কলকাতার পরিবহন ব্যবস্থা
কলকাতার পরিবহন ব্যবস্থায় এক মিশ্র প্রভাব দেখা যায় এখানে যেমন বয়েছে হাতে টানা রিকশা তেমনি রয়েছে অত্যাধুনিক মেট্রো রেল ও সড়কে রয়েছে এসি বাস। এই শহরে পরিবহনের পরিচিত প্রতীকটি হল হলুদ ট্যাক্সি। কলকাতায় পরিবহনে প্রচুর বেসরকারি বাস ও সরকারি বাস যুক্ত আছে। শহরটি জাতীয় সড়ক ও রেলপথ দ্বারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এছাড়া আকাশপথে দেশের বিভিন্ন শহর ও বিদেশের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে।
![](../I/Kolkata_Metro.jpg.webp)
![](../I/Traffic_in_Kolkata.jpg.webp)
ট্রাম
কলকাতা ট্রাম ভারতের কলকাতা শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থা। এটি দেশের প্রথম ও একমাত্র পরিষেবা প্রদানকারী ট্রাম। এটি এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিবহন ব্যবস্থা। এই ট্রাম পরিষেবা প্রথম চালু হয় ১৮৭৩ সালে। প্রথমে ঘোড়ার সাহায্যে ট্রাম চালানো হতো ; পরবর্তীকালে ১৯০২ সালে বিদ্যুতের ব্যবহার হয়। কলকাতায় ক্রমবর্ধমান ফ্লাইওভার ও রাস্তা উন্নয়নের কারণে কয়েকটি ট্রামরুট এখন বন্ধ করে দেওয়া হলেও, অবশিষ্ট রুটগুলিকে দ্রুতগতির ট্রাম পরিবহনের উপযুক্ত করে তোলা হচ্ছে। এছাড়া ট্রামকে ঘিরে কলকাতায় একটি বিশেষ পর্যটন আকর্ষণও গড়ে তোলা হয়েছে, যেটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
বিমানবন্দর
![](../I/External_view_of_Netaji_Subhas_Chandra_Bose_International_Airport.jpg.webp)
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দমদমে অবস্থিত একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যা মূলত কলকাতা মহানগর অঞ্চলে পরিষেবা প্রদান করে। এটি শহরের কেন্দ্র থেকে আনুমানিক দূরে অবস্থিত। ১৯৯৫ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিশিষ্ট নেতা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নামে বিমানবন্দরটি নামকরণের পূর্বে এটি দমদম বিমানবন্দর নামে পরিচিত ছিলো, যদিও স্থানীয়ভাবে এটি কলকাতা বিমানবন্দর নামে অধিক পরিচিত। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে উদ্বোধিত কলকাতা বিমানবন্দরটি ভারতের পূরাতন বিমানবন্দরগুলির মধ্যে একটি।
এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, কলকাতা বিমানবন্দর দেশের পূর্ব অংশে বিমান পরিবহনের বৃহত্তম কেন্দ্র এবং পশ্চিমবঙ্গে পরিচালিত দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর একটি এবং অন্যটি বাগডোগরা। বিমানবন্দরটি ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে ২২ মিলিয়ন যাত্রী পরিবহনে সক্ষম হওয়ায় দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু ও চেন্নাইয়ের পরে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে ভারতের পঞ্চম-ব্যস্ততম বিমানবন্দরে পরিণত হয়। বিমানবন্দরটি উত্তর-পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, চীন ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই, আবু ধাবি ও দোহার উড়ানের জন্য একটি প্রধান কেন্দ্র। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে, কলকাতা বিমানবন্দরটি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এয়ারপোর্ট কাউন্সিল ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ উন্নত বিমানবন্দর শিরোপা অর্জন করে।
রেলপথ
কলকাতা মহানগর অঞ্চলের প্রধান পাঁচটি রেলওয়ে স্টেশন হল হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন, শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন, সাঁতরাগাছি জংশন রেলওয়ে স্টেশন, কলকাতা রেলওয়ে স্টেশন এবং শালিমার রেলওয়ে স্টেশন। এই রেলওয়ে স্টেশনগুলি থেকে দেশের বিভিন্ন প্রন্তে রয়েছে রেল পরিষেবা। এছাড়াও রয়েছে কলকাতা চক্ররেল, যা বৃহত্তর কলকাতা শহরতলি রেলের অংশ।
