Fuchs, and he was, as it has been shown by history, the most important atom spy in history. Not any of the notorious names in the saga of the theft of the atom bomb secrets Allan Nunn May, Julius and Ethel Rosenberg, and David Greenglass had been as important to the Russian effort as Klaus Fuchs.

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.