উদ্ভিদকোষ

উদ্ভিদকোষ হল সব উদ্ভিদের ক্ষুদ্রতম গাঠনিক ও ক্রিয়ামূলক একক যা উদ্ভিদের বৃদ্ধি, বিকাশ ও জীবনধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

একটি উদ্ভিদ কোষের গঠন

উদ্ভিদকোষ এক ধরনের সুকেন্দ্রিক কোষ, অর্থাৎ এর কোষকেন্দ্রটি ঝিল্লি দ্বারা আবৃত ও এতে অনেক ঝিল্লি দ্বারা আবদ্ধ কোষীয় অঙ্গাণু আছে। কোষকেন্দ্রটি উদ্ভিদের বংশাণুগত উপাদান (ডিএনএ) ধারণ করে ও কোষের বৃদ্ধি, প্রতিলিপন ও বিভাজনের জন্য দায়ী। কোষপর্দা নামের একটি পাতলা অর্ধভেদ্য ঝিল্লি বা কোষস্তর কোষের অভ্যন্তরভাগকে এর বহিস্থ পরিবেশ থেকে পৃথক করে রেখেছে। প্রাণীকোষের বিপরীতে উদ্ভিদকোষগুলিতে আরও আছে সেলুলোজ দিয়ে তৈরি একটি শক্ত স্তর যার নাম কোষপ্রাচীর, যা কোষপর্দাকে আবৃত করে রাখে ও কোষকে দৃঢ়তা, কাঠামো ও সুরক্ষা প্রদান করে। এছাড়া উদ্ভিদকোষের অভ্যন্তরে অনেক কোষীয় অঙ্গাণু আছে। মাইটোকন্ড্রিয়া নামক অঙ্গাণুগুলি কোষীয় শ্বসনের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন করে। উদ্ভিদকোষের সবচেয়ে লক্ষণাত্মক একটি বৈশিষ্ট্য হল এটিতে হরিৎকণিকা (ক্লোরোপ্লাস্ট) নামক অঙ্গাণুর উপস্থিতি, যা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী। এই অঙ্গাণুগুলিতে ক্লোরোফিল নামক রঞ্জক পদার্থ থাকে, যা সূর্যের আলো থেকে শক্তি শোষণ করে সেটিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে, যে শক্তি উদ্ভিদ ব্যবহার করে গ্লুকোজ ও অক্সিজেন উৎপাদন করে। এভাবে উদ্ভিদ সূর্যালোক থেকে নিজের খাদ্য উৎপাদন করে নিতে পারে। হরিৎকণিকাগুলির নিজস্ব ডিএনএ থাকে এবং এগুলি কোষকেন্দ্র থেকে স্বাধীনভাবে প্রতিলিপন করতে পারে। অন্তঃপ্লাজমীয় জালিকা হল কিছু ঝিল্লি দ্বারা আবদ্ধ ক্ষুদ্রনালি ও থলির জালতন্ত্র যেগুলি প্রোটিন সংশ্লেষণ, লিপিড বিপাক ও অন্যান্য কোষীয় প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। গলজি যন্ত্র হল কিছু সমতল ঝিল্লিযুক্ত থলি যেগুলি প্রোটিন ও লিপিড পরিবর্তন, বাছাই ও মোড়কবন্দী করে কোষের অভ্যন্তরে বা বাইরে সেগুলির পরিবহনে সহায়তা করে। প্রাণীকোষের বিপরীতে উদ্ভিদকোষে একটি বৃহৎ কেন্দ্রীয় কোষগহ্বর থাকে, যেটি কোষের আকৃতি বজায় রাখা, জল ও জলে দ্রবীভূত আয়ন, পুষ্টি উপাদান ও বর্জ্য পদার্থ সঞ্চয় ও উদ্ভিদের অভ্যন্তরীণ অভিস্রাবণিক চাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। রাইবোজোম নামের ক্ষুদ্র, ঝিল্লিহীন অঙ্গাণুগুলি প্রোটিন সংশ্লেষণের জন্য দায়ী। প্রাণীকোষের মতো উদ্ভিদকোষেও একটি কোষকঙ্কাল থাকে যেটি প্রোটিন তন্তুর জালতন্ত্র দিয়ে গঠিত এবং যেটি কোষকে কাঠামোগত সহায়তা ও আকৃতি প্রদানের পাশাপাশি কোষ বিভাজন, নড়াচড়া ও সংগঠনে সাহায্য করে। উদ্ভিদকোষগুলিতে আরও আছে কিছু বিশেষায়িত কাঠামো, যাদের নাম প্লাজমোডেজমা। এগুলি হল কোষপ্রাচীরের ছিদ্র দিয়ে বাইরে অভিক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র কিছু প্রবর্ধক প্রণালী যেগুলি পাশাপাশি সংলগ্ন কোষগুলিকে সংযুক্ত করে ও নিজেদের মধ্যে পুষ্টি উপাদান ও সংকেতবাহী অণু বিনিময়ের অনুমতি দেয়। এটি উদ্ভিদের কোষসমূহের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে সমন্বয় সাধনকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যপদ্ধতি, যে কর্মকাণ্ডগুলির মধ্যে আছে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশ, পরিবেশের উদ্দীপনার প্রতি (যেমন পীড়ন বা জীবাণু সংক্রমণ) সাড়া দেওয়া। উদ্ভিদকোষগুলি সমবিভাজন বা মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় নতুন কোষ উৎপাদন করে উদ্ভিদের অযৌন প্রজনন এবং জননকোষগুলি যৌন প্রজননে সাহায্য করে। উদ্ভিদকোষগুলি বিভাজন, বিভেদীকরণ ও নতুন কলা ও অঙ্গ উৎপাদনের মাধ্যমে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে ভূমিকা রাখে। উদ্ভিদকোষগুলি বিষাক্ত পদার্থ, কাঁটা ও অন্যান্য ভৌত প্রতিবন্ধক সৃষ্টির মাধ্যমে উদ্ভিদকে তৃণভোজী প্রাণী, রোগজীবাণু ও পরিবেশগত পীড়কের হাত থেকে প্রতিরক্ষা ও সুরক্ষা দান করে। কিছু উদ্ভিদকোষ উদ্ভিদদেহের সর্বত্র জল, পুষ্টি উপাদান ও অন্যান্য অণু পরিবহন করে।