চক্ররেল
কলকাতা চক্ররেল হল কলকাতা শহর ও তার উপকণ্ঠের বিভিন্ন অংশকে যোগ করা একটি রেলপথ ব্যবস্থা। উত্তরে দমদম জংশন স্টেশন থেকে থেকে শুরু করে পাতিপুকুর, কলকাতা, টালা, বাগবাজার, শোভাবাজার আহিরীটোলা, বড় বাজার, বি.বা.দী বাগ, ইডেন গার্ডেন্স, প্রিন্সেপ ঘাট, খিদিরপুর, রিমাউন্ট রোড, মাঝেরহাট, নিউ আলিপুর, টালিগঞ্জ, লেক গার্ডেন্স, বালিগঞ্জ জংশন, পার্ক সার্কাস, স্যার গুরুদাস ব্যানার্জী হল্ট , বিধান নগর রোড পার হয়ে সবশেষে পুনরায় দমদম জংশন পর্যন্ত চক্ররেলপথ আছে।[1]
মেট্রো
![](../I/KolkataMetroOldCoaches.jpg.webp)
কলকাতা মেট্রো পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ও হাওড়া জেলার অংশবিশেষে পরিষেবা প্রদানকারী দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের তথ্য অনুসারে, কলকাতা মেট্রোর তিনটি সক্রিয় রেলপথ রয়েছে, যেগুলি হল দক্ষিণেশ্বর থেকে কবি সুভাষ পর্যন্ত দীর্ঘ নীল লাইন, সল্টলেক সেক্টর ৫ থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত দীর্ঘ সবুজ লাইন এবং জোকা থেকে তারাতলা পর্যন্ত দীর্ঘ বেগুনি লাইন। এই ব্যবস্থায় পথে ব্রডগেজ (৫ ফুট ৬ ইঞ্চি) এবং আদর্শগেজ উভয় বিস্তারযুক্ত ৪০ টি মেট্রো স্টেশন বিদ্যমান, যার মধ্যে ১৭ টি স্টেশন ভূগর্ভস্থ, ২১ টি স্টেশন উত্তোলিত এবং ২ টি স্টেশন ভূমিগত। এছাড়া আরো তিনটি লাইন বিভিন্ন পর্যায়ে নির্মীয়মান হয়ে রয়েছে। ভারতীয় প্রমাণ সময় ০৫:৪৫ থেকে ২১:৫৫ পর্যন্ত মেট্রো পরিষেবা চালু থাকে এবং মেট্রোর ভাড়া ₹৫ থেকে ₹৩০ এরমধ্যে ঘোরাফেরা করে।
১৯৮৪ সালে চালু হওয়া কলকাতা মেট্রো ভারতের প্রথম মেট্রো রেল পরিষেবা (দ্বিতীয় মেট্রো পরিষেবা দিল্লি মেট্রো চালু হয় ২০০২ সালে)। প্রাথমিকভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে এর পরিকল্পনা করা হলেও সত্তরের দশকে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়৷ ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে চালু হওয়া কলকাতা মেট্রোর প্রথম ধাপটি ছিলো ভবানীপুর (বর্তমান নেতাজি ভবন) থেকে এসপ্ল্যানেড অবধি দীর্ঘায়িত ছিল। এটি দিল্লি মেট্রো, হায়দ্রাবাদ মেট্রো, চেন্নাই মেট্রো এবং নাম্মা মেট্রোর পর বর্তমানে ভারতের কর্মক্ষম পঞ্চম দীর্ঘতম মেট্রো যোগাযোগ ব্যবস্থা।
কলকাতা মেট্রোর উত্তর-দক্ষিণ লাইনটি উত্তরে দক্ষিণেশ্বর থেকে দক্ষিণে কবি সুভাষ (নিউ গড়িয়া) পর্যন্ত ৩১.৩৬৫ কিলোমিটার প্রসারিত ও মোট স্টেশনের সংখ্যা ২৬ টি। এবং নোয়াপাড়ার পর থেকে বরানগর হয়ে লাইনটি দক্ষিণেশ্বর অবধি সম্প্রসারিত হয় ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১এ। এই লাইনে ভূগর্ভস্থ ও উড়াল, উভয় প্রকার ষ্টেশন রয়েছে। প্যারিস মেট্রোর মতো কলকাতা মেট্রোতেও দেশের বিভিন্ন মণীষী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে স্টেশনের নামকরণ করা হয়ে থাকে। পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলের মেট্রো ভবনে কলকাতা মেট্রোর সদর কার্যালয় অবস্থিত।
২০২০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতা মেট্রোর দ্বিতীয় লাইন হিসাবে পূর্ব-পশ্চিম লাইনের সেক্টর ৫ থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত ৫.৮ কিলোমিটার পথ খোলা হয় যেখানে মোট ৬ টি স্টেশন ছিল এবং প্রতিটি স্টেশন রেলপথ সহ উত্তোলিত ভাবে নির্মিত। ২০২১ সালে এটি ফুলবাগান অব্দি সম্প্রসারিত হয় এবং ২০২২ সালে শিয়ালদহ অব্দি। এই ২টি স্টেশন ভূগর্ভস্থ।
