উকিল মুন্সী

উকিল মুন্সী (১১ জুন ১৮৮৫ - ১২ ডিসেম্বর ১৯৭৮) একজন বাঙালি বাউল সাধক। তার গুরু ছিলেন আরেক বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন[1] তার অসংখ্য গানের মধ্যের আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে, সোনা বন্ধুয়া রে এতো দুঃখ দিলে তুই আমারে উল্লেখযোগ্য।

উকিল মুন্সী
জন্ম
আব্দুল হক আকন্দ

(১৮৮৫-০৬-১১)১১ জুন ১৮৮৫
মৃত্যু১২ ডিসেম্বর ১৯৭৮(1978-12-12) (বয়স ৯৩)
জাতীয়তাবাংলাদেশী
পেশাবাউল
পরিচিতির কারণগীতিকবি
দাম্পত্য সঙ্গীহামিদা খাতুন
সন্তানসাত্তার মুন্সী (ছেলে)

জীবনী

নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুড়ির নূরপুর বোয়ালীগ্রামে ১৮৮৫ সালের ১১ জুন একটি ধনাঢ্য মুসলিম পরিবারে উকিল মুন্সী জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক নাম আব্দুল হক আকন্দ।[2] তার পিতার নাম গোলাম রসুল আকন্দ ও মাতা উকিলেন্নেসা।[3] শৈশবে তিনি ঘেটুগানে যোগ দেন। পরে গজল ও পরিণত বয়স থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাউল সাধনায় লিপ্ত থাকেন।[4] তার গজল গানের সূত্রপাত হয় তরুণ বয়সে। তার চাচা কাজী আলিম উদ্দিনের বাড়ি মোহনগঞ্জ থানার জালালপুর গ্রামে বেড়াতে যান। সেখানে ধনু নদী পারের এক গ্রামের লবু হোসেনের মেয়ে হামিদা খাতুনের (লাবুশের মা) প্রেমে পড়ে যান তিনি। এই প্রেম নিয়ে তিনি লিখেন "উকিলের মনচোর" নামক একটি গান। তার চাচা এই প্রেমের কথা জানার পর হামিদার বাবা সাধারণ কৃষক হওয়ায় তাকে পরিবার থেকে বাঁধা দেন। তিনি বাড়ি ছেড়ে শ্যামপুর, গাগলাজোর, জৈনপুরে ঘুরে বেড়ান। ১৯১৫ সালে জালালপুর গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে মোহনগঞ্জের বরান্তর গ্রামের এক মসজিদে ইমামতি ও আরবি পড়ানোর কাজে নিযুক্ত হন। এই সময়ে ইমামতির পাশাপাশি গজল লিখতেন এবং রাত জেগে তা গাইতেন।[4] এতে বিরক্ত হয়ে এক ব্যক্তি পুলিশের কাছে নালিশ করে। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যেতে আসলে উকিল পুলিশ নিয়ে গান ধরেন। সে গানে পুলিশ তার নিজের ভিতরে লুকোনো কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় এবং পরে কয়েকটি পালাগানের মঞ্চে উকিলের গান শুনে পুলিশ উকিলের মুরিদ হয় যায়।[5] ১৯১৬ সালে হামিদা খাতুনের আগ্রহে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের এক পুত্র, সাত্তার মুন্সী।[2]

উকিল মুন্সীর গান


আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে
উকিল মুন্সী
পুবালী বাতাসে-

বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি

আমার নি কেউ আসে রে।।

যেদিন হতে নতুন পানি

আসল বাড়ির ঘাটে

অভাগিনীর মনে কত শত কথা উঠে রে।।

কত আসে কত যায় রে

নায় নাইওরির নৌকা

মায়ে ঝিয়ে বইনে বইনে

হইতেছে যে দেখা রে।।

আমি যে ছিলাম ভাই রে

বাপের গলায় ফাঁস

আমারে যে দিয়া গেল

সীতা বনবাস রে।।

আমারে নিল না নাইওর

পানি হইতে তাজা

দিনের পথ আধলে যাইতাম

রাস্তা হইত সোজা রে।।

ভাগ্য যাহার ভাল নাইওর

যাইবে আষাঢ় মাসে

উকিলেরই হইবে নাইওর

কার্তিক মাসের শেষে রে।[6]

উকিল মুন্সীর অনেক জনপ্রিয় গান আজও উচ্চারিত হয় সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গানঃ[6]

  • 'নবীজির খাশ মহলে'
  • 'হায়রে লুকাইয়া কয়দিন রই'
  • 'বন্ধু বিফলে গেল নব যৌবন'
  • 'সোনা বন্ধুয়া রে এতো দুঃখ দিলে তুই আমারে'
  • 'এসো হে কাঙালের বন্ধু'
  • 'বিদেশী বন্ধুরে রূপ দেখাইয়া'
  • 'ভেবেছিলাম রঙে দিন যাবেরে সুজন নাইয়া'
  • 'ও কঠিন বন্ধুরে……'
  • 'আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে'
  • 'বন্ধু আমার দিনদুনিয়ার ধন-রে'
  • 'সখী গো……….'
  • 'আর কি অলি আমার বসিবে ফুলে'
  • 'আমার শ্যাম শোক পাখি গো'
  • 'প্রাণ সখিগো……..'
  • 'সে যে আড়ালে থাকে, উঁকি দিয়া দেখে'
  • 'পিরিত ও মধুর পিরিত'
  • 'আমার কাংখের কলসী গিয়াছে ভাসি'
  • 'রজনী প্রভাত হল ডাকে কোকিলা'
  • 'কাহার নামে বসবেন খোদা'
  • 'দীন দুনিয়ার বাদশা তুমি, উম্মতের জামিন'