উদ্ভিদকোষগুলিকে মূলত দুইটি প্রধান প্রকারে ভেদ করা যায়। এগুলি হল প্যারেনকাইমা কোষ ও বিশেষায়িত কোষ। প্যারেনকাইমা কোষগুলি সবচেয়ে সাধারণ ধরনের উদ্ভিদকোষ; এগুলির কোষপ্রাচীর পাতলা হয়, এগুলি উদ্ভিদের কোমল অংশগুলি গঠন করে ও সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন, খাদ্যসঞ্চয়, সংবহন, প্রতিরক্ষা, ক্ষত নিরাময়, ক্ষরণ ও গ্যাস বিনিময় সম্পাদন করে। বিশেষায়িত কোষগুলি বিশেষ বিশেষ কাজ সম্পাদন করে যেগুলি উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোলেনকাইমা কোষগুলির কোষপ্রাচীর অপেক্ষাকৃত স্থূল এবং এগুলি উদ্ভিদের বর্ধনশীল অঙ্গগুলিকে দৃঢ়তা ও কাঠামো দিতে সাহায্য করে। স্ক্লেরেনকাইমা কোষগুলি সবচেয়ে দৃঢ় মজবুত উদ্ভিদকোষ; এগুলির কোষপ্রাচীরগুলি পুরু ও লিগনিনসমৃদ্ধ, যেগুলি উদ্ভিদকে কাঠামো ও সুরক্ষা প্রদান করে; এগুলি হয় দীর্ঘায়িত (তন্তুকোষ) বা হ্রস্ব ও অতিশাখায়িত (স্ক্লেরাইড) হয়ে থাকে। বহিস্ত্বকীয় কোষগুলি উদ্ভিদের সবচেয়ে বহিঃস্থ স্তর গঠন করে; এগুলির উদ্ভিদকে উদ্ভিদভোজী প্রাণী ও জলহানির মতো বহিঃস্থ নিয়ামকগুলির থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। জাইলেম ও ফ্লোয়েম কোষগুলি উদ্ভিদ সংবহন কলা গঠন করে; জাইলেম উদ্ভিদের মূল থেকে উদ্ভিদদেহের সর্বত্র জল বহন করে, আর ফ্লোয়েম কোষগুলি পাতা থেকে উদ্ভিদের সর্বত্র চিনি ও অন্যান্য জৈব পুষ্টি উপাদান বহন করে নিয়ে যায়। প্রহরী কোষগুলি পাতায় গ্যাসের বিনিময় নিয়ন্ত্রণ করে। ভাজক (মেরিস্টেম্যাটিক) কোষগুলি হল অবিভেদীকৃত কোষ যেগুলি উদ্ভিদ বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য দায়ী; এগুলি মূল ও বিটপের ডগায় অবস্থিত থাকে এবং বিভেদীকৃত হয়ে অন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদকোষে রূপান্তরিত হতে পারে।

