উত্তম কুমার
উত্তম কুমার (৩ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ - ২৪ জুলাই ১৯৮০) (প্রকৃত নাম অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়) ছিলেন একজন ভারতীয়-বাঙালি চলচ্চিত্র অভিনেতা, চিত্রপ্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সঙ্গীত পরিচালক ও গায়ক। বাংলা চলচ্চিত্র জগতে তাঁকে 'মহানায়ক' আখ্যা দেওয়া হয়েছে। উত্তম কুমারকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জাত অভিনেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি হলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ও সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা। ক্যারিয়ার জুড়ে অসংখ্য বাণিজ্যিক সাফল্যের পাশাপাশি সমালোচকদেরও তুমুল প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। তাঁকে বাঙালি সংস্কৃতির আইকন এবং বাংলার ম্যাটিনি আইডল রুপে ধরা হয়। তাঁর ভক্তরা তাঁকে "গুরু" বলে ডাকে। তাঁর খ্যাতি মূলত পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ, এছাড়াও পৃথিবী ব্যাপি বাঙালিদের মধ্যে বেষ্টিত।
মহানায়ক উত্তম কুমার | |
---|---|
জন্ম | অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় ৩ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ |
মৃত্যু | ২৪ জুলাই ১৯৮০ ৫৩) | (বয়স
জাতীয়তা | ভারতীয় বাঙালি |
অন্যান্য নাম | মহানায়ক, উত্তমবাবু |
নাগরিকত্ব | ভারত |
পেশা | অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক, গায়ক |
কর্মজীবন | ১৯৪৮-১৯৮০ |
পরিচিতির কারণ | ভারতীয়-বাঙালি চলচ্চিত্রকার, চিত্রপ্রযোজক এবং পরিচালক |
উল্লেখযোগ্য কর্ম | অগ্নিপরীক্ষা (চলচ্চিত্র) ১৯৫৪,
হারানো সুর ১৯৫৭, সপ্তপদী ১৯৬১, নায়ক (চলচ্চিত্র) ১৯৬৬, এন্টনী ফিরিঙ্গী ১৯৬৭, স্ত্রী (১৯৭২-এর চলচ্চিত্র) ১৯৭২, অমানুষ (চলচ্চিত্র) ১৯৭৪, সন্ন্যাসী রাজা ১৯৭৫, ওগো বধু সন্দরী ১৯৮১ |
আদি নিবাস | কলকাতা |
উচ্চতা | ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি (১.৮০ মিটার) |
উপাধি | মহানায়ক |
দাম্পত্য সঙ্গী | গৌরী চট্টোপাধ্যায় (বিবাহ ১৯৪৮ - মৃত্যু ১৯৮০), সুপ্রিয়া চৌধুরী (বিবাহ ১৯৬৩ - মৃত্যু ১৯৮০) |
সন্তান | ১ গৌতম চট্টোপাধ্যায় |
পিতা-মাতা |
|
আত্মীয় | গৌরব চ্যাটার্জি (grandson), তরুণ কুমার (brother) |
পুরস্কার |
|
উত্তম কুমার প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা সিনেমায় কাজ করেছেন, ১৯৪৮ সালে তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি দৃষ্টিদান থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা মোট ২০২টি, যার মধ্যে ১৫টি হিন্দি ছবিও আছে। তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলির মধ্যে অগ্নিপরীক্ষা, হারানো সুর, সপ্তপদী, ঝিন্দের বন্দী, জতুগৃহ, লাল পাথর, থানা থেকে আসছি, রাজদ্রোহী, নায়ক, এন্টনী ফিরিঙ্গি, চৌরঙ্গী, এখানে পিঞ্জর, স্ত্রী, অমানুষ, অগ্নীশ্বর, সন্ন্যাসী রাজা ইত্যাদি অন্যতম। উত্তম কুমার ভারতের প্রথম অভিনেতা যিনি ১৯৬৮ সালে জাতীয় পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান পান। তাঁর ছবি চিড়িয়াখানা ১৯৬৭ ও অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির ১৯৬৭ জন্য। তাঁকে বাংলা চলচ্চিত্রের সবচাইতে জনপ্রিয় ও সফল অভিনেতা হিসেবে ধরা হয়।
১৯৯৩ সালে টালিগঞ্জ ট্রাম্প ডিমোর পাশে তাঁর একটি র্মমর মূর্তি স্থাপিত হয়। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর নামে মহানায়ক পুরস্কার চালু করেন বাংলা চলচ্চিত্রে আজীবন স্বীকৃতির জন্য। এছাড়াও তাঁর নামে ২০০৯ সালে টালিগঞ্জের মেট্রো স্টেশনের নামকরণ করা হয় যার নাম মহানায়ক উত্তম কুমার মেট্রো স্টেশন।
প্রাথমিক জীবন
উত্তম কুমারের জন্ম ১৯২৬ সালের ৩রা সেপ্টেম্বরে। তাঁর আসল নাম অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি কলকাতায় ভবানীপুরে ৫১ আহিড়ীটোলা স্ট্রীটে তাঁর মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় এবং মা চপলা দেবী। তাঁর এক দিদি ও দুই ভাই যথাক্রমে বরুণ কুমার ও তরুণ কুমার ছিলো। ছোটোবেলাতেই তাঁর দিদি মারা যায়। ছোটো ভাই তরুণ কুমারও ছিলেন বাংলা সিনেমার এক জনপ্রিয় অভিনেতা। তাঁর বাবা ছিলেন কলকাতার মেট্রো সিনেমা হলের এক সাধারণ কর্মচারী। তাদের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার ছিলো।
তিনি প্রথমে চক্রবেড়ীয়া হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং পরে সাউথ সাবার্বান স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পাঁচ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা মুকুট নাটকে অভিনয় করে তুমুল প্রশংসিত হন এবং একটি সোনার পদক যেতেন। পরে আবার চোদ্দ পনেরো বছর বয়সে গয়াসুর নাটকে অভিনয় করেও পুরস্কৃত হন। ১৯৪৫ সালে কলকাতার গোয়েঙ্কা কলেজে অব কমার্সে ভর্তি হন। পারিবারিক আর্থিক অনটনের জন্য কলকাতার পোর্টে চাকরি নিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারেননি। শেষ বর্ষে কলেজ ছাড়তে হয় তাঁকে কাজের চাপে।[1] সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে।
ছেলেবেলা থেকেই খেলাধুলা ও অভিনয় পাগল ছিলেন। বাড়ির বড়োদের থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সিনেমা দেখা নাটক দেখা ছিল তার নেশা। নিজের বাড়িতেই পুরোনো শাড়ি টাঙিয়ে তৈরী করেছিলেন সুহৃদ সমাজ এবং পরে আবার পাড়ার ও স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে পাড়াতেই মাচা ও পর্দা খাটিয়ে গড়ে তুলেছিলেন লুনার ক্লাব এই দুই জায়গাতেই তিনি অভিনয় করতেন। রীতিমতো মেট্রো সিনেমায় গিয়ে ইংরেজি ছবি দেখতেন এবং তাদের অভিনেতাদের স্টাইল নকল করতেন। তবে তাঁর আদর্শ ছিলেন নাটকে শিশির কুমার ভাদুড়ি ও সিনেমায় প্রমথেশ বড়ুয়া। খেলাধুলা ও শরীরচর্চাতেও ছিলেন পটু। ভলিবল, ফুটবল, ক্রিকেট ও সাতাঁরের পাশাপাশি লাঠি খেলা শিখতেন সুকুমার গুপ্তর কাছে। এছাড়া ননী ঘোষের আখড়ায় কুস্তিও শিখতেন। শুধু তাই নয় ভবানীপুরের বার্ষিক সাতাঁর প্রতিযোগিতায় পর পর তিনবার সাতাঁর বিজয়ী হয়েছিলেন। গানের তালিম নিতেন নিদানবন্ধু বন্দোপাধ্যায়ের কাছে। এছাড়াও উত্তর প্রদেশের এক মৌলানার কাছে হিন্দি ও উর্দুও শিখতেন। তিনি সবেতেই পারদর্শী ছিলেন।
কর্মজীবন
প্রাথমিক কর্মজীবন
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হয়েছিলেন। তাই পারিবারিক আর্থিক অনটনের জন্য চলচ্চিত্র জগতে আসা সহজ ছিলো না। তাই এক সাধারণ পরিবারের বড়োছেলে হিসেবে সংসারের হাল ধরতে চাকরির খোঁজ শুরু করেন তিনি। অনেক খুঁজে ১৯৪৬ সালে কলকাতা বন্দরে কেরানির চাকরি নেন উত্তম কুমার। চাকরি করার জন্য কলেজ শেষ করতে পারেননি তিনি। যখন তিনি শেষ বর্ষের ছাত্র তখন তাঁকে কলেজ ছাড়তে হয় কাজের চাপে। পড়াশোনা খুব বেশি দূর করতে না পারার আক্ষেপ ছিলো তাঁর বরাবর। কলকাতা বন্দরে কেরানির চাকরিতে মাসিক ২৭৫ টাকা মাইনে দিয়ে কর্মজীবন শুরু হয় তাঁর। তবে চাকরি করলেও অভিনয় থেকে বিরত থাকতে পারেননি। রীতিমতো থিয়েটার করতেন এবং টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায় ঘোরাফেরা করতেন সিনেমায় সুযোগের জন্য। সেকারণে অনেকবার তাঁকে চাকরি কামাই করতে হয়েছে।
চলচ্চিত্রে অভিনয় ও ব্যর্থতা ১৯৪৭ - ১৯৫১