পরলোক গমন

১৯৭৮ সালের মাঝামাঝিতে উকিল মুন্সীর স্ত্রী হামিদা খাতুন এবং এর কয়েক মাস পর ছেলে সাত্তার মুন্সী মৃত্যুবরণ করেন। সে বছরই তিনি অসুস্থ হয়ে ১২ ডিসেম্বরে মৃত্যুবরণ করেন।[2] নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের জৈনপুরে বেতাই নদীর পারে চিরনিদ্রায় শায়িত হন উকিল মুন্সি।[3]

উকিল মুন্সী স্মৃতিকেন্দ্র

উকিল মুন্সীর স্মৃতিরক্ষা এবং সমাধিস্থল সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। নেত্রকোণার মোহনগঞ্জে জৈনপুর গ্রামে স্মৃতি সমাধি, ব্রিজ, সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণসহ নানা কাজে ২৮ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ ২০২০ থেকে শুরু হয়েছে। এতে একাডেমি ভবন, সমাধিস্থল সংস্কার, সীমানা দেয়াল, সংগ্রহশালা ও উকিল মুন্সী চত্বর নির্মাণাধীন। উকিল মুন্সী বসতবাড়ীগামী জৈনপুরে আড়াই কিলোমিটার রাস্তা, মরা বেতাই নদীতে ব্রিজ নির্মাণকাজ চলমান। উকিল মুন্সী সমাধিস্থলে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে বেতাই নদীতে আরও দুটি ব্রিজ নির্মাণ এবং উকিল বাজার হতে উকিল মুন্সী সমাধিস্থলে সহজে পৌঁছতে আরেকটি ব্রিজ নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন।[7]

জনপ্রিয় মাধ্যমে উকিল মুন্সী

তার অনেক গান বাংলা চলচ্চিত্রে সংযোজন হয়েছে। ১৯৯৯ সালে কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের রচনা ও পরিচালনায় নির্মিত শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রে বারী সিদ্দীকীর কণ্ঠে ব্যবহার করেন উকিলের গান। বিংশ শতাব্দীর গ্রামীণ বাংলার জীবনকে নিয়ে রচিত হুমায়ুন আহমেদের বহুকেন্দ্রিকা উপন্যাস মধ্যাহ্ন-এর অন্যতম চরিত্র উকিল মুন্সী। লোকশিল্পী মমতাজ তার সুললিত কন্ঠে " সুজন বন্ধু রে আরে ও বন্ধু, কোন বা দেশে থাকো, এই দাসীরে কান্দাইয়া রে, কোন দাসীর মন রাখো সুজন বন্ধুরে " এই গানটি গেয়ে জনপ্রিয় করে তোলেন।

নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের জৈনপুর গ্রামে উকিল মুন্সীর স্মরণে তার জীবন ও গান নিয়ে আলোচনা, প্রবন্ধ পাঠ, তার রচিত জনপ্রিয় গানের সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে "উকিল মুন্সী স্মৃতি সংসদ"।[8]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. "'উকিল মুন্সী-শাহ আ. করিমের গুরু ছিলেন বাউল রশিদ'"ঢাকা টাইমস। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬। ১৯ আগস্ট ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ জানুয়ারি ২০১৭
  2. সুজন, ওয়াহিদ (৯ জুন ২০১৬)। "উকিলের মনচোর"সাম্প্রতিক দেশকাল। ২৭ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ নভেম্বর ২০১৬
  3. হোসেন আজাদ, আলী এরশাদ (৪ জানুয়ারি ২০১৯)। "ভাটি বাংলার বিস্ময় উকিল মুন্সি"দৈনিক কালের কণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ১২ মার্চ ২০২১
  4. আকবর, মুহম্মদ (১৭ জুন ২০১৬)। "উকিল মুন্সীর প্রাসঙ্গিকতা"দৈনিক জনকণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ২৮ জানুয়ারি ২০১৭
  5. আকবর, মুহম্মদ (১০ জুন ২০১৬)। "সমকালীন সংকট ও উকিল মুন্সীর প্রাসঙ্গিকতা"দ্য রিপোর্ট। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
  6. কবির মাহবুব
  7. সরকার, ইন্দ্র (২০ জুলাই ২০২০)। "উকিল মুন্সী স্মৃতিরক্ষা প্রকল্পের কাজ শুরু"আমাদের সময়। সংগ্রহের তারিখ ১২ মার্চ ২০২১
  8. "উকিল মুন্সী স্মরণে"দৈনিক প্রথম আলো। মার্চ ১২, ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২ নভেম্বর ২০১৬

আরও পড়ুন

বহিঃসংযোগ

    বাংলা মুভি ডেটাবেজে উকিল মুন্সী

    This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.