কঠিন চীবর দান

কঠিন চীবর দান, বৌদ্ধ ধর্মের একটি ধর্মীয় আচার, ও উৎসব, যা সাধারণত বাংলা চন্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী প্রবারণা পূর্ণিমা (ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা) পালনের এক মাসের মধ্যে যেকোনো সুবিধাজনক সময়ে পালন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে মূলত বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকে ত্রি-চীবর নামে বিশেষ পোশাক দান করা হয়।[1] ধর্মাবলম্বীগণ পূণ্যের আশায় প্রতি বছর এভাবে চীবরসহ ভিক্ষুদের অন্যান্য আনুষঙ্গিক সামগ্রীও দান করে থাকেন।[2]

ত্রি-চীবর হলো চার খণ্ডের পরিধেয় বস্ত্র, যাতে রয়েছে দোয়াজিক, অন্তর্বাস, চীবর ও কটিবন্ধনী। এই পোশাক পরতে দেয়া হয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের। প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণত আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই পোশাক বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকে দেয়া হয়। এই পোশাক তৈরি করার জন্য প্রস্তুতিস্বরূপ প্রথমে তুলার বীজ বোনা হয়, পরে তুলা সংগ্রহ করা হয়, তা থেকে সুতা কাটা হয়, সেই সুতায় রং করা হয় গাছ-গাছড়ার ছাল বা ফল থেকে তৈরি রং দিয়ে, এবং সবশেষে নানা আচার-অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় নিয়ম-কানুন মেনে মাত্র ২৪ ঘণ্টায়, অর্থাৎ এক দিনের ভিতর তৈরি করা হয় এই ত্রি-চীবর। এই পোশাক বোনায় ব্যবহার করা হয় বেইন বা কাপড় বোনার বাঁশে তৈরি ফ্রেম। এরকম বেইনে একসঙ্গে চারজন কাপড় বুনে থাকেন। এভাবে ২৪ ঘণ্টা পর তৈরি হওয়া সেসব পবিত্র চীবর, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হাতে তুলে দেয়া হয় কঠোর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে।[1] এভাবে চীবর দেয়া হলে কায়িক-বাচনিক ও মানসিক পরিশ্রম বেশি ফলদায়ক হয় বলে বৌদ্ধ শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে।[3] এভাবে সাধারণ্যের কঠোর পরিশ্রমে তৈরি চীবর, বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকে দান করার বিষয়টি প্রতিদানহীনভাবে কল্যাণের নিমিত্ত কাজ বৈ আর কিছু নয় এবং এজাতীয় অনুষ্ঠান সমাজে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করবে বলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস। তাছাড়া বুদ্ধের বাণী হলো, কঠিন চীবর দানই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দান[4]

নামকরণ

ভারতীয় জনপদে 'কঠিন চীবর দান' শব্দটি গৌতম বুদ্ধের সময় থেকে প্রচলিত হয়ে আসছে। মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা কেটে, সুতা বানিয়ে, রং করে, নানা রকম আচার ও নিয়ম মেনে একেকটি চীবর তৈরি করার কাজটি খুব বেশি কঠিন বলেই অনুষ্ঠানের এই নাম।[1] 'চীবর’ শব্দের অর্থ ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র। গাছের শেকড়, গুঁড়ি, ছাল, শুকনো পাতা, ফুল ও ফলের রঙ অনুসারে এই বস্ত্রের ছয়টি রঙ নির্দিষ্ট । সাধারণত লাল ফুলের রঙের বস্ত্রই বেশি দেখা যায়।[5]

ইতিহাস

জানা যায়, গৌতম বুদ্ধের সময় বিশাখা, বুদ্ধের জন্য এক দিনের ভেতর এভাবেই চীবর তৈরি করেছিলেন। আর তারই ফলশ্রুতি বর্তমান 'কঠিন চীবর দান' অনুষ্ঠানটি।[1]

বিভিন্ন দেশে কঠিন চীবর দান

ভারত

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় বেনুবন বিহারে (Venuban bihar) অনুষ্ঠিত হয় কঠিন চীবর দান। এখানে চীবর দানের চিরাচরিত প্রথা পালনের পাশাপাশি অনুসারীগণ কল্পতরু-তে সুতা দিয়ে বই, কলম, নোট ইত্যাদি বেঁধে দেন নিজেদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার অভিপ্রায়ে। এখানে এই উৎসব সাধারণত প্রবারণা পূর্ণিমা পালনের এক মাসের মধ্যে যেকোনো সুবিধাজনক সময়ে পালন করা হয়।[2]

