কোটচাঁদপুর উপজেলা
কোটচাঁদপুর উপজেলা বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার একটি প্রশাসনিক এলাকা। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রসিদ্ধ একটি মহকুমা ছিল বর্তমানের কোটচাঁদপুর উপজেলাটি যার স্মৃতিচিহ্ন এখনো বহন করছে শহরের অসংখ্য পুরানো আমলের ভবন ও রাস্তাগুলো।
কোটচাঁদপুর | |
---|---|
উপজেলা | |
![]() ![]() কোটচাঁদপুর ![]() ![]() কোটচাঁদপুর | |
স্থানাঙ্ক: ২৩°২৪′১৩″ উত্তর ৮৯°০′৫০″ পূর্ব | |
দেশ | বাংলাদেশ |
বিভাগ | খুলনা বিভাগ |
জেলা | ঝিনাইদহ জেলা |
সরকার | |
• উপজেলা চেয়ারম্যান | মোছাঃ শরিফুন্নেছা মিকি |
আয়তন | |
• মোট | ১৬৫.৬৩ বর্গকিমি (৬৩.৯৫ বর্গমাইল) |
জনসংখ্যা (২০১১)[1] | |
• মোট | ১,৪১,১২১ |
• জনঘনত্ব | ৮৫০/বর্গকিমি (২,২০০/বর্গমাইল) |
সাক্ষরতার হার | |
• মোট | ৫০.৪% |
সময় অঞ্চল | বিএসটি (ইউটিসি+৬) |
প্রশাসনিক বিভাগের কোড | ৪০ ৪৪ ৪২ |
ওয়েবসাইট | প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইট ![]() |
অবস্থান ও আয়তন
খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ জেলাতে অবস্থিত। জেলা সদর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে ৩০ কিলোমিটার দূরে উপজেলা সদরের অবস্থান। যশোর চুয়াডাঙ্গা রোডের পাশে ছোট এই উপজেলা শহরটির অবস্থান। এই উপজেলার উত্তরে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা, দক্ষিণে মহেশপুর উপজেলা, পূর্বে সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা, পশ্চিমে চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলা ও ঝিনাইদহ সদর উপজেলা।
![](../I/%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%9F%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%A6%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%B0.jpg.webp)
প্রশাসনিক এলাকা
৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত কোটচাঁদপুর উপজেলা। এই উপজেলার ইউনিয়নসমূহ হচ্ছে -
এবং একমাত্র পৌরসভা হলো কোটচাঁদপুর পৌরসভা।
শিক্ষা
৬টি কলেজ, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২১ টি, ২টি জুনিয়র মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি কামিল মাদ্রাসা সহ ৭টি মাদ্রাসা, ৭১টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সহ বেশ কিছু কমিউনিটি ও কিন্ডার গার্ডেন আছে। গড় শিক্ষার হর ৫০.৪%, পুরুষ-৫২.৭ %, মহিলা-৪৮.২ %
কলেজের তালিকা
- সরকারি কে এম এইচ কলেজ,কোটচাঁদপুর।
- জি টি কলেজ,তালসার।
- সাফদারপুর এস ডি ডিগ্রি কলেজ।
- কোটচাঁদপুর পৌর ডিগ্রি কলেজ, কাশিপুর।
- কোটচাঁদপুর পৌর মহিলা ডিগ্রি কলেজ।
- মোহাম্মদ আলী মডেল কলেজ,নারায়ণপুর।
অর্থনীতি
কোটচাঁদপুর উপজেলায় সর্বমোট ২৮,৭৬৩ একর কৃষি জমি আছে। অধিকাংশই কৃষি কাজে নিয়োজিত। এ উপজেলায় ধান, পাট, গম, আখ, রবি শস্য চাষ হয়ে থাকে। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন প্রজাতির আম ও পেয়ারার চাষ হচ্ছে। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানী করে প্রচুর অর্থ আয় করে। এছাড়াও উপজেলার ০৪টি বাওড় সহ ব্যক্তিগতভাবে ছোট-বড় পুকুরে মাছ চাষ হয়ে থাকে। এই মাছ বিক্রয় করেও প্রচুর পরিমাণ অর্থ করে করেন মৎস্যচাষীগণ। শীতের সময় কোটচাঁদপুর উপজেলা খেজুর গুড়ের জন্য বিখ্যাত। এ মৌসুমে উপজেলার কৃষকগণ খেজুর গুড় ও গুড়ের পাটালী বিক্রয় করেও অর্থ আয় করে থাকে। ব্যবসা বাণিজ্যেও উন্নত প্রাচীন এই জনপথ। তাছাড়া মাঝারি শিল্পকারখানাও তৈরি হচ্ছে।
ভাষা ও সংষ্কৃতি
