কামারপুকুরের সাদা বোঁদে

কামারপুকুরের সাদা বোঁদে পশ্চিমবঙ্গের স্বতন্ত্র ও ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অত্যন্ত প্রিয় ছিল এই মিষ্টান্ন।[1] প্রচলিত বোঁদের সাথে এই বোঁদের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।[2][3]

কামারপুকুরের সাদা বোঁদে
প্রকারমিষ্টিজাতীয় খাবার
উৎপত্তিস্থলভারত
অঞ্চল বা রাজ্যকামারপুকুর, হুগলি, পশ্চিমবঙ্গ
পরিবেশনসাধারণ তাপমাত্রা
প্রধান উপকরণবেসন, রমা কলাই, চালের গুঁড়ো, চিনি
ভিন্নতাজনাইয়ের সাদা বোঁদে

ইতিহাস

রামকৃষ্ণ পরমহংস সাদা বোঁদে খুব ভালবাসতেন

কামারপুকুরের সাদা বোঁদে কে কবে প্রথম প্রস্তুত করেছিলেন তার সম্বন্ধে কোন তথ্য পাওয়া যায় না।[3][4][5] আদিতে কামারপুকুরে এই সাদা বোঁদে তৈরী করতেন বিশেষ কিছু হাতে গোনা পরিবার। আনুমানিক ১২০০ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৭৯৩-৯৪ সাল নাগাদ কামারপূকুরে সাদা বোঁদে তৈরী করতেন জনৈক মধুসূদন মোদক।[4] গদাধর চট্টোপাধ্যায়, যিনি পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ পরমহংস বা ঠাকুর বলে খ্যাত হন, ১৮৩৬ সালে কামারপুকুরের জন্মগ্রহণ করেন। রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্ম ভিটে ছিল মোদক বাড়ির পাশেই।[3] একটি মত অনুসারে গদাধর চট্টোপাধ্যায় মধুসূদন মোদকের পুত্র দুর্গাদাসের বাল্যবন্ধু ছিলেন। বালক গদাধর তার বন্ধু দুর্গাদাসের বাড়িতে গেলেই সাদা বোঁদে খেতেন।[4] অন্য মতে গদাধর দুর্গাদাস মোদকের পুত্র সত্যকিঙ্করের দোকান থেকে সাদা বোঁদে কিনে খেতেন।[3] সেই থেকে আজীবন কামারপুকুরের সেই সাদা বোঁদে খেতে খুব ভালোবাসতেন রামকৃষ্ণ পরমহংস। রামকৃষ্ণ কথামৃতে কামারপুকুরের সাদা বোঁদের উল্লেখ রয়েছে।[6] কামারপুকুর মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী লোকত্তরানন্দর মতে রামকৃষ্ণ সাদা বোঁদে খেতে ভালবাসতেন এমন কোনো নথি রামকৃষ্ণ মিশনের কাছে নেই।[7]

সারদা দেবীরও সাদা বোঁদে ভীষণ প্রিয় ছিল। তিনি দুর্গাদাস মোদকের পুত্র সত্যকিঙ্কর মোদকের দোকানের বোঁদে খুব ভালবাসতেন।[4] তিনি ভক্তদের সাদা বোঁদে বা জিলিপি খেতে দিতেন। সেই থেকেই কামারপুকুরের সাদা বোঁদের সাথে মোদক পরিবারের নাম জড়িয়ে আছে। ১৯৪৭ সালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন কর্তৃপক্ষ কামারপুকুরে রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্ম ভিটে অধিগ্রহণ করে নেন।[3] ক্রমে কামারপুকুর ঠাকুরের ভক্তদের জন্য একটি তীর্থস্থানে পরিণত হয় এবং ভক্তদের মাধ্যমে ঠাকুরের স্নেহধন্য কামারপুকুরের সাদা বোঁদের জনপ্রিয়তা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।[3]

