ইয়োহানেস কেপলার
ইয়োহানেস কেপলার বা জোহানেস কেপলার (জার্মান: Johannes Kepler) (২৭শে ডিসেম্বর, ১৫৭১ – ১৫ই নভেম্বর, ১৬৩০) একজন জার্মান গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও জ্যোতিষী। তিনি ১৭শ শতকের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব, বিখ্যাত হয়ে আছেন কেপলারের গ্রহীয় গতিসূত্রের কারণে। পরবর্তীকালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তার লেখা আস্ত্রোনমিয়া নোভা, হারমোনিকেস মুন্দি এবং এপিতোমে আস্ত্রোনমিয়াই কোপেরনিকানাই বইগুলির মধ্যে লেখা নীতিগুলিকেই তার সূত্র হিসাবে নামকরণ করেছেন। কেপলারের আগে গ্রহের গতিপথ জ্যোতিষ্কসমূহের খ-গোলক অণুসরণ করে নির্ণয় করা হত। কেপলারের পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন গ্রহগুলো উপবৃত্তাকার কক্ষপথ অণুসরণ করে। কেপলারের গ্রহীয় সূত্রগুলো আইজাক নিউটনের বিশ্বজনীন মহাকর্ষ তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল।
জোহানেস কেপলার | |
---|---|
জন্ম | স্টুটগার্টের নিকটে ভাইল ডেআ স্টাটের ফ্রি ইম্পেরিয়াল সিটি, হলি রোমান এম্পায়ার (বর্তমানে জার্মানির স্টুটগার্ট) | ২৭ ডিসেম্বর ১৫৭১
মৃত্যু | নভেম্বর ১৫, ১৬৩০ ৫৮) রেগেন্সবুর্গ, বাভারিয়ার ইলেক্টোরেট, হলি রোমান এম্পায়ার (বর্তমান জার্মানি) | (বয়স
মাতৃশিক্ষায়তন | টুবিঙেন বিশ্ববিদ্যালয় |
পরিচিতির কারণ | কেপলারের গ্রহীয় গতিসূত্র কেপলার কনজেকচার |
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন | |
কর্মক্ষেত্র | জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতিষ শাস্ত্র, গণিত এবং প্রাকৃতিক দর্শন |
প্রতিষ্ঠানসমূহ | ইউনিভার্সিটি অফ লিনৎস |
স্বাক্ষর | |
কর্মজীবনে কেপলার ছিলেন অস্ট্রিয়ার গ্রাৎস শহরে অবস্থিত একটি সেমিনারি স্কুলে গণিতের শিক্ষক যেখানে তিনি প্রিন্স হান্স উলরিখ ফন এগেনবের্গের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীতে পরিণত হন। এরপরে তিনি বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ট্যুকো ব্রাহের সহকারী হন এবং একসময় সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফ এবং তার দুই উত্তরসূরী মাটিয়াস ও দ্বিতীয় ফের্ডিনান্ডের রাজগণিতবিদ হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া অস্ট্রিয়ার লিনৎস শহরে গণিত পড়িয়েছেন এবং জেনারেল ভালেনস্টাইনের উপদেষ্টা হিসেবেও তিনি কাজ করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি আলোকবিদ্যার মৌলিক নীতি নিয়ে কাজ করেছেন, প্রতিসরণ দুরবিনের একটি উন্নততর সংস্করণ নির্মাণ করেন যার নাম বর্তমানে কেপলারীয় দূরবিন এবং তার সমসাময়িক গ্যালিলিও গ্যালিলেইয়ের দূরবিন বিষয়ক কাজ সম্পর্কে মন্তব্য করেন।
কেপলার যখন জীবিত ছিলেন তখন জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষ শাস্ত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না, কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল পদার্থবিজ্ঞানের। সেসময় পদার্থবিজ্ঞান ছিল প্রাকৃতিক দর্শনের একটি শাখা আর জ্যোতির্বিদ্যা ছিল লিবারেল আর্টসের অন্তর্ভুক্ত গণিতের একটি উপশাখা। কেপলারও তার আবিষ্কারগুলোকে ধর্মীয় যুক্তির মাধ্যমে সিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন, তিনি মনে করতেন ঈশ্বর একটি মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন এবং প্রাকৃতিক কার্যকারণ অণুসন্ধানের মাধ্যমেই কেবল সেই পরিকল্পনার কিছুটা বোঝা সম্ভব।[1] এজন্য বোধহয় কেপলারের গবেষণাকর্মকে জ্যোতির্বিজ্ঞান না বলে জ্যোতির্বিদ্যা বলাই বেশি যুক্তিসঙ্গত হবে। তিনি তার নতুন জ্যোতির্বিদ্যার নাম দিয়েছিলেন "খ-পদার্থবিদ্যা" (celestial physics)[2] যাকে বিবেচনা করা যেতে পারে এরিস্টটলের অধিবিদ্যার জগতে একটি বিশেষ অভিযাত্রা[3] এবং এরিস্টটলের "অন দ্য হ্যাভেনস" গ্রন্থের উত্তরখণ্ড হিসেবে।[4] মোটকথা, জ্যোতির্বিদ্যাকে সর্বজনীন গাণিতিক পদার্থবিদ্যার একটি শাখা হিসেবে বিবেচনা করে তিনি ভৌত বিশ্বতত্ত্বের সুপ্রাচীন প্রথাকে একটি নতুন আঙ্গিক দিয়েছিলেন।[5]
জীবনের প্রথম ভাগ
জোহানেস কেপলার ১৫৭১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর ভাইল ডেআ স্টাট নামক একটি মুক্ত সাম্রাজ্যের শহরে-তে জন্মগ্রহণ করেন। পবিত্র রোম সাম্রাজ্য-এ যে শহরগুলো কোন প্রিন্স নয় বরং সরাসরি সম্রাট কর্তৃক শাসিত হতো তাদেরকে মুক্ত সাম্রাজ্যের শহর বলা হতো। বর্তমানে শহরটি জার্মানির স্টুটগার্ট অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। তার পিতামহ সেবাল্ড কেপলার এই শহরের লর্ড মেয়র ছিলেন, কিন্তু কেপলারের জন্মের সময় তার দুই ভাই ও এক বোন ছিল এবং তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটছিল। তার বাবা হাইনরিশ কেপলারের ভাড়াটে সৈনিক জীবন ছিল আর্থিক অনিশ্চয়তায় ভরপুর, অবশ্য তার বয়স যখন ৫ বছর তখন তিনি পরিবার ছেড়ে চলে যান। নেদারল্যান্ডে সংঘটিত আশি বছরের যুদ্ধে তিনি মারা গিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। তার মা কাটারিনা গুল্ডেনমান ছিলেন সরাইওয়ালার মেয়ে, তিনি ভেষজ ঔষধ নিয়ে কাজ করতেন এবং ভিষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে ডাকিনীবিদ্যা চর্চার অভিযোগে তার বিচার হয়েছিল। গর্ভধারণের ৩৮তম সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগেই কেপলারের জন্ম হয়, যে কারণে শিশুকালে তিনি বেশ দুর্বল ছিলেন এবং নানা অসুখে ভুগতেন। অবশ্য মাতামহের সরাইখানার অনেক পথিককে সেই বয়সেই গণিতের দক্ষতা দেখিয়ে মুগ্ধ করে দিতেন।[6]
বেশ অল্প বয়সেই জ্যোতির্বিদ্যার সাথে পরিচিত হন এবং সারা জীবন জ্ঞানের এই শাখাটির প্রতি তার দুর্বলতা থেকে যায়। ৬ বছর বয়সে তিনি ১৫৭৭-এর মহা ধূমকেতু দেখেন, তার লেখা থেকে জানা যায় ধূমকেতুটি দেখার জন্য মা তাকে একটি উঁচু জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন।[7] ১৫৮০ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি আরও একটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন, এবার একটি চন্দ্রগ্রহণ। লেখা থেকে জানা যায় চন্দ্রগ্রহণ দেখার জন্য তাদেরকে বাইরে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং চাঁদটি লাল দেখাচ্ছিল।[7] কিন্তু শৈশবে গুটিবসন্ত রোগে তার দৃষ্টিশক্তি দুর্বল ও হাত খোঁড়া হয়ে যায়। এ কারণে পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিদ্যায় তার দক্ষতা বেশ কমে গিয়েছিল।[8]
কেপলার প্রথমে গ্রামার স্কুল, পরে লাতিন স্কুল ও মাউলব্রোনে অবস্থিত ইভানজেলিক্যাল সেমিনারিতে (রোমান ক্যাথলিক যাজকদের প্রশিক্ষণ কলেজ) পড়া শেষে ইউনিভার্সিটি অফ ট্যুবিঙেনের ট্যুবিঙার স্টিফ্ট-এ ভর্তি হন। এখানে তিনি ফিটুস ম্যুলারের অধীনে দর্শন[9] এবং ইয়াকব হিয়ারব্রান্ডের অধীনে ধর্মতত্ত্ব পড়েছেন। হিয়ারব্রান্ড মিখায়েল মায়েস্টলিনকেও পড়িয়েছিলেন যিনি পরবর্তীতে ট্যুবিঙেনের উপাচার্য এবং কেপলারের বড় পৃষ্ঠপোষক হন।[10] কেপলার এখানে চমৎকার গণিতবিদ এবং দক্ষ জ্যোতিষী হিসেবে খ্যাতি পান, এমনকি সহপাঠীদের রাশিচক্র গণনা করেও নাম কুড়িয়েছিলেন। মিখায়েল মায়েস্টলিনের দিক নির্দেশনায় তিনি গ্রহীয় গতি সম্পর্কে টলেমির ধারণা এবং কোপেরনিকুসের ধারণা দুটোই অধ্যয়ন করেন। সে সময় কিছুকালের জন্য কোপারনিকান হয়ে গিয়েছিলেন। ছাত্রদের একটি বিতর্কে সৌরকেন্দ্রিক মতবাদকে সমর্থন করে তিনি এর পক্ষে তাত্ত্বিক ও ধর্মীয় উভয় ধরনের যুক্তিই উপস্থাপন করেন, বলেন সূর্যই মহাবিশ্বের প্রধান গতিদায়ক ও প্রাণসঞ্চালক।[11] মন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও শিক্ষাজীবনের শেষ দিকে অস্ট্রিয়ার গ্রাৎসে অবস্থিত প্রোটেস্ট্যান্ট স্কুলে (যেটি পরবর্তীতে ইউনিভার্সিটি অফ গ্রাৎস হয়) গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। ২৩ বছর বয়সে ১৫৯৪ সালে তিনি পদটি গ্রহণও করে ফেলেন।[12]
গ্রাৎস (১৫৯৪–১৬০০)
মুস্তেরিয়ুম কসমোগ্রাফিকুম
কেপলারের প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রন্থ মুস্তেরিয়ুম কসমোগ্রাফিকুম (মহাবিশ্বের পবিত্র রহস্য) ছিল কোপার্নিকাসের বিশ্ব ব্যবস্থা প্রমাণের জন্য প্রকাশিত প্রথম বই। কেপলারের দাবী অনুসারে ১৫৯৫ সালের ১৯শে জানুয়ারি গ্রাৎসের একটি শ্রেণীকক্ষে রাশিচক্রে শনি ও বৃহস্পতি গ্রহের পর্যাবৃত্ত সংযোগ পড়ানোর সময় তার মনে এক স্বর্গীয় চিন্তা খেলে যায়; তিনি বুঝতে পারেন সুষম বহুভুজের অন্তর্বৃত্ত এবং পরিবৃত্ত যেমন বহুভুজটির সাথে সর্বদা একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে আবদ্ধ হয়, মহাবিশ্বের জ্যামিতিক ভিত্তিও সম্ভবত তেমন। এরপর অনেক ধরনের পরীক্ষা করেন, কিন্তু অতিরিক্ত গ্রহ যোগ করেও শেষ পর্যন্ত সুষম বহুভুজদের এমন কোন সমাবেশ পাননি যা তখন পর্যন্ত জানা জ্যোতিষ্কগুলোর গতিপথ ব্যাখ্যা করতে পারে। অগত্যা ত্রিমাত্রিক বহুতলক নিয়ে কাজ শুরু করেন। এভাবে আবিষ্কার করেন যে, পাঁচটি প্লেটোনীয় ঘনবস্তুকে খ-গোলকের মাধ্যমে অন্তর্লিখিত এবং পরিলিখিত করা যায়। তিনি বস্তুগুলোর একটিকে আরেকটির ভেতর স্থাপন করে প্রতিটিকে একটি অন্তর্বৃত্ত ও একটি পরিবৃত্ত দ্বারা আবদ্ধ করেন। এক বস্তুর অন্তর্বৃত্ত তার পরের বস্তুটির পরিবৃত্তের সাথে মিলে একটি খ-গোলক গঠন করে। এভাবে পাঁচটি বস্তুর জন্য মোট ছয়টি গোলক পাওয়া যায়। তখন পর্যন্ত জানা ছয়টি গ্রহকে (বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনি) কেপলার এই ছয় গোলকে স্থান করে দেন। অষ্টতলক, বিংশতলক, দ্বাদশতলক, চতুষ্তলক এবং ঘনক- এই বস্তু পাঁচটিকে সঠিক ক্রমে সাজিয়ে দেখেন, গোলকগুলোকে এমন দূরত্বে স্থাপন করা সম্ভব যাতে তা গ্রহীয় কক্ষপথের আপেক্ষিক আকারের প্রতিনিধিত্ব করে। অবশ্যই সে সময়কার জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দূরত্বের যে মান পাওয়া গিয়েছিল সেটাই তাকে ব্যবহার করতে হয়েছে। এমনকি কেপলার প্রতিটি গ্রহের খ-গোলকের সাথে তার কক্ষীয় পর্যায়কালের সম্পর্কসূচক একটি সূত্রও আবিষ্কার করে ফেলেন : ভেতর থেকে বাইরের দিকে যেতে থাকলে কক্ষীয় পর্যায়কালের বৃদ্ধি পরস্পরসংলগ্ন গ্রহ দুটির কক্ষীয় ব্যাসার্ধ্যের পার্থক্যের দ্বিগুণ। পরে অবশ্য সঠিক মান নির্ণয়ে সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনা করে তিনি এই সূত্রটি পরিত্যাগ করেছিলেন।[13]