কলকাতা বন্দরে কয়েক বছর চাকরি করার পর এবং মঞ্চে অভিনয় করার পর ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার বছরে উত্তম কুমার তার এক বন্ধুর সহযোগিতায় প্রথম মায়াডোর নামে একটি হিন্দি চলচ্চিত্রে কাজের সুযোগ পেয়েছিলেন। পাঁচ দিনের কাজের জন্য দৈনিক পাঁচ সিকি করে পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য জীবনের প্রথম ছবিই মুক্তিলাভ করেনি তাঁর।[1] উত্তম কুমারের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ছিল তার ঠিক পরের বছর ১৯৪৮ সালের দৃষ্টিদান ছবি। এই ছবির পরিচালক ছিলেন কিংবদন্তি নীতীন বসু, এখানেও এক সামান্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সেকালের জনপ্রিয় নায়ক অসিতবরণের ছেলেবেলার চরিত্রে। পারিশ্রমিক ধার্য ছিলো ২৭টাকা কিন্তু তা থেকে মাত্র ১৩টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন। কিন্তু এই ছবি মুক্তি পেলেও বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়েছিলো। এই ছবিতে তিনি তাঁর জন্মনাম অরুণ কুমার চ্যাটার্জি নামে অভিনয় করেছিলেন। ঠিক পরের বছর ১৯৪৯ সালে কামনা ছবিতে প্রথমবার মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং নিজের নাম পালটে রাখেন উত্তম চ্যাটার্জি। কিন্তু এ ছবিও চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়। পরে আবার নিজের নাম পাল্টে রাখেন অরূপ কুমার এবং অভিনয় করেন যথাক্রমে মর্যাদা ১৯৫০, ওরে যাত্রী, নষ্টনীড় ছবিতে, কিন্তু সাফল্য আসেনি। পরপর ব্যর্থতা তাঁর চলচ্চিত্র জীবনকে রীতিমতো মতো সংকটে ফেলে দিয়েছিলো। ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁকে অনেক অপমান ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছিল। সেটে ঢুকলেই তাঁকে ব্যঙ্গ করা হত এই দুর্গাদাস এসেছে বা ছবি বিশ্বাস এসেছে (সেই যুগের তারকারা) এই বলে। ১৯৫১ সালে সহযাত্রী ছবি থেকে প্রথমবার তাঁর নাম রাখেন উত্তম কুমার। এই ছবিও ব্যর্থ হয়। এরপরে কাজ করেন সঞ্জীবনীতে। কিন্তু পর পর সাতটি ছবি বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়। ফলে ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর নাম রাখা হয় "ফ্লপ মাষ্টার জেনারেল"। তখন বেশিরভাগ প্রযোজক পরিচালক তাকে এড়িয়ে যেতেন কেউ তাঁকে ছবিতে নিতে চাইতেন না। তখনও তিনি সিনেমার সাথে সাথে কলকাতা বন্দরে চাকরি করতেন এবং সিনেমায় অভিনয়ের জন্য প্রায়ই তিনি চাকরি কামাই করতেন। তবে সেই সময়ের কর্তারা তাঁর কামাই মঞ্জুরও করেছেন। কিন্তু এভাবে চলচ্চিত্রে বার বার ব্যর্থতার জন্য আবার তিনি কলকাতা বন্দরে পাকাপাকি ভাবে যোগ দেওয়ার কথা ও চলচ্চিত্র ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবেন এবং ভাবেন সিনেমা তার জন্য নয়। তবে তাঁর পাশে দাঁড়ান তাঁর স্ত্রী গৌরী দেবী।
১৯৫২ - ১৯৫৪ সাফল্য ও প্রতিষ্ঠা
পাহাড়ি স্যান্যালের তত্ত্বাবধানে ১৯৫২ সালে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় তাঁর। এম পি প্রোডাকশন তাঁকে তিন বছরের চুক্তিতে নেয়। আর প্রথম সাফল্য আনে এম. পি প্রোডাকশনের ব্যানারে এবং নির্মল দের পরিচালনায় বসু পরিবার চলচ্চিত্র, যেখানে তিনি প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এখানে তিনি ছিলেন অন্যতম মূখ্য ভুমিকায়। এর ঠিক পরের বছর ১৯৫৩ সালে একই ব্যানারে আর একই পরিচালকের সঙ্গে সাড়ে চুয়াত্তর মুক্তি পাবার পরে তিনি চলচ্চিত্র জগতে স্থায়ী আসন লাভ করেন। ছবিটি ব্লকবাষ্টার হয়। সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে তিনি প্রথম অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অভিনয় করেন। এই ছবির মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সফল উত্তম-সুচিত্রা জুটির সূত্রপাত হয়। এই ছবিতে তিনি মুখ্য ভুমিকায় না থাকা সত্ত্বেও তিনি সবার দৃষ্টি আর্কষণ করেন। সাড়ে চুয়াত্তরে সাফল্যের ঢেউ আছড়ে পড়ে পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৪ সালে। এই বছর তিনি টানা ১৪ টি ছবিতে অভিনয় করেন। এর মধ্যে সুচিত্রা সেনের সাথে বেশ কিছু সফল চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন যেমন মরণের পরে, ওরা থাকে ওধারে, চাঁপাডাঙ্গার বউ আরও বেশকিছু চলচ্চিত্রে। তখন বাংলায় হিন্দি সিনেমার চল বেশি ছিলো। বসু পরিবার দেখার পর উত্তম কুমারকে ভালো লেগে যায় সেই সময় চলচ্চিত্রে না আসা কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায়ের এবং পরপর কিছু উত্তম কুমারের ছবি দেখে ফেলেন যার মধ্যে সাড়ে চুয়াত্তর ও চাঁপাডাঙ্গার বউ ও ছিলো। সত্যজিৎ রায় বলে ছিলেন বাংলার অন্যান্য অভিনেতার থেকে উত্তম একেবারেই আলাদা। অভিনয়ে একটু হলিউডি ছোঁয়া আছে থিয়েটারের অভিনয়ের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। এ ছেলে অনেক দুর যাবে। সত্যজিৎ বাবুর কথা সত্যি হয়েছিল।
১৯৫৪ - ১৯৫৯ খ্য্যতির শীর্ষে এবং সুচিত্রা সেনের সাথে সফল জুটি
১৯৫৪ সালে পুজোয় মুক্তিপ্রাপ্ত কালজয়ী ছবি অগ্নিপরীক্ষা সিনেমার পর তিনি রাতারাতি তারকা হয় যান। এই চলচ্চিত্রটি বাংলা সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং বক্স অফিসে রেকর্ড গড়ে। বাংলার মানুষ হিন্দি সিনেমা থেকে বাংলা সিনেমাতে নজর দেয়। এবং এই সুচিত্রা সেনের সাথে জুটি খুব পছন্দ হয়। এরপরে আমৃত্যু তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে একচ্ছত্র ভাবে শাসন করে যান।
উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন বাংলা চলচ্চিত্রে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত অনেকগুলি ব্যবসায়িকভাবে সফল এবং একই সাথে প্রশংসিত চলচ্চিত্রে মুখ্য ভূমিকায় একসাথে অভিনয় করেছিলেন। এগুলির মধ্যে প্রধান হল সবার উপরে, শাপমোচন, শিল্পী - হারানো সুর, পথে হল দেরী, সপ্তপদী, চাওয়া পাওয়া, বিপাশা, জীবন তৃষ্ণা,সাগরিকা, গৃহদাহ আরও অনেক। তাঁরা একসাথে মোট তিরিশটি ছবিতে কাজ করেছেন যাঁর মধ্যে উনত্রিশটি ছবিই বক্স অফিসে সফল। সুচিত্রা সেন ছাড়াও তিনি সাবিত্রী চ্যাটার্জি ও সুপ্রিয়া চৌধুরীর ও আরও অনেক নায়িকার সাথে অনেক সফল ছবিতে কাজ করেন যার মধ্যে অন্নপুর্ণার মন্দির ১৯৫৪, চিরকুমার সভা ১৯৫৬, সাহেব বিবি গোলাম ১৯৫৬, সুরের পরশে ১৯৫৭, পৃথিবী আমারে চায় ১৯৫৭, বিচারক ১৯৫৯, সোনার হরিণ ১৯৫৯, মরুতীর্থ হিংলাজ ১৯৫৯, অবাক পৃথিবী ১৯৫৯ ও আরও কালজয়ী চলচ্চিত্রে।
১৯৫৫ সালেই এক বিচিত্র ভূমিকায় অভিনয় করেন হ্রদ ছবিতে। এই ছবিতে এক স্মৃতিভ্রষ্ট যুবকের চরিত্রে কাজ করেন। এবং এই ছবির জন্য জীবনে প্রথমবার বড়ো পুরস্কার বিএফজেএ শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান পান। ১৯৫৬ সালে সত্যজিৎ রায় ঘরে বাইরে ছবি তৈরীর কথা ভাবলে সেখানে সন্দীপের চরিত্রে উত্তম কুমারকে ভাবেন। সন্দীপের চরিত্রটি ছিলো খলনায়কের।কিন্তু সেই সময় রোমান্টিক ইমেজের তুঙ্গে থাকায় তখন সেই ছবিটি করতে রাজি হননি তিনি এবং সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দেন। তখন আর সত্যজিৎ সেইসময় ছবিটি বানাননি। পরে উত্তম কুমারের মৃত্যুর চার বছর পর ১৯৮৪ সালে সত্যজিৎ এই সিনেমাটা বানান যেখানে সন্দীপের চরিত্রে অভিনয় করেন তাঁর ক্রমাগত অভিনেতা সৌমিত্র চ্যাটার্জি। তিনি শুধু রোমান্টিক অভিনেতা হিসেবে নয় অনেক রকমের চরিত্র করেছিলেন। এই সময় তিনি প্রথম প্রযোজনায় আসেন এবং হারানো সুর ছবি করেন এই ছবি তাকে প্রথম জাতীয় পুরস্কার এনে দেয়। ১৯৫৭ সালে তাসের ঘর ছবিতে প্রথম দ্ধৈত ভুমিকায় অভিনয় করেন।
