ক্রসফায়ার
ক্রসফায়ার হলো বন্দুকযুদ্ধের নামে 'কুখ্যাত অপরাধী' বা 'অপরাধী সন্দেহভাজন' বা 'অপরাধীগণ্য' কোন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা। ১৯৭৩ সালে ভারতের পশ্চিম বঙ্গে নকশালবাদী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্য নিয়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রণজিৎ গুপ্ত এই কৌশলটি প্রয়োগ শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এর নাম দিয়েছিল "পুলিশ এনকাউন্টারে মৃত্যু"। বাংলাদেশে ক্রসফায়ারে নিহত অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হলেন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদার। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি তাকে আটক অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয় এবং তার লাশ সাভারের তালবাগ এলাকায় ফেলে রাখা হয়। ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশে এই পদ্ধতির পুনঃপ্রয়োগ শুরু হয়। সে সেময় সন্ত্রাস দমনের জন্য স্বল্পমেয়াদী অপারেশন ক্লিনহার্ট চালু করা হয়। আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অন্তর্গত হওয়ায় এটি ব্যাপক বিতর্কের কারণ।[1] ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে 'অপারেশন ক্লিনহার্ট' পরিচালনার সময় পুনরায় 'ক্রসফায়ার' ব্যবহার শুরু হয়।
ক্রসফায়ারের প্রকৌশল
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার জন্যই ক্রসফায়ারের আশ্রয় গ্রহণ করে। এ ধরনের সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হলে তাদের জীবনবৃত্তান্ত পর্যালোচনা করা হয়, এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে আরো তথ্য আদায় করা হয়। আর এসব করেন সংস্থার কর্মকর্তারা। যাঁর নামে গড়ে দুইটি খুনের অভিযোগ রয়েছে এবং সন্ত্রাসী যদি পেশাদার খুনি হয় তবে তাকে “মাইনাস” (“পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলা” বা “মেরে ফেলা” অর্থে) করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই মাইনাস করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তারা চূড়ান্ত সভার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। ক্রসফায়ারে হত্যার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ছাড়পত্র (clearance) নেয়া হয়। সেখান থেকে সবুজ সংকেত আসার পরই হত্যার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। গ্রেফতারকৃত আসামিকে কোথায় ক্রসফায়ার করা হবে সেজন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়। বিশেষত নির্জন স্থানকে ক্রসফায়ারের জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গ্রেফতারকৃত আসামিকে গোসল করিয়ে তওবা পড়ানো হয়। সাধারণত রাত ২টা থেকে ভোর ৪টার মধ্যে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ‘ক্রসফায়ারে হত্যা’ করা হয় করা হয়। সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর ক্রসফায়ারের আসামিকে গাড়িতে ওঠানো হয়। তার চোখ বেঁধে ফেলা হয়, এরপর তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়। গুলির পরেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শুটাররা বেশকিছু ফাঁকা গুলি ছোড়েন। এই গুলির শব্দে আশপাশের বাসিন্দারা মনে করেন দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে। পরে যেসব অস্ত্র উদ্ধার দেখানো হয় সেগুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর-ই সরবরাহকৃত অস্ত্র ও গুলি। এ বক্তব্যের প্রমাণ সাপেক্ষে বলা যে ব্যাপারটিকে নির্দেশ করা হয় তা হচ্ছে, এ পর্যন্ত ক্রসফায়ারের পর ঘটনাস্থল থেকে যত অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার দেখানো হয়েছে সেগুলো প্রায় একই ধরনের।[2]
আইন ও ক্রসফায়ার
সমালোচনা
২৬ মার্চ, ২০০৪-এ গঠিত বিশেষ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানে ক্রসফায়ারে নিহতের সংখ্যা পাওয়া যায়। ঐ বাহিনী গঠিত হওয়ার পর থেকে ৩১ আগস্ট ২০০৯ পর্যন্ত সর্বমোট ৪৭২টি ক্রসফায়ারে ৫৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়।[3]
আইনি বিরোধিতা
ক্রসফায়ারে মৃত্যুকে বিচারবহির্ভুত এবং বেআইনি হত্যাকাণ্ড হিসাবে উল্লেখ করা হয়।[4] বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র ক্রসফায়ারের মাধ্যমে বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের উদ্দেশ্যে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। তারা হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করেছে যার সূত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড “কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না” এবং “কেন এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি কার্যক্রম গ্রহণের আদেশ দেওয়া হবে না”—সে মর্মে কারণ দর্শানোর আদেশ দিয়ে ২৯ জুন ২০০৯ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি একটি রুল জারি করেছে বাংলাদেশ হাইকোর্ট।[5]
আরো দেখুন
বহিঃসংযোগ
- ক্রসফায়ার — বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য ১
- ক্রসফায়ার — বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য ২
- ক্রসফায়ার — বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য ৩
আরো পড়ুন
- নেসার আহমেদ (২০০৮)। ক্রসফায়ার:রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। ঢাকা, বাংলাদেশ।: আরিফুর রহমান নাইম, ঐতিহ্য,।
তথ্যসূত্র
- "ক্রসফায়ার'র বিরুদ্ধে সুইডেনে প্রবাসী শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ"। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডট কম। ২ অক্টোবর ২০০৯। সংগ্রহের তারিখ ১১ অক্টোবর ২০০৯।
- "ক্রসফায়ারের বন্দিকে আগে গোসল করানো হতো, এখন সরাসরিই নেয়া হয় স্পটে"। আমাদের সময়। ১৮ জুন ২০০৯। ২০ জুন ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ অক্টোবর ২০০৯।
- "এনকাউন্টারে সন্ত্রাসী মরলে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় না"। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডট কম। ৮ অক্টোবর ২০০৯। সংগ্রহের তারিখ ১১ অক্টোবর ২০০৯।
- "ক্রসফায়ার নিয়ে অনেক প্রশ্ন"। প্রথম আলো। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৯। সংগ্রহের তারিখ ১১ অক্টোবর ২০০৯।
- "বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড: কালে কালে একই বয়ান"। দৈনিক প্রথম আলো। ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯। সংগ্রহের তারিখ ১১ অক্টোবর ২০০৯।