কাশীরাম দাস
কাশীরাম দাস, কাশীদাস বা কাশীরাম দেব মধ্যযুগীয় (সময়কাল আনুমানিক ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দী) বাঙালি কবি।[1] তিনি সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারত বাংলা পদ্যে অনুবাদ করেছিলেন। তার অনূদিত গ্রন্থ ভারত-পাঁচালী বা কাশীদাসী মহাভারত নামে পরিচিত। তার অনূদিত মহাভারতই বাংলা ভাষায় সবচেয়ে জনপ্রিয়।
কাশীরাম দাস | |
---|---|
জন্ম | |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
পেশা | কবি, অনুবাদকারী |
জীবনী
কবি কাশীরাম দাস বর্ধমান জেলার ইন্দ্রাণী পরগণার[2] (অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমা) অন্তর্গত সিঙ্গি (মতান্তরে সিদ্ধি) গ্রামে এক বৈষ্ণব কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।[3]
আত্মকাহিনি সম্পর্কে কবি কাশীরাম দাস নিজেই বলেছেন,
ইন্দ্রাণী নামেতে দেশ পূর্বাপর স্থিতি।
দ্বাদশ তীর্থেতে যথা বৈসে ভাগীরথি।।
কায়স্থ কুলেতে জন্ম বাস সিঙ্গি গ্রাম।
প্রিয়ঙ্কর দাস পুত্র সুধাকর নাম।।
তৎপুত্র কমলাকান্ত কৃষ্ণদাস পিতা।
কৃষ্ণদাসানুজ গদাধর জৈষ্ঠ্য ভ্রাতা।।
পাঁচালি প্রকাশি কহে কাশীরাম দাস।
অলি হব কৃষ্ণপদ মনে অভিলাষ।।
এ গ্রাম এখনও আছে এবং এই গ্রামে কাশীরামের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলি আজও বর্তমান।[4]তাঁরা দেব উপাধিধারী কায়স্থ।[4] তাঁর পিতার নাম ছিল কমলাকান্ত।[3] কবিরা ছিলেন তিন ভাই—কৃষ্ণরাম, কাশীরাম ও গদাধর।[4] তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন কবি।[5] অগ্রজ কৃষ্ণদাস শ্রীকৃষ্ণবিজয় এবং শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ অনুসরণে শ্রীকৃষ্ণবিলাস[4] নামে কাব্য লেখেন। অনুজ গদাধর লিখেছিলেন জগন্নাথমঙ্গল বা জগৎমঙ্গল কাব্য। গদাধরের জগৎমঙ্গল কাব্যে এই বর্ণনার অনুরূপ উল্লেখ আছে।[6] কবির অনুজ গদাধরের পুত্রের নাম নন্দরাম দাস।[4] কাশীরাম বেদব্যাস বিরচিত সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারত অবলম্বনে লেখেন ভারত-পাঁচালী।[3] কাশীরাম দাস সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন।[3] তিনি অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আবাসগড় বা আসিগড় বা আওসগড়ের জমিদার বাড়ির আশ্রয়ে থেকে শিক্ষকতা করতেন।[3][5] কথিত আছে, উক্ত জমিদার বাড়িতে কথক ও সংস্কৃত পণ্ডিতদের মুখে মহাভারতের কাহিনী শুনে তিনি বাংলা ভাষায় মহাভারত অনুবাদে উদ্বুদ্ধ হন।[3]গবেষকদের অনুমান, ভারত-পাঁচালী রচনা সমাপ্ত হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। তাদের আরও অনুমান, কাশীরাম দাস সম্পূর্ণ মহাভারত অনুবাদ করে যেতে পারেননি। আদি, সভা, বন ও বিরাট – এই চার পর্ব অনুবাদের পর তাঁর মৃত্যু হলে তার জামাই অবশিষ্টাংশ অনুবাদ করেন।[7]
আদি, সভা, বন, বিরাটের কত দূর।
ইহা রচি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর।।অন্যমতে, তার ভাইপো নন্দরাম ও অন্যান্য আত্মীয়রা মিলে অনুবাদকর্ম সমাপ্ত করেন।[8] শান্তিপর্ব কৃষ্ণানন্দ বসু ও স্বর্গারোহণ পর্ব জয়ন্ত দাস (কোনো কোনো মতে ইনি কবির পুত্র) লিখেছিলেন।[9]
কাশীরাম দাসের বংশতালিকা
কাশীরাম দাশের বংশতালিকা প্রিয়ঙ্কর দেব সুধাকর দেব কমলাকান্ত গদাধর কাশীরাম কৃষ্ণদাস কাশীদাসী মহাভারত
কাশীরাম দাস রচিত অনুবাদটি কাশীদাসী মহাভারত নামে জনপ্রিয়। যদিও কবি এটির নামকরণ করেছিলেন ভারত-পাঁচালী।[10]
রচনাকাল
কাশীদাসী মহাভারতে বিরাট পর্বের শেষে কবি একটি ভণিতায় বিরাট পর্ব অনুবাদের সমাপ্তি কাল নির্দেশ করেছেন -
“ চন্দ্র বাণ পক্ষ ঋতু শক সুনিশ্চয়।
বিরাট হইল সাঙ্গ কাশীদাস কয়।।” অর্থাৎ, ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে বিরাট পর্ব রচনার কাজ সমাপ্ত হয়।[1] "এর হেয়ালী ভাষা উদ্ধার করলে অর্থ দাঁড়ায় ১ (চন্দ্র), ৫ (পঞ্চবাণ), ২ (পক্ষ) এবং ৬ (ঋতু) অর্থাৎ ১৫২৬ শতাব্দ। খ্রিস্টাব্দ হিসেবে দাঁড়ায় ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দ।"
