ইবলিশ

ইসলাম ধর্মমত অনুযায়ী, ইবলিশ (বিকল্প বানান ইবলিস) (আরবি: إبليس, বহুবচন: ابالسة ʾAbālisa) বা শয়তান (আরবি: شيطان, বহুবচন: شياطين Shayāṭīn) (ইংরেজি: Iblis or, Ebles)। ইবলিশ শব্দের অর্থ চরম হতাশ। কুরআন অনুযায়ী, আল্লাহ "ধোঁয়াহীন আগুন থেকে বা আগুনের বিশুদ্ধ শিখা" থেকে জিনদের তৈরি করেছেন এবং মানুষকে মৃত্তিকা[1] দ্বারা তৈরি করেছেন। ইবলিশ প্রচন্ড যেদি ছাড়াও, ইবলিসের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য যে, তিনি পুরুষ, নারী, এবং জিনদের হৃদয়ের মধ্যে ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এছাড়া তিনি আল্লাহ তাআ'লার নির্দেশ মতো কাজ করছেন।

শারীরিক বর্ণনা

আকৃতি বিহীন আগুন

ইতিহাস

ইসলাম ধর্মে ইবলিসকে দুষ্ট জিন বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআন এ উল্লেখ করা হয়েছে, যে যখন আল্লাহ আদম (আলাইহিস সালাম) কে সৃষ্টি করলেন এবং তিনি সকল ফেরেশতাদের বললেন আদমকে সিজদাহ্ করতে, তখন সকল ফেরেশতা সিজদাহ্ করলো। অথচ ইবলিস (শয়তান) সিজদাহ্ করলো না। ফলে সে অবিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হলো এবং আল্লাহ তাকে অভিশপ্ত করলেন।[2]

ইবলিশ সম্পর্কিত হাদিস

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আদমসন্তানের ওপর শয়তানের একটি প্রভাব আছে। অনুরূপ ফেরেশতারও একটি প্রভাব আছে। শয়তানের প্রভাব হলো, অকল্যাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা। আর ফেরেশতার প্রভাব হলো, কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং সত্যের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা। সুতরাং যে ব্যক্তি কল্যাণের অবস্থা উপলব্ধি করে সে যেন জেনে রাখে, এটি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই হয়েছে। কাজেই তার উচিত আল্লাহর প্রশংসা করা। আর যে ব্যক্তি অকল্যাণের অবস্থা উপলব্ধি করে, সে যেন অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) এ আয়াত পাঠ করেন, ‘শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং অশ্লীলতার প্রতি নির্দেশ দেয়।’

সুনানে তিরমিজি

উসমান ইবনে আবুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি একবার রাসুল (সা.)-এর কাছে আরজ করি, হে আল্লাহর রাসুল! শয়তান আমার ও আমার নামাজ-কিরাতের মধ্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং তাতে জটিলতা সৃষ্টি করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন বললেন, ‘তুমি যখন তার উপস্থিতি অনুভব করবে তখন তার কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং তোমার বাঁ দিকে তিনবার থুতু ফেলবে।’

মুসলিম

আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন সালাতের জন্য আযান দেয়া হয়, তখন শয়তান হাওয়া ছেড়ে পলায়ন করে, যাতে সে আযানের শব্দ না শোনে। যখন আযান শেষ হয়ে যায়, তখন সে আবার ফিরে আসে। আবার যখন সালাতের জন্য ইক্বামাত(ইকামত/একামত) বলা হয়, তখন আবার দূরে সরে যায়। ইক্বামাত(ইকামত/একামত) শেষ হলে সে পুনরায় ফিরে এসে লোকের মনে কুমন্ত্রণা দেয় এবং বলে এটা স্মরণ কর, ওটা স্মরণ কর, বিস্মৃত বিষয়গুলো সে মনে করিয়ে দেয়। এভাবে লোকটি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, সে কয় রাক‘আত সালাত আদায় করেছে তা মনে করতে পারে না।

