কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির

কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির বা কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির কালনার রাজবাড়ি মন্দির চত্বরের পূর্ব দিকে অবস্থিত । ১৬৭৩ শকাব্দে ( ১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে ) বর্ধমানরাজ ত্রিলোকচন্দ্রের মাতা লক্ষ্মীকুমারী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, দক্ষিণমুখী, তিনতলবিশিষ্ট মন্দিরটি পঁচিশরত্ন মন্দির। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রধান সিংহাসনে রয়েছেন কৃষ্ণচন্দ্র ও রাধার বিগ্রহ। উচ্চতা যথাক্রমে ২ ফুট ৬ ইঞ্চি ( ৭৬ সেমি ) ও ২ ফুট ( ৬১ সেমি )। সঙ্গে রয়েছেন চার সখি। মূর্তিগুলি সবই দারু নির্মিত।[1]

কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির

গঠন

কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরে টেরাকোটার শিল্প কর্ম

মন্দিরের প্রথম তলের ছাদ ধনুরাকৃতি হয়ে যে কোণের সৃষ্টি করেছে তার চারটি কোণে পর্দার আকারে খানিকটা উঁচু করে দেওয়াল তোলা। সেই দেওয়ালে আছে চুন-সুরকির বড় আকৃতির হাতি ও সিংহের মূর্তি। ঐ পর্দা-দেওয়ালের উপরেই উঁচু করা কোণগুলিতে আছে ৩ টি করে চারকোণে মোট ১২ টি চূড়া। অর্থাৎ প্রথম তলের ছাদে আছে মোট ১২ টি চূড়া। এর পর বেড় কমিয়ে খানিকটা উপরে অষ্টকোণাকৃতি ২য় তল সৃষ্টি করা হয়েছে। তার ছাদের আটকোণে আছে ৮ টি চূড়া। এরপর বেড়ের প্রসারতা কমিয়ে ২য় তলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায় ৩য় তল সৃষ্টি করা হয়েছে। তার চারকোণে ৪ টি এবং মাঝখানে আছে একটি বড় চূড়া। অর্থাৎ চূড়াগুলির সজ্জা হচ্ছে ১২+৮+৪+১ মোট পঁচিশ। মন্দিরের সামনে সন্নিবদ্ধ রয়েছে একটি 'একবাংলা ' মণ্ডপ। এটি পরিদর্শন কক্ষ রূপে ব্যবহৃত হয়। গর্ভগৃহের সামনে ত্রিখিলান দালান। তোরণগুলির তিনটি খিলান ধারণের জন্য মধ্যে দুটি পূর্ণ স্তম্ভ ও ধারে দুটি অর্ধ স্তম্ভ রয়েছে। স্তম্ভগুলিতে ফুলকারি নকশা ছাড়াও আছে টেরাকোটার অলংকরণ। অন্যান্য মূর্তির মধ্যে সপরিবার দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনীর একটি প্যানেল আছে। খিলানগুলির উপর প্রতীক শিব মন্দির ও তার মধ্যে শিবলিঙ্গ। গর্ভগৃহে মূল দ্বার একটি। মন্দিরের পূর্ব দিকে আছে ত্রিখলান সজ্জা। অলিন্দ নেই। দুটি জানলা। পশ্চিম দিকে ত্রিখিলান সজ্জা বিশিষ্ট ভোগ কক্ষ। দুটি জানলা ও একটি দরজা। কিন্তু কোন অলিন্দ নেই। পিছনে ত্রিখিলান ভরাটকরা। কোন দরজা বা জানলা নেই। উত্তর দিকের ভিতরে রয়েছে সিঁড়ি। ঐ সিঁড়ি উঠে গেছে ৩য় তলে।

ভাস্কর্য ও দেয়াল চিত্র

মন্দিরের সামনের দেওয়ালে, স্তম্ভের গায়ে, চালা-মণ্ডপটির সর্বত্র রয়েছে অজস্র টেরাকোটা মূর্তি ও ফুলকারি নকশা। মূল মন্দিরের সামনের দেওয়ালে কার্নিসের নিচ পর্যন্ত খোপে খোপে অসংখ্য মূর্তিফলক বসানো। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে 'কল্পলতা' বা 'মৃত্যুলতা'কে দেওয়ালের কোণে বা গায়ে খাড়াকরে লাগানোই প্রচলিত রীতি। এখানেও কোণের দুপাশে তা সমতলভাবে নিবদ্ধ এবং তা একতলার কার্নিস পর্যন্ত উঠে গেছে। ( 'কল্পলতা' হল উপর থেকে নিচে লতার মত কোণাচ। হাতি, সিংহ, লতা-পাতা অরণ্যের প্রতীক। এইভাবে মন্দির হয় অভীষ্ট ফলপ্রদ 'কল্পতরু'। আবার সমস্ত মায়ার মৃত্যু ঘটায় বলে একে 'মৃত্যুলতা'-ও বলা হয়। )

শুধুমাত্র টেরাকোটা প্রাচুর্য নয়, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র, সুন্দর সুন্দর টেরাকোটা মূর্তি ও ফুলের নকশা যা এই মন্দিরে রয়েছে তা উচ্চমানের বলা যায়। ধর্মীয় ও সামাজিক দৃশ্যের ফলকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, অশ্বমেধ যজ্ঞ, বকাসুর বধ, নৌকাবিলাশ, যুদ্ধ চিত্র, বন্দুকধারী ফিরিঙ্গি সৈন্য, শিকার দৃশ্য, ভয়ংকর সিংহের উপর কোন দেব বা দেবীর দণ্ডায়মান আবস্থায় যুদ্ধ প্রভৃতি। তবে টেরাকোটাগুলির বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে বা হতে চলেছে। পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দিকের দেওয়ালের গায়ে রয়েছে ফুলকারি নকশা, এগুলিতে কোন মূর্তিসজ্জা নেই।

পূজা অর্চনা

মন্দিরের বিগ্রহ নিত্য পূজিত। সকালে মাখন ও মিছরি ভোগ, তারপর পূজা, মধ্যাহ্নে ভোগ ও শয়ন, বৈকালে উত্থান এবং সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি ও ভোগ। মন্দিরটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ঠাকুরবাড়ি, রন্ধনশালা প্রভৃতিও আছে।

সংরক্ষন

মন্দিরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ, কলকাতা মণ্ডল দ্বারা সংরক্ষিত।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. বাংলার মন্দিরের খোঁজ-শ্যামল কুমার ঘোষ
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.