কোটচাঁদপুর উপজেলার ভূ-প্রকৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থান এই উপজেলার মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি গঠনে ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত এই উপজেলাকে ঘিরে রয়েছে খুলনা ও ঢাকা বিভাগের অন্যান্য উপজেলাসমূহ। এখানে ভাষার মূল বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের অন্যান্য উপজেলার মতই, তবুও কিছুটা বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন কথ্য ভাষায় মহাপ্রাণধ্বনি অনেকাংশে অনুপস্থিত, অর্থাৎ ভাষা সহজীকরণের প্রবণতা রয়েছে। উপজেলার আঞ্চলিক ভাষার সাথে সন্নিহিত যশোর ও খুলনার ভাষার অনেকটা সাযুজ্য রয়েছে। এই এলাকার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে কোটচাঁদপুর এর সভ্যতা বহুপ্রাচীন। এই এলাকায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রাচীন সভ্যতার বাহক হিসেবে দেদীপ্যমান। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে উপজেলার অবদানও অনস্বীকার্য।
নদ-নদী ও জলাশয়
কোটচাঁদপুর উপজেলায় ২টি নদী রয়েছে। নদীগুলো হচ্ছে চিত্রা নদী ও কপোতাক্ষ নদ। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কপোতাক্ষ নদ। ব্রিটিশ শাসনামলে এই নদকে কেন্দ্র করে কোটচাঁদপুরে গড়ে উঠেছিল বাণিজ্যকেন্দ্র। [2][3]
এছাড়া এই উপজেলার সীমানার মধ্য আছে কয়েকটি বাওড়। কুশনা বাওড়, বলুহর বাওড় ও জয়দিয়া বাওড়। বলুহর বাওড়কে কেন্দ্র করে পর্যটন এলাকাও গড়ে উঠেছে।
উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসন
ক্রম নং. | পদবী | নাম |
---|---|---|
০১ | উপজেলা চেয়ারম্যান | মোছাঃ শরিফুন্নেছা মিকি |
০২ | ভাইস চেয়ারম্যান | মোঃ রিয়াজ হোসেন ফারুক |
০৩ | মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান | পিংকী খাতুন |
০৪ | উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা | "মোঃ দেলোয়ার হোসেন |
ইতিহাস
বাংলাদেশের এক পুরোনো শহর ও প্রসিদ্ধ এলাকা হলো বর্তমানের কোটচাঁদপুর। কোটচাঁদপুর শহরটি বর্তমানে খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ জেলায় অবস্থিত। ১৯৮৬ সালে ঝিনাইদহ জেলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে পর্যন্ত এই শহরটি বৃহত্তর যশোর জেলার অধীনে ছিল। ছোট এই শহরটি একইসাথে থানা, পৌরসভা ও উপজেলা। এই শহরের অধীনে আছে ৫ টি ইউনিয়ন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদের এই শহরের রয়েছে এক প্রসিদ্ধ ইতিহাস। একসময় এই কপোতাক্ষ নদী বড় বড় লঞ্চ, হাজারমণি নৌকা এমনকি কিছু কিছু জাহাজও আসতো। বণিকরা এখানে আসতো ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। বিশেষ করে চিনি, খেঁজুরের গুড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল এই এলাকা। লোকমুখে শোনা যায় যে, এই এলাকা একসময় কেয়া বাগানে ভরা এক মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিদর্শন ছিল। ব্রিটিশ শাসন আমলে ইংরেজদের শাসনের স্মৃতি এখনো বহন করছে ইংরেজদের বসবাসের বিশাল ভবনটি যেটি এখন বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ, যোগাযোগব্যবস্থা ভালো ও ভারতের নিকটবর্তী হওয়ার ক্রমেই তখন ছোট কলকাতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল কোটচাঁদপুর।