১৯৬০ - ১৯৬৯ মধ্যগগনে এবং একছত্র শাসন
১৯৬০ এর দশকে উত্তম কুমার বাংলার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ তারকা হয়ে যান এবং ইন্ডাস্ট্রিতে একের পর এক বক্স অফিস সাফল্য আনেন। তার ছবি সেই সময় হলে পড়া মাত্রই ছবি হিট। ৬০ দশকের অনেক সফল ছবি তিনি করেন তার মধ্যে খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন', শহরের ইতিকথা, শুন বরনারী, সপ্তপদী, দুই ভাই, ঝিন্দের বন্দী, বিপাশা, শিউলি বাড়ি, দেয়া নেয়া, ভ্রান্তি বিলাস, জতুগৃহ, লালপাথর, সুর্যতপা, থানা থেকে আসছি, রাজদ্রোহী, শুধু একটি বছর, কাল তুমি আলেয়া ও শঙ্খবেলা প্রভৃতি অন্যতম।
এই সময়ই ১৯৬০ এ কুহুক ছবিতে তিনি প্রথম নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করেন এবং খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন ছবিতে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেন। ১৯৬১ তে মুক্তিপ্রাপ্ত তপন সিনহার কালজয়ী ঝিন্দের বন্দী ছবিতে তিনি প্রথমবার কিংবদন্তি সৌমিত্র চ্যাটার্জির বীপরীতে অভিনয় করেন।
১৯৬৬ সালে সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে ডাক পেয়েছিলেন উত্তম নায়ক ছবিতে অভিনয়ের জন্য। পাড়ার অভিনেতা থেকে অরিন্দমের নায়ক হওয়ার গল্প নিয়ে ছবিতে উত্তম অভিনয় করতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন নিজেকে। এটিকে উত্তমের জীবনের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে ধরা হয়। নায়ক তাঁর কেরিয়ারের ১১০তম ছবি। এই ছবির স্ক্রিপ্ট সত্যজিৎ রায় উত্তমকে ভেবেই লেখেন দার্জিলিঙে বসে। এই ছবিতে তাঁর অভিনয় দেখে বিখ্যাত হলিউড ছবির তারকা অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলর রীতিমতো উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন এবং উত্তমের সঙ্গে দেখা করতেও চেয়েছিলেন। নায়কে উত্তম কুমারের অভিনয়কে ফোর্বস ইন্ডিয়া তাদের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২৫টি সেরা ভারতীয় সিনেমার পারফরম্যান্স তালিকায় নথিভুক্ত করে। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় দু’টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। প্রথমটি নায়ক এবং দ্বিতীয়টি হলো চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানা চলচ্চিত্রে তিনি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।[4]
১৯৬৭ সালে চিড়িয়াখানার সেটে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এরপরেও তিনি অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, নায়িকা সংবাদ, গৃহদাহ, জীবন মৃত্যু, চৌরঙ্গী, কখনো মেঘ, তিন অধ্যায়, সাবরমতী, মন নিয়ে, কমললতা, অপরিচিত প্রভৃতি ছবি দিয়েছেন।
১৯৭০ - ১৯৭৫ তারকা থেকে মহানায়ক
১৯৬৯ সালে বাংলার কোনো এক পত্রিকা তাকে প্রথম মহানায়ক বলে সম্মোধন করে। জনসাধারণের কাছেও তিনি মহানায়ক হয়ে ওঠেন। এই সময় বাংলায় নকশাল আন্দোলনের জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতির জেরে জনজীবন উত্তাল হয়ে উঠছিল। যার জেরে ক্ষতি হচ্ছিল বাংলা সিনেমার। এবং এই সময় তিনি আততায়ীর কাছ থেকে খুনের হুমকি পান কারণ তিনি একটি খুন হতে দেখে ফেলেন। তাই ওই সময় তিনি বম্বেতে চলে যান এবং সেখানে কিছুদিন থাকেন। এরপরে পরিবেশ শান্ত হলে আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। সেইসময়ে বেশিরভাগ বাংলা চলচ্চিত্র ব্যবসা করতে পারছিলনা। এর মধ্যেও তার ছবি দিব্যি চলছিল যেমন মঞ্জরী অপেরা, কলঙ্কিত নায়ক, নিশিপদ্ম, ছদ্মবেশী, এখানে পিঞ্জর, ধন্যি মেয়ে, জীবন জিঞ্জাসা, স্ত্রী, মেমসাহেব, বন পলাশীর পদাবলী, রৌদ্র ছায়া, অমানুষ, মৌচাক, অগ্নীশ্বর, সন্ন্যাসী রাজা প্রভৃতি ছবি যেগুলো দুর্দান্ত সাফল্য পেয়েছিল। ১৯৭৪ সালে অমানুষ ছিলো তাঁর ক্য্যরিয়ারের সবচেয়ে সফল ছবি।
১৯৭৬ - ১৯৮০ শেষ বছরগুলো
১৯৭৬ সাল থেকে তাঁর বেশিরভাগ ছবিই বক্স অফিসে ব্যর্থ হতে থাকে। মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি ছবি সাফল্য পায়। এদের মধ্যে বহ্নিশিখা, সব্যসাচী, আনন্দ আশ্রম, ধনরাজ তামাং, সুননয়নী, দুই পৃথিবী মাত্র কয়েকটি ছবিই বক্স অফিস সাফল্য পেয়েছিল। শেষ চার বছর তার সাফল্যের হার একেবারে কমে গেছিল কারণ তিনি কিছু নিম্নমানের চিত্রনাট্যে কাজ করছিলেন। কারন বিভিন্ন প্রযোজকরা ছবি হিট করাতে তার কাছেই আসতেন কারণ তিনিই একমাত্র তারকা ছিলেন বাংলায় যাঁকে বক্স অফিস যন্ত্র বলা হত। ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থে তাই তিনি সেই সমস্ত ছবিতে কাজ করতেন। তবে এই সময় তপন সিনহা তাঁকে নিয়ে বাঞ্ছারামের বাগান করতে চেয়েছিলেন মুখ্য ভুমিকায়। কিন্তু ডেটের সমস্যার জন্য তিনি উত্তম কুমারকে বাদ দেন যেটা নিয়ে কোর্টেও মামলা শুরু হয়ে যায়। পরে তাঁর জায়গায় অভিনয় করেন দীপঙ্কর দে। ১৯৮০ সালের জুন মাসে মুক্তি পাওয়া দুই পৃথিবী ছিলো তাঁর মৃত্যুর আগে মুক্তিপ্রাপ্ত শেষ ছবি। এই ছবিটি তার কামব্যাক ছবি ছিলো কারন ছবিটি বক্স অফিসে দারুন সাফল্যের পাশাপাশি তাকে সমালোচকদের থেকেও তুমুল প্রশংসা এনে দেয়। কিন্তু এরপরই তার অকস্মাৎ মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর পরবর্তী মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি
তাঁর মৃত্যুর পর বেশ কিছু ছবি বাকিছিলো যেগুলি কখনো ডাবিং বা বডিডাবল ব্যবহার করে শেষ করা হয়। এছাড়াও কিছু সম্পূর্ণ ছবি যেগুলো শুধু মুক্তি হওয়া সেগুলো সব এক এক করে মুক্তি পেতে থাকে। মৃত্যুর পরে প্রথম যে ছবিটি মুক্তি পায় সেটি হল রাজা সাহেব। কিন্তু সেই ছবিতে তিনি নেগেটিভ রোল করেছিলেন তাই সদ্য শোকার্ত দর্শক সে ছবি গ্রহন করেনি। তাই ছবিটি ব্যর্থ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি উন্মাদনা ছিলো ওগো বধু সুন্দরী নিয়ে। যে ছবি করতে করতেই তাঁর দেহাবসান ঘটি। এই ছবিটি ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর প্রায় সাত মাস পরে মুক্তি পেয়েছিল। কিন্তু এই ছবিটি নিয়ে দর্শকদের উন্মাদনা ছিলো সবচেয়ে বেশি। তাই ছবিটি মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথেই বিশাল সাফল্য পায়। দর্শকরা তাদের প্রিয় মহানায়ককে দেখতে হল ভরিয়ে দেয়। এছাড়াও মুক্তি পেয়েছিল সুর্য সাক্ষী, প্লট নাম্বার ফাইভ, কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী, প্রতিশোধ ও দেশপ্রেমী প্রভৃতি। এদের মধ্যে বেশিরভাগ ছবিই বক্স অফিসে সাফল্য পেয়েছিল।
হিন্দি ছবিতে
১৯৫৫ সালে প্রথমবার হিন্দি ছবি থেকে কাজের অফার আসে কিন্তু সেই মুহূর্তে বাংলা সিনেমা ছেড়ে যেতে চাননি তিনি। ১৯৫৬ সালে বিখ্যাত অভিনেতা পরিচালক প্রযোজক রাজ কাপুর তাঁর আর.কে ফিল্মসের ব্যানারে জাগতে রাহো ছবির বাংলা ভার্সান একদিন রাত্রে ছবিতেও তাঁকে কাষ্ট করেন কিন্তু ডেটের সমস্যায় সেই ছবিও করতে পারেননি তিনি।
