উয়ারী-বটেশ্বর
উয়ারী-বটেশ্বর বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে[1] নরসিংদীর বেলাবো ও শিবপুর উপজেলায় অবস্থিত উয়ারী ও বটেশ্বর নামীয় দুটি গ্রামব্যাপী একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। ধারণা করা হয় এটি মাটির নিচে অবস্থিত একটি দুর্গ-নগরী। বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ী এটি প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো।[2] তবে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে আবিষ্কৃত কিছু প্রত্ন নিদর্শনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যাণ্ডস এবং নিউ জিল্যাণ্ড তিনটি দেশের পরীক্ষাগারে কার্বন-১৪ পরীক্ষার প্রেক্ষিতে উয়ারীর বসতিকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের বলে নিশ্চিত করা হয়েছে।[1]
বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর উয়ারী-বটেশ্বর এলাকায় উৎখনন কর্ম চলমান রেখেছে। সর্বশেষ ২ জানুয়ারী ২০১৭ তারিখে উয়ারীতে উৎখনন কালে বেশ কিছু প্রত্ননিদর্শন সংগৃহীত হয়েছে।
আবিষ্কার ও উৎখননের ইতিহাস
দক্ষিণ এশিয়া | |||||
---|---|---|---|---|---|
• প্রস্তর যুগ | ৭০,০০০-৩৩০০ খ্রীষ্টপূর্ব | ||||
• মেহেরগড় | ৭০০০-৩৩০০ খ্রীষ্টপূর্ব | ||||
• হরপ্পা ও মহেঞ্জদর সভ্যতা | ৩৩০০-১৭০০খ্রীষ্টপূর্ব | ||||
• হরপ্পা সংস্কৃতি | ১৭০০-১৩০০ খ্রীষ্টপূর্ব | ||||
বৈদিক যুগ | ১৫০০-৫০০ খ্রীষ্টপূর্ব | ||||
লৌহ যুগ | ১২০০-৩০০ খ্রীষ্টপূর্ব | ||||
• ষোড়শ মহাজনপদ | ৭০০-৩০০ খ্রীষ্টপূর্ব | ||||
• মগধ সাম্রাজ্য | ৫৪৫খ্রীষ্টপূর্ব | ||||
• মৌর্য সাম্রাজ্য | ৩২১-১৮৪খ্রীষ্টপূর্ব | ||||
• মধ্যকালীন রাজ্যসমূহ | ২৫০ খ্রীষ্টপূর্ব | ||||
• চোল সাম্রাজ্য | • ২৫০খ্রীষ্টপূর্ব | ||||
• সাতবাহন সাম্রাজ্য | • ২৩০খ্রীষ্টপূর্ব | ||||
• কুষাণ সাম্রাজ্য | ৬০-২৪০ খ্রীষ্টাব্দ | ||||
• বাকাটক সাম্রাজ্য | ২৫০-৫০০ খ্রীষ্টাব্দ | ||||
• গুপ্ত সাম্রাজ্য | ২৮০-৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ | ||||
• পাল সাম্রাজ্য | ৭৫০-১১৭৪ খ্রীষ্টাব্দ | ||||
• রাষ্ট্রকুট | ৭৫৩-৯৮২ | ||||
• ইসলামের ভারত বিজয় | |||||
• সুলতানী আমল | ১২০৬-১৫৯৬ | ||||
• দিল্লি সালতানাত | ১২০৬-১৫২৬ | ||||
• দাক্ষিনাত্যের সুলতান | ১৪৯০-১৫৯৬ | ||||
• হৈসল সাম্রাজ্য | ১০৪০-১৩৪৬ | ||||
• কাকতীয় সাম্রাজ্য | ১০৮৩-১৩২৩ | ||||
• আহমন সাম্রাজ্য | ১২২৮-১৮২৬ | ||||
বিজয়নগর সাম্রাজ্য | ১৩৩৬-১৬৪৬ | ||||
মুঘল সাম্রাজ্য | ১৫২৬-১৮৫৮ | ||||
মারাঠা সাম্রাজ্য | ১৬৭৪-১৮১৮ | ||||
শিখ রাষ্ট্র | ১৭১৬-১৮৪৯ | ||||
শিখ সাম্রাজ্য | ১৭৯৯-১৮৪৯ | ||||
ব্রিটিশ ভারত | ১৮৫৮–১৯৪৭ | ||||
ভারত ভাগ | ১৯৪৭ | ||||
স্বাধীন ভারত | ১৯৪৭–বর্তমান | ||||
জাতীয় ইতিহাস বাংলাদেশ • ভুটান • ভারত মালদ্বীপ • নেপাল • পাকিস্তান • শ্রীলঙ্কা | |||||
আঞ্চলিক ইতিহাস আসাম • বেলুচিস্তান • বঙ্গ হিমাচল প্রদেশ • উড়িষ্যা • পাকিস্তানের অঞ্চল সমূহ পাঞ্জাব • দক্ষিণ ভারত • তিব্বত | |||||
বিশেষায়িত ইতিহাস টঙ্কন • রাজবংশ • অর্থনীতি ভারততত্ত্ব • ভাষাবিজ্ঞানের ইতিহাস • সাহিত্য • নৌসেনা • সেনা • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি • সময়রেখা | |||||