(১২২২, ১২৩১, ১২১৩২, ৩২৮৫; মুসলিম ৪/৮, হাঃ ৩৮৯, আহমাদ ৯৯৩৮) (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৫৮১)

জাবির (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ইবলিশ পানির ওপর তার সিংহাসন স্থাপন করে বাহিনী প্রেরণ করে। তন্মধ্যে তার সর্বাধিক নৈকট্য অর্জনকারী সে-ই, যে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। তাদের একজন এসে বলে, আমি অমুক কাজ করেছি। সে বলে, তুমি কিছুই করোনি। অতঃপর অন্যজন এসে বলে, অমুকের সঙ্গে আমি সব ধরনের ধোঁকার আচরণই করেছি। এমনকি তার থেকে তার স্ত্রীকে আলাদা করে দিয়েছি। তারপর শয়তান তাকে তার নিকটবর্তী করে নেয় এবং বলে, হ্যাঁ, তুমি খুব ভালো। বর্ণনাকারী আমাশ বলেন, আমার মনে হয় তিনি বলেছেন, অতঃপর শয়তান তার সঙ্গে আলিঙ্গন করে।’

সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৯৯৯

আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার ঘাড়ের পশ্চাদংশে তিনটি গিঠ দেয়। প্রতি গিঠে সে এ বলে চাপড়ায়, তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত, অতএব তুমি শুয়ে থাক। অতঃপর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে একটি গিঠ খুলে যায়, পরে উযূ করলে আর একটি গিঠ খুলে যায়, অতঃপর সালাত আদায় করলে আর একটি গিঠ খুলে যায়। তখন তার প্রভাত হয়, উৎফুল্ল মনে ও অনাবিল চিত্তে। অন্যথায় সে সকালে উঠে কলূষ কালিমা ও আলস্য সহকারে।

(৩২৬৯; মুসলিম ৬/২৮, হাঃ ৭৭৬, আহমাদ ৭৩১২) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১০৭১. , ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১০৭৬)

আবদুল্লাহ্‌ ইব্‌নু মাস‘ঊদ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে এক ব্যক্তির ব্যাপারে আলোচনা করা হল- সকাল বেলা পর্যন্ত সে ঘুমিয়েই কাটিয়েছে, সালাতের জন্য জাগ্রত হয়নি, তখন তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) ইরশাদ করলেনঃ শয়তান তার কানে পেশাব করে দিয়েছে।

(৩২৭০; মুসলিম ৬/২৮, হাঃ ৭৭৪) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১০৭৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১০৭৮)

কোরআনে বর্ণিত ইবলিশ শয়তানের কাহিনী

সুরা আল আরাফ (১১-৩৭):