হিন্দি চলচ্চিত্র থেকে পরে বেশকিছু বড়ো অফারও পান উত্তম কুমার। ১৯৬২ সালে তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতাসম বন্ধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রযোজনায় নির্মিত বিশ সাল বাদ ছবিতে তাঁকে মুখ্য ভূমিকায় অফার দেন। কিন্তু কোনো এক কারণে সে ছবি করেননি। ফলে তাঁদের দুজনের সম্পর্কে কিছুটা ছেদ পরে। এরপর ১৯৬৪ সালে রাজ কাপুর আবার তাঁকে একটি বিখ্যাত ছবি সঙ্গম সিনেমায় অফার দেন কিন্তু কিছু লোকের কথায় সে ছবিও ছেড়ে দেন। পরে নিজের ভুল বুঝতে পারেন সঙ্গম বড়ো হিট করায়। ১৯৬০ এর দশকেই বিখ্যাত অভিনেত্রী আশা পারেখের সঙ্গে কাজ করেন ঝংকার নামে একটি ছবিতে। কিন্তু সে ছবি কখনো মুক্তি পায়নি। ১৯৬৭ সালে নিজের প্রযোজনায় নির্মাণ করেন একটি হিন্দি ছবি যাঁর নাম ছোটিসি মুলাকাত। এটি ছিলো তাঁর জনপ্রিয় সিনেমা অগ্নিপরীক্ষার হিন্দি রিমেক। যেখানে তাঁর সাথে কাজ করেন বিখ্যাত অভিনেত্রী বৈজয়ন্তীমালা। উত্তম ও বৈজয়ন্তীমালা দুজনেরই দারুণ আশা ছিলো ছবিটি নিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য সে ছবি বক্স অফিসে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়ে। ফলে প্রবল আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েন তিনি। সবসময় অতিরিক্ত পরিশ্রম করতেন তিনি যার কুফলও পড়ে এবং ১৯৬৭ সালের শুরুতে সত্যজিৎ রায়ের চিড়িয়াখানা ছবির শুটিংয়ে তার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। ছোটি সি মুলাকাত ব্যর্থ হলেও সত্তরের দশকে বেশকিছু অফার আসে যার মধ্যে হৃষিকেশ মুখার্জীর পরিচালনায় আনন্দ সংবাদ যেখানে তিনি এবং রাজ কাপুর মুখ্য ভুমিকায় ছিলেন। কিন্তু দুজনের বচসায় সে ছবি হয়নি পরে সেটাকে আনন্দ ছবি হিসেবে তৈরি করা হয় যেখানে রাজেশ খান্না ও অমিতাভ বচ্চন অভিনয় করেন। এছাড়াও বাসু চ্যাটার্জি পরিচালিত গৃহ প্রবেশ ছবিতেও অভিনয় করার কথা হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার জায়গায় আসেন সঞ্জীব কুমার। কিন্তু পরে উত্তম কুমার বেশ কয়েকটি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। ১৯৭৪ বলিউডের বিখ্যাত বাঙালি পরিচালক শক্তি সামন্ত একটি ছবির অফার আনেন নাম অমানুষ। অমানুষ হলো উত্তম কুমারের একমাত্র সফল হিন্দি ছবি। ছবিটি ছিলো দ্বিভাষিক। বাংলা ভার্সন মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে পুজোয়। বিশাল বাজেটের এবং ইষ্টম্যান কালারের এই বাংলা ভার্সনটি বক্স অফিসে ইতিহাস তৈরী করে এবং এই ছবিটিই তাঁর কেরিয়ারের সবচেয়ে সফল ছবি হয়ে যায় এবং গোল্ডেন জুবিলিও হয়। হিন্দি ভার্সন মুক্তি পায় ১৯৭৫ সালের মার্চে এবং এটিও রজত জয়ন্তী সপ্তাহ চলে। এরপরে তিনি কাজ করেন আনন্দ আশ্রম, কিতাব, দুরিঁয়া, প্লট নাম্বার ফাইভের মতো হিন্দি চলচ্চিত্রে। ছবিগুলি বক্স অফিসে তেমন সাফল্য না পেলেও উত্তম কুমারের অভিনয় তুমুল প্রশংসিত হয়েছিল।
জাত শিল্পীর পরিচয় ও সাফল্যের রেকর্ড
তাঁর অভিনীত রোমান্টিক ছবি বা বাণিজ্যিক ছবিগুলিই বেশি সফল ও জনপ্রিয় হয়েছে। তবে উত্তম কুমার নিজেকে বরাবরই জাত-অভিনেতা হিসেবে প্রমাণ করে এসেছেন। ১৯৫৪ সালের একটি হিট ছবি ছিলো অন্নপূর্ণার মন্দির। এটি তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি যেটি জাতীয় পুরস্কার পায়। বিভিন্ন ছবিতে ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার তাঁর এক বিরল প্রতিভা ছিলো। যেমন তাসের ঘর, ঝিন্দের বন্দী ও ভ্রান্তিবিলাস ছবিতে দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করেন। অবাক পৃথিবী, দেয়া নেয়া বা ছদ্মবেশী তে কমেডি চরিত্রে অভিনয় করেন। খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তনে ভৃত্যের চরিত্রে অভিনয় করেন। চৌরঙ্গী ছবিতে হোটেল কর্মী ভূমিকায় কাজ করেন, উকিল/মুন্সেফ/জজের ভূমিকায় অভিনয় করেন বিচারক ও জীবন জিজ্ঞাসা ছবিতে, থানা থেকে আসছি ও চিড়িয়াখানায় পুলিস অফিসার/গোয়েন্দার চরিত্রে অভিনয় করেন। শেষ অঙ্ক ছবিতে হত্যাকারীর ভূমিকায়, স্ত্রী ছবিতে লম্পট মাতাল জমিদারের চরিত্রে কাজ করেন, বাঘ বন্দি খেলায় দুর্ধর্ষ খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। হ্রদ ছবিতে স্মৃতিভ্রষ্ট যুবকের চরিত্রে, এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছবিতে পোর্তুগিজ সাহেব কবির স্বভাবসুলভ ভাব প্রভৃতি চরিত্রগুলো অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। কারণ এই সমস্ত ছবিতে উত্তম কুমার তার পরিচিত ইমেজ থেকে সরে আসার চেষ্টা করেছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন। এতে তিনি সফলও হয়েছিলেন। উত্তমের সেই ভুবন ভোলানো হাসি, প্রেমিকসুলভ আচার-আচরণ বা ব্যবহারের বাইরেও যে থাকতে পারে অভিনয় এবং অভিনয়ের নানা ধরন, মূলত সেটাই তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ও চিড়িয়াখানা ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন (তখন এই পুরস্কারের নাম ছিল 'ভরত')।[4] অবশ্য এর আগে ১৯৫৭ সালে অজয় কর পরিচালিত হারানো সুর ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন সমগ্র ভারতজুড়ে। সেই বছর হারানো সুর পেয়েছিল রাষ্ট্রপতির সার্টিফিকেট অফ মেরিট। ইংরেজি উপন্যাস 'রানডম হারভেস্ট' অবলম্বনে ছবিটি নির্মাণ করা হয়। প্রযোজক ছিলেন উত্তম কুমার নিজেই[5]
উত্তম কুমার বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে সফল অভিনেতা। তিনি থাকাকালীন প্রায় একচ্ছত্র ভাবে বাংলা ইন্ডাস্ট্রি শাসন করে গেছেন। তাঁর অভিনীত ছবি গুলো সবচেয়ে বেশিবার বছরের সবচেয়ে আয়কারী বাংলা সিনেমার তালিকায় স্থান পেয়েছে। ষাটের দশকে একবার টানা পনেরোটা হিট দেওয়ার রেকর্ডও আছে যা আজও কেউ ভাঙতে পারেনি। এছাড়া পুজোয় তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ও হিটের সংখ্যাও কেউ ভাঙতে পারেনি। উত্তম কুমার অভিনীত, মুক্তিপ্রাপ্ত মোট ছবির সংখ্যা ২০২টি যার মধ্যে ৩৯টি ব্লকবাষ্টার, ৫৭টি সুপারহিট, ৫৭টি হিট ও ৪৯টি অসফল ছবি আছে। অর্থাৎ তার সাফল্যের হার ৭৬ শতাংশেরও বেশি। ষাটের দশক থেকে তাঁর সঙ্গে আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চ্যাটার্জির এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বুদ্ধিজীবীরা ও কিছু বাঙালি বিভক্ত হয়ে যায় একদল উত্তম ভক্ত ও আরেক দল সৌমিত্র ভক্ত হিসেবে। তবে উত্তম কুমারের ভক্ত সংখ্যা অনেক বেশি ছিলো সৌমিত্রর তুলনায়। তবে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র বলেছিলেন পেশায় একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকলেও উত্তমের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিলো একেবারে দাদা ভাইয়ের মতো।
উত্তম কুমার তার কেরিয়ার জুড়ে প্রায় ৫০টিরও বেশি নায়িকার সাথে কাজ করেছেন। তাঁর এক বিরল ক্ষমতা ছিলো সমস্ত নায়িকার সাথে দারুণ রসায়ন ফুটিয়ে তোলা পর্দায়। নায়িকাদের সঙ্গে জুটির মধ্যে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তার জুটি সবচেয়ে জনপ্রিয় হলেও। এছাড়াও রয়েছেন কিংবদন্তি সুপ্রিয়া দেবী ও সাবিত্রী চ্যাটার্জি। এদের সাথে সবচেয়ে বেশি জুটিতে কাজ করেছেন এবং দারুন সফলও হয়েছেন উত্তম। এবং এদের সাথে তাঁর জুটিও জনপ্রিয় হয়েছে, এছাড়াও তিনি কাজ করেছেন মাধবী মুখার্জি, শর্মিলা ঠাকুর, মালা সিনহা, অঞ্জনা ভৌমিক, অরুন্ধুতি দেবী, কাবেরি বসু, সুমিত্রা দেবী, মৌসুমী চ্যাটার্জি, সুমিত্রা মুখার্জি, বৈজয়ন্তীমালা, অলিভিয়া লোপেজ (বাংলাদেশী অভিনেত্রী)। ষাটের দশকে তিনি আশা পারেখের সঙ্গেও কাজ করেছেন ঝংকার নামে একটি ছবিতে তবে সেটি সম্পূর্ণ হয়নি।