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, উয়ারী-বটেশ্বর ছিল একটি সমৃদ্ধ, সুপরিকল্পিত, প্রাচীন গঞ্জ বা বাণিজ্য কেন্দ্র। "সৌনাগড়া " যা গ্রিক ভূগোলবিদ, টলেমী তার বই " জিওগ্রাফিয়াতে" উল্লেখ করেছিলেন ।[3][4][5]
নরসিংদীর বেলাব উপজেলায় উয়ারী এবং বটেশ্বর পাশাপাশি দুটো গ্রাম। আকারে উয়ারী বৃহত্তর। এই গ্রাম দুটোতে প্রায়ই বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান পাওয়া যেত। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে উয়ারী গ্রামে শ্রমিকরা মাটি খননকালে একটি কলসীতে সঞ্চিত মুদ্রা ভাণ্ডার আবিষ্কার করে। স্থানীয় স্কুলশিক্ষক হানিফ পাঠান সেখান থেকে ২০-৩০টি মুদ্রা সংগ্রহ করেন। এগুলো ছিলো বঙ্গভারতের প্রাচীনতম রৌপ্যমুদ্রা। এ ভাবেই উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ শুরু হয়। মুহম্মদ হানিফ পাঠান তৎকালীন সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকায় "প্রাচীন মুদ্রা প্রাপ্তি" শীর্ষক সংবাদ ছাপেন। তিনি তার ছেলে হাবিবুল্লাহ পাঠানকে এই এলাকার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সম্পর্কে সচেতন করে তুলছিলেন। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে বটেশ্বর গ্রামে স্থানীয় শ্রমিকরা দুটি লৌহপিণ্ড পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে যায়। ত্রিকোণাকৃতি ও এক মুখ চোখা, ভারী লৌহপিণ্ডগুলো হাবিবুল্লা পাঠান তার বাবাকে নিয়ে দেখালে তিনি অভিভূত হন। ঐ বছরের ৩০ জানুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকার রবিবাসরীয় সংখ্যায় "পূর্ব পাকিস্তানে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা" শিরোনামে একটি প্রবন্ধ ছাপেন হানিফ পাঠান। এরপর ঐ এলাকায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যেতে থাকে। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে উয়ারী গ্রামের কৃষক জাড়ু মিয়া মাটি খননকালে ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রার একটি ভাণ্ডার আবিষ্কার করেন। ওই ভাণ্ডারে কমপক্ষে চার হাজারের মতো মুদ্রা ছিল। ওজন ছিলো নয় সের। জাড়ু মিয়া মুদ্রাগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য অনুধাবন করতে না পেরে প্রতি সের আশি টাকা হিসেবে রৌপ্যকারের কাছে বিক্রি করে দেন। মাত্র ৭২০ টাকার জন্য ইতিহাসের অমূল্য সামগ্রীগুলো রৌপ্যকারের চুল্লিতে গলে চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়।
১৯৭৪-১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে হাবিবুল্লা পাঠান ঢাকা জাদুঘরের অবৈতনিক সংগ্রাহক ছিলেন। তখন গবেষণার জন্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাপাঙ্কিত মুদ্রা, পাথরের গুটিকা, লৌহ কুঠার ও বল্লম জাদুঘরে দান করেন তিনি। ঐ সময় রাইঙ্গারটেক গ্রাম থেকে প্রাপ্ত ত্রিশটি লৌহ কুঠার জাদুঘরে প্রদান করেন তিনি। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে উয়ারী গ্রামের শাহাবুদ্দিন মাটির নিচ থেকে ব্রোঞ্জের ৩৩টি পাত্রের একটি সঞ্চয় উদ্ধার করেন। পরবর্তীকালে সেগুলো মাত্র ২০০ টাকায় এক ভাঙ্গারির কাছে বিক্রি করে দেন শাহাবুদ্দিন। হাবিবুল্লা পাঠান একসময় স্থানীয় শিশু-কিশোরদেরকে প্রাচীন প্রত্নসামগ্রী কুড়িয়ে দেয়ার বিনিময়ে সামান্য কিছু পয়সা দিতে লাগলেন আর সংগ্রহ করতে লাগলেন উয়ারী-বটেশ্বর এলাকার অনাবিষ্কৃত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। তার একাগ্র শ্রমেই খননের আগেই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিলো বঙ্গভারতের দুর্লভ একক নিদর্শন বিষ্ণুপট্ট, ব্রোঞ্জের তৈরি ধাবমান অশ্ব, উচ্চমাত্রায় টিনমিশ্রিত হাতলওয়ালা পাত্র, শিব নৈবেদ্য পাত্র, রেলিক কাসকিট-এর ভগ্নাংশ, পাথরের বাটখারা, নব্যপ্রস্তর যুগের বাটালি, লৌহকুঠার, বল্লম, পাথরের তৈরি সিল, ত্রিরত্ন, কচ্ছপ, হস্তী, সিংহ, হাঁস, পোকা, ফুল, অর্ধচন্দ্র , তারকা, রক্ষাকবচ, পোড়ামাটির কিন্নর, সূর্য ও বিভিন্ন জীব-জন্তুর প্রতিকৃতি, রিংস্টোন, ব্রোঞ্জের গরুড়, কয়েক সহস্র স্বল্প মূল্যবান পাথর ও কাচের গুটিকা।[1]
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মুহম্মদ হানিফ পাঠান (১৯০১-১৯৮৯)[1] প্রথম উয়ারী-বটেশ্বরকে সুধী সমাজের নজরে আনা শুরু করেন। পরে তার ছেলে জনাব হাবিবুল্লা পাঠান স্থানটির গুরুত্ব তুলে ধরে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বারবারই এ ব্যাপারে সোচ্চার থাকলেও সরকারী ভাবে উৎখনন বিলম্বিত হয়। অবশেষে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে যথাযথ প্রক্রিয়ায় উৎখনন শুরু হয়।[6] খননকাজে নেতৃত্ব দেন উক্ত বিভাগের প্রধান সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, উপনেতা হিসেবে ছিলেন মিজানুর রহমান, আর পুরো খননকাজেই সক্রিয় ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীবৃন্দ। তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে এগিয়ে আসে মোবাইল ফোন সেবাদাতা কোম্পানী গ্রামীণফোন। ৯ জানুয়ারি ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে নবম ধাপের উৎখনন যখন শুরু হয় তখন প্রথমবারের মতো আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দিতে এগিয়ে আসে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়।[2] উৎখননের সকল পর্যায়ে স্থানীয় জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা প্রদান করে।
প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শন
উয়ারী-বটেশ্বরে প্রত্ন-বস্তু খননে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন দুর্গ-নগর, বন্দর, রাস্তা, পার্শ্ব-রাস্তা, পোড়ামাটির ফলক, স্বল্প-মূল্যবান পাথর ও কাচের পুঁতি, মুদ্রা-ভাণ্ডারসহ উপমহাদেশের প্রাচীনতম ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। উল্টো-পিরামিড আকৃতির স্থাপত্যটি নিয়েও বিশেষজ্ঞ স্থপতিরা ইতোমধ্যে গবেষণা শুরু করেছেন।[2] এখানে পাওয়া চারটি পাথুরে নিদর্শন প্রত্নপ্রস্তরযুগের বলে কেউ কেউ মনে করে। নব্যপ্রস্তর যুগের হাতিয়ার প্রাপ্তির আলোকে অনুমান করা হয়েছে যে, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে এগুলো এখানে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। বিপুল পরিমাণ লৌহ কুঠার ও বর্শাফলকের সময়কাল এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে ড. জাহানের রাসায়নিক পরীক্ষার ভিত্তিতে এগুলো ৭০০-৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বলে ধারণা করা হচ্ছে। ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রাগুলো মৌর্যকালপর্বে (খ্রিস্টপূর্ব ৩২০- খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৭) প্রচলিত থাকার সম্ভাবনা। কাচের গুটিকাগুলো সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিলো। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় শিল্পকলা চর্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে উয়ারীতে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে প্রাপ্ত উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র, রোলেটেড মৃৎপাত্র, নব্ড মৃৎপাত্র প্রভৃতির দুটি কার্বন-১৪ পরীক্ষা করা হয়। ঐ পরীক্ষায় উয়ারীর বসতিকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের বলে নিশ্চিত করা হয়েছে।[1]
উয়ারী গ্রামে ৬৩৩ মিটার দীর্ঘ বাহুবিশিষ্ট বর্গাকৃতি গড় ও পরিখা রয়েছে। পূর্ব পাশের পরিখাটি ছাড়া গড় ও পরিখার চিহ্ন লুপ্তপ্রায়। ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট আরেকটি বহির্দেশীয় গড় ও পরিখা সোনারুতলা গ্রাম থেকে শুরু করে বটেশ্বর হানিয়াবাইদ, রাজারবাগ ও আমলাব গ্রামের ওপর দিয়ে আঁড়িয়াল খাঁ নদের প্রান্তসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটিকে স্থানীয় লোকজন "অসম রাজার গড়" বলে থাকেন। এরূপ দুটো প্রতিরক্ষা প্রাচীর গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক বা প্রশাসনিক কেন্দ্রের নির্দেশক, যা নগরায়ণেরও অন্যতম শর্ত।[1]
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ-এপ্রিলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎখননে উয়ারী গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে ১৮ মিটার দীর্ঘ, ৬ মিটার প্রশস্ত ও ৩০ সেন্টিমিটার পুরু একটি প্রাচীন পাকা রাস্তা। রাস্তাটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে ইটের টুকরা, চুন, উত্তর ভারতীয় কৃষ্ণ মসৃণ মৃৎপাত্রের টুকরা, তার সঙ্গে রয়েছে ল্যাটারাইট মাটির লৌহযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান এটিকে আড়াই হাজার বছর পুরনো বলে দাবি করেছেন। এসম্পর্কে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তীর অভিমত: এতো দীর্ঘ ও চওড়া রাস্তা এর আগে পুরো গাঙ্গেয় উপত্যকায় দ্বিতীয় নগরায়ণ সভ্যতায় কোথাও আবিষ্কৃত হয়নি। গাঙ্গেয় উপত্যকায় দ্বিতীয় নগরায়ণ বলতে সিন্ধু সভ্যতার পরের নগরায়ণের সময়কে বোঝায়। ফলে যেটি আবিষ্কৃত হয়েছে বলা হচ্ছে তা তধু বাংলাদেশেই নয়, সিন্ধু সভ্যতার পর ভারতবর্ষের সবচেয়ে পুরোন রাস্তা।[1]
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও আড়িয়াল খাঁ নদের মিলনস্থলের অদূরে কয়রা নামক একটি শুষ্ক নদীখাতের দক্ষিণতীরে বন্যাযুক্ত গৈরিক মাটির উঁচু ভূখণ্ডে উয়ারী-বটেশ্বরের অবস্থান। ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় আদি ঐতিহাসিক কালপর্বে এ প্রত্নস্থানকে বহির্বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে অধিকতর স্পষ্ট করেছে। টলেমির বিবরণ থেকে দিলীপ কুমার চক্রবর্তীর অনুমান আদি ঐতিহাসিক যুগে উয়ারী-বটেশ্বর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও রোমান সাম্রাজ্যের মালামাল সংগ্রহ ও বিতরণের সওদাগরি আড়ত (Entry port) হিসেবে কাজ করতো। তার এই ধারণাকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন সুফি মোস্তাফিজুর রহমান।[1]