প্রথমেই জানা যাক এই শহরের নামকরণ সম্পর্কে। মুঘল সাম্রাজের সম্রাট আকবরের আমলে ইসলাম প্রচারের জন্য এই এলাকায় এসেছিলেন সরদার চাঁদ খা নামের এক দরবেশ। তিনি তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে কপোতাক্ষ নদের তীর বসতি স্থাপন করেন। তার নামানুসারেই প্রথমে এই এলাকার নাম রাখা হয় চাঁদপুর। ধীরে ধীরে চাঁদপুর বঙ্গের একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে ও দেশ বিদেশ থেকে এখানে মানুষ আসতে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বসবাসের উদ্দেশ্যে। দেশ বিদেশে এই বাণিজ্য কেন্দ্রটির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে সেটি নজরে আসে মগ ও পর্তুগীজদের। বেশ কয়েকবার তারা এখানে আক্রমণ ও লুটপাট করেন। তখন ছিল বাদশা জাহাঙ্গীরের শাসনামল। ১৬০৮ সালে তিনি খাঁ চিশতী নামের একজন সুবেদারকে তৎকালীন চাঁদপুরে পাঠান মগ-পর্তুগীজসহ ভিনদেশি দস্যুদের দমন করতে। তারপরে ১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খাঁ এখানে প্রাচীর নির্মাণ ও দস্যুদের বিচারের জন্য কোর্ট(আদালত) নির্মাণ করেন। তখন চাঁদপুরের আগে কোর্ট শব্দটি যুক্ত হয়ে নাম হয় কোর্টচাঁদপুর। কোর্টচাঁদপুর থেকেই আরেকটু পরিমার্জিত হয়ে বর্তমান নাম কোটচাঁদপুর।
সুবেদার ইসলাম খাঁ মৃত্যুবরণ করার পরে কোটচাঁদপুরের সুবেদার নিযুত হন কাসিম খাঁ। এরপরে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে কোটচাঁদপুরকে মহকুমায় উন্নীত করা হয়। ১৮৬৩ সালের ১৪ই মার্চ পর্যন্ত এই এলাকাটি মহকুমা হিসেবে ছিল। কিন্তু তারপরে সেটি সম্পূর্ণরুপে বিলুপ্ত করা হয় এবং কোর্টটিও তখন বিধ্বস্ত হয়ে যায়।
একসময় ছোট কলকাতা খ্যাত কোটচাঁদপুর বিখ্যাত ছিল মাতগুড়ের জন্য। এই গুড় দিতেই তৈরি হতো চিনি এবং সেই চিনি সুখ্যাতি ছিল দেশ-বিদেশে। সেই আমলের চিনিকলের স্মৃতিবহন করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে বেশকিছু পুরোনো ভবন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপিয়ান নাগরিক মিস্টার বেইক কোটচাঁদপুরে একটি চিনিকল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারপরে এখানে আরও বেশকিছু চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৮৮৩ সালে কোটচাঁদপুরকে মিউনিসিপাল কর্পোরেশনে উন্নীত করা হয়। সেই সময় ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্টারের দায়িত্বে ছিলেন মি.ক্যাসেল। তারপরে পর্যায়ক্রমে মি. ই জি ম্যাকলয়েড, এইচ সি ম্যাকলয়েড, নীলরঞ্জন রায়, হেমন্ত চন্দ্র দায়িত্ব পালন করেন। কোটচাঁদপুর পৌরসভার প্রথম মুসলিম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন গোলাম হায়দার সরদার, ১৯৪৭ সালে।
প্রাচীন আমলে তৈরি একটি বিশাল ভবন এখন শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়। শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত আরেকটি ভবন (তারিন দত্তের বাড়ি) বর্তমানে ব্যবহারের অনুপযোগী ও নড়বড়ে হয়ে গেছে। এখন আর কপোতাক্ষে বড় বড় লঞ্চ, স্টিমার, হাজারমণি নৌকা আসে না। কোটচাঁদপুরের সেই সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আর নেই এখন। কোটচাঁদপুরের এসব ভবনগুলো বাংলাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের একটি বড় অংশ। এই শহরের পুরাকীর্তিগুলো সংরক্ষণ করা হলে তা আমাদের ঐতিহ্যকে করবে আরও সমৃদ্ধ।
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
- বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন (জুন ২০১৪)। "এক নজরে কোটচাঁদপুর"। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। সংগ্রহের তারিখ ২৫ জানুয়ারী ২০১৫।
- ড. অশোক বিশ্বাস, বাংলাদেশের নদীকোষ, গতিধারা, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১১, পৃষ্ঠা ৩৮৯, আইএসবিএন ৯৭৮-৯৮৪-৮৯৪৫-১৭-৯।
- মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক (ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। বাংলাদেশের নদনদী: বর্তমান গতিপ্রকৃতি। ঢাকা: কথাপ্রকাশ। পৃষ্ঠা ৬০-৬১, ৬১২। আইএসবিএন 984-70120-0436-4।