অন্যান্য ভূমিকায় উত্তম
- গান শেখা, গাওয়া ও সঙ্গীত পরিচালনা
উত্তম কুমার শুধু অভিনেতা হিসেবেই থেমে থাকেননি। তিনি আরও বিভিন্ন ভুমিকায় কাজ করেছেন। তিনি খুব ভালো গান জানতেন। ছোটবেলা থেকে নিদানবন্ধু ব্যানার্জির কাছে গান শিখতেন। ১৯৫৬ সালে তাঁর নিজের অভিনীত ছবি নবজন্মতে তিনি নিজের লিপে নিজের গলায় গান গেয়েছিলেন সে ছবির সুরকার ছিলেন বিখ্যাত নচিকেতা ঘোষ। সে ছবিতে ছটি গানই তিনি নিজে গেয়েছিলেন। নিজে গান জানার জন্য তিনি গানে খুব সুন্দর লিপ দিতে পারতেন। ছবির গান রেকর্ডিংয়ের সময় শিল্পীর পাশে বসে তার অনুভূতি উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন এছাড়াও তাঁর একটি টেপ রেকর্ডার ছিলো যেখানে গায়কদের গাওয়া গান গুলো তিনি বারবার শুনতেন এর ফলে গানের সাথে পর্দায় ঠোঁট মেলানো তার পক্ষে খুবই সহজ হতো। ১৯৫০ সালে মর্যাদা ছবিতে তিনি প্রথম কোনো গানে লিপ দেন। ১৯৫১ সালে তাঁর লিপে প্রথম গান করেন হেমন্ত মুখার্জি। ভারতের বিভিন্ন বিখ্যাত গায়ক তাঁর লিপে গান গেয়েছেন এবং প্রত্যেক গায়কের সাথে তার দারুন মেলবন্ধন হয়। তাঁর লিপে গেয়েছেন হেমন্ত কুমার (যার সাথে তাঁর জুটি সবচেয়ে কালজয়ী), মান্না দে (জুটিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গান), শ্যামল মিত্র, কিশোর কুমার, মহঃ রফি, ভুপিন্দর সিং ও আরও অনেকে। গায়কের পাশাপাশি সুরকার হিসেবেও নিজের ছাপ রেখেছেন। ১৯৬৬ সালে কাল তুমি আলেয়া ছবিতে নিজে সুর দেন। তাঁর সুরে গান গেয়েছেন কিংবদন্তি আশা ভোঁসলে ও হেমন্ত মুখার্জী। ছবির গান ও ছবি দুটোই হিট হয় এবং টানা ৯৮ দিন চলে পেক্ষাগৃহে। এছাড়াও ১৯৭৭ সালে সব্যসাচী ছবিতেও সুরকার ছিলেন সেখানে অবশ্য সবই রবীন্দ্র সংগীত ছিল। ষাট ও সত্তরের দশকে উত্তম কুমার বেশ কিছু রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ড করেন। তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পরে গ্রামাফোন রেকর্ড কোম্পানি তাদের নিজেদের সংস্থা থেকে সেগুলো প্রকাশ করে।
- প্রযোজনা
প্রযোজক হিসেবও দারুণ সফল হয়েছিলেন উত্তম কুমার প্রায় প্রত্যেকটি ছবি সফল ও কালজয়ী। তিনি মোট ছটি বাংলা ছবি ও একটি হিন্দি ছবি প্রযোজনা করে। ১৯৫৭ সালে প্রথমবার প্রযোজনায় আসেন। তাঁর লক্ষ্য ছিলো বাংলা চলচ্চিত্রকে হিন্দি ছবির সমগোত্রীয় করে তোলা। অজয় করের সাথে যৌথ ভাবে গড়ে তোলেন আলোছায়া প্রোডাকশন প্রাইভেট লিমিটেড যার প্রথম নিবেদন ছিলো হারানো সুর ১৯৫৭। এটি বাংলা বক্স অফিসে এক মাইলফলক গড়ে এবং সেই বছর জাতীয় পুরস্কারে রাষ্ট্রপতির সার্টিফিকেট অব মেরিট পুরস্কার পায়। ১৯৬১ সালে প্রযোজনা করেন দ্বিতীয় ছবি কালজয়ী সপ্তপদী এই ছবি বক্স অফিসে আগের সব রেকর্ড ভেঙে দেয় এবং আবার জাতীয় পুরস্কার পায়। ১৯৬৩ সালে উত্তম কুমার তাঁর প্রযোজনা সংস্থার নাম রাখেন উত্তম কুমার ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেড এবং প্রযোজনা করেন দুটি ছবি একটি হলো শেকসপিয়রের কমেডি অব এররস কাহিনী অবলম্বনে বিদ্যসাগর মহাশয়ের দ্বারা পুনঃলিখিত কাহিনী নিয়ে নির্মিত ভ্রান্তিবিলাস এখানে তিনি ছিলেন দ্বৈত ভুমিকায় এটি সুপার হিট হয় এবং অপরটি হলো উত্তর ফাল্গুনী যেটিতে তিনি অভিনয় করেননি তার বদলে করেছিলেন বিকাশ রায়। এই ছবিটি দারুন সফল হয় এবং পায় শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবির জাতীয় পুরস্কার। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায় তার প্রযোজনায় জতুগৃহ পরিচালক ছিলেন কিংবদন্তি তপন সিনহা এবং আবার এই সিনেমাও জাতীয় পুরস্কার পায়। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রযোজিত একটি হিন্দি ছবি ছোটিসি মুলাকাত যে ছবি চুড়ান্ত ব্যর্থ হয়। এটি তাঁর প্রযোজিত শেষ ছবি ও একমাত্র অসফল ছবি। তবে এ ছবির গান দারুণ জনপ্রিয় হয়। এই বছরই তাঁর প্রযোজিত ছবি গৃহদাহ মুক্তি পায়। যদিও এই ছবির শুটিং হয়েছিলো ১৯৬৪ সালে। এই ছবি বক্স অফিসে সফল হয়। এই ছবির জন্য উত্তম কুমার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার বি এফ জে এ পুরস্কার পান।
- পরিচালনা ও চিত্রনাট্য
উত্তম কুমার পরিচালকের ভুমিকাতেও পারদর্শী ছিলেন এবং এখানেও তিনি সমান সফল হয়েছিলেন এবং নিজের শিল্পীসত্তার পরিচয় দিয়ে ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি প্রথমবার পরিচালনা করেন এবং চিত্রনাট্য লেখেন শুধু একটি বছর ছবির। ছবিটি সুপারহিট হয় এবং টানা ৮৪ দিন চলে প্রেক্ষাগৃহে। এরপরে উত্তম কুমার পরিচালনায় আসেন ১৯৭৩ সালে তাঁর নিজের তৈরী সংস্থা শিল্পী সংসদের প্রযোজনায়। এই ছবিতে তিনি এবং সমস্ত প্রথম সারির অভিনেতারা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছিলেন। এটি ছিলো উত্তম কুমারের একটি ড্রিম প্রোজেক্ট। ছবিটি হলো রমাপদ চৌধুরীর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত বন পলাশীর পদাবলী। এই ছবির চিত্রনাট্য ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। ছবিটি ব্লকবাষ্টার এবং গোল্ডেন জুবিলি হিট হয় এবং উত্তম কুমারের পরিচালনা তুমুল প্রশংসিত হয়। ছবিটি থেকে বিশাল অংকের টাকা উঠে আসে যা দুঃস্থ শিল্পীদের সাহায্যে ব্যবহার হয়। তাঁর শেষ পরিচালিত ছবি ছিলো নীহার রঞ্জন গুপ্তর কাহিনী নিয়ে তৈরী কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী ১৯৮১। কিন্তু উত্তম কুমার এই ছবির কাজ শেষ করতে পারেননি তার আচমকা মৃত্যুর জন্য। ছবিটি মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর প্রায় একবছর পরে এবং এই ছবিটিও হিট হয়।
নাটক ও থিয়েটার
ছোটবেলা থেকেই থিয়েটারের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিলো থিয়েটারে শিশির কুমার ভাদুড়িকে তিনি গুরু মানতেন এবং তাঁকে দেখে অভিনয় শিখতেন। বন্ধুদের সাথে নিয়ে গড়েছিলেন লুনার ক্লাব ও সুহৃদ সমাজ এইখানে তিনি নাটক করতেন। নাটক সবসময় তার খুব কাছের মাধ্যম ছিলো। তাই চলচ্চিত্রে ব্যস্ত হওয়ার পরেও সময় পেলেই থিয়েটারও করেছেন। ১৯৫৩ সালে স্টার থিয়েটার তাঁকে তিন বছরের চুক্তিতে নেয়। সেই সময় তিনি টলিউডের একজন জনপ্রিয় এবং ব্যস্ত অভিনেতা। স্টার থিয়েটারে তিনি অভিনয় করেন শ্যামলী নাটকে। যেখানে তিনি এবং সাবিত্রী চ্যাটার্জি ছিলেন প্রধান ভুমিকায়। এটি ছিলো বাংলা নাট্যের ইতিহাসে অন্যতম সফল নাটক। টানা ৪৮৪ রজনী চলে রেকর্ড গড়েছিলো এই নাটকটি। তুমুল প্রশংসিত হয়েছিলো তাঁর অভিনয়। এই নাটকের জনপ্রিয়তা এতোটাই বেড়ে গেছিলো যে তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় উত্তম কুমারের নাম রেখেছিলেন শ্যামল। তিনি এই নামেই ডাকতেন। বলাবাহুল্য এই নাটকটিও উত্তম কুমারকে জনপ্রিয় করার এক কারিগর। শ্যামলী নাটকের এই অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার জন্য বিখ্যাত পরিচালক অজয় কর ১৯৫৬ সালে এটিকে সিনেমায় নিয়ে আসেন একই শ্যামলী নামে। যেখানে উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনয় করেন কাবেরী বসু। বলাবাহুল্য এটিও ব্লকবাষ্টার হয়। পরে সিনেমা তারকা হয়ে যাওয়ায় তাঁর ব্যস্ততাও বেড়ে যায় ফলে থিয়েটার করা সম্ভব হচ্ছিল না। অনেক পরে সত্তরের দশকে আবার ফিরে আসেন থিয়েটারে। তাঁর নিজের তৈরী সংস্থা শিল্পী সংসদের ব্যানারে ১৯৭০ এর দশকে তিনটি নাটক মঞ্চস্থ করেন যথাক্রমে চারণকবি মুকুন্দ দাস, শাহজাহান ও চরিত্রহীন। এই তিনটি নাটক তিনি শুধু পরিচালনা করেন অভিনয় করেননি। পরে অবশ্য আলিবাবা নামে একটি নাটকে অভিনয় করেন। তাঁর মঞ্চস্থ করা প্রত্যেকটি নাটক জনপ্রিয় হয়ছিলো।