উদ্ভিদকোষগুলি রাসায়নিক সংকেতের সাহায্যে একে অপরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে উদ্ভিদের বৃদ্ধি, বিকাশ, পরিবেশের উদ্দীপনায় সাড়াপ্রদান ও রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষায় সমন্বয় সাধন করে। উদ্ভিদকোষগুলিকে কাচের নলে বা পাত্রে কর্ষণ করা যায় ও এগুলি থেকে নতুন উদ্ভিদ উৎপাদন করা যায় বা এগুলির কোষীয় প্রক্রিয়াগুলি অধ্যয়ন করা যায়। উদ্ভিদকোষের বিবর্তন পৃথিবীতে উদ্ভিদ জীবনের বিবর্তনের মূল ভূমিকা পালন করেছে, বিশেষ করে সালোকসংশ্লেষণের বিকাশ ও স্থলজ উদ্ভিদের উদ্ভব। উদ্ভিদকোষ নিয়ে অধ্যয়নকারী কিছু বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষায়তনিক জ্ঞানের শাখা হল উদ্ভিদকোষবিজ্ঞান, যেখানে উদ্ভিদকোষের কাঠামো, ক্রিয়া ও আচরণ এবং কোষ বিভাজন, অঙ্গাণুর কাজ ও কোষীয় সংকেতপ্রেরণের উপরে অধ্যয়ন করা হয়। আণবিক জীববিজ্ঞানে ডিএনএ রেপ্লিকেশন, ট্রান্সক্রিপশন ও ট্রান্সলেশন ছাড়াও প্রোটিন ও অন্যান্য অণুর কাঠামো ও ক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করা হয়। বংশাণুবিজ্ঞানে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ইনহেরিটেন্স ও উদ্ভিদের বৃদ্ধি, বিকাশ ও পরিবেশের প্রতি সাড়া নিয়ন্ত্রণকারী বংশাণুগত কার্যপদ্ধতিগুলি গবেষণা করা হয়। বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানে উদ্ভিদকোষ কাঠামো ও ক্রিয়ার বিবর্তন এবং সামগ্রিকভাবে উদ্ভিদের বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করা হয়। ব্যবস্থাদি জীববিজ্ঞান নামক আন্তঃশাস্ত্রীয় ক্ষেত্রটিতে জৈবিক সংগঠনের একাধিক স্তর থেকে সংগৃহীত উপাত্ত সংকলিত করে বংশাণু, প্রোটিন ও অন্যান্য অণুর মধ্যে আন্তঃক্রিয়া গবেষণা করা হয়। পরিগণনামূলক জীববিজ্ঞানে উদ্ভিদকোষীয় প্রক্রিয়াসমূহের গাণিতিক ও পরিগাণনিক প্রতিমান নির্মাণ করে সেগুলির ছদ্মায়োন করা হয় এবং উচ্চ-উৎপাদী পরীক্ষাগুলি দ্বারা সৃষ্ট বৃহৎ উপাত্তসংগ্রহগুলির বিশ্লেষণ সাধন করা হয়।

