কাবা শরীফের গিলাফ
কাবা শরীফের গিলাফ একটি বস্ত্রখণ্ড যা দ্বারা কাবাকে আচ্ছাদিত করে রাখা হয়। বর্তমানে গিলাফ কালো রেশমী কাপড় নির্মিত, যার ওপর স্বর্ণ দিয়ে লেখা থাকে "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ", "আল্লাহু জাল্লে জালালুহু", "সুবহানাল্লাহু ওয়া বেহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আযিম" এবং "ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান"। ১৪ মিটার দীর্ঘ এবং ৯৫ সেমি প্রস্থবিশিষ্ট ৪১ খণ্ড বস্ত্রখণ্ড জোড়া দিয়ে গিলাফ তৈরি করা হয়। চার কোণায় সুরা ইখলাস স্বর্ণসূত্রে বৃত্তাকারে উৎকীর্ণ করা হয়। রেশমী কাপড়টির নিচে মোটা সাধারণ কাপড়ের লাইনিং থাকে।[1] একটি গিলাফে ব্যবহৃত রেশমী কাপড়ের ওজন ৬৭০ কিলোগ্রাম এবং স্বর্ণের ওজন ১৫ কিলোগ্রাম।[2] বর্তমানে এটি তৈরীতে ১৭ মিলিয়ন সৌদী রিয়াল ব্যয় হয়।[3]
গিলাফ দ্বারা আচ্ছাদনের প্রবর্তক
কাবা শরীফকে গিলাফ দ্বারা আচ্ছাদন কখন বা কার উদ্যোগে শুরু হয় সে সম্পর্কে মতভেদ আছে। একটি ঐতিহাসিক সূত্রানুযায়ী নবী হযরত ইসমাঈল (আ.) প্রথম পবিত্র কাবা শরীফকে গিলাফ দ্বারা আচ্ছাদন করেন। ভিন্ন আরেকটি বর্ণনায় আছে যে শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর পূর্ব পুরুষ আদনান ইবনে আইদ পবিত্র কাবা শরীফকে প্রথম গিলাফ দিয়ে আচ্ছাদিত করেন। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুসারে হিমিয়ারের রাজা তুব্বা আবু কবর আসাদই সম্ভবতঃ পবিত্র কাবা শরীফ গিলাফ আচ্ছাদনকারী প্রথম ব্যক্তি।[4]
স্বপ্নাদেশ
ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর ইয়াসরিব শহরে (অর্থাৎ, মদীনা শহর) হিজরতের ২২০ বৎসর আগে হিমিয়ারের রাজা তুব্বা আবু কবর আসাদ এই শহরটিতে (ইয়াসরিব) আক্রমণ করেন। তুব্বা আবু কবর আসাদ ইয়াসরিব ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় মক্কায় গিয়ে কাবা শরীফ তাওয়াফ করত: মাথা মুণ্ডন করেন। অত:পর তিনি এই শহরে কয়েকদিন অবস্থান করেন। মক্কায় অবস্থানকালে তিনি ঘুমের মধ্যে একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন যে তিনি কাবা শরীফ গিলাফ দ্বারা আচ্ছাদন করছেন। এ স্বপ্ন দ্বারা প্রাণিত হয়ে অবিলম্বে "খাসাপ" দ্বারা কাবাঘরটি আচ্ছাদিত করেন। "খাসাপ" হচ্ছে তালগাছ জাতীয় গাছের পাতা ও আঁশের তৈরি এক ধরনের মোটা কাপড়। অনন্তর তিনি আবার স্বপ্ন দেখেছিলেন যে তিনি আরো উন্নতমানের কাপড় দ্বারা কাবা শরীফ আচ্ছাদন করছেন। অত:পর তিনি খাসাপের পরিবর্তে মামিজিয়ান, পাপিরাস (মিশর দেশীয় নলখাগড়া বিশেষ পাতা) দ্বারা কাবা ঘর আচ্ছাদন করেন। ইয়েমেনের মামিজ নামক একটি উপজাতীয় গোত্র এই কাপড় তৈরি করতো। এরপরও তৃতীয়বারের মতো তিনি স্বপ্নে আরো উন্নত মানের কাপড় দ্বারা কাবা আচ্ছাদনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তৃতীয় দফা স্বপ্নটির পর তিনি ইয়েমেনের লাল ডোরাকাটা কাপড় দিয়ে পবিত্র কাবা ঢেকে দিয়েছিলেন।
সুন্দর কাপড়ের গিলাফ