বইয়ের শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় কেপলার ভেবেছিলেন তিনি মহাবিশ্বের জ্যামিতি নিয়ে ঈশ্বরের মহাপরিকল্পনা বুঝে ফেলেছেন। কোপের্নিকুসের বিশ্ব-ব্যবস্থা নিয়ে তার এত আগ্রহের কারণ ছিল মূলত আধ্যাত্মিক বা ধর্মতাত্ত্বিক, তিনি ভৌত বিশ্বের সাথে আধ্যাত্মিক জগৎের সম্বন্ধ খুঁজে পেতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি ভাবতেন মহাবিশ্ব নিজেই ঈশ্বরের একটি ছবি, যেখানে সূর্য পিতা, তারাসমূহের খ-গোলক পুত্র, আর মাঝের স্থানটুকু পবিত্র আত্মা। বাইবেলে ভূকেন্দ্রিক মতবাদ সমর্থন করা হচ্ছে মনে হলেও তিনি সৌরকেন্দ্রিক মতবাদের সাথে বাইবেলের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে মুস্টেরিয়ুমের প্রথম পাণ্ডুলিপিতে একটি পৃথক অধ্যায়ই লিখেছিলেন।[14]
তার পৃষ্ঠপোষক মিখায়েল মায়েস্টলিনের সমর্থন ও সাহায্যে তিনি ট্যুবিঙেন ইউনিভার্সিটি থেকে পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশের অণুমতি পান, তবে শর্ত ছিল বাইবেলের চুলচেরা বিশ্লেষণসমৃদ্ধ অধ্যায়টি বাদ দিয়ে তার বদলে কোপের্নিকুসের বিশ্ব-ব্যবস্থার একটি সহজবোধ্য ব্যাখ্যা ও তার নিজের নতুন ধারণাগুলোর সাধারণ পরিচিতি লিখতে হবে। ১৫৯৬ সালে বইটি প্রকাশিত হয়, ১৫৯৭-এ তিনি নিজের কপিগুলো হাতে পান এবং বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে পাঠাতে থাকেন। খুব বেশি পাঠকপ্রিয়তা না পেলেও বইটি কেপলারকে একজন উঁচুমানের জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। তার আত্মনিবেদন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় গ্রাৎসে তার পৃষ্ঠপোষকরা সন্তুষ্ট হয় এবং ভৌগলিকভাবেই তার পৃষ্ঠপোষকতা বেড়ে যায়।[15]
পরবর্তী কাজের সুবাদে বেশ কিছু পরিবর্তন আনলেও কেপলার কখনো প্লেটোনীয় ঘনবস্তুর উপর ভিত্তি করে নির্মীত তার এই বিশ্বতাত্ত্বিক মডেলটি বর্জন করেন নি। পরবর্তী জীবনে তার অনেক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক কাজের উদ্দেশ্যও ছিল মডেলটিকে আরও সূক্ষ্ণ ও কার্যকরী করে তোলা, বিশেষ করে গ্রহগুলোর সঠিক উৎকেন্দ্রিকতা নির্ণয়ের মাধ্যমে খ-গোলকগুলোর অন্তর্ব্যাসার্ধ্য ও বহির্ব্যাসার্ধ্যের আরও সঠিক মান নির্ণয়ের ব্রত ছিলেন। ১৬২১ সালে তিনি মুস্টেরিয়ুমের একটি বর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন। প্রথমটির প্রায় অর্ধেক পরিমাণ বেশি দীর্ঘ এবং বেশ কিছু সংশোধন ও পাদটীকার মাধ্যমে গত ২৫ বছরে তার অর্জন ও উপলব্ধিগুলো এই সংস্করণে তুলে ধরেন।[16]
মুস্টেরিয়ুমের প্রভাব সম্পর্কে প্রথম কথা হচ্ছে, এটি ছিল কোপের্নিকুসের তত্ত্বের আধুনিকায়নের পথে প্রথম পদক্ষেপ। De revolutionibus orbium coelestium গ্রন্থে কোপের্নিকুস যে সৌরকেন্দ্রিক একটি মডেল তৈরি করার চেষ্টা করেছেন সে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেটি করতে গিয়ে তাকে টলেমীয় পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হয়েছে, গ্রহগুলোর কক্ষীয় বেগ ব্যাখ্যা করতে অণুবৃত্ত এবং উৎকেন্দ্রিক বৃত্তের ধারণা তুলে ধরতে হয়েছে। উপরন্তু কোপের্নিকুস নিজেও সূর্যের কক্ষপথের কেন্দ্রের বদলে পৃথিবীর কক্ষপথের কেন্দ্রকে প্রসঙ্গ বিন্দু হিসেবে উল্লেখ করে যাচ্ছিলেন। তার নিজের লেখাতেই এর কারণ হিসেবে পাওয়া যায়, "হিসাবের সুবিধা এবং টলেমির বিশ্ব থেকে খুব বেশি সরে গিয়ে পাঠককে বিভ্রান্ত করে না দেওয়ার জন্য"। সেহেতু মুস্তেরিয়ুম কসমোগ্রাফিকুমের তত্ত্ব ভুল হলেও নিঃসন্দেহে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নতির পেছনে তার বিশাল ভূমিকা আছে। কারণ এই গ্রন্থই কোপের্নিকুসের সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ থেকে টলেমির শেষচিহ্ন বিলুপ্ত করে তাকে পরিশুদ্ধ করেছে।[17]
বারবারা ম্যুলারের সাথে বিয়ে
১৫৯৫ সালে কেপলার কোন এক সূত্রে বারবারা ম্যুলারের সাথে পরিচিত হন। ম্যুলার তখন ২৩ বছরের বিধবা যুবতী, তার এক মেয়েও ছিল (নাম Gemma van Dvijneveldt)। পরিচয়ের পরপরই কেপলার ও ম্যুলারের প্রেম শুরু হয়। স্বামীর বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকার হওয়ার পাশাপাশি ম্যুলার ছিলেন এক ধনকুবের মিল মালিকের কন্যা, নাম ইয়োব্স্ট। বাবা মেয়েকে কেপলারের কাছে বিয়ে দিতে চান নি। কারণ সম্মান ও বংশমর্যাদার দিক দিয়ে বেশ উঁচুমানের হলেও কেপলারের যথেষ্ট অর্থকড়ি ছিল না। তিনি যখন মুস্টেরিয়ুমের উপর কাজ করছেন তখন ইয়োব্স্ট একটু সদয় হলেও, প্রকাশনার খুঁটিনাটি দেখাশোনা করতে যখন দূরে যান তখন বিয়েটা একরকম ভেঙেই যেতে বসেছিল। কিন্তু গির্জার কর্মকর্তারা এক্ষেত্রে সহযোগিতা করে। গির্জার কর্মকর্তারাই ম্যুলার পরিবারকে তাদের প্রতিজ্ঞা পালন করার অণুরোধ জানায়। অবশেষে ১৫৯৭ সালের ২৭শে এপ্রিল জোহানেস কেপলার ও বারবারার বিয়ে হয়।[18] বিয়ের প্রথমদিকেই কেপলার দম্পতির দুই সন্তান হাইনরিশ ও সুজানা-র জন্ম হয়, যদিও শিশু অবস্থায়ই তাদের মৃত্যু ঘটে। ১৬০২ সালে তাদের মেয়ে সুজানা, ১৬০৪ সালে ছেলে ফ্রিডরিশ এবং ১৬০৭ সালে আরেকটি ছেলে লুডভিগের জন্ম হয়।[19]
অন্যান্য গবেষণা
মুস্টেরিয়ুম প্রকাশিত হওয়ার পর গ্রাৎস স্কুলের পরিদর্শকদের পৃষ্ঠপোষকতায় কেপলার তার পূর্বতন কাজগুলোকে আরও সম্প্রসারিত করার একটি উচ্চাভিলাসী প্রকল্প হাতে নেন। চারটি নতুন বই প্রকাশের পরিকল্পনা করেন : একটি মহাবিশ্বের স্থির অবস্থা বিশেষত সূর্য এবং স্থির তারাগুলো নিয়ে, একটি গ্রহ ও তাদের গতিবিধি বিষয়ে, একটি গ্রহসমূহের ভৌত প্রকৃতি এবং ভৌগোলিক কাঠামোর (বিশেষ করে পৃথিবী) উদ্ভব বিষয়ে, এবং আরেকটি পৃথিবীর উপর জ্যোতিষ্কসমূহের প্রভাব বিষয়ে যাতে বায়ুমণ্ডলীয় আলোকবিদ্যা, আবহবিদ্যা এবং জ্যোতিষ শাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত হতো।[20]
এছাড়া যেসব জ্যোতির্বিদদের কাছে মুস্টেরিয়ুমের কপি পাঠিয়েছিলেন তাদের মন্তব্য সংগ্রহের ব্যাপারেও তার বিশেষ আগ্রহ ছিল, এর মধ্যে ছিলেন হলি রোমান সম্রাজ্যের রাজা রুডলফ ২-এর রাজগণিতবিদ এবং ট্যুকো ব্রাহের তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্ব্বী রাইমারুস উরসুস। উরসুস সরাসরি তার চিঠির উত্তর দেন নি কিন্তু ট্যুকোর সৌরজাগতিক মডেলের বিপরীতে তার ধারণার গ্রহণযোগ্যতার একটি শক্ত প্রমাণ হিসেবে চিঠিটি পুনঃপ্রকাশ করেন। চিঠিটির এই নেতিবাচক ব্যবহার সত্ত্বেও ট্যুকো এক সময় সরাসরি কেপলারের সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন, প্রথমেই কেপলারের জগতের একটি কঠোর কিন্তু যুক্তিযুক্ত সমালোচনা প্রকাশ করেন যাতে বলা হয় কেপলার কোপের্নিকুসের কাছ থেকে পাওয়া বেশ কিছু ভুল উপাত্ত ব্যবহার করেছেন। চিঠি আদান-প্রদাণের মাধ্যমে তাদের মধ্যে সে সময়কার জ্যোতির্বিদ্যার বড় বড় সমস্যা নিয়ে আলোচনা হতো, যার মাঝে ছিল চান্দ্র ঘটনাসমূহ এবং কোপের্নিকুসের তত্ত্বের ধর্মীয় গ্রহণযোগ্যতা। অবশ্য ট্যুকোর মানমন্দিরের অপেক্ষাকৃত উন্নতমানের উপাত্ত ছাড়া এর কোনটি নিয়েই কেপলারের পক্ষে কাজ করা সম্ভব ছিল না।[21]
অগত্যা কেপলার কালনিরূপণবিদ্যা ও বিশ্বজগতের শৃঙ্খলা, সঙ্গীত, গণিত ও ভৌত বিশ্বের মাঝে সংখ্যাতাত্ত্বিক সম্পর্ক এবং তাদের জ্যোতিষ শাস্ত্রগত পরিণতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে পৃথিবীর একটি আত্মা আছে, একই অণুমিতির সাহায্যে পরে তিনি সূর্য কীভাবে তার চারদিকে গ্রহগুলোকে আবর্তন করায় তাও ব্যাখ্যা করেছিলেন। যাহোক, এভাবে তিনি জ্যোতিষ শাস্ত্র থেকে পাওয়া বিভিন্ন ঘটনার কার্যকারণের ব্যাখ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা থেকে পাওয়া দূরত্বের পরিমাপ এবং পৃথিবীর আবহাওয়া ও বিভিন্ন পার্থিব ঘটনাকে এক সূত্রে গেঁথে একটি নতুন ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা করেন। ১৫৯৯ এর মধ্যে অবশ্য আবারও বুঝতে পারেন তার মডেলে পুঙ্খানুপুঙ্খ উপাত্তের অভাব রয়েছে। ওদিকে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা গ্রাৎসে তার পদটিকেও একটু অনিশ্চিত করে তুলেছিল। সে বছরের ডিসেম্বর মাসে ট্যুকো কেপলারকে প্রাগে আসার আমন্ত্রণ জানান। অবশ্য ট্যুকোর আমন্ত্রণ পত্র হাতে পাওয়া আগেই ১৬০০ সালের ১লা জানুয়ারি তিনি প্রাগের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এই ভেবে যে ট্যুকোর পৃষ্ঠপোষকতা তার দার্শনিক ও সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবে।
প্রাগ (১৬০০–১৬১২)
ট্যুকো ব্রাহের সাথে