বাংলাদেশ

বাংলাদেশে অনেকটা কঠোর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে পালিত হয় কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান, রাঙামাটি জেলা রাজবন বিহার-কে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ত্রি-চীবর তৈরির জন্য একত্রে কাজ করেন চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়। এখানে ত্রি-চীবর তৈরির কার্যক্রম উদ্বোধন করেন রাজমাতা। কঠোর ধর্মীয় নিয়ম-কানুন মেনে এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ত্রি-চীবর তৈরির পর তা, স্থানীয় চাকমা রাজা তুলে দেন রাজবন বিহারের অধ্যক্ষের হাতে। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে শুরু হয় তিন মাসব্যাপী কঠোর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা। এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে চলে বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন। মূল অনুষ্ঠানের তিনদিন আগে থেকে শুরু হয় বিভিন্ন আদিবাসী নৃগোষ্ঠীর অনুষ্ঠানস্থলে আগমন। বিহার-প্রাঙ্গনে বসে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন পণ্যের মেলা। পরবর্তিতে আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্ত্তিক পূর্ণিমা পর্যন্ত একমাসব্যাপী সারা দেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। একথা অনস্বীকার্য যে, বান্দরবানের বৌদ্ধ বিহারে কঠোর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ও নিয়মকানুন মেনে ত্রি-চীবর তৈরি ও বিতরণ করা হয়।[1]

এছাড়া খাগড়াছড়িতে ধর্মপুর আর্য বন বিহার, পানছড়ির শান্তিপুর অরণ্য কুটির, দিঘীনালা বন বিহার, বাবুছড়ার সাধনা টিলা বন বিহারআলুটিলা আলোক নবগ্রহ ধাতু চৈত্য বিহার-এ এই উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। এছাড়া কক্সবাজারের রামুতে উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বন বিহার এবং বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র-তে এই উৎসব পালিত হয়। সংঘদান, অষ্টপরিষ্কার দান, ধর্মসভা, চীবর ও কল্পতরু শোভাযাত্রা, ও আকাশে ফানুস ওড়ানোর মাধ্যমে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।[6]

ব্যতিক্রম

সব চীবরই কঠোর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা মেনে দেয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই থাইবার্মিজ চীবর বাজারে কিনতে পাওয়া যায়।[1]

তথ্যসূত্র

  1. আনিকা ফারজানা (২১ নভেম্বর ২০১০)। "ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, শ্রদ্ধা ও সমারোহে কঠিন চীবর দান"। দৈনিক প্রথম আলো (মুদ্রিত)। ঢাকা। পৃষ্ঠা ১৫ ও ২৪।
  2. Pinaki Das (১ নভেম্বর ২০১০)। "Buddhist monks get new robes in Tripura"নিউজট্রেকইন্ডিয়া (ইংরেজি ভাষায়)। ভারত। ২ অক্টোবর ২০১১ তারিখে মূল (ওয়েব) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ নভেম্বর ২০১০
  3. "রাঙামাটিতে কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান শুরু" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৯ আগস্ট ২০১১ তারিখে, BDNews24.com; ১৮ নভেম্বর ২০১০; ২২ নভেম্বর ২০১০ তারিখে সংগৃহীত।
  4. বান্দরবান প্রতিনিধি (১০ নভেম্বর ২০১১)। "হাজারো পুণ্যার্থীর মিলনমেলা: বান্দরবানে কঠিন চীবর দান উৎসব শুরু"দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা। ২৯ মে ২০২০ তারিখে মূল (মুদ্রিত) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ মার্চ ২০১২
  5. কঠিন চীবর দান, বাংলাপিডিয়া
  6. খাগড়াছড়ি ও রামু (কক্সবাজার) প্রতিনিধি (১১ নভেম্বর ২০১১)। "পাহাড়ে কঠিন চীবর দান উৎসব শেষ"দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা। ২৯ মে ২০২০ তারিখে মূল (মুদ্রিত) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ মার্চ ২০১২
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.