তুব্বা আবু কবর-এর রীতি অনুযায়ী মক্কার স্থানীয় লোকজন সুন্দর কাপড় বা গিলাফ দিয়ে পবিত্র কাবাঘর আচ্ছাদন করতে থাকে এবং তা নিয়মিত প্রথায় পরিণত হয়। বর্তমানে দামী কালো রং সিল্কের কাপড়ের তৈরি স্বর্ণ-খচিত ক্যালিগ্রাফি মোটা গিলাফ দিয়ে কাবা শরীফ আচ্ছাদন করা হয়। কাপড়টি কিসওয়াহ নামে আখ্যায়িত। আব্বাসীয় খলিফা আল আব্বাস আল মাহদী ১৬০ হিজরীতে পবিত্র হজ্ব পালনকালে পবিত্র কাবা থেকে একটি ছাড়া সবগুলো সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। এখনো এই ধারাই অব্যাহত রয়েছে। ৭ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের আগে মুহম্মদ (সা:) গিলাফ পরানো শুরু করেননি।[5] অত:পর গিলাফ পরানোর সংস্কৃতি অব্যাহত থাকে। বাদশাহ বাইবার্স হচ্ছেন পবিত্র কাবায় গিলাফ পরিয়ে দেয়া প্রথম মিশরীয় শাসক। তারপর ইয়েমেনের বাদশা আল মুদাফ্ফার ৬৫৯ হিঃ কাবা শরীফে গিলাফ পরান। পরবর্তীতে মিসরের শাসকরা পর্যায়ক্রমে এ কাজ অব্যাহত রাখেন। বাদশাহ আবদুল আজিজ আল সউদ মক্কা-মদীনার দুই পবিত্র মসজিদের দেখাশোনার দায়িত্বভার গ্রহণের পর ১৩৪৬ হিজরিতে কাবা শরীফের গিলাফ তৈরির জন্য একটি বিশেষ কারখানা স্থাপনের নির্দেশ প্রদান করেন। একই বৎসর মাঝামাঝি সময়ে প্রয়োজনীয় কাপড় তৈরি করে মক্কার দক্ষ শিল্পীর মাধ্যমে তা সুন্দর নকশায় সুসজ্জিত করে কাবা শরীফ আচ্ছাদিত করা হয়।[1] ১৩৫৭ হিজরী পর্যন্ত এই কারখানাটি গিলাফ বা "কিসওয়াহ" তৈরি অব্যাহত রাখে। পরবর্তীতে ১৩৮১ হিজরীতে সৌদি হজ্জ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে দক্ষ সৌদি কারিগর দ্বারা রেশমী ও সোনালী সুতা দিয়ে গিলাফ তৈরি করে কাবার গায়ে পরিধানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৩৮২ হিজরীতে বাদশাহ ফয়সাল ইবনে আব্দুল আজিজ নতুন ডিক্রিজারির মাধ্যমে নতুন করে পবিত্র কাবার গিলাফ তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। খাঁটি প্রাকৃতিক রেশমী রং এর সাথে কালো রং-এর কাপড় দিয়ে পবিত্র কাবার গিলাফ তৈরির ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্যে কুরআনের কিছু আয়াত শোভা পায়।[6] অক্ষরগুলো সোনালী আভায় উদ্ভাসি ত।
গিলাফ পরিবর্তন
প্রতি বৎসর হজ্জের ঠিক আগে কাবা শরীফের গিলাফ সরিয়ে তা সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। হাজীদের ইহরামের শ্বেতশুভ্রতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই সাদা গিলাফ পরানো হয়। হজ্জ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ১০ জিলহজ্জ তারিখে নতুন গিলাফ পরানো হয়।[7][8] প্রতিস্থাপতি গিলাফটি খণ্ড খণ্ড করে বিলিয়ে দেয়া হয়।
তথ্যসূত্র
- "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০০৯।
- "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৯ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০০৯।
- "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৮ মে ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০০৯।
- ইসলামিক অনলাইন ডট নেট ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৫ তারিখে — প্রথম অনুচ্ছেদের চতুর্থ লাইনের শেষাংশ দ্রষ্টব্য।
- Kern, Karen M.; Rosenfield, Yael; Carò, Federico; Shibayama, Nobuko (২০১৭-১২-০১)। "The Sacred and the Modern: The History, Conservation, and Science of the Madina Sitara"। Metropolitan Museum Journal। 52: 72–93। আইএসএসএন 0077-8958। ডিওআই:10.1086/696548।
- ইসলামিক ভয়েস ডট কম ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৯ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে — প্রথম প্যারা দ্রষ্টব্য।