১৬০০ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি কেপলার প্রাগ শহরের ৩৫ কিলোমিটার দূরে বেনাৎকী নাদিই যারো নামক একটি স্থানে ট্যুকো ব্রাহে এবং তার সহকারী ফ্রান্স টেংনাগেল ও ক্রিসতেন সোরেনসেন লঙ্গোমোনতানুস-এর সাথে দেখা করেন। উল্লেখ্য এ স্থানে তখন ট্যুকোর নতুন মানমন্দিরের নির্মাণ কাজ চলছিল। পরবর্তী দুই মাস তিনি অতিথি হিসেবে থেকে ট্যুকোর মঙ্গল গ্রহের পর্যবেক্ষণগুলো বিশ্লেষণ করেন। প্রথমদিকে নিজের উপাত্ত বেশ যত্নের সাথে গোপন করে রাখলেও কেপলারের তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে একসময় তাকে আরও বেশি অধিকার দেন। কেপলার মঙ্গল গ্রহের উপাত্তের মাধ্যমে মুস্টেরিয়ুম কসমোগ্রাফিকুমে উল্লেখিত তার তত্ত্বটি প্রমাণের উদ্যোগ নিলেও পরে বুঝতে পারেন এই কাজ শেষ করতে পুরো দুই বছর লাগবে, কারণ নিজের ব্যবহারের জন্য ট্যুকোর উপাত্ত সরাসরি নকল করে নেয়ার অধিকার তার ছিল না। এ কারণে সে সময় প্রাগে অবস্থানরত স্লোভাকীয় দার্শনিক, চিকিৎসক ও রাজনীতিবিদ ইউহানেস ইয়েসসেনিউস-এর সহায়তায় ট্যুকোর সাথে আরও নিয়মানুগ ও আনুষ্ঠানিক একটি চুক্তি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চুক্তির চেষ্টা তিক্ততায় পর্যবসিত হয় এবং কেপলার ৬ই এপ্রিল প্রাগের উদ্দেশ্যে মানমন্দির ত্যাগ করেন। কেপলার ও ট্যুকো অবশ্য এর অল্পদিন পরেই বেতন এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি করেন এবং জুন মাসে কেপলার গ্রাৎসে ফিরে যান তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে আসার জন্য।[22]
কিন্তু গ্রাৎসে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমস্যার কারণে তাৎক্ষণিক প্রাগে ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। যেকোন মূল্যে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা অব্যাহত রাখার জন্য কেপলার তাই এক সময় হলি রোমান সম্রাজ্যের রাজা আর্কডিউক ফের্ডিনান্ড ২-এর রাজগণিতবিদ হওয়ার চেষ্টা করেন। এই উদ্দেশ্যে ফের্ডিনান্ডকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি মৌলিক বলের উপর ভিত্তি করে চাঁদের গতিপথ বিষয়ে একটি নতুন তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। লাতিন ভাষায় লিখেছিলেন "In Terra inest virtus, quae Lunam ciet" যার বাংলা হচ্ছে "পৃথিবীর এমন একটি বল আছে যা চাঁদকে গতিশীল করে"।[23] চিঠিটি ফের্ডিনান্ডের দরবারে পদ পেতে সাহায্য না করলেও চন্দ্রগ্রহণ পরিমাপের একটি নতুন পদ্ধতি তৈরিতে ঠিকই ভূমিকা রেখেছিল। ১০ই জুলাই গ্রাৎসে চন্দ্রগ্রহণের সময় তিনি এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এই পর্যবেক্ষণগুলোই আলোকবিদ্যা মৌলিক নীতি বিষয়ে তার চিন্তাধারাকে শাণিত করে যার চূড়ান্ত পরিণতি Astronomiae Pars Optica নামক বইটি।[24]
১৬০০ সালের ২রা আগস্ট ক্যাথলিকবাদে ধর্মান্তরিত হতে রাজি না হওয়ার কারণে কেপলার ও তার পরিবারকে গ্রাৎস থেকে বহিষ্কার করা হয়। কয়েক মাস পর পরিবারের সবাইকে নিয়ে অবশেষে তিনি প্রাগ চলে আসেন। ১৬০১ সালের অধিকাংশ সময় জুড়ে ট্যুকো তাকে সরাসরি আর্থিক সহযোগিতা দেন, বিনিময়ে কেপলারকে গ্রহের গতিপথ বিশ্লেষণ এবং ট্যুকোর একসময়কার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্ব্বী উরসুসের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতে হয়। সে সময় অবশ্য উরসুসের প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতা অনেক কমে গিয়েছিল। সেপ্টেম্বরে ট্যুকো সম্রাটের কাছে যে নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব রেখেছিলেন তার সহযোগী হিসেবে কেপলারকে একটি চাকরি জুটিয়ে দেন। এই প্রকল্পের কাজ ছিল কোপের্নিকুসোর উপাত্তের উপর ভিত্তি করে এরাসমুস রাইনহোল্ডের করা প্রুটেনীয় জ্যোতিষ্ক তালিকাকে প্রতিস্থাপন করার জন্য একটি নতুন তালিকা প্রণয়ন। ট্যুকোর উপাত্তের ভিত্তিতে কেপলার নতুন তালিকাটি প্রণয়ন করেন, হলি রোমান সম্রাট রুডলফ ২-এর সম্মানে যার নাম রাখা হয় রুডলফীয় তালিকা। ১৬০১ সালের ২৪শে অক্টোবর ট্যুকোর আকস্মিক মৃত্যুর দুই দিন পর কেপলার নতুন রাজগণিতবিদ হিসেবে অভিষিক্ত হন, ট্যুকোর অসমাপ্ত কাজ শেষ করার দায়িত্ব বর্তায় তার উপর। রাজগণিতবিদ হিসেবে পরবর্তী ১১ বছরই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে ফলপ্রসূ সময়।[25]
রুডলফ ২-এর উপদেষ্টা হিসেবে
রাজগণিতবিদ হিসেবে কেপলারের প্রধান কাজ ছিল সম্রাটকে জ্যোতিষতাত্ত্বিক উপদেশ দেয়া। সমসাময়িক জ্যোতিষীরা যে একেবারে ভবিষ্যৎ এবং স্বর্গীয় ঘটনাবলির খুঁটিনাটি ভবিষ্যদ্বাণী করতেন তা কেপলারের ঠিক পছন্দ ছিল না। নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি হয়ত তার অতোটা বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু এমনিতে ট্যুবিঙেনে অধ্যয়নের সময় থেকেই সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব ও পরিবার-পরিজন ও পৃষ্ঠপোষকদের রাশিচক্র গণনা করেছেন। মিত্রপক্ষ এবং বিদেশী শক্তিগুলোর রাশিচক্র গণনা করে তাদের ভবিষ্যৎ হালচাল ব্যাখ্যার পাশাপাশি সম্রাট কেপলারের কাছে রাজনৈতিক পরামর্শও চাইতেন। অবশ্য এসব ক্ষেত্রে কেপলারের পরামর্শ যতোটা না রাশিচক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল সাধারণ বুদ্ধিনির্ভর। রুডলফ তার দরবারের অনেক বুদ্ধিজীবীদের কাজকর্মের ব্যাপারে ব্যক্তিগত আগ্রহ পোষণ করতেন। আলকেমীদের কাজকর্ম এবং ভৌত জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে কেপলারের অগ্রগতি সম্পর্ক নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখতেন।[26]
সরকারিভাবে প্রাগে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্মীয় রীতি ছিল ক্যাথলিক এবং ইউট্রাকুইস্ট। কিন্তু রাজদরবারের সদস্য হওয়ার কারণে কেপলার তার লুথারান ধর্মীয় বিশ্বাস পালন করতে পারতেন। সম্রাট তার পরিবারের জন্য একটি সম্মানজনক ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন, কিন্তু রাজকোষ অনেক বড় হয়ে যাওয়ায় নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখী হতে হতো এবং মাঝে মাঝেই আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে সংগ্রাম করতে হতো তার। মূলত আর্থিক কষ্টের কারণেই বাড়িতে বারবারার সাথে তার সময় ভাল কাটতো না। এর সাথে ছিল সাময়িক অসুস্থতা। কিন্তু রাজদরবারে তার জীবন বেশ আনন্দের ছিল কারণ এখানে তিনি সেযুগের অন্য বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীদের সাথে পরিচিত হতে পারতেন, এদের মধ্যে ছিলেন ইয়োহানেস মাতেউস ভাকার ফন ভাকেনফেল্স, ইয়োস্ট ব্যুর্গি, ডাভিড ফাব্রিকিউস, মার্টিন বাখাৎসেক, ইয়োহানেস ব্রেংগার এবং অন্যরা। ভাল পরিবেশ পেয়ে তার জ্যোতির্বিদ্যার কাজও দ্রুত এগুচ্ছিল।[27]
আস্ত্রোনোমিয়াই পার্স অপতিকা
ট্যুকোর মঙ্গল গ্রহের সকল পর্যবেক্ষণ তখন কেপলারের হাতে আসে এবং তিনি বেশ ধীরলয়ে তা বিশ্লেষণ করতে থাকেন, সেই সাথে রুডলফীয় তালিকা তৈরির প্রক্রিয়াও শুরু করেন। ১৬০০ সালের চাঁদ সম্পর্কিত প্রবন্ধে আলোকবিদ্যার মৌলিক নীতি বিষয়ে যা লিখেছিলেন সে নিয়ে শুরু করেন নতুন গবেষণা। চন্দ্রগ্রহণ এবং সূর্যগ্রহণ দুটোরই অনেকগুলো বিষয় ব্যাখ্যা করা যেতো না তখন, যেমন, ছায়ার অনাকাঙ্ক্ষিত আকার, পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের লাল রং এবং পূর্ণ গ্রহণের সময় সূর্যের চারপাশে অস্বাভাবিক আলোর ছটা নিয়ে যে কথা ছড়িয়েছিল তা। এর সাথে সম্পর্কিত বায়ুমণ্ডলীয় প্রতিসরণের বিষয়গুলো সকল জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। ১৬০৩ সালের অধিকাংশ সময় কেপলার তার অন্য সব কাজ বন্ধ রেখে আলোক তত্ত্বের উপর মনোনিবেশ করেন, এই গবেষণার পাণ্ডুলিপি ১৬০৪ সালের ১লা জানুয়ারি সম্রাটের কাছে পেশ করেন যার নাম রাখা হয় "আস্ত্রোনোমিয়াই পার্স অপতিকা" (লাতিন ভাষায় Astronomiae Pars Optica), বাংলায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোকবিদ্যা সংশ্লিষ্ট অংশ। এই বইয়ে উল্লেখিত বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল, আলোর তীব্রতা যে বিপরীত বর্গীয় সূত্র মেনে চলে তার বর্ণনা, সমতল ও বক্র দর্পণ থেকে প্রতিফলন, পিনহোল ক্যামেরার মূলনীতি, এবং আলোকবিদ্যার বিভিন্ন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ, যেমন লম্বন ও জ্যোতিষ্কসমূহের আপেক্ষিক আকার। মানুষের চোখ নিয়েও গবেষণা করেছিলেন এবং স্নায়ুবিজ্ঞানীরা মনে করেন কেপলারই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন যে মানব চোখের লেন্স কোন বস্তুর বিম্ব উল্টো করে রেটিনায় প্রক্ষেপিত করে। এই উল্টো বিম্ব কীভাবে সোজা হয় সে নিয়ে তিনি খুব বেশি ভাবার প্রয়োজন অণুভব করেননি কারণ তার মতে আলোকবিদ্যার সাথে এর খুব বেশি সম্বন্ধ ছিল না। অবশ্য তিনি অন্তত এটুকু বলেছিলেন যে, মস্তিষ্কের ফাঁপা অভ্যন্তরভাগে আত্মার কার্যকলাপের কারণেই উল্টো বিম্ব সোজা হয়ে যায়।[28] বর্তমানকালে, আস্ত্রোনোমিয়াই পার্স অপতিকাকে আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয় যদিও এতে প্রতিসরণের সূত্র একেবারে অণুপস্থিত।[29]
১৬০৪ সালের অতিনবতারা