উদ্ভিদকোষগুলি উদ্ভিদের বৃদ্ধি, বিকাশ ও বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যক। তাই উদ্ভিদকোষের কাঠামো ও ক্রিয়া সম্পর্কে অধ্যয়ন কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও মানব স্বাস্থ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিতে উদ্ভিদকোষের গবেষণা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং নতুন, ঘাতসত ফসলের জাতের বিকাশে সহায়ক হতে পারে। এটি উন্নত সার ও কীটনাশক প্রস্তুতি, উন্নত বালাই ব্যবস্থাপনা কৌশল ও সেচ কৌশল নির্ণয়ে সাহায্য করতে পারে, যেগুলি অধিকতর দক্ষ ও টেকসই। এছাড়া উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশ নিয়ন্ত্রণকারী কোষীয় কার্যপদ্ধতিগুলি বুঝতে পারলে উদ্ভিদের নতুন প্রজাতির উদ্ভাবনে সহায়ক হতে পারে, যে প্রজাতিগুলি উচ্চমাত্রায় উৎপাদনশীল, অধিক পুষ্টিশোষণে সক্ষম, রোগ প্রতিরোধক ও পরিবেশগত চাপ (তাপ, খরা, বন্যা) সহ্য করার ক্ষমতার মতো কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বংশাণু প্রকৌশলের মাধ্যমে উদ্ভিদকোষগুলির জৈবপ্রযুক্তিগত প্রয়োগ করা হয়। উদ্ভিদকোষের বংশাণুগত উপাদান কারসাজি করে বিজ্ঞানীরা কোনও উদ্ভিদ থেকে উচ্চমাত্রায় নির্দিষ্ট প্রোটিন বা অন্যান্য যৌগ উৎপাদন করাতে পারেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে মানব রোগগুলির চিকিৎসা অনেক ঔষধ ব্যবহার করা হয়, যেগুলি উদ্ভিদ বা উদ্ভিদকোষ থেকে আহরণ করা হয়। উদ্ভিদকোষের উপর গবেষণা ঐসব ঔষধের নিরাময়কারী ক্রিয়ার জন্য দায়ী নির্দিষ্ট যৌগ শনাক্তকরণ ও পৃথকীকরণ সহজ করে ও নতুন ঔষধ বিকাশ করা যাবে যেগুলি অধিকতর কার্যকর ও যেগুলির পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কম। অধিকন্তু, উদ্ভিদকোষগুলি কীভাবে রোগসৃষ্টিকারক জীবাণুর সাথে আন্তঃক্রিয়া করে, সে ব্যাপারটি অধ্যয়ন করলে উদ্ভিদের রোগগুলির নতুন চিকিৎসা শনাক্ত করা যেতে পারে, যে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার উপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। উদ্ভিদকোষ কর্ষণের কৌশল ব্যবহার করে ঔষধশিল্পের জন্য বিপুল পরিমাণে ঐ সব যৌগ উৎপাদন করা হয়। পরিবেশবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্ভিদেরা বাস্তুগত ভারসাম্য বজায় রাখা ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদ্ভিদকোষ অধ্যয়ন করলে উদ্ভিদের কীভাবে পরিবেশের পরিবর্তনের (যেমন দূষণ, আবাসস্থল লোপ) প্রতি সাড়া দেয় ও অন্যান্য জীবের সাথে কীরূপে মিথস্ক্রিয়া করে, তা আরও ভালো করে বোঝা সম্ভব। এই জ্ঞান পরিবেশ সংরক্ষণমূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা, যেমন অবক্ষয়প্রাপ্ত বাস্তুতন্ত্রে পূর্বাবস্থায় ফেরত ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাস করার জন্য কৌশল বের করতে (যেমন কার্বন পৃথকীকরণ) তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারে। বনবিজ্ঞানে বৃক্ষসমূহের বৃদ্ধি ও বিকাশ বুঝতে এবং বন ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণে নতুন কৌশলে বিকাশে উদ্ভিদকোষীয় জীববিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ। জৈবজ্বালানি ও অন্যান্য ধরনের নবায়নযোগ্য শক্তির গবেষণায় উদ্ভিদকোষ ব্যবহার করা হয়; যেমন উদ্ভিজ্জ উপাদানকে জৈবজ্বালানিতে রূপান্তরিত করতে অধিকতর দক্ষ উৎসেচক নিঃসরণের জন্য উদ্ভিদকোষের পরিবর্তন সাধন করা হতে পারে।

