ঈসা খান
ঈসা খান (মধ্যযুগীয় বাংলা: ঈশা খাঁ, আনু. ১৫২৯ – সেপ্টেম্বর ১৫৯৯) ছিলেন ১৬ শতকের বাংলার বারো ভূঁইয়া সর্দারদের একজন এবং খিজিরপুর (সোনারগাঁও) অঞ্চলের জমিদার।[1] তাঁর শাসনামলে তিনি সফলভাবে বাংলার ভূস্বামীদের একত্রিত করেন এবং বাংলায় মুঘল আক্রমণ প্রতিহত করেন। তাঁর মৃত্যুর পরই এই অঞ্চলটি সম্পূর্ণ মুঘলদের অধীনে চলে যায়।।
ঈসা খান ঈশা খাঁ | |
---|---|
মসনদ-এ-আলা | |
![]() | |
বাংলার বারো ভুঁইয়াদের নেতা | |
রাজত্ব | ১৫৭৬–১৫৯৯ |
উত্তরসূরি | মুসা খাঁ |
জন্ম | ১৫২৯ খ্রিষ্টাব্দ সরাইল, ভাটি অঞ্চল, সুলতানি বাংলা (বর্তমানে সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বাংলাদেশ) |
মৃত্যু | সেপ্টেম্বর, ১৫৯৯ (৭০ বছর) ভাটি অঞ্চল |
দাম্পত্য সঙ্গী | ফতেমা খান সোনাবিবি |
বংশধর | মুসা খাঁ দাঊদ খাঁ মাহমূদ খাঁ আব্দুল্লাহ খাঁ |
প্রাসাদ | জঙ্গলবাড়ি দূর্গ |
পিতা | সোলেমান খাঁ |
মাতা | সৈয়দা মোমেনা খাঁতুন |
ধর্ম | সুন্নি ইসলাম |

ঈসা খানের জন্ম সুলতানি শাসনভুক্ত ভাটি অঞ্চলের সরাইলে। ১৫৭৬ সালে সম্রাট আকবর বাংলা বিজয়ের পর ভাটি অঞ্চলের সুরক্ষার স্বার্থে বাংলা প্রভাবশালী জমিদারদের একত্রিত করে মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, যাঁরা বারো ভূঁইয়া নামে পরিচিত। তখন সম্রাট আকবরের তাঁর বেশ কয়েকজন সেনাপতিকে পর্যায়ক্রমে ঈসা খানকে পরাজিত করতে পাঠান কিন্তু ঈসা খানের সাথে যুদ্ধে তাঁরা সকলে যুদ্ধে পরাস্ত হন। ঈসা খানের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় দুই দশকেরও বেশি সময় মুঘলরা শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি।
ঈসা খানের বাড়ি বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে অবস্থিত। তিনি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার সেইসময়ের জমিদার কুইচ রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করে বাড়িটি র্নিমান করেন। ঈসা খানের অনেক নিদর্শন কিশোরগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। মধ্যযুগীয় বাংলার একজন প্রভাবশালী স্বাধীনতাকামী হিসেবে ঈসা খান আজও বাংলাদেশে সমাদৃত হন। চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বৃহত্তম ঘাঁটি বানৌজা ঈসা খান তাঁর নাম বহন করে।
প্রারম্ভিক জীবন
ঈসা খানের দাদা ভগীরথ বাইস গোত্রের রাজপুত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি অযোধ্যা থেকে বাংলায় আসেন এবং বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ (রাজত্বকাল: ১৫৩৩–১৫৩৮) এর অধীনে দেওয়ানের চাকরি গ্রহণ করেন। তাঁর পুত্র কালিদাস গজদানি তাঁর মৃত্যুর পরে এই পদটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে সুফি সৈয়দ ইব্রাহীম দানিশমান্দের নির্দেশনায় গজদানি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সোলেমান খাঁ নামে নতুন নাম রাখেন।[2]
তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ’র (১৫৩৩–৩৮) মেয়ে সৈয়দা মোমেনা খাঁতুনকে বিয়ে করে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার সরাইল পরগণা ও পূর্ব মোমেনশাহী অঞ্চলের জমিদারি লাভ করেন।[3]
১৫২৯ সালে সরাইল পরগণায় ঈসা খান জন্ম গ্রহণ করেন। ১৫৪৫ সালে শের শাহ সুরির পুত্র ইসলাম শাহ সুর সাম্রাজ্যের সম্রাট হবার পর সোলেমান খান সম্রাটের আনুগত্য অস্বীকার করলে কৌশলে তাঁকে হত্যা করে তাঁর দুই অপ্রাপ্তবয়স্ক পুত্র ঈসা খান এবং ইসমাইল খানকে একদল তুরানি বণিকের নিকট বিক্রি করা হয়। ১৫৬৩ সালে ঈসা খানের চাচা কুতুব খাঁ রাজকার্যে নিযুক্তি লাভ করে বহু অনুসন্ধানের পর তুরানের এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে ২ ভ্রাতুস্পুত্রকে উদ্ধার করেন। এ সময় ঈসা খানের বয়স ছিল ২৭ বছর।
১৬ শতকের ঐতিহাসিক এবং আকবরনামার লেখক আবুল ফজলের মতে:
ঈসা খানের পিতার জন্ম বাইসে। তিনি বিদ্রোহ করেন এবং পরে ইসলাম শাহ সুরির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত হন। ইসলাম শাহ সুরির মৃত্যুর পর তাজ খান কররানী বাংলা শাসন করেন। ঈসা খানের মামা কুতুবউদ্দিন তাজ খানের অধীনে তার অবস্থান সুসংহত করেন। কুতুবুদ্দিন তখন তুরান অঞ্চল থেকে দুই ভাইকে নিয়ে আসেন। ঈসা খান ধীরে ধীরে কররানী শাসকদের অধীনে তার অবস্থান শক্ত করেন।[4][5]
ক্ষমতায় আরোহণ
বাংলার সুলতান তাজ খান কররানী (১৫৬৪-৬৫) ১৫৬৪ সালে সিংহাসনে আরোহণ করলে ঈসা খানকে তাঁর পিতার জমিদারি ফেরত দেওয়া হয়। বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খান কররানীর রাজত্বকালে (১৫৭২-৭৬) ঈসা খান বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করেন। ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দাউদ খান কাররানীকে ত্রিপুরার মহারাজা উদয় মানিক্যের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম অভিযানে সহায়তা করেন। মুঘলদের বাংলা জয়ের পূর্বে ঈসা খান ১৫৭৫ সালে সোনারগাঁও সংলগ্ন এলাকা থেকে মুঘলের নৌবাহিনীকে বিতাড়িত করতেও দাউদ খানকে সহায়তা করেছিলেন।
একটি কামানের শিলালিপি থেকে জানা যায় যে ১৫৯৩–১৫৯৪ সাল নাগাদ ঈসা খান মসনদ-ই-আলা উপাধি ব্যবহার করছিলেন। ধারণা করা হয়, দাউদ খানের প্রতি আনুগত্যের জন্য ঈসা খান উপাধিটি লাভ করেন।[6] ইতিহাসবিদ আবদুল করিম বিশ্বাস করেন যে তিনি ১৫৮১–১৫৮২ সালের কিছু সময় পরে এই উপাধিটি গ্রহণ করেছিলেন।[7]
সামরিক অভিযান
১৫৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুর হতে ১২ মাইল দূরে ঈসা খান মাসুম খান কাবুলির সম্মিলিত বাহিনী দুর্জন সিংহকে বাধা দিলে দুর্জন সিংহ বহু মুঘল সৈন্যসহ নিহত হন এবং অনেকে বন্দী হন। কিন্তু এই যুদ্ধের পর ঈসা খান মুঘলদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন এবং আগ্রায় গিয়ে সম্রাট আকবরের সাথে সাক্ষাত করেন। সম্রাট আকবর তাঁকে দেওয়ান ও মসনদ-ই-আলা উপাধিতে ভূষিত করেন।
মৃত্যু
ঈসা খান বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে অন্যতম কেদার রায়ের বিধবা কন্যা স্বর্ণময়ীকে অপহরণ করলে ক্রুদ্ধ কেদার রায় ঈসা খানের রাজধানী আক্রমণ করেন । কেদার রায়ের আক্রমণে ঈসা খান প্রাণভয়ে মেদিনীপুর পালিয়ে যান।[8] কেদার রায় ঈসা খানের প্রায় সম্পূর্ণ জমিদারির দখল নিয়ে নেন। ঈসা খান অজ্ঞাত রোগে তার স্ত্রী ফাতেমা খানের বাড়ি ফুলহরি (ফুলদি) জমিদার বাড়ি ১৫৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মারা যান। পরবর্তীতে তার শশুর জমিদার মুন্সী মুহাম্মদ নাসির খানের শাসনাধীন মৌজা বক্তিয়ারপুর (বক্তারপুর) বাজারের সন্নিকটে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত বক্তারপুর নামক গ্রামে তার সমাধি রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঈসা খানের সমাধিস্থলটিকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগে নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র
- বাংলাপিডিয়া
- Hussainy Chisti, Syed Hasan Imam (১৯৯৯)। Sylhet : history and heritage। Sharif Uddin Ahmed (১ম সংস্করণ)। Dhaka: Bangladesh Itihas Samiti। পৃষ্ঠা ৬০০। আইএসবিএন 984-31-0478-1। ওসিএলসি 43324874।
- AA Sheikh Md Asrarul Hoque Chisti। "Isa Khan"। Banglapedia: The National Encyclopedia of Bangladesh। Asiatic Society of Bangladesh। ২৮ মার্চ ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ মে ২০১৫।
- Akbarnama, Volume III, Page 647
- Chowdhury, Kamal (২০০৫)। Banglar Baro Bhuiyan and Maharaj Pratapaditya। পৃষ্ঠা 163।
- Karim, Abdul (১৯৯২)। History of Bengal: From the fall of Daud Karrani, 1576 to the death of Jahangir, 1627 (ইংরেজি ভাষায়)। Institute of Bangladesh Studies, University of Rajshahi।
- Abdul Karim (১৯৯২)। History of Bengal: Mughal Period। 1। Institute of Bangladesh Studies, University of Rajshahi। পৃষ্ঠা 84–85। ওসিএলসি 28183749।
- মেদিনীপুরের ইতিহাস, যোগেন্দ্রনাথ বসু