১৬০৪ সালের অক্টোবর মাসে একটি উজ্জ্বল নতুন সন্ধ্যাতারা আকাশে দেখা দেয়, যদিও কেপলার নিজ চোখে দেখার আগে শোনা কথা বিশ্বাস করেননি। এই নতুন জ্যোতিষ্কটিই ছিল অতিনবতারা ১৬০৪। জ্যোতিষ শাস্ত্রে ১৬০৩ সালের শেষ একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো। বৃহস্পতি এবং শনি গ্রহ আকাশে মোটামুটি একই স্থানে দেখা দেয় প্রতি ২০ বছর পরপর। এই ঘটনাকে বলে মহা গ্রহসংযোগ। জ্যোতিষীরা হিসাব করে আরও দেখেছিলেন যে প্রতি ৮০০ বছর পরপর আকাশের একটি নির্দিষ্ট স্থানেই এই গ্রহসংযোগ ঘটে। এই স্থানটি অগ্নিত্রিভুজ (fiery trigon বা triplcity) নামে পরিচিত যা আসলে মেষ, সিংহ ও ধনু রাশির সম্মিলিত রূপ।[30] ১৬০৪ সাল থেকে প্রতি ২০ বছর পরপর আকাশের এই অগ্নিত্রিভুজেই মহা গ্রহসংযোগ ঘটবার কথা। সময়ের সাথে সাথে গ্রহসংযোগের অবস্থান পরিবর্তিত হতে থাকবে এবং ৮০০ বছর পর আবার সেই অগ্নিত্রিভুজে ফিরে আসবে। জ্যোতিষী ও সে সময়কার সাধারণ মানুষেরা বিশ্বাস করতেন যে এই ৮০০ বছরের চক্র যখন নতুন করে শুরু হয় তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ঘটে। তাদের দাবী অনুসারে ১ সালের দিকে যে অগ্নিত্রিভুজ সংযোগ শুরু হয়েছিল তার পরই যিশু খ্রিস্টের জন্ম হয়, ৮০০ সালে পশ্চিম ইউরোপ এবং ইউরোপীয় মধ্যযুগের সংজ্ঞা নির্ধারণকারী মহারাজা শার্লামাইন রোমান সম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন। সেই ধারাবাহিকতায় ১৬০৩ সালের পরেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটবে বলে আশা করছিলেন সবাই।[31]
আর কেপলার যেহেতু সে সময় রাজ-জ্যোতিষী ছিলেন সেহেতু এ নিয়ে তার কিছু বলাটা ছিল অবশ্যম্ভাবী। দুই বছর পর "দে স্তেলা নোভা" (De Stella Nova) বইয়ে তিনি এটি বর্ণনা করেন। অসংখ্য জ্যোতিষীর ব্যাখ্যা তখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু কেপলার সেগুলো গ্রহণের পরিবর্তে সংশয়বাদী দৃষ্টিতে নতুন তারাটির জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গুণাবলি বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন। লক্ষ্য করে দেখেন, এর দীপ্তি দিনদিন কমে যাচ্ছে, তারাটির উৎপত্তি কীভাবে হচ্ছে সে নিয়েও একটি ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন এবং লম্বন পর্যবেক্ষণ করা যায়নি বলে তারাটি স্থির তারাদের খ-গোলকে অবস্থিত বলেও মন্তব্য করেন। এরিস্টটলের যুগ থেকেই ধারণা করা হতো খ-গোলক সুস্থির এবং অপরিবর্তনীয়, কেপলার সেই গোলকে একটি নতুন তারার জন্ম হয়েছে বলার মাধ্যমে অণুকল্পটিকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেন। পরিশিষ্টে তিনি পোল্যান্ডীয় ইতিহাসবিদ ও কবি লরেনত্যুস সুসলিগা-এর করা সাম্প্রতিক কালপঞ্জি নিয়ে একটি আলোচনা যোগ করেন। লরেনত্যুস সুসলিগা বলেছিলেন, যিশুর জন্ম ১ সালে নয় বরং খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ অব্দে। কেপলার হিসাব করে বলেন, এই যদি সত্যি হয় তাহলে ১৬০০ বছর আগের মহা গ্রহসংযোগের মাধ্যমে ৮০০ বছরের চক্র শুরু হওয়ার সাথে বেথলেহেমের তারা উদিত হওয়ার সময় খুব ভালভাবে মিলে যায়।[32]
আস্ত্রোনোমিয়া নোভা
কেপলার ট্যুকোর অধীনে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথ নিয়ে গবেষণা করার সময় গ্রহীয় গতির প্রথম দুটি সূত্র সম্পর্কে ধারণা পান যার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশিত হয় আস্ত্রোনোমিয়া নোভা (নতুন জ্যোতির্বিজ্ঞান) নামক বইটিতে। তিনি ইকুয়েন্টের সাহায্যে মঙ্গলের কক্ষপথের বিভিন্ন রূপ বারবার হিসাব করেন যদিও কোপের্নিকুস তার সৌরকেন্দ্রিক মডেলের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ইকুয়েন্টকে বাতিল করে দিয়েছিলেন। কেপলার এই হিসাবের মাধ্যমেই এমন একটি মডেল তৈরিতে সক্ষম হন যার সাথে ট্যুকোর পর্যবেক্ষণের সর্বোচ্চ পার্থক্য মাত্র ২ আর্কমিনিট, যা গ্রহণযোগ্য সীমা। তারপরও জটিল এবং কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ ফলাফল তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে মডেলের কয়েকটি বিন্দু পর্যবেক্ষণ থেকে প্রায় ৮ আর্কমিনিট দূরে সরে যাচ্ছিল। চলিত জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে সঠিক মডেল তৈরিতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে উপাত্তের সাথে ডিম্বাকার মডেল মেলানোর চেষ্টা শুরু করেন।[33]
বিশ্ব সম্পর্কে কেপলারের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সূর্যই ছিল সৌরজগৎের গতিদায়ক শক্তির উৎস এবং ঈশ্বরের প্রতীক। উইলিয়াম গিলবার্টের দে মাগণেতে (১৬০০) বইয়ে পৃথিবীর চৌম্বক আত্মার যে ধারণা প্রকাশিত হয়েছিল তার সাথে নিজের আলোকবিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণা এক করে এর একটি ভৌত ভিত্তিও দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। সূর্য থেকে বিকিরিত গতিদায়ক শক্তি (বা গতিদায়ক "প্রজাতি", motive species)[34] দূরত্বের সাথে সাথে কমতে থাকে যে কারণে গ্রহ সূর্যের কাছে এলে দ্রুত এবং দূরে গেলে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে চলে।[35][36] এই অণুমিতি গণিতের সাহায্যে জ্যোতির্বিদ্যার নিয়মনিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করেছিল। পৃথিবী এবং মঙ্গল গ্রহের অণুসূর ও অপসূর পরিমাপের মাধ্যমে তিনি আবিষ্কার করেন যে, কোন গ্রহের গতির হার সূর্য থেকে তার দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। অবশ্য পুরো কক্ষপথের জন্য এই সূত্রের সত্যতা যাচাই করতে অনেক পরিমাপের দরকার ছিল। তাই ১৬০২ সালের মধ্যে সূত্রটিকে তিনি জ্যামিতিক রূপে নিয়ে আসেন: "গ্রহগুলো সমান সময়ে সমান ক্ষেত্রফল অতিক্রম করে" যা কেপলারের গ্রহীয় গতির দ্বিতীয় সূত্র নামে পরিচিত।[37]
এরপর তিনি জ্যামিতিক ব্যস্তবর্গীয় নীতির সাহায্যে এবং ডিম্বাকৃতির কক্ষপথ ধরে নিয়ে মঙ্গলের পুরো গতিপথ হিসাব করার অভিযানে নামেন। অন্তত ৪০ বার ব্যর্থ হওয়ার পর অবশেষে ১৬০৫ সালে বুঝতে পারেন কক্ষপথের প্রকৃত আকৃতি উপবৃত্তের মত। উপবৃত্তের চিন্তা মাথায় আগেও এসেছিল, কিন্তু সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা খুব বেশি সোজা হয়ে যায় যা পূর্বের জ্যোতির্বিদদের বোঝা উচিত ছিল- এই ভেবে তিনি ক্ষান্ত থাকতেন। মঙ্গলের উপবৃত্তাকার কক্ষপথ পরিমাপের পরই তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে, "সকল গ্রহ উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরে, যেখানে সূর্য থাকে উপবৃত্তের একটি ফোকাসে"- এরই নাম কেপলারের গ্রহীয় গতির প্রথম সূত্র। কিন্তু কোন সহযোগী নিয়োগ করেননি বিধায় মঙ্গল ছাড়া অন্য কোন গ্রহের কক্ষপথ আর পরিমাপ করা হয়নি তার। এই বছরের শেষ দিকে আস্ত্রোনোমিয়া নোভার পাণ্ডুলিপি রচনা শেষ করেন যদিও ট্যুকোর পর্যবেক্ষণ (যা তার উত্তরসূরীদের সম্পত্তি) ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট আইনগত জটিলতায় পড়ে ১৬০৯ সালের আগে এটি বই হিসেবে প্রকাশিত হয়নি।[38]
দিয়োপোত্রিকে, সোমনিয়ুম ও অন্যান্য পাণ্ডুলিপি
আস্ত্রোনোমিয়া নোভা শেষ করার পর কেপলারের মূল কাজ ছিল রুডলফীয় তালিকা শেষ করা এবং এর উপর ভিত্তি করে একটি পূর্ণাঙ্গ এফিমেরিস (যাতে জ্যোতিষ্কসমূহের অবস্থান লিপিবদ্ধ থাকে) প্রণয়ন। এর কোনটিই অবশ্য অদূর ভবিষ্যতে শেষ হয়নি। এ সময় কেপলার ইতালীয় জ্যোতির্বিদ জিওভান্নি আন্তোনিও মাজিনি-র সাথে সহযোগিতার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তার অন্য কিছু কাজের বিষয়বস্তু ছিল কালপঞ্জি, বিশেষ করে যিশুর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর তারিখ প্রণয়ন এবং জ্যোতিষ শাস্ত্র। তিনি জ্যোতিষ শাস্ত্রের মাধ্যমে কোন নাটকীয় বিপর্যয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করার সমালোচনা করেছেন।[39]
তার এক সময়কার সহপাঠী হেলিসাইয়ুস রোজেলিন জ্যোতিষ শাস্ত্রের উপর বেশি জোড় দিতেন এবং কেপলারের কোপের্নিকুসীয় চিন্তাধারা পছন্দ করতেন না। তারা বেশ কিছু লেখায় একে অপরকে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ করেন। ওদিকে চিকিৎসক ফিলিপ ফেজেলিয়ুস জ্যোতিষ শাস্ত্রকে পুরো বাতিল করে দিয়ে একটি বইই লিখেছিলেন যাতে সমালোচনার প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল রোজেলিনের কাজ। একদিকে জ্যোতিষ শাস্ত্র নিয়ে বাড়াবাড়ি এবং অন্যদিকে অতিমাত্রায় ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে তা পুরোপুরি বর্জন- এই দুয়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে কেপলার তের্তিয়ুস ইন্তেরভেনিয়েন্স (তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ) নামে একটি বই লিখে রোজেলিন ও ফেজেলিয়ুসের সাধারণ পৃষ্ঠপোষকের কাছে পাঠান। দুই পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সমঝোতা তৈরির উদ্দেশ্যে রচিত হলেও এই বইয়ে জ্যোতিষ শাস্ত্র সম্পর্কে কেপলারের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এতে তিনি গ্রহ এবং মানুষের আত্মা কি পদ্ধতিতে মিথস্ক্রিয়া করে সে নিয়ে একটি অণুকল্প হাজির করেন। জ্যোতিষীদের প্রথাগত নিয়মকানুন ও পদ্ধতিকে তিনি দুর্গণ্ধযুক্ত মল ঘেঁটে মুরগীর খাবার সন্ধানের সাথে তুলনা করলেও অন্যদিকে আবার বলেন, বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক জ্যোতিষীর পক্ষে সেখানে একটি হলেও দানা খুঁজে পাওয়া সম্ভব।[40]