বৈশিষ্ট্য
ভাবানুবাদ
কাশীরাম দাসের মহাভারত মূল মহাকাব্যের আক্ষরিক অনুবাদ নয়, ভাবানুবাদ। তিনিও কৃত্তিবাস ওঝা এবং মালাধর বসু'র মতো মূল গ্রন্থের কাহিনী বর্জন বা অন্য গ্রন্থ থেকে কাহিনী সংযোজন করেছেন। মহাভারতের ভীষ্ম পর্বের গীতা পর্বাধ্যায় (যা শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা নামে পরিচিত)-সহ অনেক গুরুগম্ভীর দার্শনিক আলোচনা তিনি বাদ দিয়েছেন। আবার শ্রীবৎস চিন্তা, সুভদ্রা হরণের মতো বাঙালি-মানসের উপযোগী নানা কাহিনী অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ থেকে সংযোজন করেছেন। আসলে, মহাভারতের মূলানুগ অনুবাদ নয়, কবির উদ্দেশ্য ছিল মহাভারতের নীতিকথাগুলি বাঙালি সমাজে প্রচার করা।[10] মহাভারতে সংসার জীবন, সত্যপালন, ন্যায়ধর্মাচরণ, বীরত্ব, সতীত্ব, সত্যনিষ্ঠা, ঈশ্বরভক্তি, ধার্মিকতা, উদারতা, আত্মবিসর্জন প্রভৃতি যেসব সদগুণের কথা বলা হয়েছে এবং যা হিন্দুধর্মের মূল ভিত্তি, তা-র প্রচারই মহাভারত অনুবাদের মাধ্যমে করতে চেয়েছিলেন কাশীরাম দাস।[11]
জনপ্রিয়তা
ঊনবিংশ শতাব্দীর কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার ‘কাশীরাম দাস’ সনেটে (চতুর্দশপদী কবিতাবলী, সনেট নং ৬) কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখেন:[12]
মহাভারতের কথা অমৃতসমান।
হে কাশি, কবীশদলে তুমি পুণ্যবান্।।স্বীকৃতি
বর্ধমান জেলার অন্তর্গত সিঙ্গিগ্রামে (কোন কোন মতে সিদ্ধ বা সিদ্ধিগ্রাম) কাশীরামের জন্ম হয়েছিল। অধুনা সিঙ্গিগ্রামের অধিবাসীরা কাশীরামের নাম স্মরণ করে রাখার লক্ষ্যে কাশীরাম দাস ইন্স্টিটিউশন নামে একটি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় স্থান করেছেন।[13]
রচিত পুস্তকাদি
কাশীরাম দাস বাংলায় মহাভারত মহাকাব্য অনুবাদ ভারত পাঁচালী কাব্য রচনা করে গেছেন। এছাড়াও, তার রচিত সত্যনারায়ণের পুঁথি, স্বপ্নপর্ব, জলপর্ব ও নলোপাখ্যান কাব্যগ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়।[5]
বাংলা ভাষার উইকিসংকলনে এই নিবন্ধ বা অনুচ্ছেদ সম্পর্কিত মৌলিক রচনা রয়েছে: কাশীদাসী মহাভারততথ্যসূত্র
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, শ্রীধর প্রকাশনী, কলকাতা, পৃ. ১২২
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, শ্রীমন্ত কুমার জানা, ওরিয়েন্টাল বুক কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃ. ১৮৫
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, কালীপদ চৌধুরী, বাণী সংসদ, কলকাতা, পৃ. ১২১-২২
- ডঃ অমিও বন্ধু সিংহ (২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০)। বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্তান্ত খ্রীষ্টীয় চতুর্থ সপ্তদশ শতাব্দী প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগ। একুশ শতক।
- সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সম্পাদনাঃ অঞ্জলি বসু, ৪র্থ সংস্করণ, ১ম খণ্ড, ২০০২, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, পৃ. ৯৫
- কাশীদাসী মহাভারত, স্বর্গারোহণ পর্ব, পরিশিষ্ট, পৃঃ ১২২৪–২৫
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, কালীপদ চৌধুরী, বাণী সংসদ, কলকাতা, পৃ. ১২১-২২
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, শ্রীধর প্রকাশনী, কলকাতা, পৃ. ১২২
- বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস, ক্ষেত্র গুপ্ত, গ্রন্থনিলয়, কলকাতা, পৃ. ১৫১-৫২
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, শ্রীধর প্রকাশনী, কলকাতা, পৃ. ১২৩
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, শ্রীধর প্রকাশনী, কলকাতা, পৃ. ১২৪
- মধুসূদন রচনাবলী, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, পৃ. ৩৬৭
- সরল বাঙালা অভিধান, সংকলকঃ সুবলচন্দ্র মিত্র, নিউ বেঙ্গল প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড, ৮ম সংস্করণ, ১৯৯৫, কলকাতা, পৃ. ৩৮৩