মেট্রো রেলওয়ে, কলকাতা, এবং কলকাতা মেট্রো রেল কর্পোরেশন এই রেল পরিষেবার কর্ণধার ও পরিচালক৷ ২০১০ সালের ২৯শে ডিসেম্বর কলকাতা মেট্রো রেলওয়ে ভারতীয় রেলওয়ের ১৭তম ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত হয়৷ এটি পুরোপুরিভাবে ভারতীয় রেল মন্ত্রকের অধিকৃত ও নিহিত৷ এটিই একমাত্র মেট্রো পরিষেবা যা ভারতীয় রেলের অধীনস্থ এবং ভারতীয় রেলের একটি ক্ষেত্রীয় রেলওয়ের মর্যাদা ভোগ করে। দৈনিক ৩০০ টি ট্রেন যাত্রায় ৭,০০,০০০-এর অধিক যাত্রী পরিষেবা ভোগ করেন৷
বর্তমানে কলকাতা মেট্রোর একাধিক সম্প্রসারণ প্রকল্প ও নতুন লাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে।
সড়ক পরিবহন
শহরটি বিদ্যাসাগর সেতু ও রবীন্দ্র সেতু দ্বারা সড়ক পথে হাওড়ার সঙ্গে যুক্ত। সড়ক পথে এখনও চলমান আছে কলকাতা ট্রাম। শহরটির সঙ্গে বিভিন্ন জেলার যোগাযোগ রক্ষা করে বাস। এছাড়া শহরটির বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে সাধারণ বাস ও এসি বাস চলাচল করে। শহরটির উত্তর প্রান্তে অবস্থিত বিবেকানন্দ সেতু ও নিবেদিতা সেতু ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ককে ২ ও ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের সঙ্গে যুক্ত করেছে। শহরটির দক্ষিণ দিকের ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক বিদ্যাসাগর সেতু দ্বারা ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের সঙ্গে যুক্ত। শহরের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তকে যুক্ত করেছে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাস।
বেসরকারি পরিবহন
কলকাতায় সুলভ বেসরকারি বাস পরিষেবা রয়েছে। তার ভাড়ার তালিকা নিম্নরূপ[2] :
দূরত্ব (কিমি) | ভাড়া (ভারতীয় টাকা) |
---|---|
০-৪ | ৭ |
৪-৮ | ৮ |
৮-১২ | ৯ |
১২-১৬ | ১০ |
১৬-২০ | ১১ |
২০-২৪ | ১২ |
জলপথ ও বন্দর
![](../I/Motor_Vessel_Jalapath_-_Hooghly_River_2012-01-14_0908.JPG.webp)
কলকাতা বন্দর কলকাতা শহরে অবস্থিত একটি নদীবন্দর। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই বন্দরটির গোড়াপত্তন করেছিলেন। বর্তমানে ভারতের চালু বন্দরগুলির মধ্যে এই বন্দরটি প্রাচীনতম। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা বন্দর ছিল ব্রিটিশ ভারতের প্রধান বন্দর। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে পশ্চাদভূমি হ্রাসপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে এই বন্দরের সাময়িক অবনতি ঘটে। তবে বিংশ শতাব্দীর সূচনায় পূর্ব ভারতের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন ও পরিকাঠামোোগত উন্নতি্র ফলে বর্তমানে কলকাতা বন্দর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মালবাহী বন্দরে পরিণত হয়েছে।কলকাতা বন্দর পূর্ব ভারতের একটি প্রধান নদীবন্দর। কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট কলকাতা ও হলদিয়া ডকের দায়িত্বপ্রাপ্ত। কলকাতা বন্দর থেকে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পোর্ট ব্লেয়ার পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন পরিষেবা ও ভারত ও বহির্ভারতের বন্দরগুলিতে শিপিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার মাধ্যমে পণ্য পরিবহন পরিষেবা চালু আছে।[3]কলকাতা থেকে হাওড়া, বালি প্রভৃতি শহরে লঞ্চ পরিসেবা রয়েছে।
তথ্যসূত্র
- "শহরে প্রতি ধাপে বাস ও মিনিবাসের ভাড়া"। ৮ জুন ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ জুন ২০১৮।
- "Salient Physical Features"। Kolkata Port Trust। Kolkata Port Trust,। ১৩ মার্চ ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১২-১৫।