১৬১০ সালের প্রথম দিতে গালিলেও গালিলেই তার নতুন শক্তিশালী দূরবিনের সাহায্যে বৃহস্পতি গ্রহকে আবর্তনকারী চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করেন। সিদেরেয়ুস নুনকিয়ুস (তারকাশোভিত দূত) বইয়ের মাধ্যমে এই আবিষ্কারের খবর প্রকাশের পর গালিলেও কেপলারের মতামত জানতে চান, যাতে তার পর্যবেক্ষণের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। কেপলার বেশ উৎসাহের সাথে একটি প্রকাশিত পত্রের মাধ্যমে তার অভিমত জানান, পত্রটির নাম দিসেরতাশিও কুম নুনকিও সিদেরেও (তারকাশোভিত দূতের সাথে কথোপকথন)। তিনি গালিলেওর পর্যবেক্ষণকে সত্যায়িত করেন এবং জ্যোতির্বিদ্যা, আলোকবিদ্যা, বিশ্বতত্ত্ব ও জ্যোতিষ শাস্ত্রের জন্য এই আবিষ্কারের অর্থ ও গালিলেওর দূরবিন প্রযুক্তির কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা করেন। সে বছরেরই শেষের দিকে নারাশিও দে জোভিস সাতেলিতিবুস প্রকাশের মাধ্যমে নিজের দূরবিন দিয়ে দেখা চাঁদ বর্ণনা করেন। এতে গালিলেওর পর্যবেক্ষণ আরো পাকাপোক্ত হয়। কিন্তু গালিলেও কখনও আস্ত্রোনোমিয়া নোভার প্রতিক্রিয়া (যদি আদৌ থেকে থাকে) প্রকাশ করেননি বলে কেপলার বেশ হতাশই হয়েছিলেন।[41]
গালিলেওর নতুন দূরবিন উদ্ভাবনের খবর পাওয়ার পর কেপলার কলোনের ডিউক আর্নেস্টের কাছ থেকে একটি দূরবিন ধার নিয়ে দুরবিনের আলোকবিদ্যা বিষয়ে তাত্ত্বিক ও পরীক্ষণমূলক গবেষণা শুরু করেন।[42] এর ফলে ১৬১০ সালে একটি নতুন পাণ্ডুলিপি রচনা শেষ করেন যা ১৬১১ সালে দিয়োপোত্রিকে (Diopotrice) নামে প্রকাশিত হয়। এতে বর্ণীত বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল- দ্বি-উত্তল অভিসারী এবং দ্বি-অবতল অপসারী লেন্সের তাত্ত্বিক ভিত্তি এবং এদের সমন্বয়ে গালিলীয় দূরবিনের উদ্ভব, সদ ও অসদ বিম্ব, সোজা ও উল্টো বিম্ব এবং বিবর্ধন ও লঘূকরণের উপর ফোকাস দূরত্বের প্রভাব। এছাড়া তিনি নতুন এক ধরনের দূরবিনের ধারণা দেন যার বর্তমান নাম জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বা কেপলারীয় দূরবিন। এই দুরবিনে গালিলেওর মত উত্তল ও অবতল লেন্সের সমন্বয় ব্যবহারের পরিবর্তে দুটি উত্তল লেন্স ব্যবহার করা হয় যাতে বিবর্ধন আরও বেড়ে যায়।[43]
১৬১১ সালের দিকে কেপলার একটি পাণ্ডুলিপি প্রচার করেন যা তার মৃত্যুর পর সোমনিয়ুম (Somnium, স্বপ্ন) নামে প্রকাশিত হয়। এই বই লেখার উদ্দেশ্যগুলোর একটি ছিল অন্য কোন গ্রহের সাপেক্ষে জ্যোতির্বিদ্যা কেমন হবে তা বর্ণনা করে। এর মাধ্যমে তিনি মূলত এমন তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন যাতে পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র ভাবা হয় না। কয়েক জনের হাতে ঘোরার পর পাণ্ডুলিপিটি অদৃশ্য হয়ে যায়। বইয়ে গল্পের ছলে একটি রোমহর্ষক চন্দ্র অভিযানের বর্ণনা দেন, পাণ্ডুলিপিটিকে বলা যায় কিছুটা রূপক, কিছুটা আত্মজীবনী এবং কিছুটা আন্তঃগ্রহ যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে কেপলারের চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ। কার্ল সেগান একে প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন।[44] পাণ্ডুলিপি প্রচারেরও বেশ কয়েক বছর পর সম্ভবত এর একটি বিকৃত সংস্করণের কারণে ডাকিনীবিদ্যা চর্চার অভিযাগো তার মাকে আটক করা হয়। গল্পে বর্ণনাকারীর মাকে মহাকাশ অভিযানের পদ্ধতি শেখার জন্য একটি প্রেতের সাথে আলোচনা করতে দেখা যায়। মা মুক্তি পাওয়ার পর কেপলার গল্পের সাথে ২২৩টি পাদটীকা যুক্ত করেন যা মূল গল্পের চেয়েও অনেক বড় হয়ে যায়। এর মাধ্যমে গল্পে ব্যবহৃত বিভিন্ন রূপকের অর্থ, লুক্কায়িত নানান বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণা এবং বিশেষ করে চাঁদের ভূতত্ত্ব নিয়ে অনেক আলোচনা উঠে আসে।[45]
গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে অবদান
নববর্ষের উপহার হিসেবে তার বন্ধু ও এক সময়কার পৃষ্ঠপোষক ব্যারন ভাখার ফন ভাখেনফেল্ডের জন্য সে বছর তিনি স্ত্রেনা সেউ দে নিভে সেক্সাঙ্গুলা (নববর্ষের জন্য ষড়ভুজী তুষারের উপহার) নামে একটি ছোট পুস্তিকা লেখেন। এতেই তিনি প্রথমবারের মত তুষারকণার ষড়ভুজাকৃতির প্রতিসাম্য বর্ণনা করেন যার ফলশ্রুতিতে প্রতিসাম্যের একটি পরমাণুবাদী ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। গোলকের সজ্জার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী উপায় সম্পর্কেও এভাবে একটি অণুকল্প বেরিয়ে আসে যাকে কেপলার অণুমিতি বলা হয়।[46][47] কেপলার ছিলেন অনীয়ানের গাণিতিক প্রয়োগ আবিষ্কারের অন্যতম পুরোধা। (দেখুন: অবিচ্ছিন্নতার নীতি)
ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক দুর্ভোগ
১৬১১ সালে প্রাগে ধর্মীয়-রাজনৈতিক উত্তেজনা চরম রূপ ধারণ করে। সম্রাট রুডলফের শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে তার ভাই মাটিয়াস তাকে বোহেমিয়ার রাজার পদ থেকে অবসর নিতে বাধ্য করেন। রুডলফ ও মাটিয়াস উভয়েই কেপলারের কাছে জ্যোতিষতাত্ত্বিক উপদেশ চান। এই সুযোগে তিনি কিছু আপোসমূলক উপদেশের মাধ্যমে অবস্থার উন্নতি ঘটাতে চেষ্টা করেন, গ্রহ-তারার অবস্থান সম্পর্কে খুব কমই মন্তব্য করেছিলেন যাতে রাজারা কোন আকস্মিক পদক্ষেপ না নেন। কিন্তু এটি বুঝতে বাকি ছিল না যে মাটিয়াসের দরবারে কেপলারের খুব একটা ভবিষ্যৎ নেই।[48]
সে বছরই কেপলারের স্ত্রী বারবারা হাঙ্গেরীয় তিলকিত জ্বরে আক্রান্ত হন, মৃগী রোগের লক্ষণ দিয়ে যারা সূচনা ঘটে। বারবারা সুস্থ হতে না হতেই তার তিন সন্তান গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়, ৬ বছর বয়সী ফ্রিডরিশ মারা যায়। ছেলের মৃত্যুর পর তিনি পাদোয়া ও ভ্যুআটেমবের্গের পৃষ্ঠপোষকদের কাছে জ্যোতির্বিদ্যা বা গণিতের পদের আবেদন করে পত্র পাঠান। ভ্যুআটেমবের্গের ট্যুবিঙেন বিশ্ববিদ্যালয় কেলভিনীয় ধর্মদ্রোহীতা এবং আউগসবুর্গ কনফেশন (লুথারান চার্চের প্রধান বিশ্বাসের স্বীকারোক্তি) ও কনকর্ড ফর্মুলা (লুথারান চার্চে বিশ্বাসের প্রতিজ্ঞা) লঙ্ঘনের কারণে কেপলারকে নিতে রাজি হয়নি। ১৬১০ সালে গালিলেও ইউনিভার্সিটি অফ পাদোয়া থেকে চলে যাওয়ায় সৃষ্ট শূন্যস্থান পূরণের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু কেপলার জার্মান ভূমিতে থাকা শ্রেয় মনে করে অস্ট্রিয়ার লিনৎসে যান শিক্ষক ও জেলা গণিতবিদের একটি পদের ব্যবস্থা করতে। তিনি ফিরে আসার কিছুদিন পরই অবশ্য আরও অসুস্থ হয়ে বারবারা মৃত্যুবরণ করেন।[49]
এ কারণে কেপলার লিনৎসে যাওয়ার তারিখ পিছিয়ে দিয়ে আরও কিছুকাল প্রাগে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ১৬১২ সালে সম্রাট রুডলফ মারা যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এখানেই ছিলেন যদিও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, পারিবারিক দুঃখভোগ এবং তার স্ত্রীর জমি নিয়ে আইনি জটিলতার কারণে এ সময়ের মাঝে তার গবেষণা এগোয়নি। গবেষণা হচ্ছে না দেখে এ সময় তিনি পূর্বের কাজ ও অন্যদের সাহায্য নিয়ে একলোগাই ক্রোনিকাই নামে একটি কালপঞ্জি তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন। মাটিয়াস হলি রোমান সম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার পর কেপলারের পূর্বতন চাকরি পূর্ণ বেতনসহ পুনর্বহাল করেন এবং এই চাকরি নিয়েই তাকে লিনৎসে চলে যাওয়ার অণুমতি দেন।[50]
লিনৎস এবং অন্যত্র (১৬১২–১৬৩০)
লিনৎসে রুডলফীয় তালিকা শেষ করার পাশাপাশি কেপলারের অন্য কাজ ছিল জেলা স্কুলে শিক্ষকতা এবং জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষ শাস্ত্রের উপদেশ প্রদাণ। এখানে প্রাগের তুলনায় বেশি ধর্মীয় স্বাধীনতা ও আর্থিক স্বচ্ছলতা ভোগ করেন যদিও লুথারান চার্চ তার ধর্মীয় সংশয়বাদীতার কারণে তাকে ইউক্যারিস্ট (হলি কম্যুনিয়ন, একটি খ্রিস্টান আচারানুষ্ঠান) থেকে বহিষ্কার করে রেখেছিল। লিনৎসে তার প্রথম প্রকাশনা ছিল দে ভেরো আন্নো (১৬১৩), যিশুর জন্মের বছর নিয়ে একটি বিস্তৃত রচনা। এছাড়া পোপ গ্রেগরির পরিমার্জিত বর্ষপঞ্জি জার্মান ভূমিতে চালু করা ঠিক হবে কিনা সে বিষয়ক বিতর্কে অংশ নেন। একই বছর গণিতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা নোভা স্তেরেওমেত্রিয়া দোলিওরুম ভিনারিওরুম (Nova stereometria doliorum vinariorum) রচনা শেষ করেন। এর বিষয়বস্তু ছিল মদের বোতল বা এ ধরনের অন্যান্য বোতলের আয়তন পরিমাপের পদ্ধতি, ১৬১৫ সালে এটি প্রকাশিত হয়।[51]
দ্বিতীয় বিয়ে
১৬১৩ সালের ৩০শে অক্টোবর কেপলার ২৪ বছর বয়সী সুজানা রয়টিঙারকে বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী বারবারার মৃত্যুর পর ১১ জন পাত্রী দেখে অবশেষে ৫ম পাত্রীর কাছে ফিরে এসেছিলেন। সুজানা সম্পর্কে লিখেছিলেন, "ভালবাসা, নম্র আনুগত্য, বাসাবাড়ির আর্থিক দেখভাল, অধ্যবসায়, এবং সৎ সন্তানদের প্রতি ভালবাসা দিয়ে সে আমাকে জয় করে নিয়েছিল।"[52] এই বিয়ের মাধ্যমে জন্ম নেয়া প্রথম তিন সন্তান (মার্গারেটা রেগিনা, কাটারিনা ও সেবাল্ড) বাল্যকালেই মারা যায়। আরও তিন জন পূর্ণ বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকে: কোর্ডুলা (জন্ম: ১৬২১), ফ্রিডমার (জন্ম: ১৬২৩) ও হিল্ডেবের্ট (জন্ম: ১৬২৫)। কেপলারের জীবনীকারদের মতে তার এই বিয়ে পূর্বেরটির তুলনায় অনেক সুখের ছিল।[53]
এপিতোমে আস্ত্রোনোমিয়াই কোপেরনিকানাই, বর্ষপঞ্জি ও মা-র বিচার
