ঈসা
ঈসা ইবনে মারইয়াম (আরবি: عيسى, প্রতিবর্ণী. ʿĪsā) ইসলাম ধর্মে একজন অদ্বিতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ নবী ও রাসূল (আল্লাহ বা একেশ্বরের বার্তাবাহক ও প্রচারক) হিসেবে স্বীকৃত।[1] ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনে ঈসা আঃ ও তার মা মারইয়াম আঃ(মেরী) সম্পর্কে অনেক বর্ণনা দেওয়া আছে। ইসলামে ঈসা আঃ কে "মাসীহ্" উপাধি দেওয়া হয়েছে, মশীহ বা মসীহ (হিব্রু ভাষায়: מָשִׁיחַ; গ্রিক: μεσσίας, আরবি: مسيح) ইব্রাহিমীয় ধর্ম অনুসারে জনগোষ্ঠীর ত্রাণকর্তা বা রক্ষাকারী। কুরআন ও হাদিসে "সময়ের সমাপ্তি" সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনাবলির এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেন ঈসা আঃ। আল কুরআনে ঈসা আঃ এর মা মরিয়ম আঃ কে উপজীব্য করে একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় বা সুরা রয়েছে, যার নাম সুরা মারইয়াম। ঈসা আঃ ইবনে মারিয়াম আঃ পূনরায় পৃথিবীতে আগমণ করবেন। নবী হজরতʿঈসা আঃ عِيسَىٰ মসীহ আলাইহিস সালাম দুজন ফেরেশতার মাধ্যমে পিঠে ভর করে সিরিয়ার দামেস্ক শহরের দিকে নেমে আসবেন। ধারণা করা হয় তাকে ৪র্থ আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। তৃভূবনের সর্বশেষ ফেতনা সৃষ্টিকারী দাজ্জালকে হত্যা করতেই তিনি আগমণ করবেন। প্রায় চল্লিশ বছর রাজত্ব করবেন। পৃথিবী তখন ফুলে, ফসলে নতুন এক জান্নাতের রুপ ধারণ করবে। সকলে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে। ঈসা আঃ তার খ্রিস্টধর্ম অনুসারীদের বিশ্বাসঘাতক বলে তাড়িয়ে দিবেন। ভুল ব্যাখ্যা আর মিথ্যায় জর্জরিত সেন্ট পলের পরিবর্তনকারী 'নিউ টেস্টামেন্ট' এর গুরুত্ব কমে যাবে।
ʿঈসা عِيسَىٰ | |
---|---|
জন্ম | আনু. ৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
অন্তর্ধান | আনু. ৩০–৩৩ খ্রিস্টাব্দ গেৎশিমানী, যিরূশালেম, রোমান সাম্রাজ্য |
অন্যান্য নাম | ঈসা ইবনে মরিয়ম (عِيسَى ٱبْنُ مَرْيَمَ) আল-মসীহ (المسيح) আল-মসীহ ঈসা (المسيح عيسى) রুহুল্লাহ (رُوحِ ٱللَّهِ) কালিমাতুল্লাহ (كَلِمَةٍ ٱللَّهِ) (χριστός) |
পরিচিতির কারণ | ইঞ্জিল (সুসমাচার) |
পূর্বসূরী | ইয়াহিয়া (বাপ্তিস্মদাতা যোহন) |
উত্তরসূরী | মুহাম্মদ |
পিতা-মাতা | মরিয়ম |
আত্মীয় | যাকারিয়া (সখরিয়) ইয়াহিয়া (বাপ্তিস্মদাতা যোহন) |
জন্ম
আল কুরআনে বর্ণিত অন্যান্য নবীদের মতোই নবী ঈসা আঃ কেও "আল্লাহ্র (একেশ্বরের) বাণী", "আল্লাহ্র ভৃত্য", "আল্লাহ্র বার্তাবাহক", ইত্যাদি নামে ডাকা হয়েছে। কিন্তু যে কারণে তিনি (ঈসা আঃ) ব্যতিক্রম, তা হলো তার অলৌকিক জন্মগ্রহণ। কুরআনে ঈসা আঃ এর জন্মকে ইতিহাসের প্রথম মানব আদম আঃ এর সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সাথে তুলনা করে বলা হয়েছে, ঈসা আঃ প্রতিকৃতি ছিল আদম আঃ প্রতিকৃতির মতোই। আদম আঃ এর মতোই ঈসা আঃ ও আল্লাহর "হয়ে যাও" [আরবিতে "কুন"] আদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তবে ইসলামে বর্ণিত ঈসা আঃ এর জন্মকাহিনী খ্রিস্টধর্মে বর্ণিত যিশুর জন্মকাহিনী থেকে কিছুটা ভিন্ন। কুরআন অনুযায়ী মারিয়াম আঃ (ঈসা আঃ এর মাতা) মরুভূমিতে গিয়ে একটি পামবৃক্ষের ছায়ায় অনেক কষ্ট স্বীকার করে ঈসা আঃ কে জন্ম দেন। এছাড়াও, কুরআন অনুযায়ী ঈসা আঃ পিতৃহীনভাবেই জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পূর্বে মারিয়াম আঃ কে ফেরেশতা জিব্রাইল আঃ এসে আল্লাহর পক্ষ থেকে ঈসা আঃ কে জন্মের সুসংবাদ প্রদান করেন। যদিও খ্রিস্টানরা মনে করে, ঈসা আঃ বা যিশুর জন্ম পিতৃহীনভাবে নয়, বরং ঈশ্বর (আল্লাহ্) তার পিতা ছিলেন। উল্লেখ্য, মুসলিমরা এই ধারণাটিকে শিরক (অর্থাৎ, এক ও অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে তুলনা) হিসেবে সাব্যস্ত করে এবং মুসলিমদের চোখে, এরকম বিশ্বাস ধর্মদ্রোহীতার শামিল।