উদ্ভিদকোষ গবেষণার ইতিহাস

১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বিজ্ঞানী রবার্ট হুক ইতিহাসে সর্বপ্রথম একটি অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে কর্ক উদ্ভিদের কোষগুলির কাঠামো পর্যবেক্ষণ করেন ও সেগুলির বাক্স-সদৃশ বহিরাবয়ব বর্ণনা করতে লাতিন "সেল্লা" (ক্ষুদ্রকুঠুরি) পরিভাষাটির প্রবর্তন করেন। ১৬৭৬ সালে আন্টনি ফন লেউভেনহুক প্রথমবারের মত অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে জীবন্ত উদ্ভিদকোষ পর্যবেক্ষণ করেন। তবে ১৯শ শতকে এসে আলোকীয় অণুবীক্ষণ যন্ত্রের বিকাশের ফলে বিজ্ঞানীরা উদ্ভিদকোষের জটিলতা সম্পর্কে আরও বুঝতে আরম্ভ করেন। ১৮৩৮ সালে জার্মান উদ্ভিদবিজ্ঞানী মাটিয়াস শ্লাইডেন প্রস্তাব করেন যে সব উদ্ভিদকলাই কোষ দিয়ে গঠিত। এর আগে জার্মান শারীরবিজ্ঞানী টেওডোর শভানও প্রাণীকোষগুলির জন্য একই তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন। এই দুই বিজ্ঞানের তত্ত্বকে কোষ তত্ত্ব নাম দেওয়া হয়েছে, যা অনুযায়ী সব জীবের দেহ এক বা একাধিক কোষ দিয়ে গঠিত, এবং কোষ হল জীবনের মৌলিক একক। এভাবে উদ্ভিদকোষের অধ্যয়ন গবেষণার একটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্রে হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। ১৮৩১ সালে স্কটীয় উদ্ভিদবিজ্ঞানী রবার্ট ব্রাউন উদ্ভিদকোষের অভ্যন্তরে কোষকেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেন এবং এর ফলে কোষবিজ্ঞান শাস্ত্রটি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫৫ সালে হুগো ফন মোল হরিৎকণিকা বা ক্লোরপ্লাস্ট আবিষ্কার করেন। ১৮৬০-এর দশকে ইউলিউস ফন জাখস উদ্ভিদকোষের অভ্যন্তরে কোষপঙ্কীয় প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করেন, যা কোষের বিভাজন ও বৃদ্ধির প্রক্রিয়াগুলির ব্যাপারে নতুন অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। ১৮৭৩ সালে জার্মান জীববিজ্ঞানী ভাল্টার ফ্লেমিং মাইটোসিস নামক কোষবিভাজন প্রক্রিয়াটি বর্ণনা করেন, ফলে কোষ বিভাজন অধ্যয়নের ক্ষেত্রটি প্রতিষ্ঠালাভ করে এবং উদ্ভিদকোষের বৃদ্ধি ও প্রজনন বিষয়ে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করে। ১৮৮০-র দশকে এদুয়ার্ড ষ্ট্রাসবুর্গার উদ্ভিদকোষ বিভাজন অধ্যয়নের কৌশল উদ্ভাবন করেন ও মাইটোসিস প্রক্রিয়াটি বর্ণনা করেন। কামিল্লো গলজি নামক ইতালীয় চিকিৎসক একটি