প্রস্তুত প্রণালী

কামারপুকুরের সাদা বোঁদের প্রধান উপাদান হল রমা কলাইয়ের বেসন[5] এবং আতপ চালের গুঁড়ো।[4][7] তার সাথে লাগে গাওয়া ঘি বা বনস্পতি ঘি ও চিনির রস। রমা কলাই বা রম্ভা কলাই[3] বলতে বরবটির বীজকে বোঝানো হয়। সেই জন্য রমা কলাইয়ের বেসনকে বরবটির বেসনও বলা হয়। অতীতে কামারপুকুরের স্থানীয় চাষীরাই বরবটি চাষ করে পাকা বরবটির বীজের জোগান দিতেন।[8] সেই বরবটির বীজ অর্থাৎ রমা কলাইকে প্রথমে জলে ধুয়ে তারপর রোদে শুকিয়ে নেওয়া হত। এর পর সেই শুকনো কলাইকে পিষে বেসন তৈরি করা হত।[1][2] বর্তমানে কামারপুকুরের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীরা কলকাতার বড়বাজার থেকে রমা কলাইয়ের বেসন আনয়ন করেন।[8] আতপ চালের ক্ষেত্রে মেশিনে গুঁড়ো করা আতপ চালের থেকে ঢেঁকিতে গুঁড়ো করা আতপ চাল শ্রেয় কারণ তাতে স্বাদ বেশি হয়।[3] অতীতে সাদা বোঁদে ভাজা হত গাওয়া ঘিতে। কিন্তু খরচে পোষাতে না পেরে অধিকাংশ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী বনস্পতি ঘি বা ডালডা ব্যবহার করেন। কোন কৃত্রিম রঙ ব্যবহার করা হয় না।[5] সাধারণ বোঁদের মত কামারপুকুরের সাদা বোঁদেয় কোনো কৃত্রিম রং ব্যবহার করা হয় না।[7]

বোঁদের প্রস্তুতিতে প্রথমে এক ভাগ রমা কলাইয়ের সাথে মেশানো হয় দুই ভাগ আতপ চালের গুঁড়ো। তারপর সেই মিশ্রণে জল দিয়ে সারারাত ভিজিয়ে রাখা হয়।[8] পরের দিন সেই মিশ্রণকে ফেটিয়ে খামি তৈরী করা হয়। সেই খামিকে বড় ছানতার সাহায্যে অসংখ্য দানায় পরিণত করে গাওয়া ঘি অথবা বনস্পতি ঘি বা ডালডার ফুটন্ত কড়াইয়ে ছাড়া হয়। ঘি ভাজা হয় বলে এই বোঁদে সাদা রঙের হয়, তেলে ভাজা বোঁদের মত লালচে হয় না। কড়াইতে ভাজা হয়ে গেলে বোঁদেগুলোকে গাঢ় চিনির রসে ডুবিয়ে রাখা হয়।[8] তারপর চিনির রস থেকে তুলে শুকিয়ে নেওয়া হয়। ফলে বোঁদের ভেতরে রস থাকলেও বাইরেটা হয় শুকনো।[5] কামারপুকুরের সাদা বোঁদেবোঁদে সাধারণ বোঁদের থেকে বেশি। প্যকেটে রেখে দিলে এক মাস পর্যন্ত ভাল থাকে এই বোঁদে।

জনপ্রিয়তা

সারা বছর দেশ-বিদেশ থেকে কামারপুকুর-জয়রামবাটিতে আসেন হাজার হাজার পর্যটক।[2] ভক্তরা ভ্রমণ শেষে এই কামারপুকুরের সাদা বোঁদে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যান।[2] তারা মনে করেন তা না করলে ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়।[4] কামারপুকুরের বাসিন্দারা সাদা বোঁদে নিয়ে ভীষণ আবেগপ্রবণ।[7] কামারপুকুরের বাসিন্দারা বাড়িতে অতিথি এলে সাদা বোঁদে দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করেন।[2] তারা মনে করেন অতিথিদের সাদা বোঁদে না খাওয়াতে পারলে তাদের আপ্যায়ন সঠিক হয়নি।[4] আর কামারপুকুরবাসীরা যখন আত্মীয় বাড়ি যান তারা সঙ্গে করে কামারপুকুরের সাদা বোঁদে নিয়ে যান।[2] বিবেকানন্দ মঠে রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভোগে কামারপুকুরের সাদা বোঁদে দেওয়া হয়।[4]