টলেমি'র সৌনাগড়া
গ্রিক ভূগোলবিদ টলেমির উল্লেখিত "সৌনাগড়া"র সত্যিকার অবস্থান কোথায় - এ প্রশ্নে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক বাংলাদেশের এ অঞ্চলকে নির্দেশ করে থাকেন। প্রাচীন সুবর্ণগ্রাম বর্তমানে সোনারগাঁ নামে পরিচিত। স্থানটি নদীবাহিত পলি থেকে উত্থিত চরাভূমি- মধ্যযুগের খ্যাত রাজধানী ও নদীবন্দর। তাই ধরে নেয়া হয় সৌনাগড়া-সুবর্ণগ্রাম-সোনারগাঁয়ের বিস্তৃতি ছিলো সাভার, কাপাসিয়া, বর্ষী, শ্রীপুর, টোক, বেলাব, মরজাল, পলাশ, শিবপুর, মনোহরদী, উয়ারী বটেশ্বরসহ লক্ষা, ব্রহ্মপুত্র, আড়িয়াল খাঁ, মেঘনা প্রভৃতি নদ-নদী অধ্যুষিত এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে। উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাপ্ত বর্ণিল কাচের পুঁতি ও স্যান্ডউইচ কাচের গুটিকা থেকে এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (থাইল্যান্ড) ও ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের (রোমান সাম্রাজ্য) বহিঃবাণিজ্যের উপর ভিত্তি করে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনেকেই উয়ারী-বটেশ্বরকে টলেমি’র উল্লেখিত "সৌনাগড়া" বলে উল্লেখ করছেন।[1]
সোনারুতলা গ্রাম থেকে একটি পাথরের ও অন্যটি পোড়ামাটির নিবেদন স্তূপ পাওয়া যায়। এগুলোর নির্মাণ পদ্ধতি এবং পোড়ানোর কারিগরি বিষয়ে ধারণা হয় এগুলো তাম্রপ্রস্তর যুগে ব্যবহৃত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে তাম্রাশ্মীয় পর্বে (খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০-খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০০) বসতি স্থাপনকারী মানবগোষ্ঠী ধান্য তুষের ছাপ সংবলিত ধূসর, রক্তিম ও কৃষ্ণবর্ণের মৃৎপাত্র নির্মাণ করেছে। কাদামাটিতে ধান বা ধানের তুষ মিলিয়ে ইট ও মৃৎপাত্র নির্মাণের ঐতিহ্য এঅঞ্চলে দীর্ঘকাল থেকে চলে-আসা সংস্কৃতির স্বাক্ষর।[1]
আলেকজান্ডার ও তার সৈন্যবাহিনীর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ডিওডোরাস (৬৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ-১৬ খ্রিষ্টাব্দ) সিন্ধু পরবর্তী দেশ সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, গঙ্গা পেরিয়ে যে অঞ্চল সেখানে গঙ্গারিডাই-দের আধিপত্য। উল্লেখ করা হয়েছে যে, চতুর্থ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গঙ্গারিডাইর রাজা অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। তার ৬ হাজার পদাতিক, ১ হাজার অশ্বারোহী ও ৭ শত হস্তি বাহিনী ছিল। প্রাপ্ত তথ্য এ বিষয়ে ইঙ্গিত দেয় যে, পাশ্চাত্যের দূরবর্তী দেশগুলি পরবর্তী ৫০০ বছর তাদের নাম ও যশ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল।[7]
বৌদ্ধ পদ্মমন্দির
২০১০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে নবম ধাপের উৎখননে বেরিয়ে আসে প্রায় ১,৪০০ বছরের প্রাচীন ইটনির্মিত[8] বৌদ্ধ পদ্মমন্দির। ১০.৬ মিটার বাই ১০.