রঞ্জন কৌশল উদ্ভাবন করেন, যার বদৌলতে তিনি কোষের ভেতরে জটিল কিছু তন্তু জালিকা আবিষ্কার করেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে গলজি বস্তু। ১৯শ শতকের শেষভাগে অণুবীক্ষণ প্রযুক্তি ও রঞ্জন কৌশলের উন্নতির সুবাদে বিজ্ঞানীরা উদ্ভিদকোষের অভ্যন্তরীণ কাঠামো যেমন রঞ্জিতকণা তথা ক্রোমোজোম ও কোষপ্রাচীর সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জ্ঞানলাভ করেন। ২০শ শতাব্দীতে ১৯২০-এর দশকের শেষে ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কারের কারণে বিজ্ঞানীরা উদ্ভিদকোষের আরও বিশদ খুঁটিনাটি দেখার সুযোগ পান। ১৯২৯ সালে আলবের্ট ফ্রাই-ভিসলিং এভাবে উদ্ভিদকোষের অতিসূক্ষ্মকাঠামো আবিষ্কার করেন ও সেগুলির জটিল অভ্যন্তরীণ সংগঠন উন্মোচন করেন। এর সূত্র ধরে কোষীয় জীববিজ্ঞান ও আণবিক জীববিজ্ঞান ক্ষেত্রগুলির বিকাশ ঘটে। ১৯৫০-এর দশকে গবেষকেরা তেজস্ক্রিয় সমস্থানিক ও স্বতরঞ্জনবিজ্ঞান কৌশল ব্যবহার করে উদ্ভিদকোষের ভেতরে অণুসমূহের চলাচল অনুসরণ করতে সক্ষম হন এবং এভাবে অন্তঃপ্লাজমীয় জালিকাতন্ত্র আবিষ্কার করেন। ১৯৬০-এর দশকে হিমন-ভাঙন (ফ্রিজ-ফ্র্যাকচার) কৌশল ও সম্প্রচার ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ ব্যবহার করে গবেষকেরা উদ্ভিদকোষের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর আরও অনুপুঙ্খ বিবরণ বের করে আনেন। একই সময়ে উদ্ভিদকোষ থেকে নিঃসৃত হরমোনগুলি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ হয়। ১৯৭০-এর দশকে কোষীয় জীববিজ্ঞান ও আণবিক বংশাণুবিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে উদ্ভিদদেহে অঙ্গাণুসমূহের বংশাণুসমগ্র (যেমন হরিৎকণিকা ও মাইটোকন্ড্রিয়া) আবিষ্কার করা সম্ভব হয়। ১৯৯০-এর দশকে এসে সমফোকাসীয় অণুবীক্ষণ, অতিবিভেদন অণুবীক্ষণ ও অন্যান্য প্রতিবিম্বন কৌশল ব্যবহার করে গবেষকেরা উদ্ভিদকোষের ত্রিমাত্রিক প্রত্যক্ষীকরণে সক্ষম হন এবং কোষগুলির পরিবর্তনশীল আচরণ ও অন্যান্য কোষের সাথে মিথস্ক্রিয়া অধ্যয়ন করেন। বর্তমানে ২১শ শতকে এসে বংশাণু প্রকৌশল (ক্রিস্পার বংশাণু সম্পাদনা), (আরএনএ) প্রতিলিপিসমগ্র বিজ্ঞান (ট্রান্সক্রিপ্টোমিকস), প্রোটিনসমগ্র বিজ্ঞান ও অন্যান্য "সমগ্র" বিজ্ঞানের (ওমিক্‌স) বহু বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে গবেষকেরা উদ্ভিদকোষের গবেষণা চালাচ্ছেন ও নিত্যনতুন আবিষ্কার সম্পাদন করছেন।