ব্যক্তিগত জীবন
তিন পুত্র সন্তানের মধ্যে উত্তম কুমার ছিলেন সবার বড়। অবশ্য তার একটি বড়ো দিদিও ছিলো কিন্তু দিদিটি অকালেই পরলোক গমন করে। মেজো ভাই বরুণ কুমার একমাত্র সিনেমায় আসেননি। তার ছোট ভাই তরুণ কুমার ( ১৯৩১ - ২০০৩ ) একজন শক্তিশালী অভিনেতা ছিলেন। তারা একত্রে বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচিত্রে অভিনয় করেছেন (যেমন: মায়ামৃগ, ধন্যি মেয়ে, সপ্তপদী, সোনার হরিণ, জীবন-মৃত্যু, মন নিয়ে, শেষ অঙ্ক, দেয়া-নেয়া, সন্ন্যাসী রাজা, অগ্নীশ্বর, "এন্টোনি ফিরিঙ্গী" ইত্যাদি)। ছোটবেলা থেকেই উচ্চারণে সমস্যা ছিলো তাঁর। ইংরেজি উচ্চারণ কিংবা সংলাপ বলতে প্রায়ই অসুবিধে হতো। কিন্তু তিনি রীতিমতো পরিশ্রম করতেন এরজন্য। নিয়মিত সংস্কৃত পড়তেন, শেকসপিয়ার পড়তেন আবার জীভের নীচে সুপাড়ি রেখে কথা বলতেন যাতে উচ্চারণে কোনো খামতি না থাকে। এইজন্য সিনেমায় এতো ভালো করে সংলাপ বলতে পারতেন তিনি। তাঁর প্রত্যেক ছবিতে তাঁর নিজস্ব সংলাপ থাকত যা একটু আলাদা।
বিবাহ ও প্রেম
১৯৪৮ সালের ১লা জুন মাত্র ২১ বছর বয়সে উত্তম কুমার গৌরী দেবীকে (১৯২৯ -১৯৮১) বিয়ে করেন, তাদের একমাত্র সন্তান গৌতম চট্টোপাধ্যায় ১৯৫০ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। গৌতমও মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা যান ২ রা মে ২০০৫ সালে। গৌরব চট্টোপাধ্যায়, উত্তম কুমারের একমাত্র নাতি, তিনিও বর্তমানে টালিগঞ্জের একজন জনপ্রিয় ব্যস্ত অভিনেতা।
প্রায়শই তাঁর সঙ্গে গৌরী দেবীর ঝগড়া হতো সুচিত্রা সেনকে নিয়ে যে তাদের মধ্যে প্রেম আছে। এরপরে উত্তরায়ণ ছবির শুটিংয়ের সময় তিনি কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবীর প্রেমে পড়েন। একদিন ১৯৬৩ সালে গৌরী দেবীর জন্মদিনে প্রচন্ড ঝগড়া হলে তিনি তার পরিবার ছেড়ে চলে যান। সেই বছরই তিনি সুপ্রিয়া দেবীকে বিবাহ করেন। দীর্ঘ ১৭ বছর সুপ্রিয়া দেবীর ( ১৯৩৩-২০১৮) সঙ্গে একসাথে বসবাস করেন, তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত।
আত্মজীবনী
১৯৬০ সালে তিনি আত্মজীবনী লেখা আরম্ভ করেন হারানো দিনগুলি মোর নামে। পরে ১৯৭৯-৮০ সালে আবার নতুন করে আত্মজীবনী লেখেন আমার আমি নামে। যেদিন উত্তম মারা যান তাঁর আসল কপিটি চুরি হয় যায়, পরে ২০১৩ সালে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক সদস্য সেই আসল আত্মজীবনীর অরিজিনাল কপিটি খুঁজে বের করেন এবং কলকাতা বইমেলায় সেটি প্রকাশ করেন।
বিতর্ক
তাঁর প্রচন্ড জনপ্রিয়তা এবং প্রচুর ভক্ত ছিলো। ১৯৭৬ সালে তাঁর এই জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে অল ইন্ডিয়া রেডিও তাঁকে বেতারে মহালয়ায় চন্ডীপাঠ করার অফার দেয় যেটা করে থাকেন মুলত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। উত্তম কুমার প্রথমে রাজী হননি বীরেন্দ্রবাবুর জায়গা নিতে। কিন্তু রেডিওর কর্মীরা তাঁকে বিভিন্ন ভাবে রাজী করায়। ফলে মহালয়া তিনিই পাঠ করেন। কিন্তু দর্শকরা বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জায়গায় উত্তমকে কিছুতেই মেনে নেয়নি যার ফলে বাংলায় তীব্র বিক্ষোভ দেখা যায়। উত্তম সবিনয়ে তা আবার বীরেনবাবুকে ফিরিয়ে দেন পরের বছর থেকে আবার বীরেন্দ্র ভদ্র মহালয়া পাঠ করেন। ২০১৯ সালে এই নিয়ে একটি বাংলা সিনেমাও হয়েছিল যার নাম ছিলো মহালয়া যেখানে উত্তমের ভুমিকায় ছিলেন যীশু সেনগুপ্ত ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ভুমিকায় ছিলেন শুভাষিস মুখার্জি।
সমাজসেবা
উত্তম কুমার শুধু সিনেমার পর্দার নায়ক ছিলেন না বাস্তব জীবনেও নায়ক ছিলেন। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৪২ সালে গান্ধীজির ভারত ছাড়ো আন্দোলনে পথে নেমে যোগ দেন। প্রভাত ফেরী করেন। এছাড়াও ১৯৪৫ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের আই এন এ ফান্ডের জন্য একটি নাটক মঞ্চস্থ করেন যার নাম আনন্দ মঠ। নাটক থেকে উঠে আসা ১৭৫০ টাকা তিনি নেতাজির বড়ো ভাই সতীশ চন্দ্র বসুর হাতে তুলে দেন। এছাড়াও ১৯৪৬ সালের হিন্দু মুসলিম দাঙ্গাতেও নিজে গান লিখে সুর দিয়ে গান গেয়ে বেড়ান। সেখানে কিছু বাজে লোকদের পিটিয়ে সায়েস্তা করেন।
পশ্চিমবঙ্গের দু-দুবার ভয়ংকর বন্যায় উত্তম কুমার পথে নামেন। একবার ১৯৬০ সালের বন্যায় পথে নেমে চাঁদা সংগ্রহ করেন এবং নিজেও সাহায্য করেন আর একটি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করেন। এছাড়াও ১৯৭৮ সালে আরও একবার ভয়ংকর বন্যা হয় এবং আবারও পথে নামে উত্তম কুমার। কিন্তু যথেষ্ট টাকা না ওঠায় তিনি একটি বড়ো ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করেন বলিউড ও টলিউডের মধ্যে ১৯৭৯ সালে। আমন্ত্রণ জানান বম্বে ও দক্ষিণী চলচ্চিত্রের তারকাদের। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ও হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ম্যাচ হয়েছিল বিখ্যাত ইডেন গার্ডেন্সে। যেখানে তিনি নেতৃত্ব দেন বাংলাকে ও দিলীপ কুমার দেন হিন্দিকে। এই ম্যাচ থেকে বিপুল টাকা উঠে আসে যা তিনি তুলে দেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে।
নিজে বেশীদুর পড়াশোনা না করতে আক্ষেপ বরাবর ছিলো তাঁর। কিন্তু চাইতেন দেশের ছেলে মেয়েরা যেন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। তাঁর জন্য অনেক গরীব বাচ্চাদের স্কুলের বই কিনে দিয়েছিলেন। এছাড়াও অনেক নিম্নবিত্ত গরীব ঘরে মেয়ের বিয়ে দিতে পারেচ্ছনা তাদেরকেও টাকা দিয়ে সাহায্য দিতেন। এছাড়াও পাড়ার কোনো সমস্যা বা ইন্ডাস্ট্রির যেকোনো ছোটো ছোটো সমস্যার দিকেও খেয়াল রাখতেন। যেকোনো কেউ তাই তার কাছেই সাহায্য চাইতে আসতেন।
বরাবরই দুঃস্থ কলাকুশলী ও শিল্পীদের জন্য ভাবতেন তিনি। এছাড়াও নতুন নতুন শিল্পীদের সুযোগ পেতেও সাহায্য করেছেন। ১৯৬৮ সালে দুঃস্থ শিল্পীদের সাহায্যের জন্য গড়ে তুলেছিলেন শিল্পী সংসদ। শিল্পী সংসদের প্রযোজনায় একটি বড়ো ছবি বন পলাশের পদা বলী বানিয়েছিলেন যা থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা উঠে আসে যা তিনি দুঃস্থ শিল্পীদের ফান্ডে দিয়েছিলেন। তিনি কখনোই রাজনীতিতে আসেননি তিনি কখনোই চাননি চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে রাজনীতির ছোঁয়া লাগুক। কিন্তু সরকারি তহবিলে যখনই দরকার পড়েছে তখনই তিনি সাধ্যমত সাহায্য করেছেন প্রয়োজনে কখনো চাঁদা তুলেছেন, কোনো অনুষ্ঠান মঞ্চস্থও করেছেন।
পুরস্কার এবং সম্মাননা
উত্তম কুমার তাঁর চলচ্চিত্র জীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছেন। যার মধ্যে পাঁচবার জাতীয় পুরস্কার, আটবার বিএফজেএ পুরস্কার (যা দ্বিতীয় সর্বাধিক) ও তিনবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনোই পদ্মবিভুষণ, পদ্মভূষণ জাতীয় স্বীকৃতি কিছুই পাননি।
- ভারত সরকার কর্তৃক
- ১৯৭৫ : মহানায়ক উপাধি লাভ (সংসদে ঘোষিত হয়) ও পুরস্কার মুল্য ₹৫০০০০ টাকা
- ১৯৫৭ : শ্রেষ্ঠ বাংলা ভাষার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তৃতীয় শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি - হারানো সুর (১৯৫৭) (প্রযোজক হিসেবে)