আস্ত্রোনোমিয়া নোভা প্রকাশের পর থেকেই কেপলার জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর একটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে চাইছিলেন।[54] ১৬১৫ সালে এপিতোমে আস্ত্রোনোমিয়াই কোপেরনিকানাই-এর (Epitome of Copernican Astronomy) তিনটি খণ্ডের প্রথমটি রচনা শেষ করেন যা ১৬১৭ সালে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় খণ্ড ১৬২০ এবং তৃতীয় ও শেষ খণ্ড ১৬২১ সালে প্রকাশিত হয়। শিরোনাম পড়লে মনে হয় এ বুঝি কেবলই কোপের্নিকুসের সৌরকেন্দ্রিক মতবাদের উপর ভিত্তি করে, কিন্তু আসলে এতে তিনি নিজের উপবৃত্ত-ভিত্তিক ব্যবস্থা পুরোপুরি বর্ণনা করেছিলেন। এপিতোমে কেপলারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা হিসেবে স্বীকৃত হয়। গ্রহীয় গতির তিনটি সূত্রই এতে স্থান পায় এবং প্রকাশিত হয় ভৌত কার্যকারণের মাধ্যমে স্বর্গীয় (সে সময়কার বিশ্বাস অনুসারে) বস্তুসমূহের গতিবিধির ব্যাখ্যা।[55] আস্ত্রোনোমিয়া নোভাতে গ্রহীয় গতির সূত্র কেবল মঙ্গল গ্রহের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু এই গ্রন্থে সবগুলো গ্রহ, উপগ্রহ এবং গালিলেও কর্তৃক আবিষ্কৃত বৃহস্পতি গ্রহের চারটি উপগ্রহের ক্ষেত্রেও এটি প্রয়োগ করেন। অবশ্য পর্যবেক্ষণের উপাত্ত থেকে কীভাবে উপবৃত্তাকার কক্ষপথ প্রতিপাদন করা যায় সে নিয়ে কিছু লিখেননি।[56]
রুডলফীয় তালিকা এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট এফিমেরিস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কেপলার একটি নতুন জ্যোতিষতাত্ত্বিক বর্ষপঞ্জি প্রকাশ করে ফেলেন যা বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এখান থেকে পাওয়া অর্থই তার পরবর্তী কাজের ব্যয় বহনে কাজে লেগেছিল, বিশেষ করে যখন রাজকোষ থেকে অর্থ সংস্থান বন্ধ হয়ে যায়। ১৬১৭ থেকে ১৬২৪ সালের মধ্যে প্রকাশিত মোট ৬টি বর্ষপঞ্জিতে তিনি গ্রহের অবস্থান, আবহাওয়া এবং এমনকি রাজনৈতিক ঘটনারও ভবিষ্যদ্বাণী করেন। রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণীর অনেকগুলোই চতুরভাবে মিলে গিয়েছিল কারণ সমকালীন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে তিনি খুব ভাল জ্ঞান রাখতেন এবং সে অনুযায়ী ভবিষ্যৎ কি হবে তা অণুমান করা কঠিন ছিল না। কিন্তু ১৬২৪ সালে যখন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমে যায় এবং ভবিষ্যদ্বাণীর অনেকগুলোই মিথ্যা প্রমাণিত হতে থাকে তখন তিনি নিজেই বিপদে পড়েন। তার শেষ বর্ষপঞ্জি গ্রাৎসে জনসমক্ষে পোড়ানো হয়েছিল।[57]
১৬১৫ সালে উরসুলা রাইনগোল্ড, যার সাথে কেপলারের ভাই ক্রিস্টোফের আর্থিক দ্বন্দ্ব্ব চলছিল, আদালতে অভিযোগ করেন যে কেপলারের মা কাথারিনা অশুভ চোলাইকৃত মদ খাইয়ে তাকে অসুস্থ করে দিয়েছে। এ নিয়ে বিতর্কের জন্ম হয় এবং ১৬১৭ সালে কাথারিনাকে ডাকিনীবিদ্যা চর্চার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। সে সময় মধ্য ইউরোপে ডাকিনীদের বিচার হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। ১৬২০ সালের আগস্টে কাথারিনাকে ১৪ মাসের জন্য আটক করা হয়, মুক্তি পান ১৬২১ সালের অক্টোবরে। কেপলারের উপযুক্ত আইনি প্রতিরোধের কারণেই এই মুক্তি সম্ভব হয়েছিল। অভিযোক্তাদের হাতে সুদৃঢ় কোন প্রমাণ ছিল না, ছিল কেবল কিছু কানকথা এবং কেপলারের সোমনিয়ুম বইয়ের একটি বিকৃত পুরাতন সংস্করণ যাতে লেখা ছিল কীভাবে ঐন্দ্রজালিক ঔষধ মিশ্রিত করে এবং একটি শয়তানের সাহায্য নেয়। অবশ্য তেরিশিও ভের্বালিস (ডাকিনী হওয়ার কারণে তার আসন্ন শাস্তির সচিত্র বর্ণনা) এর কাথারিনার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের সর্বশেষ চেষ্টা করা হয়েছিল। বিচার চলাকালে কেপলার তার অন্য সব গবেষণা বাদ দিয়ে কেবল ঐকতান তত্ত্ব নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। ফলাফল ১৬১৯ সালে বই হিসেবে প্রকাশিত হয় যার নাম হারমোনিকেস মুন্ডি (Harmony of the World)।[58]
হারমোনিকেস মুন্দি
কেপলার অনেকটা নিশ্চিতভাবে মনে করতেন যে জ্যামিতিক বস্তুগুলোই ঈশ্বরকে সমগ্র বিশ্ব সাজানোর মডেল সরবরাহ করেছে।[59] হারমোনিকেসে তিনি সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রাকৃতিক জগৎের অণুপাতসমূহ, বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষ শাস্ত্র সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন। ঐকতানের (হারমোনিক) প্রধান সেটটি পিথাগোরাস, টলেমি এবং কেপলারের আগে আরও অনেকে অধ্যয়ন করেছিলেন যাকে তখন মুজিকা উনিভের্সালিস বা খগোল সঙ্গীত নামে আখ্যায়িত করা হতো। এমনকি তিনি হারমোনিকেস মুন্দি প্রকাশ করার পরপরই রবার্ট ফ্লুড নামে একজন বলা শুরু করেন যে কেপলারের আগেই তিনি নিজের একটি ঐকতানের তত্ত্ব লিখেছেন।[60]
কেপলার বইটি শুরু করেন সুষম বহুভুজ এবং সুষম ঘনবস্তুর বর্ণনা দিয়ে, শুরুতে যেসব বস্তুর ছবি ছিল তাদেরকে বর্তমানে কেপলারের ঘনবস্তু বলা হয়। এরপর ধীরে ধীরে ঐকতানের তত্ত্বটি তিনি সঙ্গীত, আবহাওয়াবিদ্যা এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রে প্রয়োগ করেন। তার মতে, জ্যোতিষ্কগুলোর আত্মায় সুর আছে, যে সুর থেকে ঐকতানের জন্ম হয়, এই সুরের সাথে আবার মানব আত্মার মিথস্ক্রিয়া ঘটে যা নিয়ে জ্যোতিষ শাস্ত্র কাজ করে। বইয়ের শেষ তথা পঞ্চম অধ্যায়ে কেপলার গ্রহের গতি, বিশেষ করে কক্ষীয় বেগ ও সূর্য থেকে ক্ষপথের দূরত্বের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। তার আগেও জ্যোতির্বিদরা এই সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু ট্যুকোর উপাত্ত হাতে থাকায় কেপলার অনেক সূক্ষ্ণভাবে ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন এবং এর ভৌত গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন।[61]
ছন্দ অনেকগুলো ছিল, তবে এর মধ্যে কেপলার সবচেয়ে স্পষ্টভাবে যেটি ব্যক্ত করেছেন পরবর্তীকালে তার নাম দেয়া হয়েছে কেপলারের গ্রহীয় গতির তৃতীয় সূত্র। অনেক ধরনের সমাবেশ নিয়ে গবেষণা করে তিনি শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, "পর্যায়কালের বর্গ সূর্য থেকে কক্ষপথের দূরত্বের ঘনফলের সমানুপাতিক"। ঠিক কত তারিখে তার এই বোধদয় হয়েছে তার উল্লেখ পাওয়া গেলেও ঠিক কীভাবে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন সে সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না।[62] গ্রহীয় গতির জন্য এই বিশুদ্ধ গতিতাত্ত্বিক সূত্রের মাহাত্ম্য্য অবশ্য ১৬৬০-এর দশকের পূর্বে একেবারেই বোঝা যায়নি। কারণ এই দশকেই ক্রিস্টিয়ান হাওখেন্সের নতুন কেন্দ্রাতিগ বেগ সম্পর্কিত সূত্রের সাথে কেপলারের এই সূত্র মিলিয়ে আইজাক নিউটন, এডমান্ড হ্যালি এবং খুব সম্ভবত ক্রিস্টোফার রেন ও রবার্ট হুক প্রায় একই সময়ে দেখাতে সক্ষম হন যে, মহাকর্ষীয় আকর্ষণ সূর্য থেকে গ্রহের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক।[63] এই সূত্র পদার্থবিজ্ঞানের চিরায়ত স্কলাস্টিক চিন্তাধারাকে ভুল প্রমাণিত করে। স্কলাস্টিক পদার্থবিদ্যায় মনে করা হতো দুটো বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষ বল সবসময়ই ধ্রুব থাকে, কেপলার এবং এমনকি গালিলেও-ও তাই মনে করতেন। গালিলেও মহাকর্ষ নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে একটি সর্বজনীন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন যার সারকথা হচ্ছে মহাকর্ষের প্রভাবে পড়ন্ত বস্তু সব সময়ই সমান হারে ত্বরণ লাভ করে। ১৬৬৬ সালে গালিলেওর ছাত্র বোরেল্লিও তার খ-বলবিদ্যায় এই ধ্রুব মহাকর্ষকে সমর্থন করেছেন।[64] উইলিয়াম গিলবার্ট চুম্বক নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে পৃথিবীর কেন্দ্র আসলে একটি বিশাল চুম্বক। এই কথা পড়ে কেপলার ভেবে নিয়েছিলেন হয়ত সূর্যের চৌম্বক বল গ্রহগুলোকে আবর্তন করায়। বেশ মজার হলেও ধারণাটি আসলে ভুল।
রুডলফীয় তালিকা এবং শেষ বছরগুলো
১৬২৩ সালে কেপলার অবশেষে রুডলফীয় তালিকা সম্পূর্ণ করেন, যাকে সে সময় তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ভাবা হয়েছিল। অবশ্য সম্রাটের সাথে প্রকাশনা বিষয়ক বোঝাপড়া এবং ট্যুকো ব্রাহের উত্তরাধিকারীদের সাথে লেনদেনের বিষয় ছিল বলে মুদ্রিত হতে হতে ১৬২৭ সাল হয়ে যায়। এর মধ্যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও বিশৃঙ্খলা, যা ছিল চলমান ত্রিশ বছরের যুদ্ধের প্রধাণ কারণ, আবারও কেপলার ও তার পরিবারকে বিপাকে ফেলে দেয়। ১৬২৫ সালে ক্যাথলিক কাউন্টার-রিফর্মেশনের এজেন্টরা কেপলারের গ্রন্থাগার তালাবদ্ধ করে রাখে, ১৬২৬ সালে লিনৎস শহর অবরোধ করা হয়। অগত্যা তিনি উলম শহরে চলে যান এবং সেখানে নিজ খরচায় তালিকাটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।[65]
১৬২৮ সালে জেনারেল ভালেনস্টাইনের অধীনে পরিচালিত পুণ্য রোমান সম্রাট ফের্ডিনান্ডের সেনাবাহিনী জয়লাভ করায় অবস্থা কেপলারের অণুকূলে আসে এবং তিনি ভালেনস্টাইনের উপদেষ্টা মনোনীত হন। জেনারেলের সরাসরি রাজ-জ্যোতিষী না হলেও কেপলার রাজ-জ্যোতিষীদের জন্য জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক হিসাব-নিকাশ করে দিতেন এবং মাঝেমধ্যে রাশিচক্রও লিখতেন। শেষ বছরগুলোতে তিনি প্রচুর ভ্রমণ করেন, প্রাগের রাজদরবার থেকে লিনৎস এবং উলম, সেখান থেকে সাগানের একটি সাময়িক বাড়িতে এবং সবশেষে রেগেন্সবুর্গে। রেগেন্সবুর্গে আসার পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৬৩০ সালের ১৫ই নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন, তাকে রেগেন্সবুর্গেই সমাধিস্থ করা হয়। সুয়েডীয় সেনাবাহিনী গির্জার প্রাঙ্গণ ধ্বংস করে দেয়া তার কবরটি হারিয়ে গিয়েছিল। কেবল কেপলারের নিজের লেখা সমাধিলিপিটিই রক্ষিত আছে:
- Mensus eram coelos, nunc terrae metior umbras
- Mens coelestis erat, corporis umbra iacet.