উদ্ভিদকোষের গঠন

কোষপ্রাচীর

উদ্ভিদকোষের[1] ক্ষেত্রে কোষপর্দার বাইরে জড় পদার্থ দিয়ে তৈরি একটি পুরু প্রাচীর থাকে, একে কোষ প্রাচীর বলে। এটি সেলুলোজ দ্বারা গঠিত। প্রাণিকোষে এ ধরনের প্রাচীর[2] থাকে না। প্রাণিকোষ আবরণটি প্লাজমাপর্দা দ্বারা গঠিত। কোষের সজীব অংশকে রক্ষা করা এবং কোষএর সীমারেখা নির্দেশ করা কোষপ্রাচীরের প্রধান কাজ। উদ্ভিদকোষের কোষপ্রাচীর তিন স্তর বিশিষ্ট : প্রাথমিক প্রাচীর, গৌণ প্রাচীর, টারশিয়ারী প্রাচীর। কোষপ্রাচীরের প্রধান রাসায়নিক উপাদান সেলুলোজ যা গ্লুকোজের পলিমার। প্রাথমিক কোষপ্রাচীরে পেকটিক পদার্থ এবং গৌণ প্রাচীরে লিগনিন, সুবেরিন ইত্যাদি থাকে। এছাড়াও কোষ প্রাচীরে হেমিসেলুলোজ, প্রোটিন, লিপিড এবং প্রচুর পানি থাকে। পাশাপাশি অবস্থিত দুটি কোষপ্রাচীর মধ্যপর্দা দ্বারা সংযুক্ত থাকে। মধ্যপর্দা পেকটিক এসিড, পেকটিন ও প্রোপেকটিন দ্বারা গঠিত। অনেক ধরনের উদ্ভিদ কোষ একটি বৃহৎ কেন্দ্রীয় ভ্যাকুওল [3] ধারণ করে যা টনোপ্লাস্ট নামে পরিচিত ।

কোষপর্দা

কোষ প্রাচীরের ঠিক নিচে সমস্ত প্রোটোপ্লাজমকে ঘিরে একটি সজীব ঝিল্লি আছে।এ ঝিল্লিকে কোষপর্দা বলে। ইংরেজিতে একে প্লাজামা মেমব্রেন,প্লাজমালেমা, সাইটোমেমব্রেন এসব নামেও অভিহিত করা হয়। তবে বর্তমানে অনেকে একে বায়োমেমব্রেন বলতে চান। ঝিল্লিটি স্থানে স্থানে ভাঁজবিশিষ্ট হতে পারে। প্রতিটি ভাঁজকে মাইক্রোভিলাস বলে।কোষাভ্যন্তরে অধিক প্রবিষ্ট মাইক্রোভিলাসকে বলা হয় পিনোসাইটিক ফোস্কা।

সাইটোপ্লাজম

কোষের প্রোটোপাজমের নিউক্লিয়াসবিহীন জেলির মতো অংশকে সাইটোপ্লাজম বলে। সাইটোপ্লাজমের অভ্যন্তরে অবস্থিত কোষের বিভিন্ন জৈবনিক ক্রিয়াকলাপের সাথে সংশিষ্ট সজীব বস্তুসমূহকে একত্রে সাইটোপ্লাজমীয় অঙ্গাণু বলা হয়।

মাইটোকন্ড্রিয়া

(ইংরেজি: Mitochondria) এক প্রকার কোষীয় অঙ্গাণু, যা সুকেন্দ্রিক কোষে পাওয়া যায়। এ অঙ্মাগানুটি ১৮৯৮ সালে বেনডা(Benda) আবিষ্কার করেন।জীবের শ্বসন কার্যে অংশগ্রহণ করা এর প্রধান কাজ।শ্বসন প্রক্রিয়ার ধাপ চারটি ;গ্লাইকোলাইসিস, অ্যাসিটাইল কো এ সৃষ্টি , ক্রেবস চক্র এবং ইলেকট্রন প্রবাহ তন্ত্র। এর প্রথম ধাপ মাইটোকন্ড্রিয়ায় ঘটেনা। তবে দ্বিতীয় এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিক্রিয়া গুলো মাইটোকন্ড্রিয়াতেই সম্পন্ন হয়। ক্রেবস চক্রে সবচেয়ে বেশি শক্তি উৎপাদিত হয় বলে মাইটোক‌ন্ড্রিয়াকে কোষের শ‌ক্তি উৎপাদন কেন্দ্র বা পাওয়ার হাউস বলা হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সকল উদ্ভিদ ও প্রাণী কোষে মাইটোকন্ড্রিয়া পাওয়া যায়।

