কারক

আধুনিক বাংলা ব্যাকরণে কারক ছয় প্রকার:

• কর্তৃকারক
• কর্ম কারক
• করণ কারক
• অপাদান কারক
• অধিকরণ কারক
• সম্বন্ধ কারক[1]

পূর্বে সম্প্রদান কারককে কারকের একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসাবে ধরা হলেও বর্তমানে তা কর্ম কারকের অংশ হিসাবে বিবেচিত।

অধিকাংশ ভাষাতত্ত্ববিদ এটি মেনে নিয়েছেন, যে প্রাচীন গ্রিকদের তাদের নিজেদের ভাষার বিভিন্ন ক্রিয়াপদের সঙ্গে নামপদের সম্পর্ক ও বাক্যে এদের ব্যবহার সম্মন্ধে বিস্তৃত ধারণা ছিল। গ্রিক কবি আনাক্রিয়ন এর একটি পুস্তিকা থেকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। তবুও এই বিষয়টি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নয়, যে আধুনিক ব্যাকরণে "কারক" বলতে যে বিষয়টিকে বোঝানো হয়, তা সম্পর্কে প্রাচীন গ্রিকরা পুরাপুরি অবগত। "ব্যাকরণের কারক"কে সর্বপ্রথম ব্যাকরণের একটি স্বতন্ত্র অংশ হিসাবে বৈরাগ্যবাদীরা স্বীকৃতি দিয়েছিল, যা তারা জানতে পেরেছিল প্রাচীন গ্রিসের পেরিপেটীয় ঘরানার কিছু দার্শনিকদের কাছ থেকে।[2][3]

কারক শব্দটি প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার *কাড ধাতু থেকে এসেছে[4], যার অর্থ হলো- "যা কাজ সম্পাদন করে"।

বাক্যস্থিত ক্রিয়াপদের সঙ্গে নামপদের যে সম্পর্ক, তাকে কারক বলে।[1]

মোটামুটি সকল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহর ব্যাকরণেই কারক বিদ্যমান। তবে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোর থেকে ভারত উপমহাদেশের ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহতে কারকের বৈশিষ্ট্য বেশি ফুটে ওঠে। এর কারণ অত্যাধিক হারে বিভক্তি ও অনুসর্গের ব্যবহার। বাংলা ভাষাতেও এর ব্যাতিক্রম নয়। ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহের অধিকাংশ কারক সংস্কৃত হতে আগত।

বাংলা কারক সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে বিভক্তি সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। কারণ কারকের সম্পর্ক বোঝাতে নামপদের সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত হয়। বিভক্তিগুলো ক্রিয়াপদের সাথেও নামপদের সম্পর্ক স্থাপন করে।[1]

০ (শূন্য) বিভক্তি (অথবা অ-বিভক্তি), এ (য়), তে (এ), কে, রে, র (এরা) - এ কয়টি খাঁটি বাংলার শব্দ বিভক্তি। এছাড়া বিভক্তি স্থানীয় কয়েকটি অব্যয় শব্দও কারক-সম্বন্ধ নির্ণয়ের জন্য বাংলায় প্রচলিত রয়েছে। যেমন - দ্বারা, দিয়ে, হতে, থেকে ইত্যাদি।

নিচের ছকের বিভক্তিগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে নামপদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে।

তারকা চিহ্নিত (*) বিভক্তিগুলো এবং বন্ধনীতে লিখিত শব্দ চলিত ভাষায় ব্যবহৃত হয়।

দ্রষ্টব্য: বিভক্তি চিহ্ন স্পষ্ট না হলে সেখানে শূন্য বিভক্তি আছে মনে করা হয়।

প্রশ্ন কাঠামো: কে, কারা + ক্রিয়া +?

বাক্যস্থিত যে বিশেষ্য বা সর্বনাম পদ কাজ সম্পন্ন করে তাকে ক্রিয়ার কর্তা বা কর্তৃকারক বা কর্তা কারক বলে। ক্রিয়ার সঙ্গে কে বা কারা যোগ করে প্রশ্ন করলে উত্তরে কর্তৃকারক পাওয়া যায়।

উদাহরণ:

• খোকা বই পড়ে। [কে বই পড়ে?]
• মেয়েরা ফুল তোলে। [কারা ফুল তোলে?]
• আমরা নদীর ঘাট থেকে রিকশা নিয়েছিলাম। [কারা নদীর ঘাট থেকে রিকশা নিয়েছিলাম/নিয়েছিল?]

প্রশ্ন কাঠামো: কি, কাকে + ক্রিয়া +?

যাকে আশ্রয় করে কর্তা কাজ সম্পন্ন করে, তাকে কর্ম কারক বলে। ক্রিয়ার সঙ্গে কি বা কাকে দ্বারা প্রশ্ন করলে উত্তরে কর্ম কারক পাওয়া যায়।

উদাহরণ:

• ডাক্তার ডাকো। [কাকে ডাকো?]
• তাকে বলো। [কাকে বলো?]
• শিক্ষককে জানাও। [কাকে জানাও?]

প্রশ্ন কাঠামো: কি বা কাকে + ক্রিয়া +?