বর্তমান অবস্থা

২০১৭ সালের হিসেবে কামারপুকুরে মিষ্টির দোকানের সংখ্যা মোট কুড়িটি।[3] তার মধ্যে তিনটি দোকান রামকৃষ্ণ পরমহংসের সমসাময়িক সত্যকিঙ্কর মোদকের বংশধরদের। দোকানগুলি মঠ চত্বর, লাহা বাজার ও কামারপুকুর চটি এই তিনটি অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে। প্রতিটি মিষ্টির দোকানেই এই সাদা বোঁদে পাওয়া যায়।[4] শীতের সময় অর্থাৎ নভেম্বর থেকে মার্চ কামারপুকুরের পর্যটক সংখ্যা সব চেয়ে বেশি হয়। তখন চাহিদা মেটাতে মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারকরা সাদা বোঁদের উৎপাদন বাড়িয়ে দেন। এই সময় প্রতিদিন গড়ে ৮-১০ টন সাদা বোঁদে তৈরী হয় কামারপুকুরে। বছরের বাকি সময়টা দৈনিক ২-৩ টন সাদা বোঁদে উৎপাদন হয়।[3]

২০১৭ সালে রসগোল্লা জি আই স্বীকৃতি পাওয়ার পর কামারপুকুরের সাদা বোঁদের জি আই স্বীকৃতির দাবী ওঠে।[2] কামারপুকুরের মানুষ কামারপুকুরের ঐতিহ্যবাহী সাদা বোঁদের জি আই স্বীকৃতি দাবী করেন।[4] গোঘাট-২ ব্লকের বিডিও অরিজিৎ দাসের মতে যেহেতু এই সাদা বোঁদে কামারপুকুর ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায় নানা সেহেতু কামারপুকুরের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের জি আই স্বীকৃতি দাবী করার অধিকার রয়েছে।[2][4] কামারপুকুরের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের দাবী কামারপুকুরের জলের গুণের বোঁদের রঙ সাদা হয়। কামারপুকুরের এই জল অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না, তাই কামারপুকুরের সাদা বোঁদের জি আই স্বীকৃতির দাবী যুক্তিযুক্ত।[2] ২০১৮ সালে জি আই স্বীকৃতির আবেদনের জন্য কামারপুকুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সাথে জেলা প্রশাসনের প্রাথমিক কথাবার্তা সম্পন্ন হয়।[7]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. মিনৎজ, সিডনি (২০১৫)। দ্য অক্সফর্ড কম্প্যানিয়ন টু সুগার অ্যান্ড সুইটস। অক্সফর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃষ্ঠা 650। আইএসবিএন 9780199313396। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭
  2. "কামারপুকুরের সাদা বোঁদে ও জিলিপির জিআই স্বীকৃতির দাবি"বর্তমান। বর্তমান পত্রিকা প্রাইভেট লিমিটেড। ২৮ নভেম্বর ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭
  3. নন্দী, পীযূষ (২৮ জুলাই ২০১৫)। "শ্রীরামকৃষ্ণ স্নেহধন্যেই অনন্য সাদা বোঁদে"আনন্দবাজার। এবিপি গ্রুপ। সংগ্রহের তারিখ ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭
  4. মণ্ডল, তুফান (২০ ডিসেম্বর ২০১৭)। "জাতে উঠবে সাদা বোঁদে?"আজকাল। আজকাল পত্রিকা প্রাইভেট লিমিটেড। সংগ্রহের তারিখ ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭
  5. "রসগোল্লার পর পরিচিতি পাক বাংলার এই মিষ্টিরাও"এই সময়। বেনেট কোলম্যান। ১ ডিসেম্বর ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭
  6. বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমিত্র (২০ অক্টোবর ২০১৩)। "মধুর রসের বশে"এই সময়। কলকাতা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ আগস্ট ২০১৪
  7. নন্দী, পীযুষ (১২ নভেম্বর ২০১৮)। "সাদা বোঁদের জিআই চায় কামারপুকুর"আনন্দবাজার পত্রিকা। এবিপি গ্রুপ। সংগ্রহের তারিখ ১৮ নভেম্বর ২০১৮
  8. কুণ্ডু, অশোককুমার (২৬ নভেম্বর ২০১১)। "সাদা বোঁদেতেই খ্যাতি ভোলানাথের"আনন্দবাজার পত্রিকা। এবিপি গ্রুপ। সংগ্রহের তারিখ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.