দেবত্ব
কুরআনে ঈসা আঃ এর জন্মকে অলৌকিক বলা হলেও তার দেবত্ব বা "ঈশ্বরের পুত্রসন্তান" জাতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ইসলামে একেশ্বর আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে উপাস্য মনে করা একটি গুরুতর পাপ, যার নাম "শিরক" ("ঈশ্বরের অংশীদারিত্ব" পাপ)। যদিও খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে ঈশ্বরের তিন রূপের কথা বলা নেই (পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা), তা সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্মের একটি অন্যতম বিশ্বাস ঈশ্বরের ত্রিত্ববাদকে কুরআনে কঠোর ভাষায় "ঈশ্বরনিন্দা" হিসেবে তিরস্কার করা হয়েছে। ঈসা আঃ কে প্রায়শই আল কুরআনে মারিয়াম আঃ এর পুত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে ঈসা আঃ এর মানবত্বকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ঈসা আঃ এর বংশপরিচয় তার মা মরিয়াম আঃ এর মাধ্যমে ইসরায়েলি গোত্রের ইব্রাহিম আঃ এর পুত্র ইসহাক আঃ এর সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।
অলৌকিকতা
কুরআন ও বাইবেল উভয় গ্রন্থেই ঈসা আঃ বা যিশুর মু‘জিযাহ্ (অলৌকিকতা)-র কথা বর্ণিত হয়েছে। ঈসা আঃ কয়েকমাস বয়সেই কথা বলা শিখে গিয়েছিলেন। তিনি মৃত ব্যক্তিকে হাতের স্পর্শে জীবিত করতে পারতেন, ধবল-কুষ্ট রোগে আক্রান্তদেরকে ঠিক করে দিতে পারতেন, এবং অন্ধ ব্যক্তিদের দৃষ্টি শক্তি প্রদান করতে পারতেন। এছাড়াও কুরআনের বর্ণনামতে পিতৃহীন জন্ম তার অলৌকিকতার অন্যতম নিদর্শন।
ক্রুশবিদ্ধকরণ
ঈসা আঃ এর ক্রুশবিদ্ধকরণের ব্যাপারেও কুরআনের বর্ণনা বাইবেল থেকে ভিন্ন। পবিত্র আল-কুরআন অনুযায়ী যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়নি।[2] কুরআনের ভাষ্যমতে, ঈসা আঃ এর অনুসারীরা তাকে ঈশ্বরপুত্র মনে করে ভুল বুঝে ছিল। আর তার সমগোত্রীয় ইস্রাইলিরা (বনি ইসরায়েল, যারা মূলত ছিল ইহুদি) তখন রোমানদের সহায়তায় ঈসা আঃ কে ক্রুশবিদ্ধ করার জন্য তাইতালানুস নামে এক বাহককে পাঠায় তাকে ধরে আনতে। রোমানরাও ঈসা আঃ এর মৃত্যু কামনা করছিল, কারণ রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্ম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল। খ্রিস্টধর্ম পালন করতে গেলে রোমান সম্রাটকে পূজা করা যায় না, যেটা ছিল রোমানদের নীতির বিরুদ্ধে। বাহক যখন তাকে নিতে ঘরে প্রবেশ করে তখনই আল্লাহ ঈসা আঃ কে উপরে তুলে নেন এবং বাহকের চেহারাকে ঈসা আঃ এর চেহারার অনুরুপ করে দেন। ফলে ঈসা আঃ মনে করে ঐ বাহককে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে মারা যাওয়ার আগেই আল্লাহ ঈসা আঃ কে তার দিকে আসমানে তুলে নেন অর্থাৎ তিনি আসমানে আরোহণ করেন।
আল্লাহ কর্তৃক ঈসা আঃ কে রক্ষা প্রসঙ্গে কুরআনের বাণী:
"এবং তারা চক্রান্ত করেছিল, আল্লাহও কৌশল করেছিলেন, আল্লাহ কৌশলীদের শ্রেষ্ঠ। স্মরণ করো, যখন আল্লাহ বললেন, হে ঈসা! আমি তোমার কাল পূর্ণ করছি এবং আমার নিকট তোমাকে তুলে নিচ্ছি এবং যারা কুফরী করেছে তাদের মধ্য হতে তোমাকে পবিত্র করছি। আর তোমার অনুসারীদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত কাফিরদের উপর প্রাধান্য দিচ্ছি। অতঃপর আমার কাছে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তারপর যে বিষয়ে তোমাদের মতান্তর ঘটছে। আমি তা মীমাংসা করে দিব।" [আলে-ইমরান: ৫৪-৫৫]