৬ মিটার বর্গাকার বৌদ্ধমন্দিরটির দেয়াল ৮০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত আর ভিত্তিমূল এক মিটার। কাদামাটির গাঁথুনির দেয়ালের ভিত্তি তিন ধাপে প্রক্ষিপ্ত। মূল দেয়ালের উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমে ৭০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সমান্তরালভাবে ৭০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত দেয়াল রয়েছে। মূল দেয়ালের চারদিকে ইট বিছানো ৭০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত প্রদক্ষিণ পথ রয়েছে। প্রদক্ষিণ পথের বাইরের দিকে মূল দেয়ালের সমান্তরাল ৬০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত দেয়াল রয়েছে। তবে পূর্বদিকে মূল দেয়াল ও বহির্দেয়ালের দূরত্ব ৩.৫ মিটার। পূর্বদিকে প্রদক্ষিণ পথ ও বারান্দা রয়েছে। এপর্যন্ত বৌদ্ধমন্দিরটিতে দুটি নির্মাণ যুগ শনাক্ত করা হয়েছে। আদি নির্মাণ যুগের ইট বিছানো মেঝের অংশবিশেষ উন্মোচিত হলেও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করতে আরও সময় লাগবে। তবে পরবর্তী নির্মাণ যুগে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে ইট বিছানো একটি বেদি পাওয়া গেছে। উৎখননে আটটি পাপড়িযুক্ত একটি পদ্ম অনেকটা অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে এসেছে। এই পদ্মের উপস্থিতিই মন্দিরটিকে পদ্মমন্দিরের মর্যাদা দেয়। বৌদ্ধধর্মে পদ্ম খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। বৌদ্ধধর্মের আটটি শুভ লক্ষণ প্রতীকের মধ্যে পদ্ম একটি। মন্দিরটি শিবপুর উপজেলার মন্দির ভিটা থেকে শনাক্ত করা হয়েছে।[9]
প্রকাশনা
ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশের অনেক খ্যাতিমান প্রত্নতত্ত্ববিদ উয়ারী বটেশ্বর নিয়ে মূল্যবান গবেষণা সন্দর্ভ প্রকাশ করেছেন।[1] তবে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এখনও পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শন
উয়ারী-বটেশ্বরের উৎখননে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কোন জাদুঘরে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয় নি। কিছু নিদর্শন বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর-এর অধিকারে এবং কিছু নিদর্শন ঐতিহ্য অন্বেষণ গবেষণা কেন্দ্র এর অধিকারে রয়েছে। তবে হানিফ পাঠান নিজ উদ্যোগে তার বসতবাড়িতে 'বটেশ্বর প্রত্ন সংগ্রহশালা ও গ্রন্থাগার' নামে পারিবারিক যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তার পুত্র মো. হাবিবুল্লা পাঠান এটির দেখাশুনা করেন। এতে রয়েছে তিনহাজার বছর আগের লৌহ কুঠার, চার-পাঁচহাজার বছর আগের নব্য প্রস্তর যুগের নিদর্শন, তিন-চার হাজার বছর আগের তাম্র প্রস্তর যুগের ব্রোঞ্জ বলয়, যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত পোড়া মাটির গোলক, নানা বর্ণের পাথরের পুঁতি, খ্রিস্টপূর্ব সময়ের ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা, বিভিন্ন সময়ে সংকলিত ঐতিহাসিক সাময়িকী, স্মারক ও কয়েক হাজার দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রহ।[10]
উয়ারী বটেশ্বর দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘর
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র "ঐতিহ্য অন্বেষণ"- এর উদ্যোগে উয়ারী প্রত্নতাত্ত্বিক গ্রামে ২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি "উয়ারী বটেশ্বর দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘর" উদ্বোধন করা হয়েছে। উদ্বোধন কালে ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ ধরনের প্রত্ন জাদুঘর বাংলাদেশে এই প্রথম। এই উয়ারী বটেশ্বর দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘরে প্রত্নবস্তুর মডেল, রেপ্লিকা, প্রত্নবস্তু, প্রত্নবস্তুর আলোকচিত্র, বিবরণ, বিশ্লেষণ প্রদর্শন করা হয়েছে।[11]