যাকে স্বত্ব ত্যাগ করে দান, অর্চনা, সাহায্য ইত্যাদি করা হয়, তাকে সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী সম্প্রদান কারক বলে। একে নিমিত্ত কারক-ও বলা হয়। এখানে লক্ষণীয় যে, বস্তু নয় ব্যক্তিই সম্প্রদান কারক। ক্রিয়াকে কাকে দিয়ে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায় তা সম্প্রদান কারক। স্বত্বত্যাগ না করে কোনো জিনিস কাউকে উদ্দেশ্য করে দিলে সেটি কর্মকারক হিসাবে বিবেচিত হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হয় না। এই বিভ্রান্তি এড়াতে বর্তমানে সম্প্রদান কারককে কর্ম কারকের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

উদাহরণ:

• ভিখারিকে ভিক্ষা দাও। (স্বত্বত্যাগ করে)
• বেলা যে পড়ে এল, জলদি চলো।

প্রশ্ন কাঠামো: কিসের দ্বারা, কি দ্বারা, কি দিয়ে + ক্রিয়া +?

"করণ" শব্দটির অর্থ - যন্ত্র, সহায়ক বা উপায়। ক্রিয়া সম্পাদনের যন্ত্র, উপকরণ বা উপায়কেই করণ কারক বলে। বাক্যস্থিত ক্রিয়াপদের সঙ্গে কিসের দ্বারা বা কি দ্বারা (কি দিয়ে) প্রশ্ন করলে উত্তরে করণ কারক পাওয়া যায়।

উদাহরণ:

• নীরা কলম দিয়ে লেখে। [নীরা কি দিয়ে লেখে?]
• “জগতে কীর্তিমান হয় সাধনায়।” [কি দিয়ে/কি দ্বারা জগতে কীর্তিমান হয়?]
• চাষিরা ধারালো কাস্তে দ্বারা ধান কাটছে। [চাষিরা কি দ্বারা ধান কাটছে?]

প্রশ্ন কাঠামো: কি হতে, কি থেকে, কোথা হতে, কোথা থেকে + ক্রিয়া +?

যা থেকে কিছু বিচ্যুত, গৃহীত, জাত, বিরত, আরম্ভ, দূরীভূত ও রক্ষিত হয় এবং যা দেখে কেউ ভীত হয়, তাকে অপাদান কারক বলে।

উদাহরণ:

• জমি থেকে ফসল পাই। [কোথা থেকে ফসল পাই?]
• গাছ থেকে পাতা পড়ে। [কোথা থেকে পাতা পড়ে?]
• সুক্তি থেকে মুক্তো মেলে। [কি থেকে মুক্তো মেলে?]
• ঢাকা থেকে কলকাতা অনেক দূর। [কোথা থেকে কলকাতা অনেক দূর?]
• পরাজয়ে ডরে না বীর। [ভয় বুঝাতে অপাদান কারক]
• সোমবার পরীক্ষা শুরু হবে। [আরম্ভ বুঝাতে অপাদান কারক]

প্রশ্ন কাঠামো: কোথায়, কখন, কিসে + ক্রিয়া +?

ক্রিয়া সম্পাদনের সময়, স্থান এবং আধারকে অধিকরণ কারক বলে।

উদাহরণ:

• বাড়িতে কেউ নেই। [কোথায় কেউ নেই?]
• বসন্তে কোকিল ডাকে। [কখন কোকিল ডাকে?]
• সূর্যোদয়ে অন্ধকার দূরীভূত হয়। [কিসে অন্ধকার দূরীভূত হয়?]
• বাবা বাড়ি আছেন। [বাবা কোথায় আছেন?]
• বিকাল পাঁচটায় অফিস ছুটি হবে। [কখন অফিস ছুটি হবে?]

যে পদ বিশেষ্য ও সর্বনাম পদের সঙ্গে বিশেষ্য ও সর্বনাম পদের সম্পর্ক নির্দেশ করে, তাকে সম্বন্ধ পদ বা সম্বন্ধ কারক বলে। ক্রিয়াপদের সঙ্গে এদের সম্পর্ক পরোক্ষ হয়। পূর্বে কারকে শ্রেণিভুক্ত না করা হলেও বর্তমানে একটি কারক হিসাবে বিবেচিত হয়, কারণ ক্রিয়ার সঙ্গে এদের সম্পর্ক বিদ্যমান।

"সম্বোধন" শব্দটির অর্থ আহ্বান। যাকে সম্বোধন বা আহ্বান করে কিছু বলা হয়, তাকে সম্বোধন পদ বলে। সম্বোধন পদ বাক্যের অংশ। কিন্তু বাক্যস্থিত ক্রিয়াপদের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ থাকে না বলে, সম্বোধন পদ কারক নয়।

বাংলায় এমন অনেক বাক্য রয়েছে যেখানে ক্রিয়াপদ নেই। উদাহরণস্বরূপ, "মাঠে মাঠে অজস্র ফসল", "ছোট ছোট ডিঙি নৌকাগুলো নদীতে ভাসমান।"
এ জাতীয় ক্রিয়াহীন অনেক বাক্য বাংলায় রয়েছে। ক্রিয়াপদ নেই বলে এই বাক্যগুলোর অন্তর্গত নাম শব্দগুলোর কারকও নেই। সেজন্য বলা হয়, "বাংলা বাক্য কারক-প্রধান নয়।"[5] তবে বিভক্তি ছাড়া বাংলা বাক্য গঠিত হতে পারে না বলে বাংলা বাক্য বিভক্তিপ্রধান।

• বাংলা ব্যাকরণ
• সমাস
• বাচ্য