- আমি একদিন আকাশ মেপেছি, আজ মাপি ছায়া
- আমার মন ছিল আকাশমুখো, আর দেহ বিশ্রাম নিল ধরায়[66]
কেপলারীয় জ্যোতির্বিদ্যার গ্রহণযোগ্যতা
কেপলারের সূত্র তাৎক্ষণিক গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। গালিলেও এবং রনে দেকার্তের মত নামীদামী বিজ্ঞানীরা তার আস্ত্রোনোমিয়া নোভা পুরোপুরি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। অনেক জ্যোতির্বিদ, এমনকি তার সরাসরি শিক্ষক মিখায়েল মায়েস্টলিন পর্যন্ত তাদের জ্যোতির্বিজ্ঞানে কেপলারের পদার্থবিদ্যা অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধিতা করেছেন। অনেকে অবশ্য মধ্যম পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করেছেন। যেমন ফরাসি জ্যোতির্বিদ Ismaël Bullialdus উপবৃত্তাকার কক্ষপথ গ্রহণ করলেও কেপলারের ক্ষেত্রফল তত্ত্বটিকে সুষম গতিবেগ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেন, তিনি ধরে নিয়েছিলেন উপবৃত্তের শূন্য ফোকাসের সাপেক্ষে ঘূর্ণনের কারণে গতিবেগ সুষমই থাকবে। সেথ ওয়ার্ডও উপবৃত্তাকার কক্ষপথ গ্রহণ করেন কিন্তু গ্রহের গতি ব্যাখ্যা করেন অণুবৃত্তের (equant) মাধ্যমে।[67][68][69]
অনেক জ্যোতির্বিদ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কেপলারের তত্ত্ব পরীক্ষা করেছিলেন। সূর্যের সামনে দিয়ে বুধ এবং শুক্র গ্রহের অতিক্রমণ তার তত্ত্বের জন্য খুব ভাল একটি পরীক্ষা হতে পারতো। ১৬৩১ সালে বুধের অতিক্রমণের সময় কেপলার বেশ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিলেন, ঠিক কোন দিন অতিক্রমণ ঘটবে বুঝতে না পেরে তিনি পর্যবেক্ষকদেরকে ঘোষিত দিনের আগের এবং পরের দিনও আকাশে চোখ রাখতে বলেন। কেপলারের ভবিষ্যদ্বাণী করা দিনেই অবশেষে অতিক্রমণ পর্যবেক্ষণ করেন পিয়ের গাসেঁদি।[70] এটা ছিল বুধ গ্রহের প্রথম অতিক্রমণ পর্যবেক্ষণ। অবশ্য এর ঠিক এক মাস পর শুক্র গ্রহের অতিক্রমণ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হন কেপলার, কারণ ছিল রুডলফীয় তালিকায় ত্রুটি। গাসেঁদি অবশ্য বুঝতে পারেননি যে প্যারিসের মত ইউরোপের অধিকাংশ স্থান থেকেই এই অতিক্রমণ দেখা যায়নি।[71] জেরেমিয়া হোরকস ১৬৩৯ সালে শুক্রের অতিক্রমণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, তবে সেজন্য তাকে নিজের পর্যবেক্ষণের সাপেক্ষে কেপলারের মডেলে কিছু পরিমার্জন আনতে হয়েছিল এবং সে অনুযায়ী অতিক্রমণ দেখার উপযোগী যন্ত্র বানাতে হয়েছিল। তিনি আজীবন কেপলারের মডেলের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন।[72][73][74]
এপিতোমে আস্ত্রোনোমিয়াই কোপের্নিকানাই ইউরোপের সর্বত্র জ্যোতির্বিদরা পড়তেন, কেপলারের মৃত্যুর পর তার চিন্তাধারা প্রচারের জন্য এটিই ছিল সর্বোত্তম বাহন। ১৬৩০ থেকে ১৬৫০ সালের মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে বেশি পঠিত জ্যোতির্বিজ্ঞান পাঠ্যবই, যে কারণে এ সময় অনেককেই উপবৃত্ত-ভিত্তিক জ্যোতির্বিদ্যায় বিশ্বাসী হয়ে উঠতে দেখা যায়।[55] অবশ্য খুব কম ব্যক্তিই নভোগতির পক্ষে তার দেয়া ভৌত ভিত্তিটি গ্রহণ করেছিল। সপ্তদশ শতকের শেষদিকে বেশ ভৌত জ্যোতির্বিজ্ঞানের বেশ কয়েকটি তত্ত্বে কেপলারের পথ ধরে আকর্ষণমূলক বলের সূত্রপাত ঘটে, অবশ্য কেপলার যে ছদ্ম-আধ্যাত্মিক গতিদায়ক শক্তির কথা বলেছিলেন এখানে তার কোন স্থান ছিল না। এই তত্ত্বগুলোর প্রবর্তকদের মধ্যে আছেন জিওভান্নি আলফোন্সো বোরেল্লি, রবার্ট হুক এবং রনে দেকার্ত। দেকার্তই প্রথম জড়তার মাধ্যমে এই ধারণাটি ব্যক্ত করেছিলেন। এ সকল প্রচেষ্টারই চূড়ান্ত উৎকর্ষ ঘটে আইজাক নিউটনের ফিলোসফিয়া নাতুরালিস প্রিংকিপিয়া মাথেমাটিকার (১৬৮৭) মাধ্যমে। এই বইয়ে নিউটন বলভিত্তিক একটি সূত্রের মাধ্যমে কেপলারের গ্রহীয় গতিসূত্রগুলো প্রতিপাদন করেন।[75]
ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং প্রাকৃতিক দর্শনে অসামান্য অবদানের পাশাপাশি বিজ্ঞানের দর্শন এবং বিজ্ঞানের ইতিহাস-লিখনেও কেপলারের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। কেপলার এবং তার গতির সূত্রগুলো প্রথম দিককার জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস রচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল। উদাহরণ হিসেবে Jean-Étienne Montucla-র Histoire des mathématiques (১৭৫৮) এবং Jean-Baptiste Delambre-র Histoire de l’astronomie moderne (১৮২১) এর নাম করা যেতে পারে। এই বইগুলো আলোকিত যুগের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা, এই দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা সব প্রায় সব গ্রন্থেই কেপলারের ধর্মীয় এবং অধিবিদ্যা বিষয়ক চিন্তাধারার সমালোচনা করে তা বর্জন করা হয়েছে, কিন্তু এর পর রোমান্টিক যুগের দার্শনিকরা এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কেপলারের সাফল্যের প্রধান কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। William Whewell তার প্রভাবশালী বই History of the Inductive Sciences (১৮৩৭) এ কেপলারকে আরোহী যুক্তি অবলম্বনকারী বিজ্ঞানীদের আদিপুরুষ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত একই লেখকের Philosophy of the Inductive Sciences বইয়ে বলা হয়েছে কেপলার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সবচেয়ে উন্নত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। Ernst Friedrich Apelt ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি কেপলারের সকল পাণ্ডুলিপির (ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট এর ক্রয়ক্রীত) চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন, তার মতে কেপলার বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি কেপলারের গণিত, সুকুমার বৃত্তি, ভৌত চিন্তাধারা এবং ধর্মতত্ত্বকে একটি একীভূত চিন্তাধারার টুকরো টুকরো অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছেন, তিনিই কেপলারের জীবন ও কর্ম নিয়ে প্রথম বিস্তৃত গবেষণা করেছিলেন।[76]
ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ এবং বিংশ শতকের শুরুর দিকে কেপলারের বইগুলোর বেশ কয়েকটি আধুনিক অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৩৭ সালে তার সকল রচনার বিধিবদ্ধ প্রকাশনা শুরু হয়, একবিংশ শতকের শুরুতে এসে এই প্রকাশনযজ্ঞ প্রায় সমাপ্ত হতে চলেছে। ১৯৪৮ সালে ম্যক্স ক্যাসপারের লেখা কেপলারের জীবনী প্রকাশিত হয়।[77] অবশ্য Apelt এর পর কেপলারের বিশ্বতত্ত্ব ও প্রভাবের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা প্রদাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ছিল Alexandre Koyré-র লেখা বইগুলো। ১৯৩০ এবং ৪০-এর দশকে তিনি এবং তার সাথে পেশাদার বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদদের প্রথম প্রজন্মের অন্যান্য সদস্যরা বিজ্ঞানের ইতিহাসে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং কেপলারকে সেই বিপ্লবের প্রায় কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করেন। Koyré-র মতে পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষা নয় কেপলারের তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনাগুলোই প্রাচীন থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। ১৯৬০-এর দশক থেকে কেপলারের বুদ্ধিবৃত্তির আরও বিশদ বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে কেপলারের জ্যোতিষ শাস্ত্র, আবহাওয়াবিজ্ঞান, জ্যামিতিক কাজসমূহ, তার কাজের উপর ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব, তার সাহিত্যিক ও আলঙ্কারিক পদ্ধতি, সে সময়কার বৃহত্তর দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক জগৎের সাথে তার সম্পর্ক ও মিথস্ক্রিয়া, এবং এমনকি ইতিহাসবিদ হিসেবে তার ভূমিকা।[78]
বৈজ্ঞানিক বিপ্লবে কেপলারের ভূমিকা বিষয়ক দার্শনিক বিতর্ক বেশ কিছু জনপ্রিয় সাহিত্যেও স্থান করে নিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি হচ্ছে আর্থার কেসলারের লেখা দ্য স্লিপওয়াকারস (১৯৫৯) যেখানে কেপলার বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মতাত্ত্বিক সকল দিক থেকেই বিপ্লবের অবিসংবাদিত নায়ক।[79] প্রভাবশালী বিজ্ঞানের দার্শনিক যেমন চার্লস স্যান্ডার্স পার্স, নরউড রাসেল হ্যানসন, স্টিফেন টুলমিন এবং কার্ল পপার, বারবার কেপলারের কাছে ফিরে এসেছেন, তারা কেপলারের কাজে পেয়েছেন প্রমেয়তা, সাদৃশ্যমূলক যুক্তি, বাতিলযোগ্যতা এবং আরও অনেক দার্শনিক ধারণা। পদার্থবিদ ভোলফগাং পাউলি এমনকি রবার্ট ফ্লুডের সাথে কেপলারের বিতর্ক ব্যবহার করে বৈজ্ঞানিক অণুসন্ধানে বিশ্লেষণমূলক মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগ দেখিয়েছেন।[80] জন ব্যানভিলের একটি সুপরিচিত উপন্যাস কেপলার (১৯৮১) এ কেসলারের বইয়ে বর্ণীত বেশ কিছু বিষয় এবং বিজ্ঞানের দর্শনে তার ভূমিকার অনেক কিছু ব্যবহার করা হয়েছে।[81] বেশ খামখেয়ালি একটি বই হচ্ছে ২০০৪ সালে প্রকাশিত হেভেনলি ইনট্রিগ যাতে দাবী করা হয়েছে ট্যুকো ব্রাহের উপাত্ত হাতে পাওয়ার জন্য কেপলার তাকে হত্যা করেছিলেন।[82] কেপলার সময়ের আগে জন্ম নেয়া আধুনিক বিজ্ঞানের এক প্রবাদপুরুষ হিসেবে একটি জনপ্রিয় পরিচিতি পেয়ে গেছেন, কার্ল সেগান তাকে "প্রথম জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী এবং শেষ বৈজ্ঞানিক জ্যোতিষী" হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।[83]
অস্ট্রিয়ায় কেপলারের ঐতিহাস গুরুত্ব খুব ভালভাবে প্রকাশ পেয়েছে, সেদেশের একটি রুপোর মুদ্রা তৈরির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল তাকে সম্মানিত করা, ২০০২ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর তার সম্মানে ১০ ইউরোর একটি স্মারক মুদ্রা মুক্তি পায়। মুদ্রার উল্টো পিঠে কেপলারের প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে। উল্লেখ্য তিনি অস্ট্রিয়ার গ্রাৎস এবং আশপাশের কিছু স্থানে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছিলেন। কেপলার প্রিন্স হান্স উলরিখ ফন এগেনবের্গকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন এবং সম্ভবত এগেনবের্গ দুর্গ নির্মাণে তার প্রভাব ছিল। এই দুর্গ মুদ্রাটির সম্মুখ পিঠে অঙ্কিত ছিল। মুদ্রায় কেপলারের প্রতিকৃতির সামনে মুস্তেরিয়ুম কসমোগ্রাফিকুমে প্রকাশিত বহুতলকের মডেল রয়েছে।[84]
২০০৯ সালে নাসা বহির্গ্রহ আবিষ্কারের জন্য একটি মহাকাশ মানমন্দির উৎক্ষেপণ করে যার নাম রাখা হয় কেপলার মিশন।[85] নিউজিল্যান্ডে ফিয়র্ডল্যান্ড জাতীয় উদ্যানে একটি পর্বতমালার নাম কেপলার, সেখানে তিন দিনের একটি হাঁটা পথের নামও কেপলার পথ।
ধর্মীয় ভক্তি
ধর্মের জগৎেও কেপলারকে সম্মানিত করতে দেখা যায়। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এপিস্কোপাল চার্চের একটি ধর্মীয় উৎসবের দিন ঘোষণা করা হয়েছে কেপলার এবং নিকোলাউস কোপের্নিকুসের সম্মানে। দিনটি ২৩শে মে।[86]
কেপলারের রচনাবলি
- Mysterium cosmographicum (মহাবিশ্বের পবিত্র রহস্য) (১৫৯৬)
- Astronomiae Pars Optica (জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোকবিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট অংশ) (১৬০৪)
- De Stella nova in pede Serpentarii (অফিয়াকাসের পায়ের পাতায় অবস্থিত নতুন তারাটি বিষয়ে) (১৬০৪)
- Astronomia nova (নতুন জ্যোতির্বিজ্ঞান) (১৬০৯)
- Tertius Interveniens (তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ) (১৬১০)
- Dissertatio cum Nuncio Sidereo (তারকাশোভিত দূতের সাথে কথোপকথন) (১৬১০)
- Dioptrice (১৬১১)
- De nive sexangula (On the Six-Cornered Snowflake) (১৬১১)
- De vero Anno, quo aeternus Dei Filius humanam naturam in Utero benedictae Virginis Mariae assumpsit (১৬১৩)
- Eclogae Chronicae (১৬১৫ সালে Dissertatio cum Nuncio Sidereo এর সাথে প্রকাশিত হয়)
- Nova stereometria doliorum vinariorum (New Stereometry of Wine Barrels) (১৬১৫)
- Epitome astronomiae Copernicanae (Epitome of Copernican Astronomy) (১৬১৮-২১ এর মধ্যে ৩ খণ্ডে প্রকাশিত হয়)
- Harmonice Mundi (Harmony of the Worlds) (১৬১৯)
- Mysterium cosmographicum ২য় সংস্করণ (১৬২১)
- Rudolphine Tables (রুডলফীয় তালিকা) (১৬২৭)
- Somnium (স্বপ্ন) (১৬৩৪)
আরও দেখুন
কেপলারের সম্মানে নামাঙ্কিত
- কেপলার মহাকাশ মানমন্দির - সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তনরত একটি দূরবিন যার কাজ গ্রহ সন্ধান করা। ২০০৮ সালে নাসা এটি প্রেরণ করে।
- কেপলার-পৈসোঁ বহুতলক - জ্যামিতিক গঠনের একটি সেট। এর মধ্য দুটি তিনি বর্ণনা করেছিলেন।
- কেপলারের তারা - অতিনবতারা ১৬০৪ যা তিনি আবিষ্কার এবং বর্ণনা করেছিলেন।
- কেপলার - চাঁদের একটি সংঘর্ষ খাদ
- কেপলার - মঙ্গলের একটি সংঘর্ষ খাদ
- ১১৩৪ কেপলার - একটি গ্রহাণু
- ইয়োহানেস কেপলার ইউনিভার্সিটি লিনৎস - প্রতিষ্ঠার ৯ বছর পর ১৯৫৭ সালে অস্ট্রিয়ার লিন্ৎসে অবস্থিত "কলেজ ফর সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক সাইন্সেস"-এর নাম পরিবর্তন করে এটি রাখা হয়। কারণ কেপলার লিন্ৎসে অবস্থানকালেই তার ম্যাগণাম ওপাস নামে পরিচিত Harmonice Mundi রচনা করেছিলেন।
- কেপলারস্ট্রাসে - ফ্রাংকফুর্টের নিকটে হানাউতে অবস্থিত একটি সড়ক
- কেপলারব্র্যুকে - গ্রাৎস, অস্ট্রিয়া
- কেপলার উৎক্ষেপণ কেন্দ্র - নভোযান ও রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র
- কেপলারপ্লাৎস - ভিয়েনা উ-বান দ্রুত পরিবহন মেট্রো ব্যবস্থার উ-১ লাইনের জন্য ব্যবহৃত একটি স্টেশন
তথ্যসূত্র ও পাদটীকা
- Barker and Goldstein. "Theological Foundations of Kepler's Astronomy", pp. 112–13.