চিত্রশালা
- "উয়ারী বটেশ্বর দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘর"- এর সাইনবোর্ড। উয়ারী- বটেশ্বর, নরসিংদী, বাংলাদেশ। (আগস্ট ২০১৯)
- "উয়ারী বটেশ্বর দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘর"- এর একটি চিত্র। উয়ারী- বটেশ্বর, নরসিংদী, বাংলাদেশ। (আগস্ট ২০১৯)
- হানিফ পাঠান কর্তৃক তার নিজস্ব বাড়িতে ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘বটেশ্বর প্রত্ন সংগ্রহশালা ও গ্রন্থাগারে' প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
আরও পড়ুন
- দিলীপ কুমার চক্রবর্তী , Ancient Bangladesh, ঢাকা ১৯৯২ (ইংরেজি)
- বাঙালির ইতিহাস (আদি পর্ব) - নীহারঞ্জন রায়। দে’জ পাবলিশিং - কলিকাতা
- ইন্ডিকা - মেগাস্থিনিস
- বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত বই "গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ", লেখক বিচারপতি মোঃ হাবিবুর রহমান।
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
- মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান (অনুল্লেখিত)। "উয়ারী বটেশ্বর, স্বপ্নের স্বর্গোদ্যান" (প্রিন্ট ওয়েব)। দৈনিক কালের কণ্ঠ। ঢাকা। সংগ্রহের তারিখ মে ১৫, ২০১০। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - নিজস্ব প্রতিবেদক, ভৈরব (৯ জানুয়ারি ২০১০)। "উয়ারী-বটেশ্বরে নবম ধাপের উত্খননকাজ শুরু আজ"। দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা। ২০২০-০৯-১৯ তারিখে মূল (প্রিন্ট ওয়েব) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মে ১৫, ২০১০।
- দ্যা ডেইলি স্টার পত্রিকা
- Excavation At Wari-Bateshwar: A Preliminary Study. Edited by Enamul Haque. Dhaka, The International Centre for Study of Bengal Art, 2001, (ইংরেজি) আইএসবিএন ৯৮৪-৮১৪০-০২-৬
- দিলীপ কুমার চক্রবর্তী , Ancient Bangladesh, ঢাকা ১৯৯২ (ইংরেজি)
- মোহাম্মদ আসাদ (২১ মার্চ ২০০৮)। "বাংলার মুখ: হাঁড়ির ভেতর গুপ্তধন" (প্রিন্ট ওয়েব)। দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা। সংগ্রহের তারিখ মে ১৫, ২০১০।
- [The Classical accounts of India, ড আর সি মজুমদার ।পৃষ্ঠা ১০৩-১২৮]
- নিজস্ব প্রতিবেদক, ভৈরব (৩ মার্চ ২০১০)। "শেষ হলো উয়ারী-বটেশ্বরে নবম ধাপের উত্খনন"। দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা। ২০২০-০৮-১২ তারিখে মূল (প্রিন্ট ওয়েব) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মে ১৫, ২০১০।
- নিজস্ব প্রতিবেদক, ভৈরব (২১ মার্চ ২০১০)। "উয়ারী-বটেশ্বরে আবিষ্কৃত হলো বৌদ্ধ পদ্মমন্দির"। দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা। ২০২০-০৯-১১ তারিখে মূল (প্রিন্ট ওয়েব) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মে ১৫, ২০১০।
- উপমহাদেশের দ্বিতীয় নগর সভ্যতা উয়ারি-বটেশ্বর, ইত্তেফাক, ২৪ নভেম্বর ২০১৮
- বাংলাদেশের প্রথম প্রত্ন জাদুঘর, উয়ারী বটেশ্বর দুর্গ নগর উন্মুক্ত, কালের কণ্ঠ, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