আল্লাহ আরও বলেন:
"এবং তারা লানতগ্রস্থ হয়েছিল তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্যে, আল্লাহর আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করার জন্যে, নবিগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার জন্যে এবং আমাদের হৃদয় আচ্ছাদিত, তাদের এই উক্তির জন্যে। বরং তাদের কুফরীর কারণে আল্লাহ তাতে মোহর মেরে দিয়েছেন। সুতরাং তাদের অল্প সংখ্যাক লোকই বিশ্বাস করে। এবং তারা লানতগ্রস্ত হয়েছিল তাদের কুফরীর জন্যে ও মারিয়ামের বিরুদ্ধে গুরুতর অপবাদের জন্যে। আর আমরা আল্লাহর রাসূল মারিয়াম-তনয় ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি— তাদের এই উক্তির জন্যে। অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি, ক্রুশবিদ্ধও করেনি, কিন্তু তাদের এরূপ বিভ্রম হয়েছিল। যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল, তারা নিশ্চয়ই তার সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এ সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ব্যতীত তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করেনি, এবং আল্লাহ তাকে তার নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তার মৃত্যুর পূর্বে তাকে বিশ্বাস করবেই এবং কিয়ামতের দিন সে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে।" [নিসা: ১৫৫-১৫৯]
মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে, ঈসা আঃ আকাশে জীবিত অবস্থায় বিরাজ করছেন এবং শেষ বিচারের দিনের আগে তিনি আবির্ভূত হবেন। তিনি আসবেন শেষ যুগে দাজ্জালকে ধ্বংস করতে।
পুনরাবির্ভাব
"এন্টি-ক্রাইস্ট" (মসীহ আদ-দাজ্জাল)-এর আবির্ভাব ও এ সংক্রান্ত অভ্যুত্থানে ঈসা আঃ এর ভূমিকা নিয়ে অনেক হাদিস আছে। বলা হয়েছে ঈসা আঃ এন্টি-ক্রাইস্টের আবির্ভাবের পরে ইসলামী নবী মুহাম্মাদ (সঃ) এর একজন উম্মত বা অনুসারী হিসেবে পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং তারপর এন্টি-ক্রাইস্টকে হত্যা করবেন। তখন তিনি হবেন মশীহ বা ত্রাণকর্তা (দাজ্জালীয় অশান্তি থেকে মুক্তিদানকারী) এবং তার সহযোগী হবেন ইমাম মাহদী। তারপর তিনি বিবাহ করবেন, তার সন্তান হবে, তারপর তিনি আরও ৪০ বছর জীবিত থাকবেন। তিনি সমস্ত পৃথিবীর শাসনভার গ্রহণ করবেন এবং পৃথিবীতে শান্তি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। সকল ক্রুশ ভেঙে ফেলবেন এবং সকল শূকর হত্যা করবেন। কুরআনে আছে, এইসময় খ্রিস্টানরা তাকে ঈশ্বর ভেবে তার উপাসনা করতে আসবে এবং তিনি খ্রিস্টানদের বিশ্বাসঘাতক বলে দূরে তারিয়ে দিবেন। সবশেষে তিনি একজন শাসক হিসেবে মৃত্যূবরণ করবেন এবং মুহাম্মদ (সঃ) এর সমাধি বা কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হবে। যে কারণে মদীনায় নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর কবরের পাশে তাকে কবর দেয়ার জায়গা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল যা এখনও বহাল আছে।
তথ্যসূত্র
- Smith, Cyril Glassé ; introduction by Huston (২০০১)। The new encyclopedia of Islam (Édition révisée. সংস্করণ)। Walnut Creek, CA: AltaMira Press। পৃষ্ঠা 239। আইএসবিএন 9780759101906।
- কুরআন ৪:১৫৭
আরও দেখুন
- যিশুর কুমারীগর্ভে জন্ম (খ্রিস্টধর্মে ঈসার ভূমিকার বর্ণনা)
- আদম