- ১৯৬১ : শ্রেষ্ঠ বাংলা ভাষার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি - সপ্তপদী (১৯৬১) (প্রযোজক হিসেবে)
- ১৯৬৪ : শ্রেষ্ঠ বাংলা ভাষার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার - উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩) (প্রযোজক হিসেবে)
- ১৯৬৪ : শ্রেষ্ঠ বাংলা ভাষার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার - তৃতীয় শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি - জতুগৃহ (১৯৬৪) (প্রযোজক হিসেবে)
- ১৯৬৮ : শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার - এন্টনী ফিরিঙ্গি ১৯৬৭ ও চিড়িয়াখানা ১৯৬৭ (রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ তাঁকে এই পুরস্কার তুলে দেন)
- ১৯৭৬ : শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার (মনোনীত) অমানুষ (১৯৭৫)
- ১৯৭৬ : ফিল্মফেয়ার বিশেষ পুরস্কার অমানুষ (১৯৭৫)
- ১৯৭৫ : শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার - অমানুষ (১৯৭৪) (পুরস্কার প্রদান করেন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্ত শংকর রায়)
- ১৯৭৯ : শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার - ধনরাজ তামাং (১৯৭৮)
- ১৯৭৫ : প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান - অমানুষ (১৯৭৪) ছবির জন্য এবং পুরস্কার মুল্য স্বরুপ ৫০০০ টাকা কিন্তু সে টাকা তিনি দুঃস্থ কলাকুশলীদের জন্য দান করেন।
- তিনি দ্বিতীয় সর্বাধিক বি এফ জে এ পুরস্কার পেয়েছেন এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে যুগ্ম শীর্ষ।
- ১৯৫৫ : বি.এফ.জে.এ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার - হ্রদ ১৯৫৫ (পুরস্কার তুলে দেন নির্মল কুমার ও হরেন্দ্রনাথ মুখার্জী)
- ১৯৬২ : বি.এফ.জে.এ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার সপ্তপদী ১৯৬১ (পুরস্কার তুলে দেন নিউ থিয়েটার্সের কর্ণধার বি এন সরকার)
- ১৯৬৭ : বি.এফ.জে.এ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার নায়ক ১৯৬৬ (পুরস্কার তুলে দেন কিংবদন্তি দেবকী বসু)
- ১৯৬৮ : বি.এফ.জে.এ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার - গৃহদাহ ১৯৬৭ (পুরস্কার তুলে দেন কে কে শো)
- ১৯৭১ : বি.এফ.জে.এ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার - এখানে পিঞ্জর ১৯৭১ (পুরস্কার তুলে দেন শ্রীমতি নন্দিনী শতপথী)
- ১৯৭৩ : বি.এফ.জে.এ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার - স্ত্রী ১৯৭২ (পুরস্কার তুলে দেন কিংবদন্তি কানন দেবী)
- ১৯৭৫ : বি.এফ.জে.এ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার - অমানুষ ১৯৭৪
- ১৯৭৭ : বি.এফ.জে.এ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার - বহ্নিশিখা ১৯৭৬
- পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিপন্থী চলচ্চিত্র সমালোচক সংস্থা পুরস্কার
১৯৭৪ : শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার - যদুবংশ ১৯৭৪ ১৯৭৫ : শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার - অমানুষ ১৯৭৪
- চলচ্চিত্র প্রসার সমিতি
- ১৯৭৪ : শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার :
- ১৯৭৫ : শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার : অমানুষ ১৯৭৪
- প্রসাদ পত্রিকা পুরস্কার
- ১৯৭৩ : শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার - স্ত্রী ১৯৭৩ (পুরস্কারটি তুলে দেন কিংবদন্তি কানন দেবী)
- ১৯৭৮ : শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার - আনন্দ আশ্রম ১৯৭৭
- সাংস্কৃতিক সাংবাদিক সংস্থা
- ১৯৭৮ : শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার - আনন্দ আশ্রম ১৯৭৭
মৃত্যু
১৯৬৭ সালে তার প্রযোজিত হিন্দি ছবি ছোটিসি মুলাকাতের চরম ব্যর্থতা তিনি সহ্য করতে পারেননি| এছাড়াও তিনি অত্যাধিক দৈহিক পরিশ্রমও করতেন ফলে সত্যজিৎ রায়ের চিড়িয়াখানা ছবির শুটিংয়ে তাঁর প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। পরে আরও দুবার হার্ট অ্যাটাক হয় তার। ১৯৮০ সালের ২৩শে জুলাই বেশ কিছু কান্ড ঘটে অর্থাৎ তার সবচেয়ে প্রিয় টেপ রেকর্ডার চুরি হয়ে যায়। ওগো বধু সুন্দরী চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণের সময় উত্তম কুমার আবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তার বলা শেষ সংলাপ ছিলো আমিও দেখেনেব আমার নাম গগন সেন। এরপর সেই রাতেই শুটিং শেষে তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে পার্টিতে যান। মধ্যরাতে বাড়ি ফিরে এলে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তড়িঘড়ি তাকে কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। টানা ষোলো ঘন্টা পাঁচজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অক্লান্ত চেষ্টা করলেও পরেরদিন ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই রাত ৯:৩৫ মিনিটে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
তাঁর মৃত্যুতে গোটা বাংলায় তুমুল শোকের ছায়া নেমে আসে। দেশ জুড়ে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যাক্তিত্বদের শোকবার্তা আসতে থাকে। পরেরদিন ২৫শে জুলাই তাঁর শেষ যাত্রায় গোটা কলকাতা রাস্তায় নেমে আসে এবং বিপুল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বাংলার ইতিহাসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর একমাত্র তাঁর মৃত্যুতেই এতো উত্তেজনা ও লক্ষ লক্ষ ভক্ত রাস্তায় নেমে আসে। মানুষের এতো উন্মাদনার কারণে তাঁর মৃতদেহ রবীন্দ্র সদনে রাখা যায়নি। এমনকি অর্ধেকদিনের বেসরকারী বোন্ধ ডাকতে হয়। স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেক বাড়িতে সেদিন অরন্ধন হয়। এমনকি প্রায় তেরোদিন বাংলায় অনেক পরিবার অশৌচ পালন করে। কেওড়াতলা মহাশ্মশানে তাঁর শেষ কৃত্য সম্পন্ন হয়। বাংলা মিডিয়া ও সংবাদমাধ্যম তাঁকে বিপুল স্মরণ করে। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে বাংলা দুরদর্শন তাঁর অভিনীত ছবিগুলো প্রায় দেখানো শুরু করে। প্রত্যেকবছর তাঁর জন্মদিন ও মৃত্যুদিন জাঁকজমক ভাবে পালন হয় গোটা বাংলা জুড়ে এছাড়াও পৃথিবী ব্যাপি বাঙালিরাও তাঁকে স্মরণ করে।
উত্তরাধিকার
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে উত্তম কুমার হলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সবচেয়ে সফল অভিনেতা। তাঁর জনপ্রিয়তা এবং অভিনয় ক্ষমতার জন্য মহানায়ক উপাধি দেওয়া হয়েছে। বন্দরের কেরানি থেকে চলচ্চিত্রে ফ্লপ মাষ্টার জেনারেল সেখান থেকে চলচ্চিত্রের অধীশ্বর হয়ে ওঠার এই রুপকথার অাখ্যানে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন বাঙালির ম্যাটিনি আইডল হিসেবে। ১৯৫৪ সালে অগ্নীপরীক্ষা চলচ্চিত্রের পর তিনি তারকা হয়ে যান যেখান থেকে আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর সময়ে তাকে অন্যতম বড়ো তারকা বলা হতো। বাঙালি জীবনে তিনি এমন ভাবে প্রভাব বিস্তার করেন যে তাকে সবাই নিজের বাড়ির ছেলে হিসেবে ভাবত। বিভিন্ন ধরনের ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে এবং তার ভিন্ন ধারার অভিনয়ের জন্য তিনি ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতার স্থান দখল করে আছেন। উত্তম কুমার প্রথম অভিনেতা যিনি বাংলা সিনেমায় ন্যাচারাল অভিনয়ের প্রবেশ ঘটান যেটা তাকে জনপ্রিয় করে তোলে মানুষের কাছে।