  1. আমি তো তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর তোমাদের আকৃতি দিয়েছি, অতঃপর ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলাম আদমকে সাজদাহ করার জন্য। তখন ইবলিস ছাড়া সবাই সিজদা করল। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হল না।
  2. তিনি বললেন, ‘আমি যখন তোমাকে আদেশ দিলাম তখন কি তোমাকে নিবৃত্ত করল যে, তুমি সিজদা করলে না?’ সে বলল, ‘আমি তার চেয়ে শ্ৰেষ্ঠ; আপনি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে কাদামাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।’
  3. তিনি বললেন, ‘তাহলে তুমি এখান থেকে নেমে যাও, এখানে থেকে অহংকার করবে, এটা হতে পারে না। সুতরাং তুমি বের হয়ে যাও, নিশ্চয় তুমি অধমদের  অন্তর্ভুক্ত।’
  4. সে বলল, ‘আমাকে সেদিন পর্যন্ত অবকাশ দিন ,যেদিন তারা পুনরুথিত হবে।
  5. তিনি বললেন, ‘নিশ্চয় তুমি অবকাশপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত।’
  6. সে বলল, ‘আপনি যে আমাকে পথভ্রষ্ট করলেন, সে কারণে অবশ্যই অবশ্যই আমি আপনার সরল পথে মানুষের জন্য বসে থাকব।’
  7. তারপর অবশ্যই আমি তাদের কাছে আসব তাদের সামনে থেকে ও তাদের পিছন থেকে, ‘তাদের ডানদিক থেকে ও তাদের বাম দিক থেকে এবং আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না।’
  8. তিনি বললেন, ‘ এখান থেকে বের হয়ে যাও ধিকৃত,বিতাড়িত অবস্থায়। মানুষের মধ্যে যারাই তোমার অনুসরণ করবে, অবশ্যই অবশ্যই  আমি তোমাদের সবাইকে দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করব।’
  9. “আর হে আদম! আপনি ও আপনার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করুন, অতঃপর যেথা হতে ইচ্ছা খান, কিন্তু এ গাছের ধারে –কাছেও যাবেন না, তাহলে আপনারা যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।’
  10. তারপর তাদের লজ্জাস্থান, যা তাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল তা তাদের কাছে প্রকাশ  করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, ‘পাছে তোমরা উভয় ফিরিশ্‌তা হয়ে যাও কিংবা তোমরা স্থায়ীদের অন্তর্ভুক্ত হও, এ জন্যেই তোমাদের রব এ গাছ থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন।’
  11. আর সে তাদের উভয়ের কাছে শপথ করে বলল , ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের শুভাকাংখীদের একজন।'
  12. অতঃপর সে তাদেরকে প্রবঞ্চনার দ্বারা অধঃপতিত করল। এরপর যখন তারা সে গাছের ফল খেল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা জান্নাতের পাতা দিয়ে  নিজেদেরকে আবৃত করতে লাগল। তখন তাদের রব তাদেরকে ডেকে বললেন, “আমি কি তোমাদেরকে এ গাছ থেকে নিষেধ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নিশ্চয় শয়তান তোমাদের উভয়ের প্রকাশ্য শত্রু ?’
  13. তারা বলল, ‘হে আমাদের রব আমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করছি। আর যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং দয়া না করেন, তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’
  14. তিনি বললেন, ‘তোমরা নেমে যাও, তোমরা একে অন্যের শক্র এবং যমীনে কিছুদিনের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল।’
  15. তিনি বললেন, ‘সেখানেই তোমারা যাপন করবে এবং সেখানেই তোমরা মারা যাবে। আর সেখান থেকেই তোমাদেরকে বের করা হবে।’
  16. আর স্মরণ করুন, যখন আমরা ফেরেশতাদের বললাম, আমাকে সিজদা করো, তখন ইবলিশ ছাড়া সকলেই সিজদা করলো ; সে অস্বীকার করলো ও অহংকার করলো। আর সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হলো।
  17. আর আমারা বললাম, ‘ হে আদম ! আপনি ও আপনার স্ত্রী  জান্নাতে বসবাস করুন এবং যেখান থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে আহার করুন, কিন্তু এই গাছটির কাছে যাবেন না ; তাহলে আপনারা হবেন যালিমদের অন্তর্ভুক্ত’।
  18. অতঃপর শয়তান সেখান থেকে তাদের পদস্থলন ঘটালো এবং তারা যেখানে ছিলো সেখান থেকে তাদের কে বের করলো। আর আমরা বললাম, ‘তোমরা একে অন্যের শত্রু রুপে নেমে যাও; এবং কিছু দিনের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল যমীনে’।
  19. তারপর আদম তার রবের কাছ থেকে কিছু বাণী পেলেন। অতঃপর আল্লাহ্‌ তার তাওবা কবুল করলেন।নিশ্চয় তিনিই তাওবা কবুলকারী,পরম দয়ালু।

তথ্যসূত্র

  1. সূরা আ'রাফঃ১২
  2. সূরা আ’রাফঃ ১১-১৩

আরও দেখুন

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.