- Kepler. New Astronomy, title page, tr. Donohue, pp. 26–7
- Kepler. New Astronomy, p. 48
- Epitome of Copernican Astronomy in Great Books of the Western World, Vol 16, p. 845
- Stephenson. Kepler's Physical Astronomy, pp. 1–2; Dear, Revolutionizing the Sciences, pp. 74–78
- Caspar. Kepler, pp. 29–36; Connor. Kepler's Witch, pp. 23–46.
- Koestler. The Sleepwalkers, p. 234 (translated from Kepler's family horoscope).
- Caspar. Kepler, pp. 36–38; Connor. Kepler's Witch, pp. 25–27.
- Connor, James A. Kepler's Witch (2004), p. 58.
- Barker, Peter; Goldstein, Bernard R. "Theological Foundations of Kepler's Astronomy", Osiris, 2nd Series, Vol. 16, Science in Theistic Contexts: Cognitive Dimensions (2001), p. 96.
- Westman, Robert S. "Kepler's Early Physico-Astrological Problematic," Journal for the History of Astronomy, 32 (2001): 227–36.
- Caspar. Kepler, pp. 38–52; Connor. Kepler's Witch, pp. 49–69.
- Caspar. Kepler, pp.60–65; see also: Barker and Goldstein, "Theological Foundations of Kepler's Astronomy."
- Barker and Goldstein. "Theological Foundations of Kepler's Astronomy," pp.99–103, 112–113.
- Caspar. Kepler, pp.65–71.
- Field. Kepler's Geometrical Cosmology, Chapter IV, p 73ff.
- Dreyer, J.L.E. A History of Astronomy from Thales to Kepler, Dover Publications, 1953, pp.331, 377-379.
- Caspar, Kepler. pp.71–75.
- Connor. Kepler's Witch, pp.89–100, 114–116; Caspar. Kepler, pp.75–77
- Caspar. Kepler, pp.85–86.
- Caspar, Kepler, pp.86–89
- Caspar, Kepler, pp. 100–08.
- Caspar, Kepler, p. 110.
- Caspar, Kepler, pp. 108–11.
- Caspar, Kepler, pp. 111–22.
- Caspar, Kepler, pp.149–153
- Caspar, Kepler, pp.146–148, 159–177
- Finger, "Origins of Neuroscience," p 74. Oxford University Press, 2001.
- Caspar, Kepler, pp.142–146
- Germana Ernst, "From the Watery Trigon to the Fiery Trigon: Celestial Signs Prophecies and History", Astrologi Hallucinati, de Gruyter, 1986, p. 266
- Burke-Gaffney, W., "Kepler and the Star of Bethlehem", Journal of the Royal Astronomical Society of Canada, Vol. 31, p.417
- Caspar, Kepler, pp.153–157
- Caspar, Kepler, pp.123–128
- On motive species, see: Lindberg, "The Genesis of Kepler's Theory of Light," pp.38–40
- "কেপলার খ-গোলকসমূহের সুষম বৃত্তীয় গতির পরিবর্তে দূরত্ব-বেগ সম্পর্কের ভিত্তিতে গ্রহের গতিপথ ব্যাখ্যা করার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার মাধ্যমে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণার উৎপত্তি ঘটে। কেবল নতুন মডেল তৈরির পরিবর্তে তিনি ভৌত সূত্রের মাধ্যমে গ্রহের গতিপথ প্রতিপাদন করেন। তাই বলা যায় ক্ষেত্রফল সূত্র আবিষ্কারের আগেই ভৌত নীতি হিসেবে সুষম বৃত্তীয় বেগের ধারণা পরিত্যাগ করেছিলেন।", Peter Barker and Bernard R. Goldstein, "Distance and Velocity in Kepler's Astronomy", Annals of Science, 51 (1994): 59–73, at p. 60.
- Koyré, The Astronomical Revolution, pp.199–202
- Caspar, Kepler, pp.129–132
- Caspar, Kepler, pp.131–140; Koyré, The Astronomical Revolution, pp.277–279
- Caspar, Kepler, pp.178–181
- Caspar, Kepler, pp.181–185. The full title is Tertius Interveniens, das ist Warnung an etliche Theologos, Medicos vnd Philosophos, sonderlich D. Philippum Feselium, dass sie bey billicher Verwerffung der Sternguckerischen Aberglauben nict das Kindt mit dem Badt aussschütten vnd hiermit jhrer Profession vnwissendt zuwider handlen, translated by C. Doris Hellman as "Tertius Interveniens, that is warning to some theologians, medics and philosophers, especially D. Philip Feselius, that they in cheap condemnation of the star-gazer's superstition do not throw out the child with the bath and hereby unknowingly act contrary to their profession."
- Caspar, Kepler, pp.192–197
- Koestler, The Sleepwalkers p 384
- Caspar, Kepler, pp.198–202
- Carl Sagan। Carl Sagan on Johannes Kepler's persecution।
- Lear, Kepler's Dream, pp.1–78
- Schneer, "Kepler's New Year's Gift of a Snowflake," pp.531–545
- Kepler, Johannes (১৯৬৬) [1611]। Hardie, Colin, সম্পাদক। De nive sexangula [The Six-sided Snowflake]। Oxford: Clarendon Press। ওসিএলসি 974730।
- Caspar, Kepler, pp.202–204
- Connor, Kepler's Witch, pp.222–226; Caspar, Kepler, pp.204–207
- Caspar, Kepler, pp.208–211
- Caspar, Kepler, pp.209–220, 227–240
- Quotation from Connor, Kepler's Witch, p 252, translated from an October 23, 1613 letter from Kepler to an anonymous nobleman
- Caspar, Kepler, pp.220–223; Connor, Kepler's Witch, pp.251–254.
- Caspar, Kepler, pp.239–240, 293–300
- Gingerich, "Kepler, Johannes" from Dictionary of Scientific Biography, pp.302–304
- Wolf, A History of Science, Technology and Philosophy, pp.140–141; Pannekoek, A History of Astronomy, p 252
- Caspar, Kepler, pp.239, 300–301, 307–308
- Caspar, Kepler, pp.240–264; Connor, Kepler's Witch, chapters I, XI-XIII; Lear, Kepler's Dream, pp.21–39
- Quotation from Caspar, Kepler, pp.265–266, translated from Harmonices Mundi
- Caspar, Kepler, pp.264–266, 290–293
- Caspar, Kepler, pp.266–290
- Arthur I. Miller (মার্চ ২৪, ২০০৯)। Deciphering the cosmic number: the strange friendship of Wolfgang Pauli and Carl Jung। W. W. Norton & Company। পৃষ্ঠা 80। আইএসবিএন 9780393065329। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ৭, ২০১১।
- Westfall, Never at Rest, pp.143, 152, 402–3; Toulmin and Goodfield, The Fabric of the Heavens, p 248; De Gandt, 'Force and Geometry in Newton's Principia', chapter 2; Wolf, History of Science, Technology and Philosophy, p 150; Westfall, The Construction of Modern Science, chapters 7 and 8
- Koyré, The Astronomical Revolution, p 502
- Caspar, Kepler, pp.308–328
- Koestler, The Sleepwalkers, p. 427.
- For a detailed study of the reception of Kepler's astronomy see Wilbur Applebaum, "Keplerian Astronomy after Kepler: Researches and Problems," History of Science, 34(1996): 451–504.
- Koyré, The Astronomical Revolution, pp.362–364
- North, History of Astronomy and Cosmology, pp. 355–360
- Albert van Helden, "The Importance of the Transit of Mercury of 1631," Journal for the History of Astronomy, 7 (1976): 1–10.
- HM Nautical Almanac Office (জুন ১০, ২০০৪)। "1631 Transit of Venus"। ১ অক্টোবর ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ২৮, ২০০৬।
- Allan Chapman, "Jeremiah Horrocks, the transit of Venus, and the 'New Astronomy' in early 17th-century England," Quarterly Journal of the Royal Astronomical Society, 31 (1990): 333–357.
- North, History of Astronomy and Cosmology, pp. 348–349
- Wilbur Applebaum and Robert Hatch, "Boulliau, Mercator, and Horrock's Venus in sole visa: Three Unpublished Letters," Journal for the History of Astronomy, 14(1983): 166–179
- Kuhn, The Copernican Revolution, pp.238, 246–252
- Jardine, "Koyré’s Kepler/Kepler's Koyré," pp.363–367
- Gingerich, introduction to Caspar's Kepler, pp.3–4
- Jardine, "Koyré’s Kepler/Kepler's Koyré," pp.367–372; Shapin, The Scientific Revolution, pp.1–2
- Stephen Toulmin, Review of The Sleepwalkers in The Journal of Philosophy, Vol. 59, no. 18 (1962), pp.500–503
- Pauli, "The Influence of Archetypical Ideas"
- William Donahue, "A Novelist's Kepler," Journal for the History of Astronomy, Vol. 13 (1982), pp.135–136; "Dancing the grave dance: Science, art and religion in John Banville's Kepler," English Studies, Vol. 86, no. 5 (October 2005), pp.424–438
- Marcelo Gleiser, "Kepler in the Dock", review of Gilder and Gilder's Heavenly Intrigue, Journal for the History of Astronomy, Vol. 35, pt. 4 (2004), pp.487–489
- Quote from Carl Sagan, Cosmos: A Personal Voyage, episode III: "The Harmony of the Worlds". Kepler was hardly the first to combine physics and astronomy; however, according to the traditional (though disputed) interpretation of the Scientific Revolution, he would be the first astrophysicist in the era of modern science.
- "Eggenberg Palace coin"। Austrian Mint। ৩১ মে ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ সেপ্টেম্বর ৯, ২০০৯।
- Ng, Jansen (জুলাই ৩, ২০০৯)। "Kepler Mission Sets Out to Find Planets Using CCD Cameras"। DailyTech। ১০ মার্চ ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জুলাই ৩, ২০০৯।
- Calendar of the Church Year according to the Episcopal Church
বহিঃসংযোগ
- JohannesKepler.Info, কেপলার সম্পর্কিত সকল তথ্যের ওয়েবসাইট, ২০০৯ সালের ২৭শে ডিসেম্বর উন্মুক্ত করা হয়।
- Harmonices mundi ("The Harmony of the Worlds") কার্নেগি-মেলন ইউনিভার্সিটিতে সংরক্ষিত সম্পূর্ণ টেক্সট
- [kepler "Johannes Kepler"] — Daniel A. Di Liscia, স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলোসফি (গ্রীষ্ম ২০১২ সংস্করণ), আইএসএসএন ১০৯৫-৫০৫৪, Edward N. Zalta সম্পাদিত।
- De Stella Nova in Pede Serpentarii ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে ("On the new star in Ophiuchus's foot"), লিন্ডা হল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত সম্পূর্ণ টেক্সট
- গুটেনবের্গ প্রকল্পেWalter W. Bryant. Kepler (১৯২০-এর বই Men of Science সিরিজের অংশ)
- ভিয়েনা ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমিতে সংরক্ষিত বিরল গ্রন্থগুলোর ইলেকট্রনিক সংস্করণ
- কার্লিতে ইয়োহানেস কেপলার (ইংরেজি)
- অডিও – Cain/Gay (২০১০) Astronomy Cast, ইয়োহানেস কেপলার ও তার গ্রহীয় গতিসূত্র
- Christianson, Gale E., Kepler's Somnium: Science Fiction and the Renaissance Scientist
- Kollerstrom, Nicholas, Kepler's Belief in Astrology
- ইয়োহানেস কেপলার সম্পর্কিত রেফারেন্স
- Plant, David, কেপলার এবং "Music of the Spheres"
- Kepler, Napier, and the Third Law, ম্যাথপেইজেস
- Calderón Urreiztieta, Carlos. Harmonice Mundi • বইটির উপর ভিত্তি করে এনিমেশন
- Reading the mind of God, কেপলারের জীবনের উপর ভিত্তি করে রচিত নাটক, লেখক প্যাট্রিক গ্যাব্রিজ, ১৯৯৭
- Johannes Kepler, জীবনীমূলক নাটক, লেখক রবার্ট ল্যালোন্ড, ২০১০
- ও'কনর, জন জে.; রবার্টসন, এডমুন্ড এফ., "Johannes Kepler", ম্যাকটিউটর গণিতের ইতিহাস আর্কাইভ, সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়।