উত্তম কুমারের কতটা জনপ্রিয়তা ছিলো তা আজকের দিনে বসে সেটা কল্পনা করা যাবে না। প্রত্যেকদিন পত্রিকা অফিসে হাজার হাজার চিঠি ও শয়ে শয়ে ফোন আসত শুধু একবার উত্তমকুমারের সাথে কথা বলার জন্য। জন্মদিনে সেই সংখ্যাটা লাখে পৌঁছত। বিশেষ করে মহিলা তিনি ছিলেন স্বপ্নের মানুষ মেয়েদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিলো মারাত্মক। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পর এক বিবাহিত মহিলা পত্রিকা অফিসে চিঠি লিখে পাঠিয়ে বলেছিলো উত্তমের মৃত্যুতে আমি বিধবা হলাম। উত্তম কুমার গোটা পৃথিবীর মধ্যে সেই বিরলতম অভিনেতা যাঁকে নিয়ে মৃত্যুর পরেও এতো আলোচনা হয় যাঁর জনপ্রিয়তা মৃত্যুর পরেও একই থেকে গেছে। তিনি হলেন বাঙালি সংস্কৃতির আইকন। আজও পযর্ন্ত তাঁর নামে প্রায় শয়ে শয়ে বই ও ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে। প্রত্যেকবছর তাঁর জন্মদিন ও মৃত্যু দিনে তাঁকে বাঙালিরা প্রবল ভাবে স্মরণ করে বাংলা সংবাদমাধ্যম গুলো তাঁকে নিয়ে প্রবন্ধ লেখে।
অনেক বাঙালি অভিনেতা তাঁর অভিনয়ে এবং কায়দায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন যেমন বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জি, শুভেন্দু চ্যাটার্জি, রঞ্জিত মল্লিক, প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি, শাশ্বত চ্যাটার্জি, যীশু সেনগুপ্ত, আবীর চ্যাটার্জি প্রভৃতি। এছাড়া হিন্দি চলচ্চিত্র থেকেও ধর্মেন্দ্র, সাম্মী কাপুর ও রাজেশ খান্নার মতো বিখ্যাত অভিনেতারাও তাঁর অভিনয় থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। অনেক বিখ্যাত অভিনেতারা তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছেন যেমন হলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলর থেকে বলিউডের অশোক কুমার, দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর, দেব আনন্দ, স্বাম্মী কাপুর, শষী কাপুর, বৈজয়ন্তীমালা, ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না থেকে গুলজার, শাবানা আজমী আরও অনেকে। এমনকি মহঃ রফি, মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখার্জী থেকে আশা ভোঁসলের মতো গাইয়েরাও উত্তম কুমারের ওপর তাঁদের মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন।
সম্মাননা
- ২০০৯ সালে ভারতীয় ডাক টিকিট সংস্থা তাঁর স্মরণে একটি হোমেজ পোষ্টার স্ট্যাম্প প্রকাশ করে এবং তাতে লেখে *উত্তম কুমার - ভারতীয় সিনেমার কিংবদন্তি।
- কলকাতা মেট্রোর টালিগঞ্জ অঞ্চলের স্টেশনটির নাম রাখা হয়েছে "মহানায়ক উত্তমকুমার মেট্রো স্টেশন"।
- ২০০৪ সালে টালিগঞ্জের ট্রাম্প ডিমোর পাশে তাঁর একটি লাইফ সাইজ মুর্তি তৈরী করা হয়। পরে ২০১৭ সালে তাঁর জন্মস্থান ভবানীপুরে একটি মূর্তি নির্মাণ করা হয়। এছাড়া ২০২০ সালে তাঁর নামে বর্ধমান শহরেও প্রায় দেড় লক্ষ টাকা ব্যয়ে শ্বেত পাথরের একটি সাড়ে ছয় ফুটের মূর্তি তৈরী করা হয়।
- ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর নামাঙ্কিত "মহানায়ক" খেতাব দেওয়া হয় চলচ্চিত্রে আজীবন স্বীকৃতির জন্য।
- টালিগঞ্জে তাঁর নামাঙ্কিত একটি অডিটোরিয়াম আছে যা মহানায়ক উত্তম মঞ্চ নামে পরিচিত। এটি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে এটি কলকাতা মিনিসিপাল কর্পোরেশনের অর্ন্তগত।
- ১৯৮১ সালে তাঁর মৃত্যুর একবছর পরথেকে তাঁর মৃত্যুদিনে প্রত্যেক বছর পর তাঁর নামে "উত্তম কুমার পুরস্কার" দেওয়া হয়।
জনপ্রিয় সংস্কৃতি ও মিডিয়ায়
১৯৭৩ সালে একটি বিখ্যাত বাংলা ছবি বসন্ত বিলাপ সিনেমায় কিংবদন্তি অভিনেতা চিন্ময় রায় উত্তম কুমারের উপর একটি সংলাপ বলেন - একবার বলো আমি উত্তম কুমার। এই সংলাপটি রাখা হয় মুলত উত্তমের জনপ্রিয়তা ও তার ক্যারিশমার জন্য ও তাঁকে সম্মান জানিয়ে।
অনেকপরে ২০০৯ সালে চিন্ময় উত্তম কুমারের ৮৩তম জন্মদিনে তাঁকে উৎসর্গ করে একটি ছবি বানান যার নাম একবার বলো উত্তম কুমার।
২০১৬ সালে প্রথমবার তাঁর জীবনী নিয়ে কাজ হয় একটি ধারাবাহিক যার নাম মহানায়ক। এই ধারাবাহিকটিতে তাঁর চরিত্রে অভিনয় করেন বিখ্যাত বাঙালি অভিনেতা প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জী এর প্রযোজনাও তিনিই করেন। মোট ১১৬টি পর্ব হয় এর এবং স্টার জলসায় সম্প্রচারিত হয়।
২০১৯ সালে উত্তম কুমারের জীবনের একটি বিতর্কিত মুহুর্ত নিয়ে ছবি হয় যেটির নাম মহালয়া। ১৯৭৬ সালে বেতারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জায়গায় উত্তম কুমারের মহালয়া চন্ডীপাঠ করা নিয়ে যে বিতর্ক তৈরী হয় ছবিটা সেটা নিয়েই। এখানে উত্তম কুমারের চরিত্রে অভিনয় করেন যীশু সেনগুপ্ত।
২০২১ সালে কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী নিয়ে তৈরী ছবি অভিযানে উত্তম কুমারের অংশ রাখা হয় যেখানে উত্তম কুমারের চরিত্রটি করেন আবারও প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি।
২০২২ সালে উত্তম কুমারের জীবনের কিছু অজানা ঘটনা গুলো নিয়ে তৈরী হয় অচেনা উত্তম ছবি। যেখানে উত্তম কুমারের ভুমিকায় ছিলেন শাশ্বত চ্যাটার্জি। এছাড়াও জাতীয় পুরস্কার জয়ী পরিচালক সৃজিত মুখার্জী একটি অত্যাশর্য ছবি বানাচ্ছেন যার নাম অতি উত্তম ছবিটি একটি অভিনব পর্যায় নির্মাণ করা হয়েছে। ছবিতে উত্তম কুমারের প্রায় ৫৬টি সিনেমার ভিডিও ফুটেজ নতুন ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে মনে হবে খোদ উত্তম কুমারই অভিনয় করছেন। অর্থাৎ এই ছবিতে স্বয়ং উত্তম কুমার অভিনয় করতে চলেছেন নিছের চরিত্রেই।
ইউটিউবে তাঁর নামাঙ্কিত একটি সরকারি চ্যানেল আছে যার নাম Uttam Kumar Movies. চ্যানেলটি ২০১১ সালে খোলা হয়। এখানে উত্তম কুমারের বিভিন্ন ছবি ও ছবির গান প্রকাশ করা হয়। বর্তমানে এই চ্যানেলটিতে প্রায় পাঁচ লক্ষের কাছাকাছি সাবস্ক্রাইবার আছে। এছাড়াও তাঁর ছবি গুলির জন্য একটি অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম আছে যাঁর নাম Klikk।
তাঁকে নিয়ে অনেক বই ও ম্যাগাজিন ছাপা হয়েছে। যার মধ্যে ২০২১ সালে একটি বই Uttam Kumar - A Life in Cinema অন্যতম। এর লেখক হলেন তাঁর ভক্ত সায়নদেব চৌধুরী।
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
- "'ফ্লপমাস্টার' থেকে 'মহানায়ক'"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ২০১৪-০৭-২৪। সংগ্রহের তারিখ ২১ জুলাই ২০১৪।
- "ইন্দিরা সিনেমায় সত্যজিতের ভাবনায় তৈরি করা হয় 'নায়ক' ছবির ব্যানার"। দ্য ওয়াল (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২১-০৫-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৫-১১।
- কর, প্রদীপ; ডটকম, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর। "কে পারতেন আর, উত্তমকুমার ছাড়া?"। bangla.bdnews24.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৫-১১।
- "চিড়িয়াখানার তুমি কী জানো"। আনন্দবাজার পত্রিকা। ২০২১-০২-১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৫-১১।
- http://www.thedailysangbad.com/print_news.php?news_id=6744&pub_no=72%5B%5D
বহিঃসংযোগ
- ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেজে উত্তম কুমার (ইংরেজি)