প্লাস্টিড

প্লাস্টিড' (গ্রীক: πλαστός) হলো ঝিল্লি-আবদ্ধ অঙ্গাণু৷ এটি উদ্ভিদ কোষে পাওয়া যায় এবং কিছু ইউক্যারিওটিক জীবেও পাওয়া যায়। এরা এন্ডোসাইম্বিয়টিক সায়ানোব্যাকটেরিয়া হিসাবে বিবেচিত হয়৷  প্লাস্টিড আর্নস্ট হেকেল আবিষ্কার করেছিলেন এবং তিনি তার নাম দিয়েছিলেন, তবে এ.এফ.ডব্লিউ শিম্পার প্রথম স্পষ্ট সংজ্ঞা দিয়েছিলেন।

রাইবোসোম

রাইবোজোম জীব কোষে অবস্থিত রাইবোনিউক্লিওপ্রোটিন দ্বারা গঠিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা। রাইবোজোম প্রধানত প্রোটিন সংশ্লেষণে সাহায্য করে। প্রোটিনের পলিপটাইড চেইন সংযোজন এই রাইবোজোমে হয়ে থাকে। এছাড়া রাইবোজোম এ কাজে প্রয়োজনীয় এনজাইম সরবরাহ করে।  এই উৎসেচক বা এনজাইমের কাজ হলো প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি বাড়িয়ে দেয় ।

গলগি বস্তু

সাইটোপ্লাজমে অবস্থিত নিউক্লিয়াসের কাছাকাছি কতকগুলো ঘনসন্নিবিষ্ট চওড়া সিস্টারনি,থলির মতো ভ্যাকুওল এবং ক্ষুদ্র ভেসিকল এর সমন্বয়ে গঠিত জটিল অঙ্গাণু হল গলগি বস্তু বা গলজি বস্তু(ইংরেজিঃ Golgi Body)।স্নায়ুবিজ্ঞানী ক্যামিলো গলগি ১৮৯৮ সালে পেঁচা ও বিড়ালের মস্তিষ্কের কোষে গলজি বস্তু আবিষ্কার করেন।গলজি বস্তুকে কোষের প্যাকেজিং কেন্দ্র বলে। গলজি বস্তু প্রধানত প্রাণিকোষে পাওয়া যায়। ইতালীয় স্নায়ুতত্ত্ববিদ ক্যামিলো গলগি ১৮৯৮ সালে গলগি বডি আবিষ্কার করেন। তার নাম অনুসারেই গলগি বডির নামকরণ করা হয় ।

নিউক্লিয়াস

নিউক্লিয়াস (ইংরেজি: Cell Nucleus) হল প্রোটোপ্লাজমের সবচেয়ে ঘন, পর্দাঘেরা এবং প্রায় গোলাকার অংশ।যা কোষের সব জৈবনিক ক্রিয়া বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে তাকে বলা হয় নিউক্লিয়াস ৷ এর আকৃতি গোলাকার ডিম্বাকার ও নলাকার।সিভকোষ ও লোহিত রক্তকণিকায় নিউক্লিয়াস থাকেনা।নিউক্লিয়াসে বংশগতির বৈশিষ্ট্য নিহিত থাকে। এটি কোষে সংঘটিত বিপাকীয় কার্যাবলীসহ সব ক্রিয়া বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। লিউয়েন হুক (Lewaen hook) সর্বপ্রথম ১৯৬৭ সালে কোষে নিউক্লিয়াস দেখতে পান এবং এর নামকরণ করেন।

তথ্যসূত্র

  1. VanderBeek, Laura; Law, Calvin HL; Tandan, Véd R (২০১০-০৭-২২)। "Gallstone Disease"Evidence‐Based Gastroenterology and Hepatology: 385–395। ডিওআই:10.1002/9781444314403.ch23
  2. Keegstra, K (২০১০)। "Plant cell walls"Plant Physiology154 (2): 483–486। ডিওআই:10.1104/pp.110.161240পিএমআইডি 20921169পিএমসি 2949028অবাধে প্রবেশযোগ্য
  3. Raven, J.A. (১৯৮৭)। "New Phytologist"। 106 (3): 357–422। ডিওআই:10.1111/j.1469-8137.1987.tb00149.x

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.